সমাজ-একটি শীতবস্ত্রের প্রতীক্ষায় by শাহ আলম
প্রতি বছরের মতো এবারও শীত এসেছে। বর্তমানে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে আরও কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে। এমনিতেই শীত মৌসুমে হতদরিদ্র মানুষ অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করে থাকেন।
তার ওপর যদি শৈত্যপ্রবাহ বইতে থাকে তখন এই মানুষগুলো অসহায় অবস্থায় একটি শীতবস্ত্রের আশায় দিন গুনতে থাকেন। অনেকে হয়তো তা পেয়েও যান। তবে দেশের এই বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই শুধু প্রত্যাশা নিয়ে রিক্তহস্তেই তীব্র শীতের মোকাবেলা করে। দেশের অনেক বিত্তশালী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতি বছরই গরিব মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটা করে তা বিতরণ করা হয়। সে ক্ষেত্রে যারা সবল ও শারীরিকভাবে সমর্থ তারাই লাইনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড ভিড় উপেক্ষা করে একটি শীতবস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে। তবে যারা বৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে দুর্বল এবং দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে অক্ষম সেসব নারী-পুরুষের অল্পসংখ্যকই শীতবস্ত্র পেয়ে থাকেন। একইভাবে শিশুরাও বঞ্চিত হয়।
আমরা যারা শহরে অট্টালিকায় বা বিলাসবহুল ভবনে বসবাস করি সেখানে শীতবস্ত্রের কমতি নেই। উপরন্তু প্রয়োজনে অনেকেই রুমহিটারও ব্যবহার করে থাকেন। সত্যিকার অর্থে আমরা কি সেসব নেহাত গরিব মানুষ যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, তেমন কোনো শীতবস্ত্রও নেই, তাদের কথা গভীরভাবে স্মরণ করি? আর করে থাকলেও যথাযথভাবে কি বুঝতে পারি তাদের করুণ অসহায়ত্তের কথা! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যা করে থাকি তাহলো পূর্বঘোষিত স্থান ও সময়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করি। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে। অনেকেই আবার গভীর রাতেও শহরের ফুটপাতে বা গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারের ভাঙা ছাপরার নিচে ঘুমন্ত হতদরিদ্র মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকেন। তা ছাড়া অনেকেই নিজ এলাকায় নেহাত গরিব মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের শীতবস্ত্র দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে যারা বয়সের ভারে নতজানু, যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে অক্ষম, সর্বোপরি যারা পঙ্গু তারা যে কী পরিমাণ খুশি হয়ে থাকেন সেই দৃশ্য যারা অবলোকন করেছেন শুধু তারাই এর মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম। একটি শীতবস্ত্র পাওয়া যে কত সুখের, কত আনন্দের তা আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করি।
এবার আমার একান্ত অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি দুর্লভ মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরতে চাই। ডিসেম্বর ২০০৩ সালের কথা। আমি তখন বগুড়া সেনানিবাসে কর্তব্যরত। সেই সময় উত্তরবঙ্গজুড়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণের সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমিও সেই মহৎ ও আর্তমানবতার সেবায় অংশগ্রহণ করি। দ্রুততার সঙ্গে শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও কেনার কাজ সম্পন্ন করি। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বগুড়া শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বস্ত্র সামগ্রী বিতরণের সিদ্ধান্ত নিই। কারণ ইতিমধ্যে বগুড়া শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। তাই আমি শহরের বাইরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করি। তা ছাড়া দিনের বেলায় বস্ত্র বিতরণের পরিবর্তে রাতে অসহায় হতদরিদ্রদের মধ্যে যেতেই মন চাইছিল। সেই সূত্রে প্রথম পর্বে শেরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘুমন্ত ও নেহাত গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করি। বেছে নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন হাটবাজার ও স্থাপনার বারান্দায় থাকা শীতকাতর মানুষগুলোকে, যাদের কাছে নামমাত্র শীতবস্ত্র ছিল। রাত ৯টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বিতরণ কার্যক্রম। প্রচণ্ড শীত তথা তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেই আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করি। বলাবাহুল্য, আমার সঙ্গে দু'জন মেজর পদবির অফিসার এবং কয়েকজন সৈনিক ছিলেন। আমরা সবাই এই মহৎ কাজটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই গ্রহণ করি। অনেকের ধারণা ছিল, এত রাতে তীব্র শীতের মধ্যে লোকজন পাওয়া যাবে না। আর আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যার একটি শীতবস্ত্র পাওয়ার দরকার অথবা এই পর্যন্ত যে একটি শীতবস্ত্রও পায়নি তাদের খুঁজে বের করা। আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। গভীর রাতে একজন নিতান্ত গরিব মানুষ বস্ত্র হাতে সেনাবাহিনীর সদস্য দেখে প্রথমত বিশ্বাসই করতে পারেননি। তারপর যখন উপলব্ধি করলেন এটা বাস্তব, তখন তার যে কী অনুভূতি বা অভিব্যক্তি ছিল সেই কথা বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবেই দ্বিতীয় পর্বও শেষ করলাম বগুড়া শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায়। এখানে একটি হৃদয়ছোঁয়া ঘটনার অবতারণা করছি। তা হলো, এই কার্যক্রমের শেষ অংশে আমরা রাত দেড়টায় বগুড়া শহরের ভেতর দিয়ে সেনানিবাসে ফিরছিলাম। শহর থেকে বের হওয়ার সময় পর্যটন কমপ্লেক্সের কাছে হাইওয়ের পাশে একটি ছোট ঝুপড়িতে সামান্য আলো দেখতে পাই। অতঃপর এখানে গাড়ি থামাই এবং ঝুপড়ির কাছে গিয়ে দেখতে পাই এক লোক শুধু হালকা একটি কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। আরও দেখলাম, লোকটি তীব্র শীতে কাতরাচ্ছে। আমি লোকটির কাছে গিয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে তাকে ডাকতে থাকলাম। এক সময় লোকটি অতি কষ্টে উঠে বসলেন। তার বয়স ছিল আশিরও ঊধর্ে্ব। সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখে প্রথমে হতভম্ব হলেও যখন জানতে পারলেন আমরা তার জন্য শীতবস্ত্র নিয়ে এসেছি, তখন তার মুখে অতি কষ্টের মধ্যেও মৃদু হাসি দেখতে পেলাম। বিতরণ কার্যক্রম শেষ হলেও আমাদের কাছে তখনও একটি কম্বল ও কয়েকটি সোয়েটার অবশিষ্ট ছিল। তাই বৃদ্ধ-হতদরিদ্র এই লোকটিকে একটি কম্বল ও একটি সোয়েটার দিতে পেরেছিলাম। তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন আমাদের দিকে। আলো-আঁধারের মাঝেও দেখতে পেলাম তার দু'চোখে আনন্দের অশ্রুধারা। মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো তার জন্যই আমাদের শেষ শীতবস্ত্রগুলো নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
কর্নেল (অব.) শাহ আলম, পিএসসি কলাম লেখক
আমরা যারা শহরে অট্টালিকায় বা বিলাসবহুল ভবনে বসবাস করি সেখানে শীতবস্ত্রের কমতি নেই। উপরন্তু প্রয়োজনে অনেকেই রুমহিটারও ব্যবহার করে থাকেন। সত্যিকার অর্থে আমরা কি সেসব নেহাত গরিব মানুষ যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, তেমন কোনো শীতবস্ত্রও নেই, তাদের কথা গভীরভাবে স্মরণ করি? আর করে থাকলেও যথাযথভাবে কি বুঝতে পারি তাদের করুণ অসহায়ত্তের কথা! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যা করে থাকি তাহলো পূর্বঘোষিত স্থান ও সময়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করি। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে। অনেকেই আবার গভীর রাতেও শহরের ফুটপাতে বা গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারের ভাঙা ছাপরার নিচে ঘুমন্ত হতদরিদ্র মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকেন। তা ছাড়া অনেকেই নিজ এলাকায় নেহাত গরিব মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের শীতবস্ত্র দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে যারা বয়সের ভারে নতজানু, যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে অক্ষম, সর্বোপরি যারা পঙ্গু তারা যে কী পরিমাণ খুশি হয়ে থাকেন সেই দৃশ্য যারা অবলোকন করেছেন শুধু তারাই এর মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম। একটি শীতবস্ত্র পাওয়া যে কত সুখের, কত আনন্দের তা আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করি।
এবার আমার একান্ত অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি দুর্লভ মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরতে চাই। ডিসেম্বর ২০০৩ সালের কথা। আমি তখন বগুড়া সেনানিবাসে কর্তব্যরত। সেই সময় উত্তরবঙ্গজুড়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণের সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমিও সেই মহৎ ও আর্তমানবতার সেবায় অংশগ্রহণ করি। দ্রুততার সঙ্গে শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও কেনার কাজ সম্পন্ন করি। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বগুড়া শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বস্ত্র সামগ্রী বিতরণের সিদ্ধান্ত নিই। কারণ ইতিমধ্যে বগুড়া শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। তাই আমি শহরের বাইরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করি। তা ছাড়া দিনের বেলায় বস্ত্র বিতরণের পরিবর্তে রাতে অসহায় হতদরিদ্রদের মধ্যে যেতেই মন চাইছিল। সেই সূত্রে প্রথম পর্বে শেরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘুমন্ত ও নেহাত গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করি। বেছে নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন হাটবাজার ও স্থাপনার বারান্দায় থাকা শীতকাতর মানুষগুলোকে, যাদের কাছে নামমাত্র শীতবস্ত্র ছিল। রাত ৯টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বিতরণ কার্যক্রম। প্রচণ্ড শীত তথা তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেই আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করি। বলাবাহুল্য, আমার সঙ্গে দু'জন মেজর পদবির অফিসার এবং কয়েকজন সৈনিক ছিলেন। আমরা সবাই এই মহৎ কাজটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই গ্রহণ করি। অনেকের ধারণা ছিল, এত রাতে তীব্র শীতের মধ্যে লোকজন পাওয়া যাবে না। আর আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যার একটি শীতবস্ত্র পাওয়ার দরকার অথবা এই পর্যন্ত যে একটি শীতবস্ত্রও পায়নি তাদের খুঁজে বের করা। আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। গভীর রাতে একজন নিতান্ত গরিব মানুষ বস্ত্র হাতে সেনাবাহিনীর সদস্য দেখে প্রথমত বিশ্বাসই করতে পারেননি। তারপর যখন উপলব্ধি করলেন এটা বাস্তব, তখন তার যে কী অনুভূতি বা অভিব্যক্তি ছিল সেই কথা বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবেই দ্বিতীয় পর্বও শেষ করলাম বগুড়া শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায়। এখানে একটি হৃদয়ছোঁয়া ঘটনার অবতারণা করছি। তা হলো, এই কার্যক্রমের শেষ অংশে আমরা রাত দেড়টায় বগুড়া শহরের ভেতর দিয়ে সেনানিবাসে ফিরছিলাম। শহর থেকে বের হওয়ার সময় পর্যটন কমপ্লেক্সের কাছে হাইওয়ের পাশে একটি ছোট ঝুপড়িতে সামান্য আলো দেখতে পাই। অতঃপর এখানে গাড়ি থামাই এবং ঝুপড়ির কাছে গিয়ে দেখতে পাই এক লোক শুধু হালকা একটি কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। আরও দেখলাম, লোকটি তীব্র শীতে কাতরাচ্ছে। আমি লোকটির কাছে গিয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে তাকে ডাকতে থাকলাম। এক সময় লোকটি অতি কষ্টে উঠে বসলেন। তার বয়স ছিল আশিরও ঊধর্ে্ব। সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখে প্রথমে হতভম্ব হলেও যখন জানতে পারলেন আমরা তার জন্য শীতবস্ত্র নিয়ে এসেছি, তখন তার মুখে অতি কষ্টের মধ্যেও মৃদু হাসি দেখতে পেলাম। বিতরণ কার্যক্রম শেষ হলেও আমাদের কাছে তখনও একটি কম্বল ও কয়েকটি সোয়েটার অবশিষ্ট ছিল। তাই বৃদ্ধ-হতদরিদ্র এই লোকটিকে একটি কম্বল ও একটি সোয়েটার দিতে পেরেছিলাম। তিনি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন আমাদের দিকে। আলো-আঁধারের মাঝেও দেখতে পেলাম তার দু'চোখে আনন্দের অশ্রুধারা। মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তো তার জন্যই আমাদের শেষ শীতবস্ত্রগুলো নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
কর্নেল (অব.) শাহ আলম, পিএসসি কলাম লেখক
No comments