ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব ও আজকের বাংলাদেশ by ওয়াহিদ নবি
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে অষ্টম স্থানের অধিকারী। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ষষ্ঠ স্থানের অধিকারী। জনসংখ্যার আধিক্যের জন্য একটি দেশ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, তার অনেকটাই বাংলাদেশে রয়েছে।
টমাস ম্যালথাস জনসংখ্যার আধিক্যের সমস্যা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন তাঁর বহুল প্রচলিত বই 'অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন'-এ। ১৭৯৮ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ৩০ বছরের মধ্যে বইটির ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় 'জ্যামিতিক হারে' কিন্তু খাদ্য বৃদ্ধি পায় 'অ্যারিথম্যাটিক হারে'। 'জ্যামিতিক হার' ও 'অ্যারিথম্যাটিক হার' কী ও কিভাবে তাদের হিসাব করা হয় সেসব জটিলতার মধ্যে না গিয়ে আমরা শুধু উল্লেখ করব যে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ে; কিন্তু খাদ্যের পরিমাণ বাড়ে মন্থর গতিতে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি মনে করেন, প্রতি ২৫ বছরে একটি দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। ম্যালথাসের তত্ত্ব অর্থনীতিভিত্তিক। এর একটি বিষয় হচ্ছে ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন। এ তত্ত্বের অর্থ হচ্ছে এই যে যদি কোনো কিছুর উৎপাদনে একটি বাড়তি উপাদান যোগ দেওয়া হয় (যদি অন্য উপাদানগুলো আগের মতোই রাখা হয়) তবে ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ে না। অর্থাৎ ম্যালথাস বলতে চান, একই পরিমাণ জমিতে কৃষি মজুরের সংখ্যা বাড়ালে শস্যের উৎপাদন বাড়বে না। এক কথায় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে প্রতি ২৫ বছরে পৃথিবীর আকার অর্ধেক হয়ে যাবে মানুষের কাছে। এমনিভাবে ধীরে ধীরে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ এত কমে যাবে, যা সবার জন্য যথেষ্ট হবে না। ফলে দেখা দেবে অনাহার ও অনাহার সম্পর্কিত সমস্যা। ম্যালথাস দুই রকমের সমাধানের কথা বলেছেন। একদিকে রয়েছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও যুদ্ধ; যেগুলো কেউ ইচ্ছা করে সৃষ্টি করে না। অন্যদিকে রয়েছে যৌন বিরতি, বিলম্বে বিবাহ ইত্যাদি; যা ব্যক্তিগত দায়িত্ব।
অর্থনীতির জনক হিসেবে ধরে নেওয়া হয় স্কটল্যান্ডের দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথকে। তাঁর লেখা 'ওয়েলথ অব দ্য নেশন'কে গণ্য করা হয় অর্থনীতির প্রথম বই হিসেবে। এ বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ সালে। এরপর রিকার্ডো ও জন স্টুয়ার্ট মিলের বই প্রকাশিত হয়। ম্যালথাসের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। অষ্টাদশ শতাব্দী পাশ্চাত্য জগতে অর্থনীতিশাস্ত্রের জন্ম শতাব্দী। কিন্তু কৌটিল্য বা চাণক্যের লেখা 'অর্থশাস্ত্র' প্রকাশিত হয়েছিল দুই হাজার বছরেরও আগে। ম্যালথাসের বইটি অভূতপূর্ব সাড়া জাগালেও এবং জনসংখ্যা প্রসঙ্গে তাঁর নাম বহুল আলোচিত হলেও জনসংখ্যা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে অনেক কাল আগে থেকেই। প্রায় দুই হাজার বছর আগে কার্থেজের অধিবাসী টার্টুলিয়ান পৃথিবীতে জনসংখ্যার আধিক্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তখন পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল ১৯ কোটি।
পৃথিবীর লোকসংখ্যা এখন প্রায় ৭০০ কোটি। এর মধ্যে ১৫ কোটি মানুষের বাস ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে খাদ্য। বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে অতীতে যেগুলো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালেও দুর্ভিক্ষ হয়েছে। এখন খাদ্য পরিস্থিতি অনেক ভালো। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে আমরা। অতীতে খাদ্য আমদানিতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। ফলে উন্নয়নকাজ ব্যাহত হয়েছে। উন্নত কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, ল অব ডিমিনিশিং রিটার্নের কথা। উৎপাদন বৃদ্ধির একটা সীমা রয়েছে।
