জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিন by একে এম শাহনাওয়াজ
স্বেচ্ছাচারী হরতালে এখন আমাদের দমবন্ধকর অবস্থা। বিপন্ন দেশবাসীর পক্ষ থেকে সরকার ও সর্বোচ্চ আদালতের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, আমাদের মুক্ত করুন। এ কথা মানতেই হবে, কর্মগুণে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা এখন অনেক বেড়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কতটা বৈধ হল বা হল না এ নিয়ে এখন মোটেও ভাবছে না রাজনীতির বলয়ে বারবার প্রতারিত সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি ডিঙ্গিয়ে যেহেতু আর কোনো পক্ষের মঞ্চ শোভিত করার মতো অবস্থান বা পরিচিতি তৈরি হয়নি, তাই মানুষের পক্ষেও হিসাব মেলানো সহজ হয়ে গেছে। দুপক্ষের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো বা মন্দের ভালো বিচার করা তেমন জটিল নয়। একটু বেশি চিন্তাশীল যারা তারা চলমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের হাজারো সীমাবদ্ধতার পরও বিএনপিকে কাছের ভাবতে পারছে না। খোদ স্বাধীনতাবিরোধী খুনি-ধর্ষকদের বিএনপির কেবিনেটে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া, যাদের অনেকেই এখন অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছেন। এসব বন্ধুর জন্য বিপাকে পড়া বিএনপি নেতৃত্ব এখন শোক বা ক্ষোভ কোনোটাই প্রকাশ করতে পারছে না। সাধারণ মানুষ দেখেছে, কয়েকবার বিএনপি শাসনক্ষমতায় থেকেছিল। এ সময় তারা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে যতটা না ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নে। হাওয়া ভবন কাণ্ড মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।
এ দেশের সাধারণ মানুষ সরল হিসাব করে। একটুতেই তারা সন্তুষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকার আমলের দুর্নীতি-সন্ত্রাসে তারা পীড়িত হয়। তারপরও নিয়তি মেনে এবং বিএনপির সময়ের সঙ্গে বর্তমান নৈরাজ্য কাটাকাটি করে। এ হিসাবে শেখ হাসিনা সরকার মানুষের কাছে কিছুটা এগিয়েই আছে। এছাড়া দৃশ্যমান কতগুলো উন্নয়ন আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেকটা বাড়তি ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে। আয়ের সঙ্গে জীবনযাত্রা নির্বাহের ব্যয়ে একটা সামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। তাই দেশে না খেয়ে থাকা লোকের সংখ্যা অনেকটা কমেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা অগ্রগতির সুফল মানুষ ভোগ করছে। এর সঙ্গে স্বর্ণ পালক যুক্ত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থান।
আমরা মনে করি, রাজনৈতিক জটিলতার নানা বাকবিতণ্ডা এবং তাত্ত্বিকদের তত্ত্বকথা সাধারণ মানুষকে তেমন ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ফলে দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখে শেখ হাসিনার এগিয়ে যাওয়ায় কোনো দ্বিধা থাকার কারণ নেই। ঠিক এই সময়ে জামায়াত কীভাবে লাগাতার অন্যায় হরতাল ঘোষণা করে মানুষকে কষ্ট দিতে ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারছে, তা সরকারকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে।
এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা মানুষ দেখতে চায়। কিন্তু এখানেও ধোঁয়াশা আছে। এ দেশে নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় হরতালকে আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে মানুষ দেখছে না। হরতাল আহ্বানকারীদের পিকেটিংয়ের নামে আগের সন্ধ্যা থেকে চালিয়ে যাওয়া উন্মত্ত আচরণ, ককটেল আর পেট্রলবোমায় মানুষের জীবন বিপন্ন করা, গাড়ি-ঘোড়ায় আগুন লাগানোর মধ্য দিয়ে মানবতাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে বৃহত্তর কোনো আন্দোলনের জন্য নয়, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে হরতাল নামের আসুরিক অস্ত্র। এতে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির, শিক্ষাব্যবস্থার রুটিন বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ তার মৌলিক অধিকার হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধারার হরতালের প্রতি হরতাল ডাকিয়ে পক্ষের সীমিতসংখ্যক মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন আছে বলে কেউ মনে করে না। অথচ এসব অন্ধকার শক্তির কাছে রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের অসহায় আত্মসমর্পণের কারণে লংঘিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার সাংবিধানিক অধিকার।
