বিচার হয়নি ৪ বছরেও by উৎপল রায়
সাভারের ‘রানা প্লাজা’ ট্র্যাজেডির পর পেরিয়ে গেছে চার বছর। কিন্তু দেশ-বিদেশে আলোচিত ও মর্মন্তুদ ওই ঘটনার দোষীদের বিচার হয়নি আজও। ঘটনার পর হত্যা ও ইমারত আইনের দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে রানা প্লাজায় নয় তলা ভবন নির্মাণের অভিযোগে আরো একটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে ভবন মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে অস্ত্র আইনে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়। খোঁজ নিয়ে এবং মামলা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা ও ইমারত আইনে অভিযোগ গঠন করা হলেও এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। আর দুর্নীতির মামলাটির অভিযোগ গঠনের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সকাল পৌনে নটায় হঠাৎ ধসে পড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন নয় তলা রানা প্লাজা ভবন। এ ঘটনায় নিহত হন এক হাজার ১৩৬ জন। প্রায় হাজারখানেক শ্রমিক প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেন। বিশ্ব বিবেক ও মানবতাকে নাড়া দেয়া ওই ঘটনার দিনই সাভার থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ঘটনার পর পালিয়ে যান ভবন মালিক ও সাভার থানা যুবলীগ নেতা সোহেল রানা। চার দিন পর ২৮শে এপ্রিল যশোরের বেনাপোল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভয়াবহ ওই ঘটনায় দায়ের করা প্রথম মামলাটিতে হতাহতের ঘটনা উল্লেখ করে ভবন মালিক রানা, তার বাবা-মা, ভবনের কারখানা মালিক এবং ভবন অনুমোদন ও নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর অন্য মামলাটিতে ধসে পড়া ওই ভবনটির অবকাঠামো নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় ২০১৫ সালের ১লা জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহ, স্থানীয় কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, ধসে পড়া ওই ভবনের তিনটি গার্মেন্ট কারখানার মালিক, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামালসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যু ঘটানোসহ দণ্ডবিধির ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩৩৭, ৩৩৮, ৪২৭, ৪৬৫, ৪৭১, ২১২, ১১৪, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় বিধি না মেনে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণের অভিযোগে ১৮ আসামির বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহ, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, রানা প্লাজার নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামালসহ হত্যা মামলার ১৭ জনকে এই মামলায়ও আসামি করা হয়েছে। মাহবুবুল আলম নামক একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীকে ইমারত নির্মাণ মামলায় আসামি করা হলেও হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি। ফলে, দুই মামলা মিলিয়ে মোট আসামি ৪২ জন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৩১ আসামি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, হত্যা মামলায় মাত্র তিনজন আসামি কারাগারে রয়েছেন। তারা হলেন- প্রধান আসামি সোহেল রানা, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও সাইট ইঞ্জিনিয়ার সারোয়ার কামাল (এই তিনজন ইমারত আইনের মামলারও আসামি)। আসামিদের মধ্যে সাতজন এখনো পলাতক। আর ১ জন ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই মামলার মধ্যে হত্যা মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এই মামলায় গত বছরের ১৮ই জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ১৮ই সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) খোন্দকার আবদুল মান্নান মানবজমিনকে জানান, উচ্চ আদালতে এই মামলায় সাতজন আসামির করা একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি এক আদেশে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার কার্যক্রমে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। ফলে, আইনি জটিলতায় এই মামলায় নির্ধারিত তারিখে বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। খোন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, আগামী ৭ই মে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় আছি আমরা। তবে, ওই দিন (৭ই মে) থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারবো বলে আমরা আশাবাদী। ঘটনার চার বছর পার হয়েছে, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কেন সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি-এমন প্রশ্নের জবাবে খোন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, বিচারকাজে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগুতে হয়। এছাড়া আসামিদেরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। উচ্চ আদালতে যাওয়াও তাদের আইনগত অধিকার। তবে, আমরা আশা করি দ্রুত বিচার শুরু করে দ্রুতই তা শেষ করা যাবে।
এদিকে হত্যা মামলায় ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করায় দ্রুত বিচার নিষ্পন্ন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন ভুক্তভোগী নিহতদের স্বজন ও বিচারপ্রার্থীরা। তাদের যুক্তি-এমনিতেই এ মামলার বিচারকাজ অনেক পিছিয়ে আছে। এখন এত সংখ্যক সাক্ষীর সাক্ষ্য নিতে গেলে বছরের পর বছর সময় পার হয়ে যাবে। এতে করে বিচার বিলম্বিত হবে। তবে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, ৫৯৪ জনের তালিকা হলেও সবার সাক্ষ্য তারা নেবেন না। বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদেরই তারা আদালতে উপস্থাপন করবেন। এ বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি খোন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, তালিকার সবার সাক্ষ্য নেয়া হয়তো সম্ভব হবে না। মামলায় অভিযোগ প্রমাণে ঠিক যতজন সাক্ষীর প্রয়োজন হবে ততজন সাক্ষীকেই ডাকা হবে।
এদিকে এ ঘটনায় ইমারত নির্মাণের আইনের মামলাটি চলছিল ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে। মামলায় গত বছরের ১৪ই জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ২৩শে আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের অতিরিক্ত পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) আনোয়ারুল কবীর বাবুল মানবজমিনকে জানান, ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটি বর্তমানে স্থগিত অবস্থায় আছে। এ মামলায় মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে রানা প্লাজা ভবনের নিউওয়েব বটম লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামানের করা একটি আবেদন জেলা ও দায়রা আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। যে কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করা হয়। তিনি জানান, ইতিমধ্যে বজলুল সামাদ আদনানের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত। আরো দুটি আবেদন শুনানি ও নিষ্পত্তি হলে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যাবে। আগামী ১৭ই মে এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী। তিনি বলেন, আসামিপক্ষের এ ধরনের আবেদন মামলার বিচারে কালক্ষেপণ করার একটি প্রয়াস। আনোয়ারুল কবীর বাবুল আরো জানান, ইমারত আইনের মামলায় সাভার পৌরসভার মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ তার মামলার ক্ষেত্রে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। পরে হাইকোর্টের এক আদেশে শুধু তার ক্ষেত্রে বিচার কার্যক্রম এক বছরের জন্য স্থগিত রয়েছে।
এদিকে রানা প্লাজা ভবন ধসের পর অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধান শেষে ছয় তলা ভবনের অনুমোদন থাকলেও দুর্নীতির মাধ্যমে রানা প্লাজায় দশ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়ে নয়তলা পর্যন্ত নির্মাণ করার অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ই জুন সাভার থানায় রানার বাবা, মাসহ ১৭ জনকে আসামি করে দুর্নীতির মামলা দায়ের করে দুদক। মামলা দায়েরের সময় ভবন মালিক সোহেল রানাকে আসামি করা হয়নি। ২০১৫ সালের ১৬ই জুলাই আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়। পরে মামলাটি বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। এই আদালতে গত বছরের ৬ই মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের বিষয়ে শুনানি হয়। আদালত রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শেষে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। পরে পুনঃতদন্ত শেষে সোহেল রানাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে ১৮ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা ও দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। আদালত সূত্র জানায়, গত ১৯শে এপ্রিল এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ শুনানি শেষে এক আদেশে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশের জন্য আগামী ৮ই মে নির্ধারণ করেছেন ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক এম আতোয়ার রহমান। আইনজীবীরা জানান, আদালত যদি ওই দিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) গ্রহণ করে সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেন তাহলে এ মামলায় আসামিদের বিচার শুরু হবে।
No comments