সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য by ড. একেএম শাহনাওয়াজ
উনপঞ্চাশ
নিরীশ্বরবাদী আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রভাব প্রাচীন বাংলায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এদের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে জৈন এবং বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের শক্ত অবস্থান বাংলার ধর্মচিন্তাকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তার ধারণায় নিজেদের যুক্ত করার আগে মহাজনপদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতবাসী। বলা হয়, রাষ্ট্র ধারণার পূর্ব রূপ হিসেবে ভারতে শক্তিশালী বড় বড় জনপদ গড়ে উঠেছিল। এরকম ষোলোটি জনপদের তালিকা পাওয়া যায় জৈনসূত্রে। জৈনদের ‘ষোড়শ জনপদে’র তালিকায় অঙ্গ, বঙ্গ, লাড় (রাঢ়) ইত্যাদি অঞ্চলের কথা বর্ণিত হওয়ায় বোঝা যায় বাংলায় জৈন ধর্মের অবস্থান ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জৈনমূর্তি স্থাপনের তথ্য জৈনদের সরব অবস্থানের কথাই প্রমাণ করে। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার স্থাপনের আগে এখানে একটি জৈন মন্দির ছিল বলে প্রত্নসূত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে সমকালীন সূত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সাত শতকের মধ্যেই বাংলায় জৈনধর্মের অবলুপ্তি ঘটেছিল। কারণ সাত শতকের মধ্যভাগের পর সমকালীন সাহিত্য আর অনুশাসনগুলোতে জৈনদের সম্পর্কে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
জৈনধর্মের অনুসঙ্গী হয়েই মানবিক আবেদন নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল। প্রাচীন বাংলায় পাল রাজবংশের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্মের চরম বিকাশ ঘটতে থাকে। আট শতক থেকে তাই বাংলা বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। রাজা ধর্মপালের সময় প্রায় ৫০টি বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৌদ্ধ ধর্মও তার আদি ধারায় টিকে থাকেনি। তান্ত্রিকবাদ প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় জনপ্রিয় ছিল। জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম জনপ্রিয় করার জন্য বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা বাংলায় এক পর্যায়ে বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মের প্রবর্তন করেন। বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রবহমানতার যুগে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরও উপস্থিতি ছিল। প্রথমদিকে বহিরাগত ব্রাহ্মণরা বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকলেও ক্রমে স্থানীয় জনপ্রিয় আচার-অনুষ্ঠান ও পূজা-পার্বণ দ্বারা প্রভাবিত হন। এ যুগে রচিত হতে থাকে পুরাণ ও তন্ত্রগুলো। এভাবে বাংলায় বৈদিক ধর্ম নতুন রূপ লাভ করে। তাই বৈদিক দেবতাদের পাশে নতুন দেবদেবীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহেশ্বর, গণেশ, পার্বতী, মনসা ইত্যাদি। হিন্দুদের পাশাপাশি কখনও কখনও বৌদ্ধরাও এসব দেবদেবীর পূজা করতে থাকে। এগার শতকে বাংলায় সেন রাজাদের তত্ত্বাবধানে বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্প্রসারণ চলতে থাকে। সেন শাসন পর্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম উচ্চ অবস্থানে এসে পৌঁছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসকদের আরোপিত বিধানে সমাজ চতুঃবর্ণে বিভাজিত হয়ে যায়। রক্ষণশীল ও সুবিধাবাদী ব্রাহ্মণ শাসকরা স্বধর্মীয় সাধারণ মানুষের প্রতি সমদর্শী ছিলেন না। তাই সেন শাসন যুগে বাংলার সাধারণ শূদ্র জনগোষ্ঠী ধর্ম, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে বিপন্ন দশায় পৌঁছেছিল। এ অবস্থা বাংলার ধর্ম সংস্কৃতির পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় বাংলার সাধারণ মানুষের সামনে মুক্তি ও মানবতার বাণী নিয়ে আসে মুসলমান সাধক শ্রেণী। নিজ ধর্মের নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে বৈরী আচরণ পাওয়া বিপন্ন মানুষদের সহজেই আকৃষ্ট করে সুফি সাধকদের অনাড়ম্বর জীবন ও মানবিক আচরণ। এভাবে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটতে থাকে বাংলায়। তের শতকের শুরু থেকেই বাংলার রাজদণ্ড মুসলমানদের করায়ত্ত হতে থাকে। আর এরই পথ ধরে এদেশের ধর্মীয় জীবনে আসে রূপান্তর। ধর্মীয় দৃষ্টিতে মধ্যযুগের যাত্রাপথ এভাবেই তৈরি হয়। তবে এরও একটি পটভূমি ছিল।
