রাজনীতি-ঘুরে দাঁড়ানোর এখনও সময় আছে by আনিসুজ্জামান মানিক

বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিকাল্ট করেছিলেন। রাজনীতিবিদরা বলছেন, রাজনীতি তাদের হাতে নেই। রাজনীতিবিদদের এই সরল স্বীকারোক্তির বাস্তব ভিত্তি রয়েছে।
নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সীমাহীন উদাসীনতা রাজনীতিকে বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠন গড়ে না তুলে সহজ পথে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতিতে অর্থ লগি্নকারীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে রাজনীতিতে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলদার, লুণ্ঠনকারী, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর অধিপত্য করতে সহজ হয়।
রাজনীতিতে সব সময়ই ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ছিল। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সখ্যের ইতিহাস পুরনো। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার এবং নির্বাচনের খরচের জন্য কখনও কখনও বিত্তবানদের ওপর নির্ভর করতেন অত্যন্ত গোপনে। স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনের ব্যয় বেড়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যয় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগানদাতা ব্যবসায়ী শ্রেণী। এই শ্রেণী এখন গোপনে অর্থের জোগান দেয় না, তারা নিজেরাই রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়েছেন। রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছেন আর রাজনীতিবিদরা ব্যবসায়ী। বর্তমানে অধিকাংশ রাজনীতিবিদের নামে-বেনামে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদ ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত। এটা না থাকলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে রাজনীতিবিদদের গরিবি হালে জীবনযাপন করাও কঠিন হবে। দেশে এখনও অল্প কিছু রাজনীতিবিদ রয়েছেন, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তাদের চাল-চলন দেখলেই তা বোঝা যায়। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের এই রাজনীতিবিদরা যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু রাজনীতিতে বিনিয়োগকারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে তারা কখনও কখনও রাজনৈতিক মঞ্চের আড়ালে চলে যান। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এজন্য অনেকাংশে দায়ী। একদিকে সীমাহীন দারিদ্র্য, অন্যদিকে দীর্ঘ সামরিক শাসনের ফলে সামাজিক অবক্ষয় স্থায়ী ক্ষত হয়ে আকার বাড়ছে। এই ক্ষত সারাতে হলে দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার প্রয়োজন। সুস্থ ধারার রাজনীতি ছাড়া এই ক্ষতের স্থায়ী সমাধান হবে না।
ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে_ এই সরল স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা এবং অযোগ্যতা-অদক্ষতা ঢেকে রাখা যাবে না। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর রাজনীতিকে রাজনীতিবিদের হাতে ফেরত দেওয়া সম্ভব ছিল। এ কাজ একক কোনো দলের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এক দল যদি ব্যবসায়ীদের দলে টেনে নেয়, অন্য দল এ পথে আসবেই এবং নব্বই-পরবর্তী সময়ে তা-ই হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসেছেন। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছেন। ব্যবসায়ীরা দেশের উন্নয়নেও অবদান রাখছেন। তারা দেশের মানুষের শত্রু নন। অসৎ ব্যবসায়ীদের কথা মাঝেমধ্যে উচ্চারিত হয়। সব পেশা-শ্রেণীর মধ্যেই সৎ-অসৎ রয়েছে। অসৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। অসৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার কখনও কখনও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য ব্যবসায়ীদের দায়ী করে। ব্যবসায়ী শ্রেণী যেন নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু অসৎ ব্যবসায়ী কেন, যে কোনো অসৎ কাজ নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের। সবই সত্য, কিন্তু অসৎ ব্যবসায়ীরা সরকার নিয়ন্ত্রণ করলে তাদের কে নিয়ন্ত্রণ করবে?
দারিদ্র্য স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধে নিলে রাজনীতি রাজনীতিবিদের হাতে কখনোই ফিরে আসবে না। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। অর্থনৈতিক দারিদ্র্য ছাড়াও রয়েছে চিত্তের বৈকল্য। হুকুম দিয়ে, হুইসেল দিয়ে অথবা পতিত ভুঁইফোড় দুর্বল চিত্তের কোনো একক ব্যক্তিকে দলের স্বপদে কিংবা আরও বড় পদে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েও রাজনৈতিকে রাজনীতিবিদের হাতে ফেরত পাঠানো যাবে না। যারা এই মত পোষণ করেন তারা রাজনীতিকে এখনও 'ডিফিকাল্ট' করার পক্ষেই রায় দেন। দারিদ্র্য নির্মূল করতে হলে মানুষকে জাগাতে হবে। হুকুম পালন করার মানুষ দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়।
মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চায়। ঘুরে দাঁড়ানো মানুষের স্বভাব। সমাজে-রাষ্ট্রে অন্ধকার স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে পারে না। আলো আসে। এ দেশের মানুষ কখনও সামরিক-স্বৈরশাসন মেনে নেয়নি। নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। মানুষ আলোর দিকে ধাবমান। আমরা স্বৈরশাসন তাড়িয়েছি। নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচিত সরকার হলেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় না।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিনবদলের অঙ্গীকার দেশের মানুষ গ্রহণ করেছিল। তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম শূন্যের ঘর দুই বছরে একটুও অতিক্রম করেনি। দল এবং সরকার এক হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং দলীয় প্রধানের অফিসের মধ্যে পার্থক্য টানা মুশকিল। দলের সেক্রেটারি গত দুই বছরে দলীয় অফিসে গেছেন কতবার? একটি আধুনিক দলের সেক্রেটারির প্রতিনিয়ত জেলা, উপজেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে সফর করার কথা। দলীয় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলকে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের সে প্রস্তুতি কোথায়? দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের সময় কাজ করে। মাঠপর্যায়ের এই ত্যাগী, আদর্শবাদী কর্মীদের সংগঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগ কোনো কাজই করেনি। আওয়ামী লীগের কথা বলছি এই কারণে যে, আর কোনো দলের পক্ষে এটা এ মুহূর্তে করা সম্ভব নয়। বিএনপি শত মত-পথে বিভক্ত। তা ছাড়া জনশক্তির ওপর তারা নির্ভর করে না। বিএনপি চেয়ারপারসন সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারেননি। কাজেই দেশের মানুষ এখনও নির্ভর করে আওয়ামী লীগ প্রধানের ওপর। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ চলি্লশ টাকা সের চাল খেয়ে আর কতদিন আশায় বুক বেঁধে থাকবে?
