বিশ্ব ইজতেমা- আত্মনিবেদনের অনুশীলন by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

শৈত্যপ্রবাহ ও তীব্র শীতকে সঙ্গী করেই আজ ফজরের নামাজের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা। অবশ্য গত বুধবার বাদ জোহর থেকেই মাঠে খিত্তাওয়ারি বয়ান ও তালিম চলছে। আজ ইজতেমা মাঠে স্মরণকালের বৃহৎ জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে।
এতে প্রায় ৫ লাখ মুসলি্ল অংশ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। টঙ্গীর ইজতেমার মাঠসহ টঙ্গীবাসীর ঘরে ঘরে এখন ইজতেমার মেহমান। বিভিন্ন সময় যাদের দাওয়াত দিয়েও আনা সম্ভব হয় না, তাদের অনেকেই ইজতেমার বয়ান শুনতে ও ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে টঙ্গীতে বিভিন্ন আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবের বাসায় উঠেছেন।
তবলিগ মূলত প্রচারের কাজ। দীনের দাওয়াত মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে পেঁৗছানোই তাদের লক্ষ্য। তবে তবলিগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের দিক দিয়ে তারা একেবারেই প্রচারবিমুখ। নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকদের তবলিগের লোকেরা মুরবি্ব বলেন। তবলিগের মুরবি্বরা কারা সেটা গোপন নয়। পরামর্শমূলক প্রক্রিয়ায় চলে তবলিগ জামাতের কাজ। কে নেতা আর কে কর্মী, কার কী অবদান, কার গুরুত্ব কতখানি, কে আগে, কে পরে, কার নাম প্রকাশ পেয়েছে, কার নাম প্রকাশ পায়নি_ এসব বিষয়ে তারা একেবারেই নির্মোহ। আধুনিককালের এ প্রচারসর্বস্বতার জোয়ারের ভেতরও তাদের এ অবস্থানটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এটা প্রতিষ্ঠার লিপ্সা, খ্যাতির লিপ্সা ও প্রচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে একটি জোরালো প্রতিবাদও বটে। তবলিগ জামাত যতদিন তাদের এ অবস্থানটি আন্তরিকভাবে ধরে রাখতে পারবে, ততদিন মানুষের শ্রদ্ধার স্থল হয়ে থাকবে। তবলিগের শীর্ষ মুরবি্বরা রেডিও-টিভিতে ইজতেমার কর্মসূচির কোনো ফুটেজ বা আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারে অনুমতি দেননি। এমনকি মাঠের ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া নিষেধ। তারপরও পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আন্তরিকভাবেই ইজতেমার নিউজ কভার করে থাকে। এমনকি কিছু বেসরকারি টেলিভিশন ইজতেমার মুরবি্বদের অজ্ঞাতেই গত কয়েক বছর ধরে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করে আসছে।
আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া এ দল ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চলে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। তারা মানুষকে দীনের নসিহত শোনায় না, বরং তারা প্রতিমুহূর্তের জীবনাচরণে দীনের চর্চা করে। শুধু বাহ্যিকভাবে নয়, পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে। দীনের দাওয়াত নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া, এর একটিই লক্ষ্য থাকে_ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। অন্য কোনো লক্ষ্য এর মধ্যে সম্পৃক্ত হয় না_ এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটাই তবলিগ জামাতের মূল দর্শন। মূলত তারা তপস্যা, সাধনা ও ধ্যান করে কিছু বনে নতুন চেহারায় সমাজে এসে কিছু করেন না। তারা চেষ্টা করেন সমাজের ভেতরেই থেকে কিছুু অর্জন করতে। তবলিগে তারা মানুষকে শেখাতে যান না, নিজেরা শিখতে যান।
তবলিগি সাথীরা নিত্যদিনকার জীবনাচরণের ক্ষেত্রে কতগুলো চমৎকার বিষয় অনুশীলন করে থাকে। সেগুলো শুধু আত্মিক নয়_ সামাজিকও। সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে এর বিশদ বিবরণ দেওয়া মুশকিল। তারপরও বলা যায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষের কল্যাণে মনকে আত্মনিবেদিত করে তোলা, শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে মানুষের কাছে সত্যের দাওয়াত পেঁৗছানো, পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে চলতে শেখা, নিজস্ব নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ইত্যাদি অনুসরণীয় শিক্ষা। তবলিগে যেতে হয় নিজের পয়সা নিয়ে, কোনো দান-খয়রাত গ্রহণ করার সুযোগ নেই। তবলিগে বের হয়ে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, খ্যাতি, পরিচয় বা যে কোনো ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ শুধু যে নিষিদ্ধ বলে করা হয় না, তা নয়। এখানে মনমানসিকতাটাই তৈরি করা হয় সেভাবে। এই যে নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর কাছে আত্মনিবেদন ও বিচরণ_ এটা সমাজ জীবনের শান্তি প্রতিষ্ঠায় এক মহান শিক্ষা। এ শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে পারলে মানবসমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে তা অনেকটা জোর গলায়ই বলা যায়। বিশ্ব ইজতেমার এখন আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাত অবশ্যই এর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব। তবলিগের বিশ্ব ইজতেমা শুধু আখেরি মোনাজাতকেন্দ্রিক হয়ে ওঠার প্রবণতা খুব একটা ইতিবাচক দিক কি-না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ তবলিগের মুরবি্বরা প্রচার চান না। চান ভেতরের আত্মনিবেদিত কাজ। তবলিগের কার্যক্রম যত নিষ্কলুষ হবে, ততই তা সমাজের জোরালো ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব ইজতেমার আয়োজনও হবে ততই সফল।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.