বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিদ্বেষের পরিসমাপ্তি যেভাবে by হামিদ মীর
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না তাদের মানচিত্র পাল্টে যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের মানচিত্র পাল্টে গেছে। এই রাষ্ট্রটি ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। পাকিস্তানি শাসকরা পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে নিছক রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অভিহিত করে পাকিস্তান ভাঙার ক্ষেত্র তৈরি করে। তাদের দুজনের ‘অপরাধ’ হলো পাকিস্তানের প্রথম সেনাশাসন মেনে নিতে পারেননি। তাদের ‘অপরাধ’ এটাও ছিল যে, উভয়েই সেনাশাসক আইয়ুব খানের বিপরীতে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করেছেন। তবে তাদের সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’ হলো তারা ছিলেন বাঙালি।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন। তার এই উদ্যোগকে সমর্থন দেয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করলে সোহরাওয়ার্দীকে ‘দেশের শত্রু’ অভিহিত করে করাচির কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান তার দল আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচিত হন। শেখ মুজিব ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেন। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা দেখুন, ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থনকারীদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ছিলেন ওলী খান, আতাউল্লাহ মিঙ্গল, আকবর বাগটি, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও মাওলানা মওদুদী প্রমুখ।
কিন্তু ১৯৭০ সালের আগে সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ এবং মাওলানা মওদুদীর জামায়াতে ইসলামী সামনে এসে যায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জেনারেল ইয়াহইয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে সেনা অপারেশন চালান। এই অপারেশন ভিনদেশীদের প্রবেশে সুযোগ করে দেয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই সময় জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গ দেয়। এক পর্যায়ে দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়, জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে আজও আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
গত বছর জামায়াতে ইসলামীর প্রবীণ নেতা গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিছু দিন আগে দীর্ঘ অসুস্থতার পর গোলাম আযম ইন্তেকাল করেন। এর কয়েক দিন পরই জামায়াতের বর্তমান প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নেসার আলী খান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানান। পাকিস্তানের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে চুপ। তবে কিছু কিছু পত্রিকার কলামে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের কড়া সমালোচনা করা হয়। সমালোচক কলামিস্টদের কেউ আগুনে পানি ঢেলে মতিউর রহমান নিজামীকে বাঁচানোর রাস্তা বের করার চেষ্টা করেনি বরং নিজেদের বিষাক্ত কলম দ্বারা আগুনে তেল ঢেলে বিষয়টিকে আরো উস্কে দিচ্ছে যাতে আব্দুল কাদের মোল্লার পর মতিউর রহমান নিজামীও ঘৃণার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যান। এরপর নিজামী সাহেবকেও ‘শহীদে পাকিস্তান’ অভিহিত করে কিছু কলাম লেখা যাবে। আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর লড়াই চলতেই থাকবে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়া অতীতে ক্ষমতা লাভের জন্য জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করেন। কিন্তু যখন গোলাম আযম সাহেবের ইন্তেকাল হলো তখন তার দল গোলাম আযমের জানাজায় পর্যন্ত শরিক হলো না। পরে যখন মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হলো তখনও খালেদা জিয়া একদম চুপ থাকলেন। অথচ নিজামী ছিলেন খালেদার মন্ত্রিসভার সদস্য।
২০০২ সালে খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী; আর নিজামী ছিলেন তার মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাশাসক পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশে সফরে গেলে খালেদা জিয়া তাকে ঢাকার অদূরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান। এটা ছিল ওই বাঙালিদের স্মরণে যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর অপারেশনে মারা যান। ওই স্মৃতিসৌধের রেজিস্টার বুকে জেনারেল পারভেজ মুশাররফ স্পষ্ট লিখেন, ‘১৯৭১ সালে যে বাড়াবাড়ি হয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। এবার পুরোনো তিক্ততা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়।’ খালেদা সরকার পারভেজ মুশাররফের এই বাক্যকে নিজেদের বড় সফলতা বলে দাবি করে। কারণ বাংলাদেশে বরাবরই এই দাবি উঠেছে, পাকিস্তান সরকারিভাবে ১৯৭১ সালের ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করুক। কিন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থান হলো, মুশাররফ ক্ষমা প্রার্থনা করেননি, শুধু দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটাও স্পষ্ট করেননি, ১৯৭১ সালে বাড়াবাড়িটা কে করেছে।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ এবং পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি বড় ইস্যু হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করে, ক্ষমতায় গেলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করা হবে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শেখ হাসিনা ওয়াজেদ প্রধানমন্ত্রী হন। পাঁচ বছরেও যুদ্ধাপরাধ মামলার কোনো আসামির সাজা না হওয়ায় ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের পেছনে শেখ হাসিনাবিরোধী লবি ছাড়াও এমন লোকজনও সম্পৃক্ত ছিলেন যারা জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধ চাচ্ছিলেন। তাদের এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করতে থাকে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডকে মানবাধিকার পরিপন্থি বলে অভিহিত করে। কিন্তু শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সরকার এসবে পাত্তা দেননি।
শেখ হাসিনা ওয়াজেদের বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এতে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে তিক্ততা ভুলে সামনে অগ্রসর হওয়া উচিত। কিন্তু কিছু দিন পর তিনি সেনা বিদ্রোহে নির্মমভাবে নিহত হন। জামায়াতে ইসলামীর ভুল হলো, দলটির নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এতে পুরোনো ঘৃণা নতুন করে জন্ম নেয়। এই ঘৃণার অবসানের জন্য সবাইকে ইতিহাসের বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে।
এই বাস্তবতায় কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনী অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। এর বর্ণনা কিছুটা পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর সাজ্জাদ হোসাইনের বই ‘শিকসতে আরজু’ এর মধ্যে। আবার আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল খাদেম হোসাইন রাজার বইয়ের কথাও অস্বীকার করতে পারবো না। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘জেনারেল নিয়াজি আমাদেরকে বললেন, বাঙালিদের নির্বংশ করে দাও।’
আমার ব্যক্তিগত মত হলো, পুরোনো তিক্ততা নিরসনের জন্য পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের সেনা অপারেশনে বাড়াবাড়ির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। এই ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা পাকিস্তান দুর্বল হবে না, বরং শক্তিশালী হবে। এই অঞ্চলের একটি মুসলিম দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে এবং আগামী দিনের ফাঁসি ও সাজাগুলো বন্ধ হবে। আমাদেরকে এটা বোঝা দরকার যে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কেন সৃষ্টি হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড ও সাজার এই ধারাবাহিকতা কেন অব্যাহত আছে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এই সংঘাত ও বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। নতুন প্রজন্মের ভুল বোঝাবুঝি এবং বিদ্বেষের অবসান ঘটানোর জন্য প্রয়োজন ভুল স্বীকার করা। মুসলমান ভাইয়ের পরস্পরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা তো কঠিন কোনো কাজ নয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন। তার এই উদ্যোগকে সমর্থন দেয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করলে সোহরাওয়ার্দীকে ‘দেশের শত্রু’ অভিহিত করে করাচির কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান তার দল আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচিত হন। শেখ মুজিব ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেন। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা দেখুন, ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থনকারীদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ছিলেন ওলী খান, আতাউল্লাহ মিঙ্গল, আকবর বাগটি, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও মাওলানা মওদুদী প্রমুখ।
কিন্তু ১৯৭০ সালের আগে সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ এবং মাওলানা মওদুদীর জামায়াতে ইসলামী সামনে এসে যায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জেনারেল ইয়াহইয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে সেনা অপারেশন চালান। এই অপারেশন ভিনদেশীদের প্রবেশে সুযোগ করে দেয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই সময় জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গ দেয়। এক পর্যায়ে দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়, জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে আজও আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
গত বছর জামায়াতে ইসলামীর প্রবীণ নেতা গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিছু দিন আগে দীর্ঘ অসুস্থতার পর গোলাম আযম ইন্তেকাল করেন। এর কয়েক দিন পরই জামায়াতের বর্তমান প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নেসার আলী খান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানান। পাকিস্তানের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে চুপ। তবে কিছু কিছু পত্রিকার কলামে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের কড়া সমালোচনা করা হয়। সমালোচক কলামিস্টদের কেউ আগুনে পানি ঢেলে মতিউর রহমান নিজামীকে বাঁচানোর রাস্তা বের করার চেষ্টা করেনি বরং নিজেদের বিষাক্ত কলম দ্বারা আগুনে তেল ঢেলে বিষয়টিকে আরো উস্কে দিচ্ছে যাতে আব্দুল কাদের মোল্লার পর মতিউর রহমান নিজামীও ঘৃণার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যান। এরপর নিজামী সাহেবকেও ‘শহীদে পাকিস্তান’ অভিহিত করে কিছু কলাম লেখা যাবে। আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর লড়াই চলতেই থাকবে।
