দামিনীর মৃত্যু এবং অন্ধকার উপাখ্যান by দেলাওয়ার জাহান
মানুষ যত সভ্যই হোক তার আদিম কামনার চরিত্রটি বদলানো মোটেও সহজ নয়_ ভারতে গণধর্ষণের শিকার এক তরুণীর মৃত্যু আরও একবার সে কথাই মনে করিয়ে দিল। মানুষ সভ্য হচ্ছে। তার লালসার কৌশলও পরিবর্তিত হচ্ছে।
তবে সাম্প্রতিক ঘটনাটি আদিম প্রবৃত্তির পৈশাচিক পুনরাবৃত্তি বলেই এত আলোড়ন। একটি ধর্ষণ, একটি মৃত্যু আজ কেবল ভারতকেই কাঁপায়নি, বরং বিশ্বের কাছে হাজির করেছে একটি প্রশ্ন_ এটি কি নৈতিক শিক্ষাহীন সভ্যতার প্রতিদান?
ঘটনা ১৬ ডিসেম্বরের। বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে রাত ১০টায় ফিরছেন দামিনী। তার বন্ধু প্রকৌশলের ছাত্র। আর তিনি পড়েন মেডিকেলে। ড্রাইভার ছাড়াও বাসটিতে ছিল আরও পাঁচজন মানুষ। তাদের মানুষ বললে হয়তো ভুল বলা হবে। ওরা পশু। আধুনিক সমাজের কামজ সন্তান ওরা। মেয়েটিকে ধর্ষণ করল একের পর এক, লালসার চরিতার্থের পর ছুড়ে ফেলল রাস্তায়। লোহার রড দিয়ে মাথা ফাটাল। বাকিটা বললে চোখ ভিজবেই। শনিবার সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়েছিল। মৃত্যুর সংবাদ শুনে বিশ্বের শতকোটি মানুষের চোখে জেগেছিল ঘৃণার বাষ্প। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে জনগণের নিরাপত্তাহীনতার। মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধীর অতিমানবিক কথনে শান্ত হয়নি যন্তরমন্তর। ধর্ষণের ঘটনার পর থেকেই উত্তাল ভারত। দামিনীর মৃত্যু ঘি ঢেলেছে বিক্ষোভে। প্রণবপুত্র অভিজিতের বেয়াড়া মন্তব্যে মানুষ আরও কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
দিলি্ল এখন অপরাধের নগরী বলে পরিচিতি পেয়ে গেছে। ২০১২ সালে খোদ রাজধানীতেই ৬৩৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে এসে তাদেরই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এক নারী! অভিমানে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ বিশাল নগরীতে ছোটখাটো অপরাধ তোয়াক্কা না করেই প্রশাসন পার পেয়ে যায়। তবে এতসব ধর্ষণের কয়টার সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে এখন। আর শেষকৃত্য শেষ হতে না হতেই আরেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে সেই ভারতেই। ভারতের জন্য ঘটনাটি আরও স্পর্শকাতর। দেশটি বছরের শেষদিকে আন্তর্জাতিক মহলে খবর হয়ে বসল একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য। কেউ কেউ বলছেন, দেশটির জননিরাপত্তা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বলিউড আর ক্রিকেটীয় উষ্ণতায় অনেকখানি জলই ঢেলেছে ঘটনাটি।
সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী জনতার উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তবে অনেকে তাদের বক্তব্য জনতাকে 'ঠাণ্ডা' রাখার কৌশল বলে মনে করছেন। মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো সেই কৌশলের অংশ কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দামিনীর মৃত্যুর বিচারই তাদের কাছে শেষ কথা নয়। দাবি উঠেছে বিদ্যমান আইন সংস্কারের। দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার। পুলিশের ভূমিকা আরও জোরালো করার আশ্বাস চায় জনগণ। বিক্ষোভ এখনও থামেনি। কঠোর নিরাপত্তা আর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শেষকৃত্য। হাজার হাজার দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বিক্ষোভপ্রধান শহরগুলোতে। পুলিশের ভয় উপেক্ষা করে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। ঘটনাটি আগের ঘটনাগুলোর মতো নয়। সরকার এটা বুঝতে পেরেছে। ফলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আরও কঠোর আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) প্রধান শরিক কংগ্রেস। দেশটিতে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে দায়ী ব্যক্তিকে রাসায়নিক প্রয়োগে খোজাকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩০ বছরের কারাদণ্ড রাখার বিধান করার কথা ভাবছে সরকার। ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রাখার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া আইনটিতে।
দামিনীর মৃত্যু আমাদের দেশের দিকে নজর ফেরাতে বাধ্য করবে। বিদ্যমান আইনকে থোড়াই কেয়ার করা হয় বাংলাদেশে। ধর্ষণ, ইভ টিজিং আর নারী নির্যাতনের ঘটনা এখানে অপ্রতুল নয়। গত বছর ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে কয়েক তরুণীর আত্মহত্যা উদ্বেগজনক। ব্র্যাক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নারী চিকিৎসক সাজিয়া খুন হয়েছেন নিরাপত্তা কর্মীর লালসার বলি হয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। নির্যাতিত নারীরা প্রায়ই আইনি সহায়তা পান না। বিষয়টিতে সরকারের যথেষ্ট নজর দেওয়ার অবকাশ রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, গত বছরের তুলনায় বিদায়ী বছরে অর্থাৎ ২০১২ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতি ঘটেছে। দামিনীর মৃত্যু তরুণ প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়ে গেছে। কারণ সে এ প্রজন্মের প্রতিনিধি। বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত পুরো বিশ্ব। তার মৃত্যু অজস্র নারীর নিরাপত্তাহীনতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভয় ঢুকিয়ে দেয় মনে_ তারা অবলা। ভয় ধরিয়ে দেয়_ তারা এখনও পুরুষের স্বেচ্ছাচার কামনার বস্তু হতে পারে। যেখানে-সেখানে, যে কোনো সময় ট্রাম কিংবা বাসে। পোশাকি সভ্যতার আড়ালের কামনা আর লালসার বসতঘর ভাঙতে হবে।