সময়ের বাস্তবতায় দাবি উঠেছিল হরতাল আইন করে বন্ধ করে দেয়ার। এ ব্যাপারে সরকার ও আদালতের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি টেলিভিশন টকশোতে একজন প্রবীণ আইনজীবীর বক্তব্য শুনে গোলকধাঁধায় পড়লাম। তিনি জানালেন, হরতাল বন্ধের আদেশ চেয়ে নাকি উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছিল। আদালত নাকি অভিমত দিয়েছেন, হরতাল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে তা বন্ধ করার সুযোগ নেই। আমি জানি না টকশো শুনে ঠিক বুঝতে পেরেছি কি-না। নিজের জানা সত্য ঝালিয়ে নিতে আরেকবার সংবিধানে চোখ রাখলাম। তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকারের পর্বটি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। সেখানে হরতাল শব্দের উপস্থিতি কোথাও দেখলাম না। তার বদলে ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষার কথাই স্পষ্ট রয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বিচারে আদালত দণ্ড দিলেই অবধারিতভাবে মানুষের ওপর একদিন, দুদিন বা লাগাতার হরতালের খক্ষ নেমে আসছে। আমরা বুঝতে পারি না, একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সময় এমন স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব হচ্ছে! আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এমন হরতাল করার আইনগত অধিকার কীভাবে জামায়াত পেয়ে থাকে! অনেক সময়ই তো আদালতকে বেশ স্পর্শকাতর মনে হয়। আদালতের রায় নিয়ে, কোনো ভূমিকা নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলেও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। এজলাসে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি ভোগ করেছেন। এ দেখে কষ্ট পেলেও মনকে বুঝিয়েছি। তবু আদালতের মর্যাদা সমুন্নত থাক এটি আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া। কিছুদিন আগে সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে অনেক হইচই হল। আমরা যারা কলাম লিখি বা টেলিভিশনে টকশোতে কথা বলি, তারা খুব দ্বন্দ্বে পড়েছিলাম। এত সব শাসনে থেকে মনের কথা কি বলা যায়, না লেখা যায়! সংবিধানে নাগরিকের যেটুকু বাকস্বাধীনতা সংরক্ষিত আছে তা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। এখন তো জামায়াতি হরতাল দেখে ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমরা সাধারণ মানুষ সদা সতর্ক থাকি, কোনো কোনো কাগজের অতি সতর্ক সম্পাদক সতর্ক করে দেন, এমন কিছু লেখা যাবে না যাতে আদালত বা সরকার বিব্রত হন। অথচ খোদ সর্বোচ্চ আদালত আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আসামি পক্ষের আইনজীবী টিভি ক্যামেরার সামনে বলতে পারছেন তারা ন্যায়বিচার পাননি। অর্থাৎ বিচারপতিরা তাদের প্রতি অন্যায় করেছেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসামির রাজনৈতিক দল রায়ের প্রতিবাদে ইচ্ছামতো হরতাল ডাকছে। অথচ এমন নয় যে, আসামি পক্ষ বিচার ব্যবস্থাকে বর্জন করেছে এবং একতরফা রায় হয়েছে। তারা রীতিমতো আইনি লড়াই করেছে, আপিল আদালতেও লড়েছে। এরপর চূড়ান্ত বিচারে রায় নিজেদের পক্ষে না এলেই অপরাধী পক্ষ জনগণের ওপর হরতাল চাপিয়ে দিতে পারে, এমন অমানবিক-অসংস্কৃত আচরণ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও কখনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এমন ভূমিকা দেখেও আদালত কোনো শাসন না করায় আমরা বিস্মিত হচ্ছি। অবশ্য কোন কথা বা আচরণে আদালত অপমানিত বোধ করবেন তা আদালতের ব্যাপার। জনস্বার্থের বিষয়টি নজরে আনাই আমাদের কাম্য। প্রায় জনসমর্থনহীন একটি দল হরতালের নামে বৃহত্তর জনগণকে কষ্ট দেবে- এটা আদালত ও সরকার নীরবে সহ্য করলে আমরা হতাশ হই। সম্মিলিত ইসলামী জোট, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলী এবং কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশের পর ডাকা হরতালগুলোয় রাস্তা-ঘাটে গাড়ি সচল থাকা এবং অফিস-আদালত, বিপণি বিতান খোলা থাকার ধরন দেখে জনগণের কাছে এই হরতালের যে কোনো মূল্য নেই তা বোঝা গেছে। কিন্তু এমন সব হরতালের আঘাতে স্কুলের লাখ লাখ শিশুর সমাপনী পরীক্ষার তারিখ বারবার পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের যে ক্ষতি করা হল এর প্রতিবিধান কে করবে? পিকেটারদের ভয়ে দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়ল না, পণ্যবাহী ট্রাক চলল না- এতে ক্ষতির শিকার হলেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা, অগণিত সাধারণ মানুষ এবং দেশের অর্থনীতি। এর দায় কি সরকার নেবে না? আমাকে এক প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জানালেন, তারা ক্যালেন্ডার মেনে সেমিস্টারের ক্লাস ও পরীক্ষা পরিচালনা করেন। সরকারি ছুটির দিনগুলো তারা মেকআপ ক্লাস নিয়ে সমন্বয় করেন। হরতালের মতো এক-আধটি অনির্ধারিত ঝামেলা হলে কায়ক্লেশে না হয় সামাল দেয়া যায়। কিন্তু এমন লাগাতার হরতালে তাদের ক্লাস পরীক্ষায় যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, একে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
একজন দণ্ডিত আসামির জন্য লজ্জিত না হয়ে কোনো দল যদি সিনা টান করে আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী ও দেশের অর্থনীতির ওপর প্রয়োগ করে, তবে এর চেয়ে অন্যায় আর কী হতে পারে!
এসব কারণে এ ধারার স্বেচ্ছাচারী হরতালের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিক্রিয়া আমরা প্রত্যাশা করি। পাশাপাশি মনে করি, এমন জিম্মিদশা থেকে আমাদের মুক্ত করা একটি সরকারের দায়িত্বই শুধু নয়, কর্তব্যও বটে। এখন মানুষ বলে বেড়াচ্ছে, সংসদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধারী আওয়ামী লীগের পক্ষেই সম্ভব আইন করে হরতাল বন্ধ করা। কিন্তু কোনো দিন বিরোধী দলে এলে এই অস্ত্র তাদেরও লাগবে বলে এ ব্যাপারে নীরব থাকছে। কিন্তু আমরা তেমনটি মনে করছি না। শুরুতেই আওয়ামী লীগের অবস্থান ও বিরোধী দলের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। এ বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যদি জনকল্যাণকামী রাজনীতির পথে এগিয়ে যায়, তাহলে এসব অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রের দরকার হবে না। তার বদলে ভুক্তভোগী মানুষের আনুকূল্য পাবে, এটা খুব সহজেই বলা যায়।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
এ দেশের সাধারণ মানুষ সরল হিসাব করে। একটুতেই তারা সন্তুষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকার আমলের দুর্নীতি-সন্ত্রাসে তারা পীড়িত হয়। তারপরও নিয়তি মেনে এবং বিএনপির সময়ের সঙ্গে বর্তমান নৈরাজ্য কাটাকাটি করে। এ হিসাবে শেখ হাসিনা সরকার মানুষের কাছে কিছুটা এগিয়েই আছে। এছাড়া দৃশ্যমান কতগুলো উন্নয়ন আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেকটা বাড়তি ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে। আয়ের সঙ্গে জীবনযাত্রা নির্বাহের ব্যয়ে একটা সামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। তাই দেশে না খেয়ে থাকা লোকের সংখ্যা অনেকটা কমেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা অগ্রগতির সুফল মানুষ ভোগ করছে। এর সঙ্গে স্বর্ণ পালক যুক্ত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থান।