নিরীশ্বরবাদী আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রভাব প্রাচীন বাংলায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এদের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায় না। তবে জৈন এবং বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের শক্ত অবস্থান বাংলার ধর্মচিন্তাকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তার ধারণায় নিজেদের যুক্ত করার আগে মহাজনপদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতবাসী। বলা হয়, রাষ্ট্র ধারণার পূর্ব রূপ হিসেবে ভারতে শক্তিশালী বড় বড় জনপদ গড়ে উঠেছিল। এরকম ষোলোটি জনপদের তালিকা পাওয়া যায় জৈনসূত্রে। জৈনদের ‘ষোড়শ জনপদে’র তালিকায় অঙ্গ, বঙ্গ, লাড় (রাঢ়) ইত্যাদি অঞ্চলের কথা বর্ণিত হওয়ায় বোঝা যায় বাংলায় জৈন ধর্মের অবস্থান ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জৈনমূর্তি স্থাপনের তথ্য জৈনদের সরব অবস্থানের কথাই প্রমাণ করে। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর মহাবিহার স্থাপনের আগে এখানে একটি জৈন মন্দির ছিল বলে প্রত্নসূত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে সমকালীন সূত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, সাত শতকের মধ্যেই বাংলায় জৈনধর্মের অবলুপ্তি ঘটেছিল। কারণ সাত শতকের মধ্যভাগের পর সমকালীন সাহিত্য আর অনুশাসনগুলোতে জৈনদের সম্পর্কে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
জৈনধর্মের অনুসঙ্গী হয়েই মানবিক আবেদন নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল। প্রাচীন বাংলায় পাল রাজবংশের শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্মের চরম বিকাশ ঘটতে থাকে। আট শতক থেকে তাই বাংলা বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। রাজা ধর্মপালের সময় প্রায় ৫০টি বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৌদ্ধ ধর্মও তার আদি ধারায় টিকে থাকেনি। তান্ত্রিকবাদ প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় জনপ্রিয় ছিল। জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম জনপ্রিয় করার জন্য বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা বাংলায় এক পর্যায়ে বৌদ্ধতান্ত্রিক ধর্মের প্রবর্তন করেন। বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের এই প্রবহমানতার যুগে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরও উপস্থিতি ছিল। প্রথমদিকে বহিরাগত ব্রাহ্মণরা বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকলেও ক্রমে স্থানীয় জনপ্রিয় আচার-অনুষ্ঠান ও পূজা-পার্বণ দ্বারা প্রভাবিত হন। এ যুগে রচিত হতে থাকে পুরাণ ও তন্ত্রগুলো। এভাবে বাংলায় বৈদিক ধর্ম নতুন রূপ লাভ করে। তাই বৈদিক দেবতাদের পাশে নতুন দেবদেবীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহেশ্বর, গণেশ, পার্বতী, মনসা ইত্যাদি। হিন্দুদের পাশাপাশি কখনও কখনও বৌদ্ধরাও এসব দেবদেবীর পূজা করতে থাকে। এগার শতকে বাংলায় সেন রাজাদের তত্ত্বাবধানে বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্প্রসারণ চলতে থাকে। সেন শাসন পর্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম উচ্চ অবস্থানে এসে পৌঁছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসকদের আরোপিত বিধানে সমাজ চতুঃবর্ণে বিভাজিত হয়ে যায়। রক্ষণশীল ও সুবিধাবাদী ব্রাহ্মণ শাসকরা স্বধর্মীয় সাধারণ মানুষের প্রতি সমদর্শী ছিলেন না। তাই সেন শাসন যুগে বাংলার সাধারণ শূদ্র জনগোষ্ঠী ধর্ম, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকারবঞ্চিত হয়ে বিপন্ন দশায় পৌঁছেছিল। এ অবস্থা বাংলার ধর্ম সংস্কৃতির পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় বাংলার সাধারণ মানুষের সামনে মুক্তি ও মানবতার বাণী নিয়ে আসে মুসলমান সাধক শ্রেণী। নিজ ধর্মের নিয়ন্ত্রকদের কাছ থেকে বৈরী আচরণ পাওয়া বিপন্ন মানুষদের সহজেই আকৃষ্ট করে সুফি সাধকদের অনাড়ম্বর জীবন ও মানবিক আচরণ। এভাবে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটতে থাকে বাংলায়। তের শতকের শুরু থেকেই বাংলার রাজদণ্ড মুসলমানদের করায়ত্ত হতে থাকে। আর এরই পথ ধরে এদেশের ধর্মীয় জীবনে আসে রূপান্তর। ধর্মীয় দৃষ্টিতে মধ্যযুগের যাত্রাপথ এভাবেই তৈরি হয়। তবে এরও একটি পটভূমি ছিল।
No comments