সমকালীন প্রসঙ্গ-সংবিধান সংশোধন প্রচেষ্টা ও শাসক শ্রেণীর শাসন সংকট by বদরুদ্দীন উমর
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির করুণ অবস্থা নিয়ে কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য ও গ্রাহ্য বিতর্ক নেই। রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক আচরণ থেকে অবিচ্ছেদ্য। রাজনৈতিক আচরণের মধ্যেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে।
শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণভাবেও আচরণগত সংস্কৃতির (নবযধারড়ঁৎধষ পঁষঃঁৎব) মধ্যেই যে কোনো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির আসল পরিচয় পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে সামাজিক সম্পর্ক, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে ধরনের সব সমস্যা ও সংকটের দেখা পাওয়া যায়, সেগুলোর সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক যে কত গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য এ ধারণা কম লোকেরই আছে। এই সম্পর্ক শুধু গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য বললেই সবটুকু বলা হয় না। প্রকৃতপক্ষে অন্য সব ক্ষেত্রও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ও শাসিত হয়।
একটি সমাজে মানবিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, রাজনীতি সংস্কৃতি সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এদের কোনোটিকেই অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা বা বিচার করা চলে না। কাজেই সংস্কৃতি কোনো স্বাধীন বর্গ (পধঃবমড়ৎু) নয়। সংস্কৃতির গঠনে মানুষের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রভাবই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নতুন সুযোগ-সুবিধার কাঠামোর মধ্যে একেবারে গ্রাম থেকেই নিম্ন সাংস্কৃতিক চেতনা ও আচরণগত সংস্কৃতি শাসক শ্রেণীভুক্ত, বিশেষত শাসক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত, লোকদের অর্থনৈতিক আচরণ নৈরাজ্যিকভাবে গড়ে তোলে। আবার এই নৈরাজ্যিক অর্থনৈতিক আচরণ তাদের সংস্কৃতির মধ্যে সৃষ্টি করে অনেক নতুন বিকৃতি। এই জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে শুধু যে শাসক শ্রেণীর জীবনই পরিচালিত হচ্ছে তাই নয়, তারা শক্তিশালী অবস্থানে থেকে সমগ্র সমাজকেই প্রভাবিত করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে আচরণ দেখা যায়, তার স্বরূপ এই পরিপ্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে বোঝা যাবে না। এদের আচরণ পরস্পরের প্রতি এত বিদ্বেষপূর্ণ যা এদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের দিক থেকেও ক্ষতিকর। একটি শোষণমূলক পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থাতেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার সম্পর্ক ও সুযোগ না থাকে তাহলে তার পরিণতিতে তাদের শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। শুধু তাই নয়, সে পরিস্থিতিতে শাসনব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হয় যা ডালে বসে সেই ডাল কাটার মতোই দাঁড়ায়।
পার্শ্ববর্তী ভারতের মতো দেশেও সরকারি-বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অনেক শত্রুতা ও তিক্ততা থাকলেও তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন নয়, যাতে তারা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে না, পরস্পরের সঙ্গে তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, মৌলিক শ্রেণীস্বার্থে, তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রয়োজনমতো বসে এবং আলাপ-আলোচনা করে। এ ধরনের বসাবসি ও আলাপ-আলোচনা উন্নত পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে আরও বেশি দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস ইত্যাদি শাসকশ্রেণীর সংস্কৃতির মধ্যে এমন বিকৃতি সৃষ্টি করেছে, যার ফলে তাদের কাছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দলীয় স্বার্থ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এসব স্বার্থ রক্ষা করতে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের বৃহত্তর শ্রেণীস্বার্থের ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করে না। এর অর্থ এই নয় যে, এর মাধ্যমে তারা নিজেদের শোষণ স্বার্থ বাদ দিয়ে শোষিত জনগণের খেদমত করছে। মোটেই তা নয়। এর অর্থ হলো, তারা নিজেদের শ্রেণী শাসনের মধ্যে এমন সংকট সৃষ্টি করছে যাতে তাদের নিজেদের অবস্থা নাজেহাল হচ্ছে। এর পরিণতিতে শোষিত এবং উপেক্ষিত জনগণের কোনো লাভ তো হচ্ছেই না, উপরন্তু শাসনব্যবস্থা অধিকতর নৈরাজ্যিক হতে থাকার কারণে তাদের দুরবস্থা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কোনো সম্পর্ক না রেখে, পরস্পরকে বয়কট করে দেশ শাসন করার পরিণতিতে সর্বক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তার এই মুহূর্তের একটা দৃষ্টান্ত হলো, সংবিধান নিয়ে তাদের নিজ নিজ অবস্থান। প্রথমেই বলা দরকার, সংবিধান নিয়ে এখন শাসক শ্রেণীর মধ্যে যে চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণ এই সংবিধানের বিশেষ কোনো প্রাসঙ্গিকতা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই। একে কার্যকর করার জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চলছে সরকারি দলের পক্ষ থেকে এবং এটা চলছে প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে। বিরোধী দলও সাংবিধানিক এই সংকটের আসল চরিত্র উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার কারণে এ নিয়ে তাদের কোনো ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা নেই। বাস্তব ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বিদ্যমান সংবিধান বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এতই অপ্রাসঙ্গিক এবং অকার্যকর হয়েছে, একে সংশোধনীর মাধ্যমে মেরামত করে কাজ চালানোর মতো অবস্থা আর নেই। শাসক শ্রেণী সুষ্ঠুভাবে বাংলাদেশের শাসন কাজ পরিচালনা করতে অক্ষম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ এই সংবিধানের অকার্যকারিতা। এটা বোঝার ক্ষমতা সরকারি ও বিরোধী দলের কারও নেই। সেটা থাকলে তারা তাদের শ্রেণী শাসনের এই সংকট দূর করার জন্য পরস্পরের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে আন্তরিক হতো তাদের পারস্পরিক শত্রুতা সত্ত্বেও।
আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য কতকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে এবং একটি সংসদীয় কমিটির ওপর এ কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা মুখে বলছে যে, তারা এ ব্যাপারে বিরোধী দলের সহযোগিতা চায়। কিন্তু বাইরে এ কথা বললেও তারা এমন সব কাজ করছে যাতে এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিরোধী দল কোনো আলোচনায় বসতে সম্মত হচ্ছে না। বিরোধী দলেরও এমন কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই যার ফলে তারা নিজেদের উদ্যোগে সংবিধান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সামগ্রিকভাবে নিজেদের শ্রেণীগত মিত্রদের নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনায় বসতে পারে।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমেই বর্তমান সাংবিধানিক সংকট শাসক শ্রেণীর দ্বারা অতিক্রম করা সম্ভব। কিন্তু এ কাজ করার জন্য যে স্পষ্ট অবস্থান এবং উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন সেটা শাসক শ্রেণীর কোনো অংশের দ্বারাই সম্ভব বলে মনে হয় না। কাজেই এই সংকট তাদের চলবে এবং দেশের পরিস্থিতি ক্রমাগত আরও খারাপ হতে থাকবে।
এই পরিস্থিতিতে এ দেশের গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তিগুলোর জন্যও প্রয়োজন হয়েছে নতুন এক সংবিধানের জন্য সংগ্রাম করা। ১৯৭২ সালের সংবিধান যেমন নব্য শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, তেমনি তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তসহ এ দেশের শ্রমজীবী জনগণের কোনো অংশের স্বার্থের। এ বিষয়টি এখন আর অস্পষ্ট নেই। এ কারণে শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ যেমন তাদের নিজেদের মতো করে সংবিধান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে, তেমনি যারা গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তি হিসেবে এ দেশের এক মৌলিক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন চায় তারাও এখন চিন্তাভাবনা করছে এক নতুন সংবিধানের।
সংবিধান নিয়ে আলাপ-আলোচনার ও বিতর্কের অবতারণা শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ শেষ পর্যন্ত নিজেরাই শুরু করেছে। কিন্তু তাদের এ চেষ্টার মধ্যে শাসক শ্রেণীর গভীর শাসন সংকটেরই যে প্রতিফলন ঘটছে এ ধারণা তাদের একেবারেই নেই।
২৫.৪.২০১১
বাংলাদেশে সামাজিক সম্পর্ক, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে ধরনের সব সমস্যা ও সংকটের দেখা পাওয়া যায়, সেগুলোর সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক যে কত গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য এ ধারণা কম লোকেরই আছে। এই সম্পর্ক শুধু গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য বললেই সবটুকু বলা হয় না। প্রকৃতপক্ষে অন্য সব ক্ষেত্রও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ও শাসিত হয়।
একটি সমাজে মানবিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, রাজনীতি সংস্কৃতি সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এদের কোনোটিকেই অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা বা বিচার করা চলে না। কাজেই সংস্কৃতি কোনো স্বাধীন বর্গ (পধঃবমড়ৎু) নয়। সংস্কৃতির গঠনে মানুষের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রভাবই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নতুন সুযোগ-সুবিধার কাঠামোর মধ্যে একেবারে গ্রাম থেকেই নিম্ন সাংস্কৃতিক চেতনা ও আচরণগত সংস্কৃতি শাসক শ্রেণীভুক্ত, বিশেষত শাসক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত, লোকদের অর্থনৈতিক আচরণ নৈরাজ্যিকভাবে গড়ে তোলে। আবার এই নৈরাজ্যিক অর্থনৈতিক আচরণ তাদের সংস্কৃতির মধ্যে সৃষ্টি করে অনেক নতুন বিকৃতি। এই জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে শুধু যে শাসক শ্রেণীর জীবনই পরিচালিত হচ্ছে তাই নয়, তারা শক্তিশালী অবস্থানে থেকে সমগ্র সমাজকেই প্রভাবিত করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে আচরণ দেখা যায়, তার স্বরূপ এই পরিপ্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে বোঝা যাবে না। এদের আচরণ পরস্পরের প্রতি এত বিদ্বেষপূর্ণ যা এদের নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের দিক থেকেও ক্ষতিকর। একটি শোষণমূলক পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থাতেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার সম্পর্ক ও সুযোগ না থাকে তাহলে তার পরিণতিতে তাদের শাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। শুধু তাই নয়, সে পরিস্থিতিতে শাসনব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হয় যা ডালে বসে সেই ডাল কাটার মতোই দাঁড়ায়।
পার্শ্ববর্তী ভারতের মতো দেশেও সরকারি-বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অনেক শত্রুতা ও তিক্ততা থাকলেও তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন নয়, যাতে তারা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে না, পরস্পরের সঙ্গে তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, মৌলিক শ্রেণীস্বার্থে, তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রয়োজনমতো বসে এবং আলাপ-আলোচনা করে। এ ধরনের বসাবসি ও আলাপ-আলোচনা উন্নত পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে আরও বেশি দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা, সন্ত্রাস ইত্যাদি শাসকশ্রেণীর সংস্কৃতির মধ্যে এমন বিকৃতি সৃষ্টি করেছে, যার ফলে তাদের কাছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দলীয় স্বার্থ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এসব স্বার্থ রক্ষা করতে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের বৃহত্তর শ্রেণীস্বার্থের ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করে না। এর অর্থ এই নয় যে, এর মাধ্যমে তারা নিজেদের শোষণ স্বার্থ বাদ দিয়ে শোষিত জনগণের খেদমত করছে। মোটেই তা নয়। এর অর্থ হলো, তারা নিজেদের শ্রেণী শাসনের মধ্যে এমন সংকট সৃষ্টি করছে যাতে তাদের নিজেদের অবস্থা নাজেহাল হচ্ছে। এর পরিণতিতে শোষিত এবং উপেক্ষিত জনগণের কোনো