আমার কক্ষে তখন অন্যরকম উষ্ণতা
আমার গর্ভে কার্লো জুনিয়রের জন্ম হলো! আমার জীবনের সবচেয়ে বড়, মিষ্টি ও বর্ণনাতীত আনন্দ ছিল সেই অভিজ্ঞতা। তাকে প্রথম কোলে নিয়ে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম- এই বুঝি আমার অসাধারণ স্বপ্নটি ভেঙে যাবে। আমি গোটা বিশ্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইলাম। হাসপাতালে আমার কক্ষে তখন যেন অন্যরকম উষ্ণতা। এসব কথা লিখেছেন হলিউডের কিংবদন্তি নায়িকা, মডেল সোফিয়া লরেন। তার লেখা ‘ইয়েসটারডে, টুডে, টুমরো’ বইয়ে উঠে এসেছে জীবনের বিভিন্ন সময়ের মিষ্টি-তিক্ত অভিজ্ঞতা। এতে তিনি লিখেছেন, আমরা হাসপাতালে গেলাম। এমন একজন ডাক্তারকে পেলাম যার কিনা একটি ককটেল পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিল। তবে বের হওয়ার আগে তিনি আমাকে শক্তিশালী ঘুমের ওষুধ দিলেন। তিনি বললেন, এটা কেবলমাত্র ক্ষণস্থায়ী বেদনা। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করুন। কিন্তু বেদনা যেন ক্রমেই বাড়ছিল। আমি যেন খুব কঠোর পরিশ্রম করছিলাম। আমার চেহারা লেবুর মতো হলুদ হয়ে গিয়েছিল। এ সময় আমার মা এলেন। তিনি এসেই ডাক্তারকে ধরলেন। চিৎকার করে বললেন, তুমি তার চেহারা দেখছো না? তার গর্ভপাত হচ্ছে! কিন্তু কিছুই করার নেই তখন! সে ডাক্তার ককটেল পার্টির জন্য আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। সকাল চারটায় আমার যন্ত্রণা হঠাৎ করে থেমে যায়! আমি বুঝতে পারলাম যে সব শেষ! ডাক্তার ডাকা হলো, কিন্তু আসতে তার ২ ঘণ্টা লাগলো। আসার পর ইতালীয় ভাষায় তিনি বললেন, জনাবা, নিঃসন্দেহে আপনার বেশ ভাল কোমর আছে। আপনি সুন্দরী মহিলাও। কিন্তু আপনার কখনওই সন্তান হবে না! তার এ কঠোর শব্দগুলো আমার সব আশা চূর্ণবিচর্ণ করে দিল। নিজেকে আমার শক্তিহীনা, অনুর্বর ও অক্ষম মনে হচ্ছিল। এরপর আমি কার্লো আসার পরপর তাকে বললাম, আমি এখন সেটে যেতে পারবো এবং ছবির কাজ শেষ করতে পারবো। আমি এখনও কতটা শক্ত, সেটাই যেন আমি বোঝাচ্ছিলাম তাকে। তার হাসিমুখ মুহূর্তেই বিকৃত হয়ে গেল। তাকে পুরোপুরি অসহায় দেখাচ্ছিল। ঠিক সে সময় আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। এর পরের কয়েক মাস, আমার আত্মার প্রত্যেক কোণায় যেন ব্যর্থতা ছড়িয়ে পড়ছিল। কার্লোর মতো ইসপাতসম ব্যবসায়ী পর্যন্ত ভেঙে পড়লো। সে কাজ করতে, কথা বলতে এমনকি হাসতে পর্যন্ত পারছিল না। সৌভাগ্যবশত ভাগ্য আমাদের এক অচিন্ত্যনীয় আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যায়। ইতালিয়ান এক চলচ্চিত্র পরিচালকের স্ত্রীও আমার মতো এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত একজন বিশেষজ্ঞের খোঁজ পেয়েছিলেন। সে বিশেষজ্ঞ তাকে সাহায্য করেছিলেন। তার নাম হুবার্ট দ্য ওয়াত্তেভিলে। তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা হাসপাতালের গাইনোকলজি বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ক্ষীণ ও দীর্ঘ ওয়াত্তেভিলের বয়স ছিল ৬০। আমি যেন আশাহত হলাম। আমি বাবার বয়সী একজনকে আশা করেছিলাম। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তার নিজেরই কোন সন্তান নেই। তিনি কাজের জন্য নিজের পিতৃত্বের ইচ্ছা বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাই তার সাহায্যে যে সব সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে, সেটার কৃতিত্ব অনেকটা যেন তারই। আমার ঘটনা শোনার পর তিনি আমাকে বললেন, এখানে খারাপ কিছু ঘটেনি। আপনি সাধারণ মহিলা। এরপরের বার আপনি গর্ভবতী হলে, আমরা আপনাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখবো। ১৯৬৮ সালে যখন আমি তৃতীয়বারের মতো গর্ভবতী হলাম, আমি জেনেভায় চলে গেলাম। সে ডাক্তারের অফিসের পাশেই আমি একটি হোটেলে উঠলাম। আমি তার হাতের কোন জাদুর আশায় ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করলাম। তিনি বললেন, আপনার শরীর থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ইস্ট্রোজেন নামের হরমোন বের হচ্ছে না। জরায়ুর সঙ্গে ডিম্বাণুর সংযোগ ঘটাতে বাধা দিচ্ছিল এটি। এরপর ইস্ট্রোজেন ইনজেকশন দিয়েই এটি সহজে সমাধান করা গেল। এর মধ্যে হোটেল ইন্টারন্যাশনালের ১৮ তলায় আমার অনেক মাস একাকী গেল। নিজেকে বিক্ষিপ্ত রাখার জন্য ছোটবেলায় নেপলস থাকতে শেখা রান্নাপ্রণালী আবারও কাজে লাগাতে লাগলাম। কয়েক বছর পর রান্নার বই হিসেবে সেটা বাজারেও ছেড়েছিলাম। অবশেষে সেদিন এলো। তার আগের রাত আমার এক ফোঁটা ঘুমও হয়নি। সত্যি বলতে কি, আমি আসলে চাইনি, আমার গর্ভ আবারও নষ্ট হোক। আমি খুব ভয়ও পাচ্ছিলাম। আমি এ শিশুকে কারও সঙ্গে ভাগ করতে রাজি ছিলাম না। এর কয়েক ঘণ্টা পর, কার্লো জুনিয়রের জন্ম হলো! আমার জীবনের সবচেয়ে বড়, মিষ্টি ও বর্ণনাতীত আনন্দ ছিল সে অভিজ্ঞতা। আমি যখন তাকে কোলে নিলাম, আমি যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, এই বুঝি আমার অসাধারণ স্বপ্নটি ভেঙে যাবে। আমি গোটা বিশ্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইলাম। হাসপাতালে আমার কক্ষে তখন যেন অন্যরকম উষ্ণতা। আমি ও কার্লো জুনিয়র একা। যতই দিন গড়াচ্ছিল, আমি ভয় পাচ্ছিলাম, আমাকে এ রুম ছাড়তে হবে। ফলে আমার ছোট্ট বাচ্চার ঠাণ্ডা লাগতে পারে। বাড়ি যাওয়ার কোন ইচ্ছাই যেন ছিল না আমার। আমি হাসপাতালের কক্ষেই রয়ে গেলাম। আমি যেন তখন সমস্ত বিপদ থেকে সুরক্ষিত। কালকের কথা ভাবতেই ইচ্ছে করছিল না। কিভাবে যে ৫০ দিন চলে গেল, টেরই পাই নি। আমার ডাক্তার এসে আমাকে জানালো, সোফিয়া, আপনি এখানে চিরকাল থাকতে পারেন না! আপনাদের দু’জনের জন্য বাইরে জীবন অপেক্ষা করছে। আমি তার দিকে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অবশেষে ৯ মাস ধরে নড়াচড়াহীন ও ২ মাস ধরে হোটেল জীবনের শেষে আমি বাস্তবতার মুখোমুখি হতে রাজি হলাম। এর চার বছর পর, ১৯৭২ সালে আমি চতুর্থবারের মতো গর্ভবতী হলাম। তখন আমি ‘ম্যান অফ লা মাঞ্চা’র শুটিং করছিলাম। আমার সহ-অভিনেতা ছিলেন পিটার ও’ টুল। এবার এ ছবির ড্রেসমেকার আমাকে ইস্ট্রোজেন ইনজেকশন দিল, যেটা আমার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। গর্ভাবস্থার পাঁচ মাস পর্যন্ত আমি কাজ থামাইনি এবার। এরপর আবার আমি বিমানে করে জেনেভা গেলাম। এবারও আমি সে শান্তিময় কয়েক মাস কাটালাম। আরেকটি ভালবাসার নিদর্শনের আগমনের অপেক্ষায় কাটতে লাগলো আমার সময়। ১৯৭৩ সালের ৬ই জানুয়ারি এদোয়ার্দো জন্ম নিল। আমার প্রথম সন্তানের পর আমি ভেবেছিলাম, জীবন এর চেয়ে ভাল হতেই পারে না। কিন্তু এদো এসে আমার জীবনের সুখ যেন দ্বিগুণ করে দিলো। আমি উপলব্ধি করলাম, মাতৃত্বের প্রগাঢ় রহস্যের একটি হচ্ছে এটিই।
No comments