আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু by আবদুল লতিফ মন্ডল
সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর শেষে দেশে ফিরে ৩০ অক্টোবর গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নির্বাচন সময় মতোই হবে। সাংবিধানিকভাবে এ সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। যে কোনো সময় নির্বাচন দেয়ার ক্ষমতা সরকারের থাকে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকেই। একটা নির্বাচনের পর আর একটা নির্বাচন আসে, এটাই স্বাভাবিক। একটা নির্বাচনের পর চাইলে যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়’ (যুগান্তর, অক্টোবর ৩১)।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মাঝে অনেকে আগাম সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখছেন। ‘যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়’- এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আসলেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবছেন কিনা সে প্রশ্নে যুগান্তর পরিচালিত এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪১.৭৩ শতাংশ হ্যাঁ-সূচক মত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য প্রদানের আগেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নেতাকর্মীদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি তাদের এ নির্দেশ দেন। ‘জনগণই বর্তমান সরকারকে ছুড়ে ফেলে দেবে’- এমন মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সম্প্রতি তার দলের নেতাকর্মীদের আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এটা সত্য যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি বিএনপি ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার প্রতিশ্রুতি থেকে প্রধানমন্ত্রী সরে এসেছেন, সে সঙ্গে এটাও সত্য যে সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না- এমন কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। ‘একটা নির্বাচনের পর চাইলে যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়।’ ৩০ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে তার এরূপ মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা অযৌক্তিক নয়। আগাম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এটাই এখন পর্যন্ত আশা জাগিয়ে রেখেছে। আসলে সরকার যে আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে কিছুদিন আগেও তা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ‘আন্দোলনের আগেই মধ্যবর্তী নির্বাচন’ শিরোনামে ২৮ এপ্রিল যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, মেয়াদ নিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা যাই বলুক আগামী দেড় থেকে দু’বছরের মাথায় নির্বাচন দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে এ নির্বাচনের আগে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা হবে। এতে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা’ নির্ধারণ করা হতে পারে। সরকারের এক নীতিনির্ধারক সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হাতে নতুন একটি প্রস্তাবনা তুলে দিয়েছেন। এ প্রস্তাবনায় আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধা না থাকলেও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে স্বস্তিতে নেই সরকার। আগামীতে বিএনপি কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। সম্ভাব্য ওই আন্দোলন, একতরফা নির্বাচনের দুর্নাম ঘোচানো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপের কারণে আগাম নির্বাচনের কথা সরকারের শীর্ষ মহলে আলোচনা করা হচ্ছে।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে আগাম সংসদ নির্বাচনের পক্ষে একাধিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে।
এক. সব দল ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ১৯৯১-২০০৮ সময়কালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলো বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করাসহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে যে পরিমাণে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে, একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন ঠিক সে পরিমাণে সুনাম ক্ষুণ্ন করে। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই সুনাম উদ্ধার করতে হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম দু’দশকে জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, নির্বাচন কমিশন নয়, সরকারই জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দলীয় সরকারের আমলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো মানুষের মন থেকে এ ধারণা দূর করতে সক্ষম হয়। দশম সংসদ নির্বাচনে সে ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এখন একটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই পারে মানুষের মন থেকে নির্বাচন সম্পর্কিত নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে।
দুই. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালীকরণে অংশগ্রহণমূলক এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত হলে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর তাদের পুরো নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলে যে সংসদ গঠিত হয়, তা হয় সত্যিকার অর্থে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্বকারী। আর তা না হলে যে সংসদ গঠিত হয়, তাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালীকরণের অপরিহার্য শর্ত হল নির্বাচনে সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় যে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে তা সত্যিকার অর্থে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্ব করে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের গণতন্ত্র। তাই এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আগাম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিন. দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় একমাত্র ভারত ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে হতাশা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মহল। তারা নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে অর্থবহ আলোচনা শুরুর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি ভারত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সমর্থন করলেও তারা একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে শেখ হাসিনার সরকারকে পরামর্শ দেয়। কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহল সরকারের সঙ্গে কাজ করে যেতে সম্মত হলেও এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে গেছেন। এর প্রমাণ মেলে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরকারী যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক উপমন্ত্রী লিন ফিদারস্টোন এবং বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বক্তব্য থেকে। লিন ফিদারস্টোন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধানসম্মত হলেও অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন না হওয়াটা হতাশাব্যঞ্জক। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেটি খুঁজে নিতে আমি সব দলকে উৎসাহ জোগাই। কারণ এ সহিংসতা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই শুভ নয়।’ আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি নয়, এ বিষয়ে সাংবাদিকরা লিন ফিদারস্টোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব রয়েছে। জনগণের কল্যাণে তাদের আলোচনায় বসতে হবে। পাঁচ বছর পর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা বন্ধের পথ তাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় নির্বাচনের পরপরই হতাশা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক সংকট অবসানে বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাগিদ দেয় শেখ হাসিনার সরকারকে। যুক্তরাষ্ট্রের সে অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ২ নভেম্বরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২ নভেম্বর একটি দৈনিকের (ইত্তেফাক) প্রতিনিধিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড্যান মজিনা বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মার্কিন সরকারের অবস্থান নিয়ে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা নেই। পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিক্রিয়া, সিনেটে শুনানিসহ বেশ কয়েকবার মার্কিন সরকারের মতামত এসেছে এ নির্বাচন নিয়ে। সেই মতামত ও অবস্থান এখনও বহাল। বাংলাদেশ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয় যে, আমরা গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চলব না। অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আগাম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাক নির্ভেজাল গণতন্ত্র।
চার. বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান খাদ্য চালের মূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে। বিগত কয়েক বছর ধরে চালের উৎপাদন সন্তোষজনক হওয়ায় এবং সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় বর্তমানে চালের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিুমুখী হওয়ায় সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক দিক থেকে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে। উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে পরিগণিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকায় সরকার ৩ লাখ নতুন গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গরিব ও অসহায় মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নতুন সুবিধাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব যে আওয়ামী লীগের জন্য প্লাস পয়েন্ট তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আগাম সংসদ নির্বাচন না করার পক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুক্তি হল, তারা নির্বাচন করে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচন নয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে ভুল করেছে সে ভুলের খেসারত তাদেরই দিতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা ভালো করেই জানেন যে, দশম সংসদ নির্বাচন অবৈধ না হলেও এর নৈতিক সমর্থন খুবই দুর্বল। তাছাড়া নির্বাচনের জন্য বর্তমান সাংগঠনিক শক্তি এবং অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে পারে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হয়তো এসব বিবেচনায় নিয়েই ‘যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়’ বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মাঝে অনেকে আগাম সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখছেন। ‘যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়’- এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আসলেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবছেন কিনা সে প্রশ্নে যুগান্তর পরিচালিত এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪১.৭৩ শতাংশ হ্যাঁ-সূচক মত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য প্রদানের আগেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নেতাকর্মীদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি তাদের এ নির্দেশ দেন। ‘জনগণই বর্তমান সরকারকে ছুড়ে ফেলে দেবে’- এমন মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সম্প্রতি তার দলের নেতাকর্মীদের আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এটা সত্য যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি বিএনপি ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার প্রতিশ্রুতি থেকে প্রধানমন্ত্রী সরে এসেছেন, সে সঙ্গে এটাও সত্য যে সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না- এমন কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। ‘একটা নির্বাচনের পর চাইলে যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়।’ ৩০ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে তার এরূপ মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা অযৌক্তিক নয়। আগাম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে এটাই এখন পর্যন্ত আশা জাগিয়ে রেখেছে। আসলে সরকার যে আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে কিছুদিন আগেও তা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ‘আন্দোলনের আগেই মধ্যবর্তী নির্বাচন’ শিরোনামে ২৮ এপ্রিল যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, মেয়াদ নিয়ে মন্ত্রী-এমপিরা যাই বলুক আগামী দেড় থেকে দু’বছরের মাথায় নির্বাচন দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে এ নির্বাচনের আগে জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা হবে। এতে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা’ নির্ধারণ করা হতে পারে। সরকারের এক নীতিনির্ধারক সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হাতে নতুন একটি প্রস্তাবনা তুলে দিয়েছেন। এ প্রস্তাবনায় আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে সাংবিধানিক ও আইনগত বাধা না থাকলেও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে স্বস্তিতে নেই সরকার। আগামীতে বিএনপি কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। সম্ভাব্য ওই আন্দোলন, একতরফা নির্বাচনের দুর্নাম ঘোচানো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপের কারণে আগাম নির্বাচনের কথা সরকারের শীর্ষ মহলে আলোচনা করা হচ্ছে।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে আগাম সংসদ নির্বাচনের পক্ষে একাধিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে।
এক. সব দল ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ১৯৯১-২০০৮ সময়কালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলো বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করাসহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে যে পরিমাণে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে, একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন ঠিক সে পরিমাণে সুনাম ক্ষুণ্ন করে। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই সুনাম উদ্ধার করতে হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম দু’দশকে জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে, নির্বাচন কমিশন নয়, সরকারই জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দলীয় সরকারের আমলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো মানুষের মন থেকে এ ধারণা দূর করতে সক্ষম হয়। দশম সংসদ নির্বাচনে সে ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এখন একটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই পারে মানুষের মন থেকে নির্বাচন সম্পর্কিত নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে।
দুই. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালীকরণে অংশগ্রহণমূলক এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জনগণ নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত হলে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর তাদের পুরো নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলে যে সংসদ গঠিত হয়, তা হয় সত্যিকার অর্থে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্বকারী। আর তা না হলে যে সংসদ গঠিত হয়, তাতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালীকরণের অপরিহার্য শর্ত হল নির্বাচনে সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় যে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে তা সত্যিকার অর্থে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্ব করে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের গণতন্ত্র। তাই এ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আগাম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিন. দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় একমাত্র ভারত ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে হতাশা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মহল। তারা নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে অর্থবহ আলোচনা শুরুর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি ভারত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সমর্থন করলেও তারা একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে শেখ হাসিনার সরকারকে পরামর্শ দেয়। কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহল সরকারের সঙ্গে কাজ করে যেতে সম্মত হলেও এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে গেছেন। এর প্রমাণ মেলে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরকারী যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক উপমন্ত্রী লিন ফিদারস্টোন এবং বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার বক্তব্য থেকে। লিন ফিদারস্টোন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধানসম্মত হলেও অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন না হওয়াটা হতাশাব্যঞ্জক। পাঁচ বছর পরপর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেটি খুঁজে নিতে আমি সব দলকে উৎসাহ জোগাই। কারণ এ সহিংসতা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যই শুভ নয়।’ আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি নয়, এ বিষয়ে সাংবাদিকরা লিন ফিদারস্টোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব রয়েছে। জনগণের কল্যাণে তাদের আলোচনায় বসতে হবে। পাঁচ বছর পর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা বন্ধের পথ তাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় নির্বাচনের পরপরই হতাশা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক সংকট অবসানে বিএনপিসহ সব দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাগিদ দেয় শেখ হাসিনার সরকারকে। যুক্তরাষ্ট্রের সে অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ২ নভেম্বরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২ নভেম্বর একটি দৈনিকের (ইত্তেফাক) প্রতিনিধিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড্যান মজিনা বলেছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্জিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মার্কিন সরকারের অবস্থান নিয়ে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা নেই। পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিক্রিয়া, সিনেটে শুনানিসহ বেশ কয়েকবার মার্কিন সরকারের মতামত এসেছে এ নির্বাচন নিয়ে। সেই মতামত ও অবস্থান এখনও বহাল। বাংলাদেশ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয় যে, আমরা গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চলব না। অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আগাম সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাক নির্ভেজাল গণতন্ত্র।
চার. বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান খাদ্য চালের মূল্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে। বিগত কয়েক বছর ধরে চালের উৎপাদন সন্তোষজনক হওয়ায় এবং সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় বর্তমানে চালের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিুমুখী হওয়ায় সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক দিক থেকে কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে। উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে পরিগণিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকায় সরকার ৩ লাখ নতুন গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গরিব ও অসহায় মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নতুন সুবিধাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব যে আওয়ামী লীগের জন্য প্লাস পয়েন্ট তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আগাম সংসদ নির্বাচন না করার পক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুক্তি হল, তারা নির্বাচন করে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচন নয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে ভুল করেছে সে ভুলের খেসারত তাদেরই দিতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা ভালো করেই জানেন যে, দশম সংসদ নির্বাচন অবৈধ না হলেও এর নৈতিক সমর্থন খুবই দুর্বল। তাছাড়া নির্বাচনের জন্য বর্তমান সাংগঠনিক শক্তি এবং অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে পারে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হয়তো এসব বিবেচনায় নিয়েই ‘যে কোনো সময়ই নির্বাচন করা যায়’ বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
No comments