লাভ তো হচ্ছেই না, উপরন্তু শাসনব্যবস্থা অধিকতর নৈরাজ্যিক হতে থাকার কারণে তাদের দুরবস্থা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কোনো সম্পর্ক না রেখে, পরস্পরকে বয়কট করে দেশ শাসন করার পরিণতিতে সর্বক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তার এই মুহূর্তের একটা দৃষ্টান্ত হলো, সংবিধান নিয়ে তাদের নিজ নিজ অবস্থান। প্রথমেই বলা দরকার, সংবিধান নিয়ে এখন শাসক শ্রেণীর মধ্যে যে চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণ এই সংবিধানের বিশেষ কোনো প্রাসঙ্গিকতা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই। একে কার্যকর করার জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চলছে সরকারি দলের পক্ষ থেকে এবং এটা চলছে প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে। বিরোধী দলও সাংবিধানিক এই সংকটের আসল চরিত্র উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার কারণে এ নিয়ে তাদের কোনো ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা নেই। বাস্তব ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বিদ্যমান সংবিধান বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এতই অপ্রাসঙ্গিক এবং অকার্যকর হয়েছে, একে সংশোধনীর মাধ্যমে মেরামত করে কাজ চালানোর মতো অবস্থা আর নেই। শাসক শ্রেণী সুষ্ঠুভাবে বাংলাদেশের শাসন কাজ পরিচালনা করতে অক্ষম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ এই সংবিধানের অকার্যকারিতা। এটা বোঝার ক্ষমতা সরকারি ও বিরোধী দলের কারও নেই। সেটা থাকলে তারা তাদের শ্রেণী শাসনের এই সংকট দূর করার জন্য পরস্পরের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে প্রকৃতপক্ষে আন্তরিক হতো তাদের পারস্পরিক শত্রুতা সত্ত্বেও।
আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য কতকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে এবং একটি সংসদীয় কমিটির ওপর এ কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা মুখে বলছে যে, তারা এ ব্যাপারে বিরোধী দলের সহযোগিতা চায়। কিন্তু বাইরে এ কথা বললেও তারা এমন সব কাজ করছে যাতে এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিরোধী দল কোনো আলোচনায় বসতে সম্মত হচ্ছে না। বিরোধী দলেরও এমন কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নেই যার ফলে তারা নিজেদের উদ্যোগে সংবিধান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সামগ্রিকভাবে নিজেদের শ্রেণীগত মিত্রদের নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনায় বসতে পারে।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমেই বর্তমান সাংবিধানিক সংকট শাসক শ্রেণীর দ্বারা অতিক্রম করা সম্ভব। কিন্তু এ কাজ করার জন্য যে স্পষ্ট অবস্থান এবং উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন সেটা শাসক শ্রেণীর কোনো অংশের দ্বারাই সম্ভব বলে মনে হয় না। কাজেই এই সংকট তাদের চলবে এবং দেশের পরিস্থিতি ক্রমাগত আরও খারাপ হতে থাকবে।
এই পরিস্থিতিতে এ দেশের গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তিগুলোর জন্যও প্রয়োজন হয়েছে নতুন এক সংবিধানের জন্য সংগ্রাম করা। ১৯৭২ সালের সংবিধান যেমন নব্য শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, তেমনি তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তসহ এ দেশের শ্রমজীবী জনগণের কোনো অংশের স্বার্থের। এ বিষয়টি এখন আর অস্পষ্ট নেই। এ কারণে শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ যেমন তাদের নিজেদের মতো করে সংবিধান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে, তেমনি যারা গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তি হিসেবে এ দেশের এক মৌলিক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন চায় তারাও এখন চিন্তাভাবনা করছে এক নতুন সংবিধানের।
সংবিধান নিয়ে আলাপ-আলোচনার ও বিতর্কের অবতারণা শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ শেষ পর্যন্ত নিজেরাই শুরু করেছে। কিন্তু তাদের এ চেষ্টার মধ্যে শাসক শ্রেণীর গভীর শাসন সংকটেরই যে প্রতিফলন ঘটছে এ ধারণা তাদের একেবারেই নেই।
২৫.৪.২০১১
No comments