বন্যায় আমাদের পানির আধিক্য হলেও আমরা নানাভাবে পানির সমস্যায় ভুগি। শহরে তো বটেই পল্লী অঞ্চলেও পানীয় জলের অভাব দেখা যাচ্ছে। দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলোতেও পানীয় জলের ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির অভাব রয়েছে। পরিচ্ছন্ন পানির অভাব তো বিশাল আকারে রয়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে বহু আলোচনা ও রাজনীতি হয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। ফলে রোগ বিস্তার হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই। দেশে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলেও হাসপাতালগুলোর গুণগত মান বাড়েনি।
আমাদের এ বিশাল জনগোষ্ঠীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা সহজ নয়। শিক্ষার অবস্থা একই রকমের। প্রাইভেট বিদ্যায়তনগুলোর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু এখানে শিক্ষালাভ ব্যয়বহুল। সব বিদ্যায়তনের শিক্ষার মান ভালো নয়। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে নৈরাশ্য বাড়ছে, অস্থিরতা বাড়ছে এবং এর ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। এ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো আর্থিক সংগতি আমাদের মতো দেশের নেই।
আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমাদের যানবাহন অপ্রচুর। আমাদের রাস্তাঘাট দ্রুত গাড়ি চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়। দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রচুর। বিশেষ করে দুই ঈদের সময় যাতায়াত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একটা বাড়তি সমস্যা হচ্ছে এই যে কার্য উপলক্ষে রাজধানীতে বাস করলেও কর্মস্থলের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সংযোগ গড়ে ওঠেনি। জলযানের অবস্থা প্রায় একই রকমের। রেল যোগাযোগ অবহেলিত হয়েছে বহুদিন ধরে।
লোকসংখ্যা বাড়ার ফলে গাছপালা কাটা হচ্ছে অনেক। অনেক গ্রামে ঝোপঝাড় উজাড় করে ফেলা হয়েছে। শহরগুলোও রক্ষা পায়নি। পুকুর ও বিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর পরিণতিতে নানাভাবে ভুগছে সমাজ।
ওজোন লেয়ার, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ইত্যাদি বহুল আলোচিত বিষয়গুলো গোটা পৃথিবীর পটভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ। এসবের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। কাজেই এসব সম্পর্কে কিছুটা জেনে রাখলে ভালো হয়।
জনসংখ্যার আধিক্যের জন্য কিছু মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এরাউজাল (অতি জাগরণ) এবং এর উল্টো উইথড্রল (প্রত্যাহার) সৃষ্টি হয়। উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষ উত্তেজিত হয় সহজেই। ভায়োলেন্স (হিংস্রতা) এর পরিণতি। বাংলাদেশে আজকাল অতি সহজেই মারামারি ও খুনোখুনি হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালেও এটি সহজেই চোখে পড়ে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে মানুষের অভাব হয় না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনেক মানুষ, আর অনেক মারামারি। আমরা আসল কারণের কথা বলি না। শুধু চোখের সামনে যাকে দেখি তাকেই দায়ী করি। রোগের উপসর্গ নিয়ে লম্ফঝম্প করি। রোগের কারণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অগভীর চিন্তাধারা মানসিক অস্থিরতার কারণেই ঘটে থাকে। দুই নেত্রীকে দোষারোপ আর তাঁদের একসঙ্গে বসার আহ্বান বুদ্ধিমানদের কাছে তো বহুদিন ধরে শুনেই আসছি। ফল কিছুই দেখছি না।
পালাক্রমে দুই বড় দলকে ক্ষমতায় এনেও আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। আল্ডুস হঙ্লি মনে করতেন, জনসংখ্যার আধিক্য গণতন্ত্রের জন্য আশঙ্কার কারণ। টমাস সোয়েল লিখেছেন, গণবিরোধী সরকার ও সরকারের ভ্রান্ত অর্থনীতি জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়।
মালথাসের তত্ত্বের বিরুদ্ধে, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা অনেক হয়েছে। ম্যালথাস ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। বলা হয়েছে, তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করেছেন। বলা হয়েছে, বিলেতের 'পুওর ল'র পরিবর্তনের জন্য তিনি দায়ী। এই পুওর ল' ১৩৪৯ সাল থেকে ছিল। প্রথমে স্বেচ্ছামূলক ছিল গরিব মানুষকে সাহায্য করা। পরে তা আইনিভাবে সরকারের দায়িত্ব হয়। ১৯৩৮ সালের পুওর ল অনুযায়ী সাহায্যদান অনেক সীমিত করে দেওয়া হয়। ম্যালথাস লিখেছিলেন, মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে তারা সন্তানের জন্ম দেয় বেশি। 