আমরা মনে করি, রাজনৈতিক জটিলতার নানা বাকবিতণ্ডা এবং তাত্ত্বিকদের তত্ত্বকথা সাধারণ মানুষকে তেমন ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ফলে দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখে শেখ হাসিনার এগিয়ে যাওয়ায় কোনো দ্বিধা থাকার কারণ নেই। ঠিক এই সময়ে জামায়াত কীভাবে লাগাতার অন্যায় হরতাল ঘোষণা করে মানুষকে কষ্ট দিতে ও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারছে, তা সরকারকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে।
এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা মানুষ দেখতে চায়। কিন্তু এখানেও ধোঁয়াশা আছে। এ দেশে নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় হরতালকে আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে মানুষ দেখছে না। হরতাল আহ্বানকারীদের পিকেটিংয়ের নামে আগের সন্ধ্যা থেকে চালিয়ে যাওয়া উন্মত্ত আচরণ, ককটেল আর পেট্রলবোমায় মানুষের জীবন বিপন্ন করা, গাড়ি-ঘোড়ায় আগুন লাগানোর মধ্য দিয়ে মানবতাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে বৃহত্তর কোনো আন্দোলনের জন্য নয়, ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে হরতাল নামের আসুরিক অস্ত্র। এতে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির, শিক্ষাব্যবস্থার রুটিন বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ তার মৌলিক অধিকার হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধারার হরতালের প্রতি হরতাল ডাকিয়ে পক্ষের সীমিতসংখ্যক মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন আছে বলে কেউ মনে করে না। অথচ এসব অন্ধকার শক্তির কাছে রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের অসহায় আত্মসমর্পণের কারণে লংঘিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার সাংবিধানিক অধিকার।
সময়ের বাস্তবতায় দাবি উঠেছিল হরতাল আইন করে বন্ধ করে দেয়ার। এ ব্যাপারে সরকার ও আদালতের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি টেলিভিশন টকশোতে একজন প্রবীণ আইনজীবীর বক্তব্য শুনে গোলকধাঁধায় পড়লাম। তিনি জানালেন, হরতাল বন্ধের আদেশ চেয়ে নাকি উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছিল। আদালত নাকি অভিমত দিয়েছেন, হরতাল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে তা বন্ধ করার সুযোগ নেই। আমি জানি না টকশো শুনে ঠিক বুঝতে পেরেছি কি-না। নিজের জানা সত্য ঝালিয়ে নিতে আরেকবার সংবিধানে চোখ রাখলাম। তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকারের পর্বটি তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। সেখানে হরতাল শব্দের উপস্থিতি কোথাও দেখলাম না। তার বদলে ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষার কথাই স্পষ্ট রয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বিচারে আদালত দণ্ড দিলেই অবধারিতভাবে মানুষের ওপর একদিন, দুদিন বা লাগাতার হরতালের খক্ষ নেমে আসছে। আমরা বুঝতে পারি না, একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সময় এমন স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব হচ্ছে! আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এমন হরতাল করার আইনগত অধিকার কীভাবে জামায়াত পেয়ে থাকে! অনেক সময়ই তো আদালতকে বেশ স্পর্শকাতর মনে হয়। আদালতের রায় নিয়ে, কোনো ভূমিকা নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলেও সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। এজলাসে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি ভোগ করেছেন। এ দেখে কষ্ট পেলেও মনকে বুঝিয়েছি। তবু আদালতের মর্যাদা সমুন্নত থাক এটি আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া। কিছুদিন আগে সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে অনেক হইচই হল। আমরা যারা কলাম লিখি বা টেলিভিশনে টকশোতে কথা বলি, তারা খুব দ্বন্দ্বে পড়েছিলাম। এত সব শাসনে থেকে মনের কথা কি বলা যায়, না লেখা যায়! সংবিধানে নাগরিকের যেটুকু বাকস্বাধীনতা সংরক্ষিত আছে তা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। এখন তো জামায়াতি হরতাল দেখে ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমরা সাধারণ মানুষ সদা সতর্ক থাকি, কোনো কোনো কাগজের অতি সতর্ক সম্পাদক সতর্ক করে দেন, এমন কিছু লেখা যাবে না যাতে আদালত বা সরকার বিব্রত হন। অথচ খোদ সর্বোচ্চ আদালত আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আসামি পক্ষের আইনজীবী টিভি ক্যামেরার সামনে বলতে পারছেন তারা ন্যায়বিচার পাননি। অর্থাৎ বিচারপতিরা তাদের প্রতি অন্যায় করেছেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আসামির রাজনৈতিক দল রায়ের প্রতিবাদে ইচ্ছামতো হরতাল ডাকছে। অথচ এমন নয় যে, আসামি পক্ষ বিচার ব্যবস্থাকে বর্জন করেছে এবং একতরফা রায় হয়েছে। তারা রীতিমতো আইনি লড়াই করেছে, আপিল আদালতেও লড়েছে। এরপর চূড়ান্ত বিচারে রায় নিজেদের পক্ষে না এলেই অপরাধী পক্ষ জনগণের ওপর হরতাল চাপিয়ে দিতে পারে, এমন অমানবিক-অসংস্কৃত আচরণ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও কখনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এমন ভূমিকা দেখেও আদালত কোনো শাসন না করায় আমরা বিস্মিত হচ্ছি। অবশ্য কোন কথা বা আচরণে আদালত অপমানিত বোধ করবেন তা আদালতের ব্যাপার। জনস্বার্থের বিষয়টি নজরে আনাই আমাদের কাম্য। প্রায় জনসমর্থনহীন একটি দল হরতালের নামে বৃহত্তর জনগণকে কষ্ট দেবে- এটা আদালত ও সরকার নীরবে সহ্য করলে আমরা হতাশ হই। সম্মিলিত ইসলামী জোট, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলী এবং কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশের পর ডাকা হরতালগুলোয় রাস্তা-ঘাটে গাড়ি সচল থাকা এবং অফিস-আদালত, বিপণি বিতান খোলা থাকার ধরন দেখে জনগণের কাছে এই হরতালের যে কোনো মূল্য নেই তা বোঝা গেছে। কিন্তু এমন সব হরতালের আঘাতে স্কুলের লাখ লাখ শিশুর সমাপনী পরীক্ষার তারিখ বারবার পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের যে ক্ষতি করা হল এর প্রতিবিধান কে করবে? পিকেটারদের ভয়ে দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়ল না, পণ্যবাহী ট্রাক চলল না- এতে ক্ষতির শিকার হলেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা, অগণিত সাধারণ মানুষ এবং দেশের অর্থনীতি। এর দায় কি সরকার নেবে না? আমাকে এক প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জানালেন, তারা ক্যালেন্ডার মেনে সেমিস্টারের ক্লাস ও পরীক্ষা পরিচালনা করেন। সরকারি ছুটির দিনগুলো তারা মেকআপ ক্লাস নিয়ে সমন্বয় করেন। হরতালের মতো এক-আধটি অনির্ধারিত ঝামেলা হলে কায়ক্লেশে না হয় সামাল দেয়া যায়। কিন্তু এমন লাগাতার হরতালে তাদের ক্লাস পরীক্ষায় যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, একে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
একজন দণ্ডিত আসামির জন্য লজ্জিত না হয়ে কোনো দল যদি সিনা টান করে আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী ও দেশের অর্থনীতির ওপর প্রয়োগ করে, তবে এর চেয়ে অন্যায় আর কী হতে পারে!
এসব কারণে এ ধারার স্বেচ্ছাচারী হরতালের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিক্রিয়া আমরা প্রত্যাশা করি। পাশাপাশি মনে করি, এমন জিম্মিদশা থেকে আমাদের মুক্ত করা একটি সরকারের দায়িত্বই শুধু নয়, কর্তব্যও বটে। এখন মানুষ বলে বেড়াচ্ছে, সংসদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধারী আওয়ামী লীগের পক্ষেই সম্ভব আইন করে হরতাল বন্ধ করা। কিন্তু কোনো দিন বিরোধী দলে এলে এই অস্ত্র তাদেরও লাগবে বলে এ ব্যাপারে নীরব থাকছে। কিন্তু আমরা তেমনটি মনে করছি না। শুরুতেই আওয়ামী লীগের অবস্থান ও বিরোধী দলের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। এ বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যদি জনকল্যাণকামী রাজনীতির পথে এগিয়ে যায়, তাহলে এসব অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রের দরকার হবে না। তার বদলে ভুক্তভোগী মানুষের আনুকূল্য পাবে, এটা খুব সহজেই বলা যায়।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
No comments