১৩ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ by কবির হোসেন
গত প্রায় সাড়ে চার বছরে ১৩ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর বাহিনীর নেতা ১২ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে নয়জনের মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনের আমৃত্যু জেল দেয়া হয়। একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অপর এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ, রায়ের জন্য অপেক্ষা চলছে। আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রাপ্ত দুই শীর্ষ অপরাধী বন্দি অবস্থায় মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের নির্দেশ ও সহায়তায় পাকবাহিনী ও রাজাকার আলবদররা সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট চালিয়েছে। এরা সরাসরি বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত।
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটা সরকারের একটা ইতিবাচক দিক। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা সম্ভব হয়েছে। সারা দেশের মানুষের প্রত্যাশাও এটাই। দণ্ডিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা হচ্ছেন- জামায়াতের সাবেক আমীর গেলাম আযম, বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু, বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারের বিচার শেষ হলেও রায় এখনও অপেক্ষমাণ।
ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দণ্ডিতরাই মূলত স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার মূল হোতা ছিলেন। বেশিরভাগ রায়ে বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বর্তন নেতৃত্বের দায় তারা এড়াতে পারেন না। তাদের নির্দেশ ও পরিকল্পনাতেই সারা দেশে রাজাকার, আল বদর ও আলশামস বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে। সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের নেতৃত্বে ছিলেন এ দণ্ডিতরাই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক গোলাম আযমকে গত বছরের ১৫ জুলাই ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, পাকিস্তানি সেনা ও অন্য আধাসামরিক বাহিনী যেমন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি গোটা বাংলাদেশে যে নৃশংসতা চালিয়েছে, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ দাখিল করেছে। এসব আধাসামরিক বাহিনী পূর্ণ ছিল মূলত জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের দিয়ে।
জামায়াতের আমীর হিসেবে এসব বাহিনীর ওপর গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। নেতা ও সংগঠনের মধ্যে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক থাকলে এবং অধস্তন বাহিনী সরাসরি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলে, অধীনস্থ বাহিনীর অপরাধের দায় ঊর্ধ্বতনের ওপর বর্তায়। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, আসামি পূর্ণ জ্ঞানে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা উপায়ে অধস্তন বাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেছেন। গত ২৪ অক্টোবর কারাবন্দি অবস্থায় মারা গেছেন এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী।
জামায়াতের বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী। গত ২৯ অক্টোবর তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায় অনুযায়ী নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলেন না, এটি গঠনের মূল হোতা ছিলেন। এছাড়া ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন, যা বর্তমানে ছাত্রশিবির নামে পরিচিত। আলবদর বাহিনী ছিল ছাত্রসংঘের অ্যাকশন সেকশন। স্পষ্টতই ছাত্রসংঘ ও আলবদরের ওপরে নিজামীর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, নিজামী মনপ্রাণ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেননি, তিনি পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী, আজহারুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবিরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। অথচ এই নিজামীকেই বাংলাদেশের মন্ত্রী করা হয়েছিল, যা ছিল বড় ধরনের ভুল।
এর আগে বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ তাকে আমৃত্যু জেল দিয়েছেন। গত বছরের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পান জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও পরিকল্পনার দায়ে তাকে এ দণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে তার আপিল বিচারাধীন। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে গত বছরের ৯ মে ফাঁসি দেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বেসামরিক নেতাদের ওপরও বর্তায়। কারণ অধস্তন বা প্রকৃত অপরাধীদের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে। কামারুজ্জামান অপরাধ করতে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, পরামর্শ, উসকানি ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। তাই এসব অপরাধের দায় কামারুজ্জামান এড়াতে পারেন না। গত তিন নভেম্বর আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। তাকে গত বছরের ৫ ফেব্র“য়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এর বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি নিয়ে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১২ ডিসেম্বর রাতে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী তিনি চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার ছিলেন। তাকে গত ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। গত বছরের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাকে একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গি আর ঐদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য আলোচিত-সমালোচিত এই বিএনপি নেতার আপিল বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রথম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু। রায় ঘোষণার পর থেকেই পলাতক এই জামায়ায়ত নেতা। এছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। এ দুজনও পলাতক রয়েছেন। এছাড়া বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু জেল দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় মারা গেছেন এই শীর্ষ অপরাধী। ব্যাপকভাবে পরিচিত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে বর্তমানে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল যে কোনো দিন তার রায় ঘোষণা করবেন। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকনের বিচার শেষে গত ১৭ এপ্রিল থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা মোবারকের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখা হয় গত ২ জুন থেকে। জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে। গত ২০ আগস্ট বিচার শেষে তার মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমীর আবদুস সুবহানের বিচার চলছে ট্রাইব্যুনাল-২ এ। এছাড়া জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে। এছাড়া কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর বিচার শুরু হয়েছে। এছাড়া বুধবার থেকে বাগেরহাটের সিরাজুল হক সিরাজ মাস্টার, আবদুল লতিফ ও আকরাম হোসেন খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার অভিযোগে প্রায় অর্ধশত বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ের নেতার বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটা সরকারের একটা ইতিবাচক দিক। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা সম্ভব হয়েছে। সারা দেশের মানুষের প্রত্যাশাও এটাই। দণ্ডিত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা হচ্ছেন- জামায়াতের সাবেক আমীর গেলাম আযম, বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু, বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারের বিচার শেষ হলেও রায় এখনও অপেক্ষমাণ।
ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দণ্ডিতরাই মূলত স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার মূল হোতা ছিলেন। বেশিরভাগ রায়ে বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বর্তন নেতৃত্বের দায় তারা এড়াতে পারেন না। তাদের নির্দেশ ও পরিকল্পনাতেই সারা দেশে রাজাকার, আল বদর ও আলশামস বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছে। সারা দেশে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের নেতৃত্বে ছিলেন এ দণ্ডিতরাই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের আমীরের দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক গোলাম আযমকে গত বছরের ১৫ জুলাই ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেন, পাকিস্তানি সেনা ও অন্য আধাসামরিক বাহিনী যেমন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি গোটা বাংলাদেশে যে নৃশংসতা চালিয়েছে, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত দালিলিক প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ দাখিল করেছে। এসব আধাসামরিক বাহিনী পূর্ণ ছিল মূলত জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের দিয়ে।
জামায়াতের আমীর হিসেবে এসব বাহিনীর ওপর গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। নেতা ও সংগঠনের মধ্যে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক থাকলে এবং অধস্তন বাহিনী সরাসরি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলে, অধীনস্থ বাহিনীর অপরাধের দায় ঊর্ধ্বতনের ওপর বর্তায়। ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, আসামি পূর্ণ জ্ঞানে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা উপায়ে অধস্তন বাহিনীকে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেছেন। গত ২৪ অক্টোবর কারাবন্দি অবস্থায় মারা গেছেন এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী।
জামায়াতের বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী। গত ২৯ অক্টোবর তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায় অনুযায়ী নিজামী শুধু আলবদর বাহিনীর প্রধানই ছিলেন না, এটি গঠনের মূল হোতা ছিলেন। এছাড়া ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন, যা বর্তমানে ছাত্রশিবির নামে পরিচিত। আলবদর বাহিনী ছিল ছাত্রসংঘের অ্যাকশন সেকশন। স্পষ্টতই ছাত্রসংঘ ও আলবদরের ওপরে নিজামীর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, নিজামী মনপ্রাণ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেননি, তিনি পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী, আজহারুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবিরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে। অথচ এই নিজামীকেই বাংলাদেশের মন্ত্রী করা হয়েছিল, যা ছিল বড় ধরনের ভুল।
এর আগে বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ তাকে আমৃত্যু জেল দিয়েছেন। গত বছরের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পান জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও পরিকল্পনার দায়ে তাকে এ দণ্ড দেয়া হয়। বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে তার আপিল বিচারাধীন। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে গত বছরের ৯ মে ফাঁসি দেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বেসামরিক নেতাদের ওপরও বর্তায়। কারণ অধস্তন বা প্রকৃত অপরাধীদের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে। কামারুজ্জামান অপরাধ করতে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, পরামর্শ, উসকানি ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। তাই এসব অপরাধের দায় কামারুজ্জামান এড়াতে পারেন না। গত তিন নভেম্বর আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। তাকে গত বছরের ৫ ফেব্র“য়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এর বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি নিয়ে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১২ ডিসেম্বর রাতে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী তিনি চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার ছিলেন। তাকে গত ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। গত বছরের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তাকে একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গি আর ঐদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য আলোচিত-সমালোচিত এই বিএনপি নেতার আপিল বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে প্রথম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু। রায় ঘোষণার পর থেকেই পলাতক এই জামায়ায়ত নেতা। এছাড়া বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। এ দুজনও পলাতক রয়েছেন। এছাড়া বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু জেল দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় মারা গেছেন এই শীর্ষ অপরাধী। ব্যাপকভাবে পরিচিত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে বর্তমানে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল যে কোনো দিন তার রায় ঘোষণা করবেন। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকনের বিচার শেষে গত ১৭ এপ্রিল থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা মোবারকের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখা হয় গত ২ জুন থেকে। জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে। গত ২০ আগস্ট বিচার শেষে তার মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমীর আবদুস সুবহানের বিচার চলছে ট্রাইব্যুনাল-২ এ। এছাড়া জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে। এছাড়া কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান আলীর বিচার শুরু হয়েছে। এছাড়া বুধবার থেকে বাগেরহাটের সিরাজুল হক সিরাজ মাস্টার, আবদুল লতিফ ও আকরাম হোসেন খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার অভিযোগে প্রায় অর্ধশত বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ের নেতার বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
No comments