দুঃখজনক বিষয় হলো, শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়া অতীতে ক্ষমতা লাভের জন্য জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করেন। কিন্তু যখন গোলাম আযম সাহেবের ইন্তেকাল হলো তখন তার দল গোলাম আযমের জানাজায় পর্যন্ত শরিক হলো না। পরে যখন মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হলো তখনও খালেদা জিয়া একদম চুপ থাকলেন। অথচ নিজামী ছিলেন খালেদার মন্ত্রিসভার সদস্য।
২০০২ সালে খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী; আর নিজামী ছিলেন তার মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাশাসক পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশে সফরে গেলে খালেদা জিয়া তাকে ঢাকার অদূরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান। এটা ছিল ওই বাঙালিদের স্মরণে যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর অপারেশনে মারা যান। ওই স্মৃতিসৌধের রেজিস্টার বুকে জেনারেল পারভেজ মুশাররফ স্পষ্ট লিখেন, ‘১৯৭১ সালে যে বাড়াবাড়ি হয়েছে তা খুবই দুঃখজনক। এবার পুরোনো তিক্ততা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়।’ খালেদা সরকার পারভেজ মুশাররফের এই বাক্যকে নিজেদের বড় সফলতা বলে দাবি করে। কারণ বাংলাদেশে বরাবরই এই দাবি উঠেছে, পাকিস্তান সরকারিভাবে ১৯৭১ সালের ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করুক। কিন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থান হলো, মুশাররফ ক্ষমা প্রার্থনা করেননি, শুধু দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এটাও স্পষ্ট করেননি, ১৯৭১ সালে বাড়াবাড়িটা কে করেছে।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ এবং পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি বড় ইস্যু হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করে, ক্ষমতায় গেলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করা হবে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং শেখ হাসিনা ওয়াজেদ প্রধানমন্ত্রী হন। পাঁচ বছরেও যুদ্ধাপরাধ মামলার কোনো আসামির সাজা না হওয়ায় ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের পেছনে শেখ হাসিনাবিরোধী লবি ছাড়াও এমন লোকজনও সম্পৃক্ত ছিলেন যারা জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধ চাচ্ছিলেন। তাদের এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করতে থাকে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডকে মানবাধিকার পরিপন্থি বলে অভিহিত করে। কিন্তু শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সরকার এসবে পাত্তা দেননি।
শেখ হাসিনা ওয়াজেদের বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এতে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে তিক্ততা ভুলে সামনে অগ্রসর হওয়া উচিত। কিন্তু কিছু দিন পর তিনি সেনা বিদ্রোহে নির্মমভাবে নিহত হন। জামায়াতে ইসলামীর ভুল হলো, দলটির নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এতে পুরোনো ঘৃণা নতুন করে জন্ম নেয়। এই ঘৃণার অবসানের জন্য সবাইকে ইতিহাসের বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে হবে।
এই বাস্তবতায় কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনী অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। এর বর্ণনা কিছুটা পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর সাজ্জাদ হোসাইনের বই ‘শিকসতে আরজু’ এর মধ্যে। আবার আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল খাদেম হোসাইন রাজার বইয়ের কথাও অস্বীকার করতে পারবো না। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘জেনারেল নিয়াজি আমাদেরকে বললেন, বাঙালিদের নির্বংশ করে দাও।’
আমার ব্যক্তিগত মত হলো, পুরোনো তিক্ততা নিরসনের জন্য পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের সেনা অপারেশনে বাড়াবাড়ির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। এই ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারা পাকিস্তান দুর্বল হবে না, বরং শক্তিশালী হবে। এই অঞ্চলের একটি মুসলিম দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে এবং আগামী দিনের ফাঁসি ও সাজাগুলো বন্ধ হবে। আমাদেরকে এটা বোঝা দরকার যে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কেন সৃষ্টি হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ড ও সাজার এই ধারাবাহিকতা কেন অব্যাহত আছে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এই সংঘাত ও বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। নতুন প্রজন্মের ভুল বোঝাবুঝি এবং বিদ্বেষের অবসান ঘটানোর জন্য প্রয়োজন ভুল স্বীকার করা। মুসলমান ভাইয়ের পরস্পরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা তো কঠিন কোনো কাজ নয়।
৬ নভেম্বর ২০১৪ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের দৈনিক জং-এ প্রকাশিত। উর্দু থেকে অনুবাদ: জহির উদ্দিন বাবর
হামিদ মীর: পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক। প্রধান নির্বাহী, জিও টিভি।
No comments