হাইকোর্ট ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অবৈধ ঘোষণা করেছে- প্রশাসনে তীব্র ৰোভ ছড়িয়ে পড়েছে এ রায়ের ফলে by তপন বিশ্বাস
ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সকে অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। আদালত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মন্ত্রী, এমপিদের সমমর্যাদা প্রদান এবং নির্বাহী প্রধান ও তিন বাহিনী প্রধানগণের উপরে অবস্থান দিয়ে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে নতুন ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় প্রদান করে। নতুন ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে সচিবদের অবস্থান বিডিআর, র্যাব, কোস্টগার্ড, আনসারের মহাপরিচালকের নিচে রাখা হয়েছে। এই রায় প্রকাশের পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা ৰোভে ফেটে পড়েন। এই রায়কে তারা নজিরবিহীন বলে উলেস্নখ করেছেন। তারা বলেছেন, এই রায়ে মামলার বিবাদীগণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশনা দেয়া হলো। বিগত ২০০৬ সালে এই মামলাটি দায়ের করেন তৎকালীন জুডিশিয়াল সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আতোয়ার রহমান। মামলা নং ১১৬৮৫/২০০৬।রায়ে হাইকোর্ট নতুন ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স প্রণয়নে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নতুন ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে সাংবিধানিক পদ থাকবে সবার ওপর। সংবিধানে উলেস্নখিত পদসমূহ যেমন জেলা ও দায়রা জজ, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণকে একই নম্বরভুক্ত(সিরিয়াল) করতে হবে। জেলা জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের একই ক্রমিক সমন্বয়ভুক্ত করতে হবে। সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জেলা জজের নিচে অতিরিক্ত জেলা জজের পদমর্যাদার কর্মকর্তারা তালিকাভুক্ত হবেন। চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটগণও অতিরিক্ত জেলা জজের ক্রমিক নম্বরে যুক্ত হবেন।
বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা মন্ত্রী-এমপিদের সমমর্যাদা এবং নির্বাহী প্রধানের ওপর অবস্থান করবেন। জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সমমর্যদার বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাগণের অবস্থান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তিন বাহিনী প্রধানের ওপর হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের অবস্থান হবে সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের নিচে। এছাড়া জেলা ও দায়রা জজগণের পদবি ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সের কোন প্রকার অস্পষ্টতা বা পরিমার্জন বা পরিবর্তন করা ছাড়া যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করতে হবে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের তাদের আঞ্চলিক অধিৰেত্রের বাইরেও মর্যাদা দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত বর্তমানে জেলাজজ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা। বর্তমানে তারা বেতন পান জাতীয় বেতন স্কেলের তৃতীয় গ্রেড অনুযায়ী।
সচিবদের অবস্থান সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের নিচে থাকবে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সশস্ত্র বাহিনী বলতে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ অন্য কোন আইন দ্বারা ঘোষিত যে কোন বাহিনীকে ব বোঝায়। সে অনুযায়ী আইজিপি, আনসার, র্যাব, ভিডিপি, কোস্টগার্ড ও বিডিআর-এর মহাপরিচালকের অবস্থান হবে সচিবের ওপরে। এমন রায় হাতে পাওয়ার পর সচিবালয়ে কর্মকর্তারা ব্যাপক ৰোভ প্রকাশ করেছেন।
আইন মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মাজদার হোসেন মামলার রায় মোতাবেক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মন্ত্রী-এমপিদের সমমর্যাদার কথা বলা হয়েছে। মাজদার হোসেন মামলার রায়ে উলেস্নখ করা হয়, মন্ত্রী-এমপিরা কাজের ৰেত্রে যেমন স্বাধীন; বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা বিচার কাজ পরিচালনার ৰেত্রে সেরূপ স্বাধীনতা ভোগ করবেন।
ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অনুমোদন করে রাষ্ট্রপতি নিজেই। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এটি প্রণয়ন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সারসংৰেপ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। সে হিসেবে ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্ট জারি হয় রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে। আর রাষ্ট্রপতি তাঁর কোন কাজের জন্য আদালতের কাছে জবাবদিহি করবেন না। সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা অনুরূপ বিবেচনায় কোন কাজ করে থাকলে বা না করে থাকলে সে জন্য তাঁকে কোন আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না।
সংবিধানের ৫৬(৬) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি সরকারী কার্যাবলী বণ্টন ও পরিচালনা করার জন্য বিধিসমূহ প্রণয়ন করবেন। এরূপ ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স সংবিধানে ৫৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করে থাকেন। এই রায়ে মামলার বিবাদীগণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশনা দেয়া হলো।
এই রায়কে বিরল আখ্যায়িত করে প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বে কোথাও এ জাতীয় ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স রয়েছে বলে জানা নেই। তবে এই মামলায় ১৯৯৩ সালে ভারতে এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এক্সিকিউটিভ এবং পলিটিক্যাল এক্সিকিউটিভের পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে ভারতীয় যে মামলার রায়ের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তা ভারতে কার্যকর হয়নি।
No comments