'কর্ন ল' পরিবর্তনের জন্যও ম্যালথাসকে দায়ী মনে করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের ওপর থেকে কর তুলে নিলে খাদ্যের দাম কমে যাবে, এ আশঙ্কা দেখা দেয় বিলাতের ভূস্বামীদের মনে। বিলাতের সংসদে তখন ভূস্বামীদের প্রাধান্য। কর আরোপ করা হলো আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের ওপর কড়া পুলিশ প্রহরায়। কর আরোপ করা না হলে বণিকদের সুবিধা হতো। সময়টা ছিল সামন্তদের সঙ্গে বণিকদের ক্ষমতার লড়াইয়ের সময়। এ রকম সময়েই অ্যাডাম স্মিথ এবং তাঁর মুক্ত অর্থনীতির আবির্ভাব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশের এসব ঘটনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? আমাদের সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যের কথা আমরা শুনে থাকি। আর শুনে থাকি মনোনয়ন-বাণিজ্যের কথা। আর আমাদের মানসিকতায় সামন্তবাদের প্রাধান্য নিঃসন্দেহে শক্তভাবে বিরাজমান।
ম্যালথাসের সমালোচনা করার সময় বলা হয়, নব নব আবিষ্কারের কথা তাঁর জানা ছিল না। উন্নত কৃষি পদ্ধতি, উন্নত সার, উন্নত কীটনাশক আমাদের অবশ্যই সাহায্য করেছে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে আমাদের ভবিষ্যতে অবদান রাখতে হবে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, বিদেশ থেকে মাল-মসলা কিনে আনতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জনগণের মানসিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 'জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি'- এ জাতীয় ভাবালুতা অবাস্তব। ব্রাজিলের মতো ক্যাথলিক দেশে এখন মানুষ সফলভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ ক্যাথলিক দেশগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ ধর্মবিরোধী মনে করা হতো। আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে সন্তানের সংখ্যা অনেক কম। শিক্ষা মানুষের চিন্তাধারার আধুনিকীকরণে সাহায্য করে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যালথাসের সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন একটি বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে। ইউরোপের অসংখ্য মানুষ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে চলে না গেলে ইউরোপ জনসংখ্যার আধিক্যে ভুগত সন্দেহ নেই। কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য আমরা ভুলে যাই; কিন্তু পরে নতুন বাস্তবতায় সেগুলো আবার ফিরে আসে। নব্য-মালথাসবাদ এর একটি উদাহরণ।
বাংলাদেশের পটভূমিকায় ম্যালথাসবাদের অনেক কিছুই হয়তো সত্য নয়; কিন্তু অনেক কিছুই সত্য। জনসংখ্যা সমস্যা আমাদের একটি বিশাল সমস্যা। আমাদের রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় আমরা প্রাত্যহিকতা নিয়ে সদা ব্যস্ত। প্রতিদিনের নিত্যনতুন সমস্যা আমাদের গতকালের সমস্যা ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের বড় সমস্যার কথা আমাদের মনেই আসছে না। আসলে উত্তেজনা না থাকলে কোনো কিছুই আমাদের মনে প্রবেশ করে না। জনসংখ্যা যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থাদি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা ও ইতিবাচক মনোভাব। প্রয়োজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর। মনে রাখতে হবে, জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু বিশেষজ্ঞদের নয়। এ দায়িত্ব সবার।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টসের ফেলো
অর্থনীতির জনক হিসেবে ধরে নেওয়া হয় স্কটল্যান্ডের দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথকে। তাঁর লেখা 'ওয়েলথ অব দ্য নেশন'কে গণ্য করা হয় অর্থনীতির প্রথম বই হিসেবে। এ বই প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ সালে। এরপর রিকার্ডো ও জন স্টুয়ার্ট মিলের বই প্রকাশিত হয়। ম্যালথাসের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। অষ্টাদশ শতাব্দী পাশ্চাত্য জগতে অর্থনীতিশাস্ত্রের জন্ম শতাব্দী। কিন্তু কৌটিল্য বা চাণক্যের লেখা 'অর্থশাস্ত্র' প্রকাশিত হয়েছিল দুই হাজার বছরেরও আগে। ম্যালথাসের বইটি অভূতপূর্ব সাড়া জাগালেও এবং জনসংখ্যা প্রসঙ্গে তাঁর নাম বহুল আলোচিত হলেও জনসংখ্যা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে অনেক কাল আগে থেকেই। প্রায় দুই হাজার বছর আগে কার্থেজের অধিবাসী টার্টুলিয়ান পৃথিবীতে জনসংখ্যার আধিক্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তখন পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল ১৯ কোটি।