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর থেকে এখনও পর্যন্ত দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ প্রধানের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। একক ব্যক্তি হিসেবে এরকম গ্রহণযোগ্যতা দেশে আর কোনো রাজনীতিবিদের নেই। এই জনপ্রিয়তাকে অবলম্বন করে আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা তিনি রাখেন। গত দুই বছরের শাসনকালে মন্ত্রিপরিষদের অযোগ্যতার কথা সমস্বরে উচ্চারিত হলেও কোনো মন্ত্রী দুর্নীতিগ্রস্ত এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু দলের সাংগঠনিক কাজ হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী এবং দলের প্রধান হয়ে যখন তিনি কাজ করেন তখন পার্থক্য করা কঠিন হয় কোনটি সরকারের কাজ আর কোনটি আওয়ামী লীগের। দলের কাজ সরকারের কাজের চেয়ে আলাদা।
বাংলাদেশকে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং দারিদ্র্য ও জঙ্গিমুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধানের যোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যোগ্যতা নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে না। আগামী দিনেই দেশ নিরাপদ হবে না। এ দেশের মানুষের সামনে বারবার সুযোগ এসেছে। নব্বইয়ের পর এখন সুযোগ। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এবার সুযোগ হাতছাড়া হলে আগামী দিনে এ জাতির সামনে গভীর অন্ধকার অপেক্ষা করছে।
পৌর নির্বাচনের ফল আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা আভাস দিয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা এই বলে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন যে, জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন এক নয়, কিন্তু এটা তো সত্য যে একই মানুষ ভোট দেবে। জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের পাঁচ বছর দেশে জঙ্গিকরণ হয়েছে, সারাদেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে একই সঙ্গে বোমা বিস্টেম্ফারিত হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগের সব নেতাকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। আদালতে বোমা পড়েছে। বিচারককে হত্যা করা হয়েছে। দেশের অস্তিত্ব নিয়েই সংকট দেখা দিয়েছিল।
রাস্তা দিয়ে চলতে ফিরতে অনেক কথা শোনা যায়, অনেক কিছু দেখা যায়। কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরে আসার পথে দুই পথচারীর কথা কানে আসে। একজন আরেকজনকে বলছে_ 'এখন ওরা চুলকাচ্ছে। সময়-সুযোগ হলে খাম (রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় খাম মানে জখম) করে দিব।' সরকারের তিন বছর বাকি রয়েছে। অর্থাৎ তিন বছর পরেই 'খাম' করার সযোগ আসবে। 'খাম' হবে দেশের মানুষ। মানুষ বিচ্ছিন্ন থাকলে ক্ষতি বেশি হবে। সংগঠিত মানুষের ওপর অপশক্তির আক্রমণ হয় না। বিচ্ছিন্ন মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষমতা রাখেন আওয়ামী লীগ প্রধান। দেশের মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্বও তার। কিন্তু তিনি যে সে দায়িত্ব পালনে সক্রিয় এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। দল এবং সরকারকে এক করে তিনি দেশের মানুষকে আগামী দিনে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ পরিবর্তন চায়। উন্নতি চায়। নিরাপদে থাকতে চায়। শ্বাপদেরা ফণা তুলবে। ভয় পওয়ার কিছু নেই। সংগঠিত মানুষ ভয় পায় না। মানুষকে সংগঠিত করুন। এই সংগঠিত মানুষ নিজেকে বদলাবে, অন্যকে বদলাবে। আওয়ামী লীগ প্রধানের উচ্চতা আরও বাড়বে। বিশ্বে তিনি নন্দিত হবেন। বাঙালির হৃদয়ে তার আসন স্থায়ী হবে।

আনিসুজ্জামান মানিক : শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
manik780@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.