কোন পথে জামায়াত?
যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা একে একে সেই বিচারে দণ্ড পাচ্ছেন। দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। অন্যদিকে জামায়াত এসব বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে হরতালসহ নানারকম কর্মসূচি দিচ্ছে। কখনো কখনো সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপন সমঝোতার আওয়াজ উঠছে। এ নিয়ে জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপির সঙ্গে সন্দেহ সংশয় বাড়ছে। সরকার ও বিএনপির সঙ্গে নানান চতুরতার আশ্রয় নিয়ে এই সঙ্কটকালকে অতিক্রমের চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। আসলে কোন পথে চলেছে জামায়াতের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি? জামায়াত-আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটা লাভ-হেট রিলেশনের মতো। প্রয়োজনে তারা পরস্পরকে কাছে টেনেছে, প্রয়োজনেই পরস্পরকে দূরে ঠেলেছে। সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এই ভালোবাসার প্রকাশ দেখা গেছে। বিশেষত ১৯৮৬ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত-আ’লীগ ঐক্য, সমঝোতার রাজনীতি প্রকাশ্য হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও বিএনপির সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে জামায়াতকে পাশে টেনেছে আ’লীগ। কিন্তু দু’দলের ক্ষেত্রেই কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য কাজ করেছে। যখনই দু’দল সুযোগ পেয়েছে পরস্পরকে আক্রমণও করেছে। ১৯৭১ সালে সুযোগমতো আওয়ামী লীগ সমর্থক ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে জামায়াত। আবার সময়মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দণ্ড দিতেও কসুর করেনি আ’লীগ। ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক সমঝোতা যতই হোক না কেন, জামায়াত এবং আ’লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব সুবিধামতো পরস্পরকে বেকায়দায় ফেলতে কসুর করেনি। কাজেই জামায়াত এবং আ’লীগ উচ্চপর্যায়ের সম্পর্ক সুবিধামতো পরস্পরকে কাছে টানা এবং পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করার নীতিই অবলম্বন করেছে। আ’লীগ জামায়াতকে কখনো তার রাজনৈতিক মিত্র ভাবেনি, রাজনৈতিক প্রয়োজনে কাছে টানলেও। অন্যদিকে জামায়াত নিজেদের বিকাশের স্বার্থে আ’লীগের সঙ্গ নিয়েছে কিন্তু তার জিহাদি রাজনীতির মিত্র ভাবেনি তাকে। বরং এই দুই দল বাস্তবিক প্রয়োজনে পরস্পরের স্বার্থেই মিলেছে, আবার দূরেও সরেছে। কখনো প্রকাশ্য মিলন হয়েছে কখনো তা ঘটেছে গোপনে। দুই রাজনৈতিক দলের বিরহ বা বৈরিতার ইতিহাসও সেই একই সূত্রে টানা। বিএনপি-জামায়াত বিএনপির রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়েই জামায়াতের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। বিএনপির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নানা সুবিধাবাদের অবস্থানের মধ্যেই জামায়াত তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্য নিয়েই বিকশিত এবং অগ্রসর হয়েছে। কখনো কখনো বিএনপির বিরুদ্ধাচরণ করলেও জামায়াত আদর্শিক এবং নিজেদের বিকাশের স্বার্থে বিএনপিকে পরিত্যাগ করেনি। বরং বিএনপির ভেতরে নিজেদের প্রভাব বলয় বাড়িয়েছে। গত চার দশকে আর্থিক, রাজনৈতিকভাবে তাদের ধারাবাহিক বিকাশ এমনভাবে ঘটেছে, যার সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিও অনেকটাই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে। ফলে, বিএনপির সঙ্গে দৃশ্যমান রাজনৈতিক জোট বাঁধলেও অদৃশ্যে একটা আদর্শিক চেতনার মিত্রতাও কাজ করেছে। বাজার অর্থনীতি তাতে আরও সুযোগ এনেছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক নীতির সুবিধা নিয়ে জামায়াত তার অতীত রাজনৈতিক কালিমা যতটা না ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছে সংগঠনের উপরিকাঠামো নির্মাণে। সমস্ত চেষ্টা চালিয়েছে রাষ্ট্রের ক্ষমতার উপরিকাঠামোগত ব্যবস্থায় নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। এক্ষেত্রে তাদের সাফল্য অনেকটাই বিএনপিকে আশ্রয় করে। ফলে, বিএনপি শাসনামলে তারা মন্ত্রীর সুবিধাও পেয়েছে। সম্প্রতি বিশেষত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ আওয়ামী লীগ, শক্তির নীতিতে ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হলে জামায়াত-বিএনপি যুগপৎ যে সঙ্কটে পড়ে সেখানেই বিএনপি-জামায়াতের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন শুরু হয়। সরকার সেই সুযোগ গ্রহণ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত তার নেতাদের বিচার রহিত, শাস্তি কমানোসহ, তাদের ওপর সরকারি রোষানল কমাতে নানাভাবে সরকারের সঙ্গে গোপন দেনদরবার শুরু করলে জামায়াত-বিএনপির মধ্যে একধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস ও সঙ্কট শুরু হয়। তার প্রকাশ্য রূপ দেখা যায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা জামায়াত নেতা গোলাম আযমের জানাজায় বিএনপির অনুপস্থিতি। এমনকি তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশে বিএনপির অনীহার পরে গোলাম আযমপুত্রের বিএনপিকে অকৃতজ্ঞ বলার মধ্য দিয়ে এই সঙ্কটরূপ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। এই টানাপড়েন সাময়িক হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। চাপের মুখে জামায়াত শেখ হাসিনার শাসনামলের এই অংশে এসে জামায়াত নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সত্যিকার একটা বড় চাপের মুখে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে টালবাহানা যতই চলুক, আন্তর্জাতিক মহলের চাপ যতই থাকুক না কেন, শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে কতগুলো দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রেখে শাস্তি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দৃঢ়তা জামায়াতকে এক দারুণতর সঙ্কটে ফেলেছে। নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করতে, অথবা কৌশলে ভারত প্রভাব বলয়কে নিজেদের অনুকূলে এনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করতে সকল বাধা অতিক্রমের যে দৃঢ়তা শেখ হাসিনা দেখাচ্ছেন, সেটাও জামায়াতকে মারাত্মক চাপের মুখে ফেলেছে। জামায়াতের এই রাজনৈতিক সঙ্কট নানাভাবে ডালপালা ছড়িয়েছে। এক. জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অপরাধে দণ্ড হয়েছে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। জামায়াতের সাবেক প্রধান, তাত্ত্বিক গুরু গোলাম আযম দণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হয়েছে, আপিল অপেক্ষমাণ। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জেনারেল সেক্রেটারি আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছে, আপিল অপেক্ষমাণ। জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুস সুবহান, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলামের বিচার চলছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অন্যতম বিশেষত আর্থিক খাত পরিচালনাকারী বলে পরিচিত মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে, আপিল অপেক্ষমাণ। দুই. জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের, প্রথম কাতারে বড় নেতাদের সবারই যুদ্ধাপরাধের অপরাধে সাজা ঘোষণা এবং তা কার্যকর হওয়ায় দলটির নেতৃত্বের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে। তিন. জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ওপর সরকার যে দমননীতি অবলম্বন করেছে, তাতে তারা ক্রমশ প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে পিছু হটে প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। চার. রাজনৈতিক দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চলমান থাকায় তা নতুনভাবে তাদের ওপর চাপ ফেলেছে। পাঁচ. আর্থিকভাবে জামায়াতের ওপর নানাভাবে চাপ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিত্রদের প্রকাশ্য সমর্থন তাদের কমেছে। সেটাও একটা নতুন সঙ্কট তৈরি করেছে। ছয়. স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার নীতিতে তাদের বড় নেতাদের শাস্তি হচ্ছে। বাংলাদেশের মিডিয়া তাদের অপকর্ম প্রকাশ্যে অধিকতর তৎপর। ফলে বাংলাদেশের জনসমাজে জামায়াতের কর্মকাণ্ডের এই প্রকাশ্য রূপ তাদের জন্য নতুন জনসমর্থন সংগ্রহে এক বিপুল বৈরিতা তৈরি করেছে। সাত. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ যে নেগেটিভ ব্রান্ডিংয়ের মুখে পড়েছে, তার চাপও পড়েছে জামায়াতের ওপর। জঙ্গিবাদ বা ‘ওয়ার অন টেরর’ এর বিরুদ্ধে যে বৈশ্বিক চাপ তারও আছর পড়েছে জামায়াতে ইসলামীর ওপর। আট. ভারতের সামরিক, বেসামরিক এবং গোয়েন্দা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক বড় অংশের কাছেও জামায়াত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সেটাও তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। নয়. তারেক জিয়া বিএনপির নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লন্ডনে বসে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্রব না রাখার হুঁশিয়ারি তিনি দিয়েছেন। অনেকের মতে তার নির্দেশে গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেনি বিএনপি। জানাজাতেও অংশ নেয়নি। গোলাম আযমপুত্র এ বিষয়ে ব্যক্তিগত উষ্মা প্রকাশ করে পরে ক্ষমাও চেয়েছেন। এটাতে স্পষ্ট তারেক জিয়ার সঙ্গে জামায়াত হাইকমান্ডের একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। বাংলাদেশে তাদের মিত্র দল বিএনপি এবং বিশেষত তারেক জিয়ার সঙ্গে তাদের আপাতত অবিশ্বাসের সম্পর্ক তাদের এক নতুনতর সঙ্কটে ফেলেছে। জেএমবি: বাংলাদেশ টু ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জঙ্গিবাদ কোনো নতুন ইস্যু নয়। বহুদিন ধরেই এ ইস্যুর নড়াচড়া হচ্ছে। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের পর মার্কিন তরফে তা প্রতিহতের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে জঙ্গিবাদ বিশেষত ইসলামী জঙ্গিবাদ নতুন মাত্রা পায়। সময়ভেদে আফগানিস্তানে মার্কিন এবং রুশ আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। ভারত এবং পাকিস্তানের বিবদমান পক্ষ, এই জঙ্গিবাদকে নানাভাবে তাদের নিজ নিজ দেশের পক্ষে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকে। এক সময় তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। সম্প্রতি জঙ্গিবাদের সেই অংশটি জামা’আতুল মুজাহিদীন (জেএমবি) পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার কাছে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে এক বিস্ফোরণের পর ধরা পড়ে। ভারতীয় গোয়েন্দাতন্ত্র কলকাতার কাছে এই জেএমবি উপস্থিতিকে খুব সিরিয়াসলি নেয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার এবং কেন্দ্রের বিজেপির সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে টানাপড়েন লক্ষ করা যায়। বিজেপি, তৃণমূল পরস্পরকে ঘায়েল করতে এবং নিজেদের অনুকূলে রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করতে এই ইস্যুকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়। ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আদর্শজাত বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় থাকায়, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা চালায়। এর মধ্যে খবর মেলে পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়া জেএমবি জঙ্গিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল। এই ঘটনার কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এক. বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে ইচ্ছুক সব সন্ত্রাসী শেখ হাসিনা সরকার হটাতে সক্ষম বলে দাবি করেছে এতকাল। এখন দেখা যাচ্ছে ঘটনা উল্টো ঘটছে। ভারতের মাটিতেই জেএমবি শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। দুই. মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে জেএমবিসহ ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের ধরছে র্যাব বা পুলিশ। এতে প্রতীয়মান হয় জঙ্গিবাদ উৎপাদন, পুনরুত্থান নিশ্চিহ্ন হয়নি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইসলামী জঙ্গি দমন দাবি যতটা বলা হয়, আদতেই তা কি না, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। অথবা সর্ষের মধ্যে কোথাও ভূত আছে কি না, সেটাও একটা কঠিন প্রশ্ন। তিন. বাংলাদেশের মাটিতে তো বটেই ভারতের মাটিতেও এই জেএমবি চালান ঘটছে। তাহলে এটা এখন স্পষ্ট, ভারতের অভ্যন্তরে কোনো না কোনোভাবে এই ইসলামি জঙ্গিবাদ পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে কারা, কেন, কীভাবে এই জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে? চার. জেএমবির এই উত্থান যদি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে ভারতের মাটি থেকে এই জঙ্গিবাদ তাদের স্বার্থে বাংলাদেশের বিপক্ষে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করতে বিশেষ সুবিধে নেবে কি নেবে না সেটাও একটা প্রশ্ন। পাঁচ. পলিটিক্যাল ইসলামের বাহক হিসেবে এদেশে জামায়াতে ইসলামী জেএমবি, হুজিসহ এসব সংগঠনের জঙ্গিবাদকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নিতে পারে কি না, সেটাও একটা বিবেচ্য বিষয়। জামায়াত এখন কী করবে? বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে এখন দুটি ধারা খুব সুস্পষ্ট। একটি পাকিস্তানি জমানার ক্ষয়িষ্ণু ধারা। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষাবলম্বন করেছে। যারা কখনোই স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এই ক্ষয়িষ্ণু ধারাই জামায়াতের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে রয়েছে। তাদের একাধিক নেতাই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দণ্ডিত অথবা বিচারাধীন। জামায়াতের অপর ধারাটি বর্ধিষ্ণু। যাদের অধিকাংশই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্য দিয়ে যাদের বেড়ে ওঠা। যারা তাদের পূর্বসূরিদের স্বাধীনতা বিরোধিতার দায় মাথায় নিয়ে পলিটিক্যাল ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। এদের বড় অংশ এখন মাঠপর্যায়ে জামায়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছে। জামায়াতের দুই ধারার মধ্যে আরেকটি নতুন ধারা গড়ে উঠেছে। যারা যেকোনো উপায়েই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত, আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং মডারেট ইসলামী রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় আকাক্সিক্ষত। জামায়াতের অভ্যন্তরের এই ত্রিধারার সমন্বয় এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও তারা এখন যা করতে চাইবে- এক. মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত নেতাদের আপিলের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার জন্য আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় পর্যায়ে লবিং। ইতোমধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং গোলাম আযমের ক্ষেত্রে যা কাজে লেগেছে। এখন সে চেষ্টা চলবে বিশেষত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলীর ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে আপসের শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। শেখ হাসিনা তার বিনিময়ে তার সরকারের বর্তমান মেয়াদকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্বিঘœ করতে চাইবেন। দুই. জামায়াতের তরুণ বর্ধিষ্ণু অংশটি বিএনপির সঙ্গে বিশেষত তারেক জিয়ার সঙ্গে সমঝোতা এবং সুসম্পর্কের উদ্যোগ নেবে। ভবিষ্যতে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলনে নামতে যাতে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে সে চেষ্টায় তারা সচেষ্ট থাকবে। তিন. দলের ক্ষয়িষ্ণু এবং বর্ধিষ্ণু দুই ধারাই বর্তমান সময়ে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্তের চাইতে ধীরে চলো নীতিই মেনে চলবে। মাঝেমধ্যে হরতাল, জনসভা, ঝটিকা মিছিল সচল থাকবে। বিএনপি নেত্রীর যেকোনো জনসভায় তারা বিপুল সংখ্যায় হাজির থাকবে, শো ডাউন দেবে। কিন্তু বিএনপি কোনো বড় ধরনের আন্দোলনে মাঠে না নামলে তারাও মাঠে না নামার বর্তমান সিদ্ধান্তে সচল থাকবে। বিরূপ পরিস্থিতিতে শান্ত থেকে যেকোনো উপায়ে টিকে থাকার নীতিতেই তারা অবিচল থাকবে। চার. মাঠপর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালাতে না পারলেও কিছু কিছু নতুন সুযোগ তাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। সরকারের দমননীতির ফলে তৃণমূলে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী বিপদে আছে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সমর্থন এবং সমব্যথা আদায়ের কৌশল তারা নিয়েছে। যেসব এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা খুন, গুম, জেল, জরিমানার শিকার হয়েছে তাদের আর্থিকভাবে, আইনগত সহায়তা দিয়ে এই নির্যাতিত অংশের সমর্থন নিজেদের অনুকূলে রাখতে সচেষ্ট জামায়াত। পাঁচ. যেকোনো পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াত তাদের পক্ষের মানুষদের জেতাতে সচেষ্ট থাকবে। উপজেলা নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। ভবিষ্যতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও তারা এই কৌশল ব্যাপকভাবে প্রয়োগের নীতিতে সচল থাকবে। ছয়. আত্মীয়তার সূত্রে, আর্থিকতার সূত্রে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকতার সূত্রে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বা তার মিত্রপক্ষের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির গোপন ও প্রকাশ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। ভবিষ্যতে আরও কোনো বিরূপ পরিস্থিতি এলে যাতে আত্মীয়তাকে কাজে লাগিয়ে, আর্থিক শক্তিকে ব্যবহার করে, প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারিত্বের সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সমর্থন পাওয়া যায় সেই চেষ্টা তারা চালিয়ে যাবে। সাত. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকা ও তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত থাকায় ইতোমধ্যে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড সাজার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। ভবিষ্যতে পশ্চিমা শক্তির এই সমর্থনকে তারা আরও সুগভীর করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আট. যুদ্ধাপরাধের বিচারে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের বিচার কাজ শেষ হলে জামায়াতের নেতৃত্বে নতুন মুখ দেখা দিতে পারে। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে মাঠপর্যায়ের পরীক্ষিত নেতৃত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে একটা নতুন নেতৃত্ব জামায়াতকে নতুন মোড়কে উপস্থাপনের চেষ্টা চালাবে। দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে, নতুন নেতাদের পরিচয়ে এ দলকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা গেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। নয়. বর্তমান দুঃসময়কে এক ধরনের রাজনৈতিক শিক্ষা হিসেবে নিতে চায় জামায়াত। মিসরের ব্রাদারহুডের অভিজ্ঞতার কথা দলীয় নেতাকর্মীদের জানিয়ে এ পরিস্থিতিতে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করার পরামর্শ মাঠপর্যায়ে অবহিত করেছে তারা। তাদের ধারণা এই বৈরী সময় খুব দীর্ঘায়িত হবে না। ভবিষ্যতের দায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশের মাটিতে কখনোই খুব শক্ত ভিত পায়নি। যুদ্ধাপরাধের দায় নেয়া জামায়াতের পক্ষে ভবিষ্যতে এই বৈরিতা কাটানো কতটা সহজ হবে তা নির্ভর করছে, এ বিষয়ে তারা কী কৌশল নেয় তার ওপর। অতীতে জামায়াত নানা কৌশলে কাজ করে সাংগঠনিকভাবে এগুলেও ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে কোনো ভুল স্বীকারের নীতি নেয়নি। ভবিষ্যতে এই নীতি অবলম্বন অব্যাহত রাখলে জনগণ শুধু এ কারণেই তাদের রাজনীতিকে কতটা গ্রহণ করবে, সেটা একটা বড় বিবেচনার বিষয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হলেও, মানুষের মনে এই স্মৃতি যতদিন জাগরূক থাকবে ততদিন জামায়াতের জনভিত্তি গড়ে তোলা সহজ কাজ হবে না। সেক্ষেত্রে তারা ভবিষ্যতে রণকৌশল বদলিয়ে আরও জঙ্গিপনার দিকে যেতে পারে। অথবা আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দৈন্যের সুযোগ নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক হয়ে নানা অঘটন ঘটানোর অপেক্ষায় থাকতে পারে। জামায়াতের ভবিষ্যৎ তাই শুধু তার নিজের কৌশল বা কাজের ওপরই নির্ভর করছে না, বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক চরিত্র, আচরণ এবং সক্ষমতার ওপরও নির্ভর করছে। ভবিষ্যতে আমাদের রাজনৈতিক বড় দলগুলো যদি জনমনের আকাক্সক্ষা পালনে ব্যর্থ হয়, সেই দুর্দিনের চোরাগলিতে জামায়াত ভয়ঙ্কর রাজনীতির পথে হাঁটলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। সৌজন্যে: সাপ্তাহিক
No comments