পৃথিবীর লোকসংখ্যা এখন প্রায় ৭০০ কোটি। এর মধ্যে ১৫ কোটি মানুষের বাস ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে। এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে খাদ্য। বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে অতীতে যেগুলো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। ১৯৭৪ সালেও দুর্ভিক্ষ হয়েছে। এখন খাদ্য পরিস্থিতি অনেক ভালো। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে আমরা। অতীতে খাদ্য আমদানিতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। ফলে উন্নয়নকাজ ব্যাহত হয়েছে। উন্নত কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, ল অব ডিমিনিশিং রিটার্নের কথা। উৎপাদন বৃদ্ধির একটা সীমা রয়েছে।
বন্যায় আমাদের পানির আধিক্য হলেও আমরা নানাভাবে পানির সমস্যায় ভুগি। শহরে তো বটেই পল্লী অঞ্চলেও পানীয় জলের অভাব দেখা যাচ্ছে। দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলোতেও পানীয় জলের ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির অভাব রয়েছে। পরিচ্ছন্ন পানির অভাব তো বিশাল আকারে রয়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে বহু আলোচনা ও রাজনীতি হয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। ফলে রোগ বিস্তার হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই। দেশে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলেও হাসপাতালগুলোর গুণগত মান বাড়েনি।
আমাদের এ বিশাল জনগোষ্ঠীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা সহজ নয়। শিক্ষার অবস্থা একই রকমের। প্রাইভেট বিদ্যায়তনগুলোর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু এখানে শিক্ষালাভ ব্যয়বহুল। সব বিদ্যায়তনের শিক্ষার মান ভালো নয়। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে নৈরাশ্য বাড়ছে, অস্থিরতা বাড়ছে এবং এর ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। এ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো আর্থিক সংগতি আমাদের মতো দেশের নেই।
আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমাদের যানবাহন অপ্রচুর। আমাদের রাস্তাঘাট দ্রুত গাড়ি চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়। দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রচুর। বিশেষ করে দুই ঈদের সময় যাতায়াত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একটা বাড়তি সমস্যা হচ্ছে এই যে কার্য উপলক্ষে রাজধানীতে বাস করলেও কর্মস্থলের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সংযোগ গড়ে ওঠেনি। জলযানের অবস্থা প্রায় একই রকমের। রেল যোগাযোগ অবহেলিত হয়েছে বহুদিন ধরে।
লোকসংখ্যা বাড়ার ফলে গাছপালা কাটা হচ্ছে অনেক। অনেক গ্রামে ঝোপঝাড় উজাড় করে ফেলা হয়েছে। শহরগুলোও রক্ষা পায়নি। পুকুর ও বিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর পরিণতিতে নানাভাবে ভুগছে সমাজ।
ওজোন লেয়ার, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ইত্যাদি বহুল আলোচিত বিষয়গুলো গোটা পৃথিবীর পটভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ। এসবের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। কাজেই এসব সম্পর্কে কিছুটা জেনে রাখলে ভালো হয়।
জনসংখ্যার আধিক্যের জন্য কিছু মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এরাউজাল (অতি জাগরণ) এবং এর উল্টো উইথড্রল (প্রত্যাহার) সৃষ্টি হয়। উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষ উত্তেজিত হয় সহজেই। ভায়োলেন্স (হিংস্রতা) এর পরিণতি। বাংলাদেশে আজকাল অতি সহজেই মারামারি ও খুনোখুনি হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালেও এটি সহজেই চোখে পড়ে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে মানুষের অভাব হয় না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনেক মানুষ, আর অনেক মারামারি। আমরা আসল কারণের কথা বলি না। শুধু চোখের সামনে যাকে দেখি তাকেই দায়ী করি। রোগের উপসর্গ নিয়ে লম্ফঝম্প করি। রোগের কারণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অগভীর চিন্তাধারা মানসিক অস্থিরতার কারণেই ঘটে থাকে। দুই নেত্রীকে দোষারোপ আর তাঁদের একসঙ্গে বসার আহ্বান বুদ্ধিমানদের কাছে তো বহুদিন ধরে শুনেই আসছি। ফল কিছুই দেখছি না।
পালাক্রমে দুই বড় দলকে ক্ষমতায় এনেও আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। আল্ডুস হঙ্লি মনে করতেন, জনসংখ্যার আধিক্য গণতন্ত্রের জন্য আশঙ্কার কারণ। টমাস সোয়েল লিখেছেন, গণবিরোধী সরকার ও সরকারের ভ্রান্ত অর্থনীতি জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়।
মালথাসের তত্ত্বের বিরুদ্ধে, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা অনেক হয়েছে। ম্যালথাস ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। বলা হয়েছে, তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করেছেন। বলা হয়েছে, বিলেতের 'পুওর ল'র পরিবর্তনের জন্য তিনি দায়ী। এই পুওর ল' ১৩৪৯ সাল থেকে ছিল। প্রথমে স্বেচ্ছামূলক ছিল গরিব মানুষকে সাহায্য করা। পরে তা আইনিভাবে সরকারের দায়িত্ব হয়। ১৯৩৮ সালের পুওর ল অনুযায়ী সাহায্যদান অনেক সীমিত করে দেওয়া হয়। ম্যালথাস লিখেছিলেন, মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হলে তারা সন্তানের জন্ম দেয় বেশি। 'কর্ন ল' পরিবর্তনের জন্যও ম্যালথাসকে দায়ী মনে করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের ওপর থেকে কর তুলে নিলে খাদ্যের দাম কমে যাবে, এ আশঙ্কা দেখা দেয় বিলাতের ভূস্বামীদের মনে। বিলাতের সংসদে তখন ভূস্বামীদের প্রাধান্য। কর আরোপ করা হলো আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের ওপর কড়া পুলিশ প্রহরায়। কর আরোপ করা না হলে বণিকদের সুবিধা হতো। সময়টা ছিল সামন্তদের সঙ্গে বণিকদের ক্ষমতার লড়াইয়ের সময়। এ রকম সময়েই অ্যাডাম স্মিথ এবং তাঁর মুক্ত অর্থনীতির আবির্ভাব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশের এসব ঘটনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? আমাদের সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যের কথা আমরা শুনে থাকি। আর শুনে থাকি মনোনয়ন-বাণিজ্যের কথা। আর আমাদের মানসিকতায় সামন্তবাদের প্রাধান্য নিঃসন্দেহে শক্তভাবে বিরাজমান।
ম্যালথাসের সমালোচনা করার সময় বলা হয়, নব নব আবিষ্কারের কথা তাঁর জানা ছিল না। উন্নত কৃষি পদ্ধতি, উন্নত সার, উন্নত কীটনাশক আমাদের অবশ্যই সাহায্য করেছে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে আমাদের ভবিষ্যতে অবদান রাখতে হবে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, বিদেশ থেকে মাল-মসলা কিনে আনতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জনগণের মানসিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 'জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি'- এ জাতীয় ভাবালুতা অবাস্তব। ব্রাজিলের মতো ক্যাথলিক দেশে এখন মানুষ সফলভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ ক্যাথলিক দেশগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ ধর্মবিরোধী মনে করা হতো। আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে সন্তানের সংখ্যা অনেক কম। শিক্ষা মানুষের চিন্তাধারার আধুনিকীকরণে সাহায্য করে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যালথাসের সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন একটি বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে। ইউরোপের অসংখ্য মানুষ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে চলে না গেলে ইউরোপ জনসংখ্যার আধিক্যে ভুগত সন্দেহ নেই। কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য আমরা ভুলে যাই; কিন্তু পরে নতুন বাস্তবতায় সেগুলো আবার ফিরে আসে। নব্য-মালথাসবাদ এর একটি উদাহরণ।
বাংলাদেশের পটভূমিকায় ম্যালথাসবাদের অনেক কিছুই হয়তো সত্য নয়; কিন্তু অনেক কিছুই সত্য। জনসংখ্যা সমস্যা আমাদের একটি বিশাল সমস্যা। আমাদের রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় আমরা প্রাত্যহিকতা নিয়ে সদা ব্যস্ত। প্রতিদিনের নিত্যনতুন সমস্যা আমাদের গতকালের সমস্যা ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের বড় সমস্যার কথা আমাদের মনেই আসছে না। আসলে উত্তেজনা না থাকলে কোনো কিছুই আমাদের মনে প্রবেশ করে না। জনসংখ্যা যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থাদি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা ও ইতিবাচক মনোভাব। প্রয়োজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর। মনে রাখতে হবে, জন্মনিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু বিশেষজ্ঞদের নয়। এ দায়িত্ব সবার।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টসের ফেলো
দারুন লেগেছে লেখা
ReplyDelete