কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর যে কোন সময়
যে কোন সময় ফাঁসি কার্যকর হবে জামায়াতের
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের। গতকাল সরকারি তরফে ফাঁসি
কার্যকরের প্রস্তুতির কথাও জানানো হয়েছে। কামারুজ্জামান প্রেসিডেন্টের কাছে
প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা এ বিষয়টি স্পষ্ট না হলেও দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের
ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। আবেদন করে গতকাল কামারুজ্জামানের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। আজ সকালে তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি
পেয়েছেন পাঁচ আইনজীবী। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, কামারুজ্জামানের ফাঁসি
কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি
জানিয়েছেন ফাঁসির রায় শোনার পর থেকে সাত দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্টের কাছে
প্রাণভিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এটি না করলে যে কোন সময় ফাঁসি কার্যকর হবে। একই
কথা জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন,
কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদনের সুযোগ নেই। তাই যে কোন সময় ফাঁসি কার্যকর
করা যাবে। তবে এটি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। এদিকে রিভিউ
নিষ্পত্তির আগে ফাঁসি কার্যকর আইনসম্মত হবে না বলে জানিয়েছেন সিনিয়র
আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। সূত্র জানায়, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পুরোপুরি
প্রস্তুত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। এজন্য সার্বিক প্রস্তুতিও
নেয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে জল্লাদের তালিকাও।
গত বছরের ৯ই মে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন কামারুজ্জামান। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ৩রা নভেম্বর সোমবার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। রায় ঘোষণার পরপর মঙ্গলবারই কামারুজ্জামানকে কড়া নিরাপত্তায় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ফাঁসি কার্যকরের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কারারক্ষীরা কে কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন, কারাগারের বাতি, সেল ও খাতাগুলো কি অবস্থায় থাকবে সে মহড়া সম্পন্ন হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরে জল্লাদ ও বিকল্প জল্লাদ হিসেবে যারা অংশ নেবেন তাদেরও তালিকা করা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে ফাঁসির দড়ি (ম্যানিলা রোপ)। কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় থাকা জল্লাদরা কেন্দ্রীয় কারাগারেরই কয়েদি। তারা হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাভুক্ত আসামি।
ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরুর আদেশ দিয়েছি- আইনমন্ত্রী: এদিকে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর বিষয়ে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক সন্ধ্যায় তার বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফাঁসির রায় মওকুফের জন্য কামারুজ্জামানের যদি প্রেসিডেন্টের কাছে কোন আবেদন করার ইচ্ছা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে আমরা জেল কর্তৃপক্ষকে বলবো, ফাঁসি দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিতে। কামারুজ্জামানের মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ফাঁসি কার্যকরের আগে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। যদি জেল কোড মানা হয় তাহলে কোথাও কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ের কথা উল্লেখ নেই। যেটা উল্লেখ আছে সেটা হচ্ছে সংক্ষিপ্ত আদেশের কথা। আপিল বিভাগ সেই সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েছে। সংক্ষিপ্ত আদেশ পেয়ে গেলেই একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাঁসি কার্যকর করা যাবে। আইনমন্ত্রী বলেন, কামারুজ্জামান যে সময় থেকে শুনেছেন আপিল বিভাগে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে, সেই সময় থেকে উনার মার্সি পিটিশনের সময় গণনা শুরু হবে। অর্থাৎ সেই সময় থেকে তাকে ৭ দিনের সময় দেয়া হবে। তবে তিনি যদি প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করেন তাহলে যে কোন সময় তার ফাঁসি কার্যকর করা যাবে। জেল কোডে এ জন্য সাত দিনের সময়ের কথা বলা আছে। এর থেকে বেশি সময় নেয়া যাবে না। আইনমন্ত্রী দাবি করেন কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ের ক্ষেত্রে এমন কিছু করা হবে না যা আইনবহির্ভূত।
রিভিউয়ের কোন সুযোগ নেই- অ্যাটর্নি জেনারেল: এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সরকার যখন চাইবে তখনই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে। কেননা, এ মামলায় আপিলের চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার কোন সুযোগ নেই। আসামি যদি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করতে চান সে ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপির প্রয়োজন আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘সে সুযোগও নেই। সরকার যখন চাইবে তখনই তার ফাঁসি কার্যকর হবে। এখন শুধু সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষের ওপর ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নির্ভর করছে। তিনি বলেন, জেল কোডের বিধান অনুযায়ী, রায়ের কপি কারা কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষার জন্য আসামি ৭দিন সময় পান। কিন্তু কামারুজ্জামান সে সুযোগও পাবেন না।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না পাওয়া পর্যন্ত ফাঁসি আইনসম্মত নয়- মাহবুব: এদিকে কামারুজ্জামানের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দাবি করেছেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না পাওয়ার আগে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না। এজন্য তিনি সরকারের কাছে ফাঁসি কার্যকর না করার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা এর আগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ে দেখেছি, আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড রদ করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। কামারুজ্জামানের বিষয়েও আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। তারপরও আমরা মনে করি রিভিউয়ের সুযোগ আছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি এখনও হাতে পাইনি। কপি পেলে রিভিউর আবেদন করবো। রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার আগে যেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হয়। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার রায়ের পরেও আমরা রিভিউ আবেদন করেছিলাম। কিন্তু রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই তাকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এরপর আমরা চেম্বার জজের কাছে গেলে সেই দিনের মতো ফাঁসি কার্যকর বন্ধ করেছিলেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা মনে করি রিভিউয়ের সুযোগ আছে। আর যদি আইনে সুযোগ নাও থাকে সে ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ নিজে থেকে ন্যায় বিচারের জন্য অনেক বিষয় বিবেচনা করতে পারেন। রিভিউয়ের সুযোগ দিলে আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাব। কারণ আপিল বিভাগের এই বিভক্ত রায় রিভিউয়ে টিকবে না।
পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ: কামারুজ্জামানের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎ করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। গতকাল সকাল সোয়া দশটার দিকে কামারুজ্জামানের স্ত্রী, ৪ পুত্র, ১ কন্যা, ভাই, শ্যালকসহ ৯ জন সদস্য তার সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে সাক্ষাতের জন্য আবেদন করায় কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়। সাক্ষাৎশেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী সাংবাদিকদের বলেন, তার পিতা মানসিকভাবে যথেষ্ট শক্ত ও স্বাভাবিক আছেন। প্রেসিডেটের কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা এটি তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।
গত বছরের ৯ই মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ঘোষিত রায়ে দুটিতে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন, একটিতে ১০ বছর ও দুটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ৬ই জুন ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কামারুজ্জামান। সুপ্রিম কোর্টে আপিল দাখিলের পর এ বছরের ৫ই জুন শুনানি শুরু হয়ে ১৭ই সেপ্টেম্বর তা শেষ হয়। গত সোমবার আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে আদেশ দেন। আপিল বিভাগের রায়ের পরেই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
No comments