য়দেলাওয়ার জাহান : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ (এলএলএম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঘটনা ১৬ ডিসেম্বরের। বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে রাত ১০টায় ফিরছেন দামিনী। তার বন্ধু প্রকৌশলের ছাত্র। আর তিনি পড়েন মেডিকেলে। ড্রাইভার ছাড়াও বাসটিতে ছিল আরও পাঁচজন মানুষ। তাদের মানুষ বললে হয়তো ভুল বলা হবে। ওরা পশু। আধুনিক সমাজের কামজ সন্তান ওরা। মেয়েটিকে ধর্ষণ করল একের পর এক, লালসার চরিতার্থের পর ছুড়ে ফেলল রাস্তায়। লোহার রড দিয়ে মাথা ফাটাল। বাকিটা বললে চোখ ভিজবেই। শনিবার সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়েছিল। মৃত্যুর সংবাদ শুনে বিশ্বের শতকোটি মানুষের চোখে জেগেছিল ঘৃণার বাষ্প। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে জনগণের নিরাপত্তাহীনতার। মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধীর অতিমানবিক কথনে শান্ত হয়নি যন্তরমন্তর। ধর্ষণের ঘটনার পর থেকেই উত্তাল ভারত। দামিনীর মৃত্যু ঘি ঢেলেছে বিক্ষোভে। প্রণবপুত্র অভিজিতের বেয়াড়া মন্তব্যে মানুষ আরও কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
দিলি্ল এখন অপরাধের নগরী বলে পরিচিতি পেয়ে গেছে। ২০১২ সালে খোদ রাজধানীতেই ৬৩৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে এসে তাদেরই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এক নারী! অভিমানে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ বিশাল নগরীতে ছোটখাটো অপরাধ তোয়াক্কা না করেই প্রশাসন পার পেয়ে যায়। তবে এতসব ধর্ষণের কয়টার সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে এখন। আর শেষকৃত্য শেষ হতে না হতেই আরেক নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে সেই ভারতেই। ভারতের জন্য ঘটনাটি আরও স্পর্শকাতর। দেশটি বছরের শেষদিকে আন্তর্জাতিক মহলে খবর হয়ে বসল একটি ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য। কেউ কেউ বলছেন, দেশটির জননিরাপত্তা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বলিউড আর ক্রিকেটীয় উষ্ণতায় অনেকখানি জলই ঢেলেছে ঘটনাটি।
সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী জনতার উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তবে অনেকে তাদের বক্তব্য জনতাকে 'ঠাণ্ডা' রাখার কৌশল বলে মনে করছেন। মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো সেই কৌশলের অংশ কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দামিনীর মৃত্যুর বিচারই তাদের কাছে শেষ কথা নয়। দাবি উঠেছে বিদ্যমান আইন সংস্কারের। দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার। পুলিশের ভূমিকা আরও জোরালো করার আশ্বাস চায় জনগণ। বিক্ষোভ এখনও থামেনি। কঠোর নিরাপত্তা আর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শেষকৃত্য। হাজার হাজার দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বিক্ষোভপ্রধান শহরগুলোতে। পুলিশের ভয় উপেক্ষা করে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। ঘটনাটি আগের ঘটনাগুলোর মতো নয়। সরকার এটা বুঝতে পেরেছে। ফলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আরও কঠোর আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) প্রধান শরিক কংগ্রেস। দেশটিতে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে দায়ী ব্যক্তিকে রাসায়নিক প্রয়োগে খোজাকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩০ বছরের কারাদণ্ড রাখার বিধান করার কথা ভাবছে সরকার। ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রাখার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া আইনটিতে।
দামিনীর মৃত্যু আমাদের দেশের দিকে নজর ফেরাতে বাধ্য করবে। বিদ্যমান আইনকে থোড়াই কেয়ার করা হয় বাংলাদেশে। ধর্ষণ, ইভ টিজিং আর নারী নির্যাতনের ঘটনা এখানে অপ্রতুল নয়। গত বছর ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে কয়েক তরুণীর আত্মহত্যা উদ্বেগজনক। ব্র্যাক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নারী চিকিৎসক সাজিয়া খুন হয়েছেন নিরাপত্তা কর্মীর লালসার বলি হয়ে। নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। নির্যাতিত নারীরা প্রায়ই আইনি সহায়তা পান না। বিষয়টিতে সরকারের যথেষ্ট নজর দেওয়ার অবকাশ রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, গত বছরের তুলনায় বিদায়ী বছরে অর্থাৎ ২০১২ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতি ঘটেছে। দামিনীর মৃত্যু তরুণ প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়ে গেছে। কারণ সে এ প্রজন্মের প্রতিনিধি। বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত পুরো বিশ্ব। তার মৃত্যু অজস্র নারীর নিরাপত্তাহীনতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভয় ঢুকিয়ে দেয় মনে_ তারা অবলা। ভয় ধরিয়ে দেয়_ তারা এখনও পুরুষের স্বেচ্ছাচার কামনার বস্তু হতে পারে। যেখানে-সেখানে, যে কোনো সময় ট্রাম কিংবা বাসে। পোশাকি সভ্যতার আড়ালের কামনা আর লালসার বসতঘর ভাঙতে হবে।
য়দেলাওয়ার জাহান : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ (এলএলএম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments