'সবার উপরে মানুষ সত্য' by প্রভাষ আমিন
গত ১৭ ডিসেম্বর কালের কণ্ঠে 'নিউজ বড় না মানুষ' শিরোনামে আমার লেখা প্রকাশের পর এ নিয়ে প্রচুর প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সরাসরি, টেলিফোনে, ই-মেইলে, ফেসবুকে, কালের কণ্ঠের অনলাইন এডিশনে কেউ একমত পোষণ করেছেন, কারো দ্বিমত ছিল, কেউ কেউ রীতিমতো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
বিশেষ করে সাংবাদিক বন্ধুরা বলেছেন, আমি সাংবাদিকতা পেশাকেই খাটো করেছি। সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি, এমনকি কারো কারো দ্বিমতের সঙ্গেও একমত পোষণ করেছি। তবু আত্মপক্ষ সমর্থনে দু-একটি কথা না বললেই নয়। প্রথমত. আমি কোনোভাবেই সাংবাদিকতা পেশাকে খাটো করতে চাইনি। সাংবাদিকতা আমার খুব প্রিয় পেশা। অনেক ভালো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আমি রীতিমতো ভালোবেসে এই পেশায় এসেছি। সাংবাদিক ছাড়া জীবনে আর কিছুই হতে চাইনি। এত ভালোবাসি বলেই এ পেশার সামান্য বিচ্যুতিও আমাকে কষ্ট দেয়। অনেকে বলেছেন, ছাত্রলীগ নামধারী পশুরা যখন বিশ্বজিৎকে কোপাচ্ছিল, তখন সেখানে খুব বেশি সাংবাদিক ছিলেন না, আর উন্মত্ত ছাত্রলীগের সামনে তাঁদের করার কিছুই ছিল না। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরাও জানিয়েছেন, দু-তিনজন ক্যামেরাম্যান দোতলা পর্যন্ত উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁরা ছাত্রলীগের হুমকির মুখে ছবিও তুলতে পারেননি, বাঁচানোর চেষ্টা করা তো অনেক পরের কথা। যাঁরা নিচে নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন, তাঁরাই জুম লেন্সে ছবি তুলেছেন। তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের এই যুক্তি মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকেই যায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়া বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন রিপন নামের এক রিকশাচালক। একজন রিকশাচালক নিয়ে গেছেন একজন আহত দর্জিকে। তাইতো ডাক্তার অবহেলা করে ফেলে রেখেছিলেন তাঁকে। আর সেই অবহেলায়ই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান বিশ্বজিৎ। কিন্তু বিশ্বজিৎকে যদি কোনো সাংবাদিক হাসপাতালে নিয়ে যেতেন, তাহলে কি ডাক্তার চিকিৎসায় শৈথিল্য দেখানোর সাহস পেতেন? আর সাংবাদিকরা চাইলে বিশ্বজিৎকে তাঁদের গাড়িতে অনেক দ্রুত হাসপাতালে নিতে পারতেন। তাতে হয়তো বেঁচে যেতেন বেচারা বিশ্বজিৎ।
অনেক সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন সাংবাদিকতার গৌরবময় অতীতের কথা, স্বাধীনতার জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ, ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের বলেছি, সাংবাদিকদের এসব ভূমিকা দেখেই তো আমরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। আর সাংবাদিকরা সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশ, সমাজের দর্পণ। তাঁদের ভালো কাজের ফিরিস্তি দিতে গেলে তো প্রতিদিনই মহাভারত লেখা যাবে। কিন্তু যখন সাংবাদিকরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না, তখন সেটাও তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। অনেকে বলেছেন, সাংবাদিকের কাজই হলো নির্মোহভাবে সংবাদ সংগ্রহ করা, ছবি তোলা। সাংবাদিকরা কখনোই অ্যাকটিভিস্ট হবেন না। সাংবাদিকরা অ্যাকটিভিস্ট হবেন না- এই যুক্তির সঙ্গে আমি একমত। তবে সাংবাদিকরা যন্ত্রের মতো নির্মোহভাবে শুধু সংবাদ সংগ্রহ করে যাবেন- এই পুরনো ধারণা ঝেড়ে ফেলার সময় বোধ হয় চলে এসেছে। ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করলে আমরা সেই ডাক্তারকে কসাই বলে গাল দিই, উকিল তাঁর মক্কেলকে ঘোরালে তাঁকে চামার বলি, পুলিশকে গাল দিতে আলাদা শব্দ লাগে না। সেভাবে একজন সাংবাদিক যদি তাঁর পেশার সঙ্গে মানবিকতার মিশেল না দেন, তাঁকেও অন্য পেশার লোকজন বা সাধারণ মানুষও তো গালি দিতে পারে। সে কথাটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে কেন। আমরা যদি সবার কাছ থেকে মানবিকতা আশা করি, তাহলে সবার আগে সবার চেয়ে বেশি মানবিক তো হতে হবে আমাদেরই। নিজে যেটা করি না, সেটা অন্যকে করতে বলা মোটেই শোভনীয় নয়, নৈতিকও নয়।
নিরপেক্ষ বলে আসলে কিছু নেই। সব সময় সমাজে দুটি পক্ষ- ভালো ও মন্দ। সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ সাংবাদিকরা অবশ্যই ভালোর পক্ষে অবস্থান নেবেন। পেশাদারির দোহাই দিয়ে নিরপেক্ষতার ভান করে মন্দকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি তো বলছি না পুলিশের সঙ্গে বিরোধী দলের কর্মীদের সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকরা বিরোধী কর্মীদের হয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়বে। তাই বলে রাস্তায় পড়ে থাকা আহত একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের একটি গাড়ি পাওয়া যাবে না, এটা হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। কোথায় নাক গলালে সমাজের উপকার হবে, মানুষের উপকার হবে; সেটা বিচার করার মতো বিবেচনা আশা করি সব সাংবাদিকেরই আছে। অনেকে বলেছেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সবার আগে। শতভাগ একমত। শুধু সাংবাদিকতা নয়, সব পেশা, সব মানুষের জন্যই নিরাপত্তা সবার আগে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সম্পূর্ণ ঝুঁকিবিহীন জীবন যাপন করা কখনোই সম্ভব নয়। রাস্তায় বেরোলে দুর্ঘটনা হতে পারে, তাই বলে তো ঘরে বসে থাকা যাবে না।
অনেকে বলছেন, আপনি সাংবাদিকদের গালি দিচ্ছেন কেন? সেখানে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন তো করেইনি, বরং ঘটনাস্থল কোন থানার অধীনে, সেই বিতর্ক তুলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। দায়িত্ব পালন করেননি মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তাররাও। আমি তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, অবশ্যই পুলিশ ও ডাক্তার তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু আমাদের তো অন্যের ভুল ধরার আগে নিজেদের ভুলটা শুধরাতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, যদি আপনার রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান ছবি না তুলে বা সংবাদ সংগ্রহ না করে বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে যেতেন, তাহলে অফিসে ফেরার পর আপনি তাঁদের কী বলতেন? আমাদের রিপোর্টার যদি বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে পারতেন, তাহলে আমি তাঁকে ধন্যবাদই দিতাম।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, আপনি সেখানে থাকলে কী করতেন? নিরাপদ অফিসে বসে বড় বড় কথা লিখে ফেলা যত সহজ, ছাত্রলীগের চাপাতি হাতের সন্ত্রাসীদের সামনে তাদের প্রতিরোধ করতে যাওয়া ততটাই কঠিন। এই প্রশ্ন নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। সত্যটা হলো, সেখানে থাকলে আমিও হয়তো অন্য সবাই যা করেছে তা-ই করতাম। নিরাপদ দূরত্বেই থাকতাম। উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা আমাদের মধ্যবিত্তের। এটা শুধু সাংবাদিকদের সমস্যা নয়, সব মধ্যবিত্তের একই সমস্যা। রিকশাচালক রিপন বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে একবারও ভাবেননি পরে কী হবে। অন্য সবাই ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নিলে পুলিশি ঝামেলা হবে, পরে আদালতে যেতে হবে, সাক্ষ্য দিতে হবে- এ রকম নানা দ্বিধা আমাদের আটকে রাখে। এক পা এগোলে তিন পা পিছিয়ে আসি। আমি তো আমাদের এই দ্বিধা, কাপুরুষতা, ভীরুতাকেই ঘৃণা করার কথা বলেছি। এই ঘৃণার তীর সবার আগে আমার নিজের দিকেই। তবে বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নেওয়ার কাজটি হয়তো আমি করতাম। একা আমি যতটা ভীরু, আমার মতো ১০ জন ভীরু একসঙ্গে হলে কিন্তু ১০ গুণ সাহসী হয়ে যাবে। সেটাই যদি করা যায়, সবাই মিলে যদি প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এটাই শুধু আমি বলতে চেয়েছি।
সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে বলেছেন, আপনার এই প্রশ্ন অনেক পুরনো, সাংবাদিকতার সমান বয়সী। কিন্তু অমীমাংসিত। যুগে যুগে সাংবাদিকরা এমন ঘটনা তুলে এনেছেন বলেই এ নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। অনেকে অনেক উদাহরণও দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, বিশ্বজিতের ঘটনা ব্যাপক প্রচারের ফলেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ধরা পড়েছে। এ ধরনের পাশবিকতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, বিশ্বজিৎ যদি না-ই মারা যেতেন, তাহলে কি সবচেয়ে বেশি ভালো হতো না। সাংবাদিকতার দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক বুঝি না; আমি বুঝি, 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
লেখক : সাংবাদিক
অনেক সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন সাংবাদিকতার গৌরবময় অতীতের কথা, স্বাধীনতার জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ, ৯ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিকদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের বলেছি, সাংবাদিকদের এসব ভূমিকা দেখেই তো আমরা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। আর সাংবাদিকরা সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশ, সমাজের দর্পণ। তাঁদের ভালো কাজের ফিরিস্তি দিতে গেলে তো প্রতিদিনই মহাভারত লেখা যাবে। কিন্তু যখন সাংবাদিকরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না, তখন সেটাও তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। অনেকে বলেছেন, সাংবাদিকের কাজই হলো নির্মোহভাবে সংবাদ সংগ্রহ করা, ছবি তোলা। সাংবাদিকরা কখনোই অ্যাকটিভিস্ট হবেন না। সাংবাদিকরা অ্যাকটিভিস্ট হবেন না- এই যুক্তির সঙ্গে আমি একমত। তবে সাংবাদিকরা যন্ত্রের মতো নির্মোহভাবে শুধু সংবাদ সংগ্রহ করে যাবেন- এই পুরনো ধারণা ঝেড়ে ফেলার সময় বোধ হয় চলে এসেছে। ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করলে আমরা সেই ডাক্তারকে কসাই বলে গাল দিই, উকিল তাঁর মক্কেলকে ঘোরালে তাঁকে চামার বলি, পুলিশকে গাল দিতে আলাদা শব্দ লাগে না। সেভাবে একজন সাংবাদিক যদি তাঁর পেশার সঙ্গে মানবিকতার মিশেল না দেন, তাঁকেও অন্য পেশার লোকজন বা সাধারণ মানুষও তো গালি দিতে পারে। সে কথাটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে কেন। আমরা যদি সবার কাছ থেকে মানবিকতা আশা করি, তাহলে সবার আগে সবার চেয়ে বেশি মানবিক তো হতে হবে আমাদেরই। নিজে যেটা করি না, সেটা অন্যকে করতে বলা মোটেই শোভনীয় নয়, নৈতিকও নয়।
নিরপেক্ষ বলে আসলে কিছু নেই। সব সময় সমাজে দুটি পক্ষ- ভালো ও মন্দ। সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ সাংবাদিকরা অবশ্যই ভালোর পক্ষে অবস্থান নেবেন। পেশাদারির দোহাই দিয়ে নিরপেক্ষতার ভান করে মন্দকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি তো বলছি না পুলিশের সঙ্গে বিরোধী দলের কর্মীদের সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকরা বিরোধী কর্মীদের হয়ে পুলিশের সঙ্গে লড়বে। তাই বলে রাস্তায় পড়ে থাকা আহত একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের একটি গাড়ি পাওয়া যাবে না, এটা হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। কোথায় নাক গলালে সমাজের উপকার হবে, মানুষের উপকার হবে; সেটা বিচার করার মতো বিবেচনা আশা করি সব সাংবাদিকেরই আছে। অনেকে বলেছেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সবার আগে। শতভাগ একমত। শুধু সাংবাদিকতা নয়, সব পেশা, সব মানুষের জন্যই নিরাপত্তা সবার আগে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সম্পূর্ণ ঝুঁকিবিহীন জীবন যাপন করা কখনোই সম্ভব নয়। রাস্তায় বেরোলে দুর্ঘটনা হতে পারে, তাই বলে তো ঘরে বসে থাকা যাবে না।
অনেকে বলছেন, আপনি সাংবাদিকদের গালি দিচ্ছেন কেন? সেখানে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন তো করেইনি, বরং ঘটনাস্থল কোন থানার অধীনে, সেই বিতর্ক তুলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। দায়িত্ব পালন করেননি মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তাররাও। আমি তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, অবশ্যই পুলিশ ও ডাক্তার তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু আমাদের তো অন্যের ভুল ধরার আগে নিজেদের ভুলটা শুধরাতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, যদি আপনার রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান ছবি না তুলে বা সংবাদ সংগ্রহ না করে বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে যেতেন, তাহলে অফিসে ফেরার পর আপনি তাঁদের কী বলতেন? আমাদের রিপোর্টার যদি বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে পারতেন, তাহলে আমি তাঁকে ধন্যবাদই দিতাম।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, আপনি সেখানে থাকলে কী করতেন? নিরাপদ অফিসে বসে বড় বড় কথা লিখে ফেলা যত সহজ, ছাত্রলীগের চাপাতি হাতের সন্ত্রাসীদের সামনে তাদের প্রতিরোধ করতে যাওয়া ততটাই কঠিন। এই প্রশ্ন নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। সত্যটা হলো, সেখানে থাকলে আমিও হয়তো অন্য সবাই যা করেছে তা-ই করতাম। নিরাপদ দূরত্বেই থাকতাম। উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা আমাদের মধ্যবিত্তের। এটা শুধু সাংবাদিকদের সমস্যা নয়, সব মধ্যবিত্তের একই সমস্যা। রিকশাচালক রিপন বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যাপারে একবারও ভাবেননি পরে কী হবে। অন্য সবাই ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নিলে পুলিশি ঝামেলা হবে, পরে আদালতে যেতে হবে, সাক্ষ্য দিতে হবে- এ রকম নানা দ্বিধা আমাদের আটকে রাখে। এক পা এগোলে তিন পা পিছিয়ে আসি। আমি তো আমাদের এই দ্বিধা, কাপুরুষতা, ভীরুতাকেই ঘৃণা করার কথা বলেছি। এই ঘৃণার তীর সবার আগে আমার নিজের দিকেই। তবে বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নেওয়ার কাজটি হয়তো আমি করতাম। একা আমি যতটা ভীরু, আমার মতো ১০ জন ভীরু একসঙ্গে হলে কিন্তু ১০ গুণ সাহসী হয়ে যাবে। সেটাই যদি করা যায়, সবাই মিলে যদি প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এটাই শুধু আমি বলতে চেয়েছি।
সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে বলেছেন, আপনার এই প্রশ্ন অনেক পুরনো, সাংবাদিকতার সমান বয়সী। কিন্তু অমীমাংসিত। যুগে যুগে সাংবাদিকরা এমন ঘটনা তুলে এনেছেন বলেই এ নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। অনেকে অনেক উদাহরণও দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, বিশ্বজিতের ঘটনা ব্যাপক প্রচারের ফলেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ধরা পড়েছে। এ ধরনের পাশবিকতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, বিশ্বজিৎ যদি না-ই মারা যেতেন, তাহলে কি সবচেয়ে বেশি ভালো হতো না। সাংবাদিকতার দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক বুঝি না; আমি বুঝি, 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
লেখক : সাংবাদিক
No comments