মার্কিন নির্বাচনেও কালো টাকা by তারেক শামসুর রেহমান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের উভয় কক্ষেই জয়লাভ করেছে। প্রতিনিধি পরিষদে তারা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে। আর সিনেটের গুরুত্বপূর্ণ ৬ আসনেও জয়ী হয়েছে তারা। এর মাধ্যমে কংগ্রেসের উভয় কক্ষই এখন বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। ফলে আইন প্রণয়নে তাদের সামনে আর কোনো বাধা থাকল না। বোঝাই যাচ্ছে, সামনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ‘কালো টাকা’ এবার একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। ৪ নভেম্বর সেখানে ৩৩ সিনেট আসনে ও ৪৩৫ প্রতিনিধি পরিষদের আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। এবার নির্বাচনজুড়ে একটা বড় আলোচনার বিষয় ছিল কালো টাকা, যাকে এখানে বলা হচ্ছে ‘ডার্ক মানি’র ব্যবহার। নির্বাচনের আগে ‘সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিকস’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় দেখিয়েছিল, প্রায় ৪০ লাখ ডলার কালো টাকা এ নির্বাচনে ব্যয় হবে। এ টাকা প্রার্থী নিজে ব্যবহার করেন না। এর একটা বড় অংশ ব্যয় করা হয়েছে ওবামাবিরোধী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীদের বিজয়ী করতে।
সর্বশেষ নির্বাচনের দিন যে জনমত জরিপ প্রকাশিত হয়েছে তাতে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, সিনেট চলে যাচ্ছে রিপাবলিকানদের হাতে। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তাদের দখলে ছিল ২৩৩ আসন। আর ডেমোক্রেটদের ১৯৯ আসন। রিপাবলিকানরা তাদের এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে পেরেছে। তবে সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ডেমোক্রেটদের সিনেটে ছিল ৫৩টি আসন, আর রিপাবলিকানদের দখলে ছিল ৪৫টি আসন। দুটি আসনে ছিল নিরপেক্ষরা। এখন সিনেটেও রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা পেল। তারা ইতিপূর্বে ডেমোক্রেটদের দখলে থাকা আরকানসাস, সাউথ ডাকোটা, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, কলোরাডো, নর্থ ক্যারোলিনা ও মন্টানা অঙ্গরাজ্যে জয়ী হওয়ায় এটা সম্ভব হল।
ধারণা করা যায়, রিপাবলিকানদের এই বিপুল পেছনের পেছনে ‘কালো টাকা’ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য উভয় দলের পক্ষেই এ ‘কালো টাকা’ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে রিপাবলিকানদের পক্ষে পাল্লাটা ভারি ছিল। বিভিন্ন সংস্থা রিপাবলিকান প্রার্থীদের বিজয়ী করাতে এ টাকা ব্যয় করেছে। রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে আর ডেমোক্রেটদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাতে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। নেতিবাচক এসব প্রচারণায় ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রার্থীকে আক্রমণ করা হয় না। আক্রমণ করা হয় দলকে। এক্ষেত্রে আক্রমণের টার্গেট হয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টি। কোথাও কোথাও স্থানীয় ইস্যুও প্রাধান্য পেয়েছে। সাধারণত বিলবোর্ড স্থাপন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার কাজে এ অর্থ ব্যয় করা হয়। যারা এ কালো টাকা নির্বাচনে ব্যয় করেছে, একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কয়েকটি সংস্থার নাম দিয়েছে। যারা অর্থ ব্যয় করছে তাদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চেম্বার্স অব কমার্স, ক্রসরোড জিপিএস, লীগ অব কনজারভেটিভ ভোটার্স, ন্যাশনাল রাইফেলস অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি। চেম্বার্স অব কমার্স ব্যয় করেছে ৩১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার, ক্রসরোড ২৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার, কনজারভেটিভ ভোটার্স ৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন, ন্যাশনাল রাইফেলস ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। এসব সংস্থার কর মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ নয় কোথায় এবং কীভাবে তারা টাকা খরচ করছে তা জানানোরও দরকার হবে না। ফলে যে টাকা তারা খরচ করেছে, এর জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে না। এখানে বলা ভালো, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের স্বার্থে এসব সংস্থায় চাঁদা দিয়ে থাকে।
এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে মহিলাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে প্রতিনিধি পরিষদে মহিলা সদস্য ছিলেন ৭৯ জন। আর সিনেটে ২০ জন। মোট আসনের শতকরা ১৮ দশমিক ৯ ভাগ মহিলাদের দখলে। এবার ১৫ জন মহিলা সিনেট নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যে ২০ জন মহিলা সিনেটে ছিলেন, তাদের মধ্যে ১৬ জন এ নির্বাচনে অংশ নেননি। অন্যদিকে ১৬১ জন মহিলা প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। শুধু কেন্দ্রীয়ভাবেই নয়, বরং রাজ্যগুলোতেও মহিলা আইন প্রণয়নকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯৭৯ সালে যেখানে রাজ্যগুলোর আইন সংস্থায় মহিলা প্রতিনিধিত্বের হার ছিল মাত্র ১০ ভাগ, সেখানে ২০১৩ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ ভাগ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে (অর্থাৎ কেন্দ্রে) ১৯৭৯ সালে যেখানে মহিলা প্রতিনিধিত্ব ছিল প্রায় ৩ ভাগ, তা ২০১৩ সালে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৫ ভাগে। এতে বোঝা যায়, আইন প্রণয়নে রাজ্য তথা কেন্দ্রে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে।
আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, ওবামার জন্য এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনটা ভালো হবে না। ওয়াশিংটন পোস্ট ও এবিসি পোলের সর্বশেষ জরিপে (২৩-২৬ অক্টোবর) দেখা যায়, সরকার পরিচালনায় ওবামার ওপর আস্থা রেখেছেন ৪৪ ভাগ, আর আস্থা রাখতে পারেননি ৫০ ভাগ মানুষ। ৪৬ জন বলেছেন, তিনি শক্ত নেতা; আর ৫২ ভাগ বলেছেন, তিনি শক্ত নেতা নন।
এখানে বলা ভালো, সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের (সিনিয়র) সময় সিনেট ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টির দখলে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদও ছিল ডেমোক্রেটদের দখলে। পরিস্থিতি বদলে যায় বিল ক্লিনটনের সময়। ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট ছিল রিপাবলিকানদের দখলে। আবার প্রেসিডেন্ট বুশের (জুনিয়র) সময়েও প্রথমদিকে, ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত, প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট নিয়ন্ত্রণ করেছে রিপাবলিকানরা। ২০১২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ওবামার প্রথম টার্মে প্রতিনিধি পরিষদ ছিল ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ২০১২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রিপাবলিকানদের দখলে।
এবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, বিশেষ করে অভিবাসন নীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা ডেমোক্রেটদের এই ভরাডুবিতে তাই অখুশি। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। চীনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা যায়।
ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.