'হানজাবিরা লই গেছে' by মোফাজ্জল করিম
একাত্তরে দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন ঘরে ঘরে শুধু হাহাকার : এমন কোনো পরিবার নেই, যারা স্বজন হারায়নি। কত মায়ের বুক যে খালি হয়েছে, কত ঘরবাড়ি জ্বলেপুড়ে হয়েছে ছাই। চারদিকে শুধু ক্রন্দন আর ক্রন্দন। এরই ভেতর কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে পড়ে চাঁদাবাজি, লুটপাট ও দখলবাজিতে।
তখন স্বভাবতই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজুক। একে তো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যুদ্ধের কারণে যার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, তার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথোপযুক্তভাবে সংগঠিত না হওয়ার কারণে নানা রঙের, নানা লেবেলের লুটেরা বাহিনী অবাধে লুটপাট চালাতে তৎপর হয়ে ওঠে। আজ ৪০ বছর পর যেখানে বলা হচ্ছে, সব মানুষের 'বেডরুমে' (সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অপর একটি মন্তব্যে বাড়ির অন্যান্য ঘরও এসে গেছে 'ঘরে ঘরে' কথাটি উচ্চারণের মাধ্যমে) তো আর পাহারা বসানো যাবে না, সেখানে বাহাত্তর সালে অতিশয় ক্ষীণকায় দুর্বল সিং নিধিরাম সর্দার পুলিশ দিয়ে দুর্বৃত্ত দমন ছিল রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। ফলে সাধারণ মানুষ পেল স্বাধীনতা নামক একটি অস্পষ্ট, বিমূর্ত ধারণা, আর অসাধারণ শক্তিশালী কিছু লুটেরা পেয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধলব্ধ স্বাধীনতার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত একটি অবাধ অধিকার। কিসের? জমি-জিরাত, দালানকোঠা, ব্যাংক, কারখানা থেকে শুরু করে টাকা-পয়সা-গয়নাগাটি-ঘটিবাটি ইত্যাদি তাবৎ পরস্ব বাগাবার নারকীয় অধিকার। এরা রাতারাতি কেবল বাহুবলে অথবা কানেকশনবলে মালিক বনে গেল গাড়ি-বাড়ি-গয়না-শাড়ির।
ওই সময়ের একটা গল্প শুনেছিলাম আমার এককালের 'বস্', পুলিশের অত্যন্ত স্বনামধন্য অফিসার মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান (মরহুম)-এর কাছে। পুলিশের অনেক যোগ্য, স্পষ্টবাদী ও সৎ অফিসার আছেন, যাঁদের নাম চিরকাল শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়ে থাকে। হাবীবুর রহমান সাহেব ছিলেন তাঁদেরই একজন। ১৯৮০-র দশকে তৎকালীন সরকারের 'কৃপায়' তিনি ও আমি আমাদের নিজস্ব বৃত্তের বাইরে নির্বাসিত হই বাংলাদেশ জুট মিলস্ করপোরেশন-এ। আমার অবস্থা যেমন-তেমন, তাঁর কিন্তু তখন জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা, সততা ইত্যাদি বিচারে আইজি অব পুলিশ হওয়ার কথা। অবশ্য পরে, হয়তো চক্ষুলজ্জার কারণে, তাঁকে আইজি করা হয় মাত্র এক ঘণ্টার জন্য। হ্যাঁ, এক ঘণ্টার জন্য। যোগদানপত্র স্বাক্ষরের পর আবার পুনর্মূষিকো ভব... ব্যাক টু বিজেএমসি অ্যাজ চেয়ারম্যান। আমি তখন ওই সংস্থার ডাইরেক্টর মার্কেটিং।
হাবীবুর রহমান সাহেব একদিন 'হানজিবারা লই গেছে' শিরোনামের একটা গল্প শোনালেন। স্বাধীনতার পর তখন তিনি ছিলেন বৃহত্তর ঢাকা জেলার সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (এসপি)। বাড়িঘর-সয়-সম্পত্তি লুটপাট, জবরদখল, উৎখাত- এসব ছিল ওই সময়ের নিত্যদিনের ঘটনা। তা এমনি এক বাড়ি জবরদখলের ব্যাপারে তাঁকে বলা হয়েছিল তদন্ত করতে। দখলকারী এলাকার এক জবরদস্ত মাস্তান। কোনো এক নেতার পেয়ারা বান্দা। স্বাধীনতার আগে ছিল জিরো, এখন হিরো। দখলকারীকে তিনি তার কাগজপত্র সাক্ষীসাবুদসহ ডেকে পাঠালেন অফিসে।
লোকটার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, সে ওই বাড়িটিতে কিভাবে আছে। লোকটি জানাল, সে ওটা কিনেছে, ক্রয়সূত্রে মালিক সে। 'কাগজপত্র আছে?' হাবীব সাহেবের পরবর্তী প্রশ্ন। 'জি, এই দেহেন কাগজ', বলে সে একটা ভাঁজ করা কাগজ বাড়িয়ে দিল এসপি সাহেবের দিকে। হাবীব সাহেব দেখলেন, ওটা একটা বায়নাপত্র। ওই মাস্তানের কাছ থেকে অগ্রিম কয়েক হাজার টাকা নিয়ে এক ব্যক্তি বায়নাপত্র লিখে সহি-ছাপ্পর মেরে দিয়েছে। হঠাৎ হাবীব সাহেবের চোখ পড়ল বায়নাপত্রে সহির নিচে বসানো তারিখের দিকে। ওটা স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরের একটা তারিখ। কাগজটা হাতে নিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে তিনি বললেন, এটা তো একটা বায়নাপত্র। বিক্রি-দলিল কই? দলিল নেই? শুনে সেই লোক খুব ডাঁটের সঙ্গে বলল, দলিল থাকত ন কিল্লাই? তয় দলিল হানজাবিরা যুদ্ধের সময় লুট করি লই গেছে। (দলিল থাকবে না কেন? তবে দলিল পাঞ্জাবিরা যুদ্ধের সময় লুট করে নিয়ে গেছে)। হাবীব সাহেব বললেন, তাহলে মিউনিসিপ্যালিটির যে কর দিয়েছিলেন তার রসিদ দেখান। ওই লোক জবাব দিল : হিগাও হানজাবিরা লই গেছে। ঠিক আছে, আপনার নামের বিদ্যুতের বিল, পানির বিল- কোনো একটা কিছু দেখান। লোকটার ওই একটাই জবাব : হানজাবিরা লই গেছে। বন্দুকের লাইসেন্স, গাড়ি-ফ্রিজ-টিভির কাগজ- যা-ই দেখতে চাওয়া হয় তার জবাব একটাই : হানজাবিরা লই গেছে।
হাবীব সাহেব তখন তড়িঘড়ি করে বানানো নতুনের মতো দেখতে সেই বায়নাপত্র পকেট থেকে বের করে বললেন, হ্যাঁ, সবই নিয়ে গেছে পাঞ্জাবিরা, নেয়নি শুধু এই কয়েক দিন আগে বানানো ভুয়া বায়নাপত্র আর আপনাকে। এবার আপনাকেও নিয়ে যাবে এই দারোগা সাহেব। তবে অন্য কোথাও নয়, হাজতে।
স্বাধীনতার পর ছোট-বড় সব অপরাধের দায় খানসেনাদের ওপর চাপানোর একটা সহজ প্রবণতা দেখা দিয়েছিল অন্যায়কারীদের মধ্যে। তারা ভাবত, খানসেনাদের ওপর দিয়ে সব কিছু চালিয়ে দিলে সাধারণ্যে এটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে। হয়তো এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পারও পেয়েছে তারা; কিন্তু অতি ব্যবহারের ফলে দর্শকদের কাছে 'ট্রিকটা' ধরা পড়ে যায়। দর্শকরা তখন দুয়ো দিতে শুরু করে।
আমাদের দাপ্তরিক কাজে কোথায় কোন ধড়িবাজ স্মার্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী এভাবে চোখে ধুলো দিতে গিয়ে ধরা খাওয়ায় হাবীবুর রহমান সাহেব গল্পটি শুনিয়েছিলেন মনে নেই; কিন্তু এই অকালপ্রয়াত (১৯৮৯) দেশপ্রেমিক পুলিশ কর্মকর্তার গল্পটি আমার বারবার মনে পড়ে যায়, যখন দেখি আমাদের কর্তাব্যক্তিরা যেকোনো অঘটন ঘটলে প্রথমেই বলে বসেন, 'হানজাবিরা লই গেছে'। আরে বাবা, 'হানজাবিরা' তো সেই কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, এখনো তাদের কাঁধে দোষ চাপাতে চাইলে দেশবাসী তা মানবে কেন? আজ এত দিন পর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল কি অনেক শুকিয়ে যায়নি? (সরি, জল গড়িয়ে গেছে বলতে পারলাম না। গড়ানোর মতো জল বা পানি- যে নামেই ডাকি না কেন, তা কি আর আছে?)
লেটেস্ট 'ফ্যাড' হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ কেন, জিনিসপত্রের দাম কমছে না কেন, ব্যাংক জালিয়াতির মহামারী লেগেছে কেন, শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত-অশান্ত কেন- এ সব কিছুর উত্তর একটাই : এটা করছে সেই গোষ্ঠী : (ক) যারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চায় না, (খ) যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে চায়। সর্বশেষ বৌদ্ধ কিয়াঙ ও বৌদ্ধপল্লীর হামলার পেছনেও ওই কেষ্টা বেটাই চোর। কিন্তু আমি বলি কী, কেষ্টা বেটাকে সব কিছুতে চোর ঠাওরাতেন যে মা-ঠাকরুন, তিনি তো আপনাদের মতো এত লেখাপড়া জানা বিএ-এমএ-পিএইচডি ছিলেন না, তাঁর জমানাটাও ছিল এক শ বছর আগের জমানা। আপনারা এই ডিজিটাল যুগেও যদি জন্ডিস রোগীর মতো সব কিছু হলদে দেখেন, অ শুনলেই মনে করেন অজগরটি আসছে ধেয়ে, তাহলে তো মহামুসিবত।
একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি- যাঁর সততা-নিষ্ঠার ওপর দেশবাসীর অগাধ আস্থা- তিনিও বৌদ্ধপল্লীতে গিয়ে বলে বসলেন, প্রশাসনের এখানে-সেখানে নাকি কোনো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের বা সংগঠনের লোকজন এখনো ঘাপটি মেরে বসে আছে। বেশ তো, তা-ই যদি হয় তাহলে প্রশাসন ঘাপটির মোকাবিলায় চুপটি করে বসে আছে কেন? কেউ যদি দেশদ্রোহিতামূলক, সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত থাকে, তাহলে তাকে ঘাড় ধরে বের করে এনে সর্বসমক্ষে শূলে চড়ান না কেন? মানা করেছে কে? আপনি যেভাবে কথাটি বললেন, আপনার বক্তব্য তো শোনা গেল রাজনৈতিক নেতার মতো। কিন্তু আপনি তো নেতা নন; আপনি প্রজাতন্ত্রের একটি কসম-খাওয়া সর্বোচ্চ পদের বেতনভুক আধিকারিক। সবিনয়ে জানতে চাই, এটা কি ঠিক হলো? আপনার বাকি সব কথা খুবই সুন্দর, স্পষ্ট ও সময়োপযোগী হয়েছে। কিন্তু...।
যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, যাঁরা ক্ষমতায় নেই- তবে যাওয়ার আশা রাখেন, তাঁদের সবার কাছে একটা বিনীত অনুরোধ : কোদালকে কোদাল বলতে শিখুন। দেখবেন, দীর্ঘমেয়াদে (হয়তো মধ্যমেয়াদেও) অবশ্যই জিতবেন। দেশের লোক বেইমান না। তারা অন্ধ না। তারা বোবাও না। তারা সব দেখে, সব শুনে ও বোঝে। আপনাদের ভালো-মন্দ সব কাজের সঠিক মূল্যায়ন সঠিক সময়ে তারা ঠিকই করতে জানে। শুধু সহজে কিছু বলে না। কারণ যুগ যুগ ধরে দারুণ ডাইরেক্টর সাহেব তাদের একটা 'রোলই' দিয়ে রেখেছেন...সেটা বোবা-কালার রোল। তবে মনে রাখবেন, ড্রপসিন পড়া মাত্র এরাই কিন্তু গর্জে ওঠে : এই শা...রা, তিনটা ঘণ্টা যা কষ্ট দিলি, কিচ্ছু কইতে পারিনি। কাল থেকে মজুরি না বাড়ালে আর ভালো চা-নাশতা না দিলে উষ্ঠা মারি তোদের নাটকে। শিল্পকলা একাডেমী ছেড়ে চলে যাবই যাব মহিলা সমিতিতে।
বিনয়ে গলে গিয়ে নয়, ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে পাথর হয়ে গিয়ে কয়টি প্রশ্ন করতে চাই। ধরে নিন, 'এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল', লেখাপড়া জানে না, ডাকাবুকো, আছে বলতে বাঙালের গোঁ আর পাঁচ বছর মেয়াদি একটি ভোট, আপনাদের গাড়ি আটকে জানতে চাইল : (১) ইব্রাহিম খালেদের শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্টে যেসব দুর্নীতিবাজের নাম এসেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না; (২) সাগর-রুনির হত্যাকারী গ্রেপ্তারের ৪৮ ঘণ্টা কখন শেষ হবে; (৩) ইলিয়াস আলী এবং আমিনুল ইসলামের মামলার তদন্ত কি অনন্তকাল ধরে চলবে; (৪) ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের শতবর্ষী হোস্টেল পুড়িয়ে যারা ছাই করল এবং যাদের কথা প্রত্যক্ষদর্শীরা বলল, যাদের ছবি এলো পত্র-পত্রিকায়, তারা কেন গ্রেপ্তার হলো না; (৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যারা লড়াই করল ও যাদের কারো কারো লাল বৃত্তায়িত সুস্পষ্ট ছবি প্রত্যেক কাগজে ছাপা হলো, তাদের বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না; (৬) হলমার্ক কেলেঙ্কারির খলমার্কা নায়ক ও তার পৃষ্ঠপোষকরা এবং জাতির 'ডেস্টিনি' নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলল, সেই ডেসটিনি গ্রুপের ওস্তাদোকা ওস্তাদরা কী করে এত দিন বহাল তবিয়তে থাকতে পারল এবং তাদের জেলে ঢোকাতে এত লজ্জা, এত সংকোচ কেন; (৭) রামু-উখিয়া-পটিয়াতে যারা দোষী...যারা বড়ুয়াসমাজবিরোধী, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক স্লোগান-বক্তৃতা দিয়ে, মিছিল-সমাবেশ করে, ট্রাক-বাস ভর্তি বাঙালি এনে, রোহিঙ্গা এনে আগুন লাগিয়ে বাংলাদেশের ১৬ কোটি শান্তিপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক মানুষের কলিজায় আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছে, দেশের সযত্নে লালিত অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে বিশ্বের দরবারে ভূলুণ্ঠিত করেছে, দল-মত নির্বিশেষে সেইসব দুর্বৃত্তকে কেন আটক করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না; অ্যান্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, (৮) স্বপ্নের পদ্মা সেতুটি হবে তো?
খালি হানজাবিরা লই গেছে, আর কেষ্টা বেটাই চোর বলার দিন শেষ হয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে, বাংলাদেশের কোটি কোটি সোজা-সরল মানুষকে গরু-ছাগল-ভেড়া ভাবার দিন। লোকে এখন আর 'ব্লেইম-গেইম' দেখতে চায় না, অ্যাকশন দেখতে চায়, দেখতে চায় রেজাল্ট।
০৬.১০.১২
ওই সময়ের একটা গল্প শুনেছিলাম আমার এককালের 'বস্', পুলিশের অত্যন্ত স্বনামধন্য অফিসার মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান (মরহুম)-এর কাছে। পুলিশের অনেক যোগ্য, স্পষ্টবাদী ও সৎ অফিসার আছেন, যাঁদের নাম চিরকাল শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়ে থাকে। হাবীবুর রহমান সাহেব ছিলেন তাঁদেরই একজন। ১৯৮০-র দশকে তৎকালীন সরকারের 'কৃপায়' তিনি ও আমি আমাদের নিজস্ব বৃত্তের বাইরে নির্বাসিত হই বাংলাদেশ জুট মিলস্ করপোরেশন-এ। আমার অবস্থা যেমন-তেমন, তাঁর কিন্তু তখন জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা, সততা ইত্যাদি বিচারে আইজি অব পুলিশ হওয়ার কথা। অবশ্য পরে, হয়তো চক্ষুলজ্জার কারণে, তাঁকে আইজি করা হয় মাত্র এক ঘণ্টার জন্য। হ্যাঁ, এক ঘণ্টার জন্য। যোগদানপত্র স্বাক্ষরের পর আবার পুনর্মূষিকো ভব... ব্যাক টু বিজেএমসি অ্যাজ চেয়ারম্যান। আমি তখন ওই সংস্থার ডাইরেক্টর মার্কেটিং।
হাবীবুর রহমান সাহেব একদিন 'হানজিবারা লই গেছে' শিরোনামের একটা গল্প শোনালেন। স্বাধীনতার পর তখন তিনি ছিলেন বৃহত্তর ঢাকা জেলার সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (এসপি)। বাড়িঘর-সয়-সম্পত্তি লুটপাট, জবরদখল, উৎখাত- এসব ছিল ওই সময়ের নিত্যদিনের ঘটনা। তা এমনি এক বাড়ি জবরদখলের ব্যাপারে তাঁকে বলা হয়েছিল তদন্ত করতে। দখলকারী এলাকার এক জবরদস্ত মাস্তান। কোনো এক নেতার পেয়ারা বান্দা। স্বাধীনতার আগে ছিল জিরো, এখন হিরো। দখলকারীকে তিনি তার কাগজপত্র সাক্ষীসাবুদসহ ডেকে পাঠালেন অফিসে।
লোকটার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, সে ওই বাড়িটিতে কিভাবে আছে। লোকটি জানাল, সে ওটা কিনেছে, ক্রয়সূত্রে মালিক সে। 'কাগজপত্র আছে?' হাবীব সাহেবের পরবর্তী প্রশ্ন। 'জি, এই দেহেন কাগজ', বলে সে একটা ভাঁজ করা কাগজ বাড়িয়ে দিল এসপি সাহেবের দিকে। হাবীব সাহেব দেখলেন, ওটা একটা বায়নাপত্র। ওই মাস্তানের কাছ থেকে অগ্রিম কয়েক হাজার টাকা নিয়ে এক ব্যক্তি বায়নাপত্র লিখে সহি-ছাপ্পর মেরে দিয়েছে। হঠাৎ হাবীব সাহেবের চোখ পড়ল বায়নাপত্রে সহির নিচে বসানো তারিখের দিকে। ওটা স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরের একটা তারিখ। কাগজটা হাতে নিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে তিনি বললেন, এটা তো একটা বায়নাপত্র। বিক্রি-দলিল কই? দলিল নেই? শুনে সেই লোক খুব ডাঁটের সঙ্গে বলল, দলিল থাকত ন কিল্লাই? তয় দলিল হানজাবিরা যুদ্ধের সময় লুট করি লই গেছে। (দলিল থাকবে না কেন? তবে দলিল পাঞ্জাবিরা যুদ্ধের সময় লুট করে নিয়ে গেছে)। হাবীব সাহেব বললেন, তাহলে মিউনিসিপ্যালিটির যে কর দিয়েছিলেন তার রসিদ দেখান। ওই লোক জবাব দিল : হিগাও হানজাবিরা লই গেছে। ঠিক আছে, আপনার নামের বিদ্যুতের বিল, পানির বিল- কোনো একটা কিছু দেখান। লোকটার ওই একটাই জবাব : হানজাবিরা লই গেছে। বন্দুকের লাইসেন্স, গাড়ি-ফ্রিজ-টিভির কাগজ- যা-ই দেখতে চাওয়া হয় তার জবাব একটাই : হানজাবিরা লই গেছে।
হাবীব সাহেব তখন তড়িঘড়ি করে বানানো নতুনের মতো দেখতে সেই বায়নাপত্র পকেট থেকে বের করে বললেন, হ্যাঁ, সবই নিয়ে গেছে পাঞ্জাবিরা, নেয়নি শুধু এই কয়েক দিন আগে বানানো ভুয়া বায়নাপত্র আর আপনাকে। এবার আপনাকেও নিয়ে যাবে এই দারোগা সাহেব। তবে অন্য কোথাও নয়, হাজতে।
স্বাধীনতার পর ছোট-বড় সব অপরাধের দায় খানসেনাদের ওপর চাপানোর একটা সহজ প্রবণতা দেখা দিয়েছিল অন্যায়কারীদের মধ্যে। তারা ভাবত, খানসেনাদের ওপর দিয়ে সব কিছু চালিয়ে দিলে সাধারণ্যে এটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে। হয়তো এভাবে অনেক ক্ষেত্রে পারও পেয়েছে তারা; কিন্তু অতি ব্যবহারের ফলে দর্শকদের কাছে 'ট্রিকটা' ধরা পড়ে যায়। দর্শকরা তখন দুয়ো দিতে শুরু করে।
আমাদের দাপ্তরিক কাজে কোথায় কোন ধড়িবাজ স্মার্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী এভাবে চোখে ধুলো দিতে গিয়ে ধরা খাওয়ায় হাবীবুর রহমান সাহেব গল্পটি শুনিয়েছিলেন মনে নেই; কিন্তু এই অকালপ্রয়াত (১৯৮৯) দেশপ্রেমিক পুলিশ কর্মকর্তার গল্পটি আমার বারবার মনে পড়ে যায়, যখন দেখি আমাদের কর্তাব্যক্তিরা যেকোনো অঘটন ঘটলে প্রথমেই বলে বসেন, 'হানজাবিরা লই গেছে'। আরে বাবা, 'হানজাবিরা' তো সেই কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, এখনো তাদের কাঁধে দোষ চাপাতে চাইলে দেশবাসী তা মানবে কেন? আজ এত দিন পর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল কি অনেক শুকিয়ে যায়নি? (সরি, জল গড়িয়ে গেছে বলতে পারলাম না। গড়ানোর মতো জল বা পানি- যে নামেই ডাকি না কেন, তা কি আর আছে?)
লেটেস্ট 'ফ্যাড' হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ কেন, জিনিসপত্রের দাম কমছে না কেন, ব্যাংক জালিয়াতির মহামারী লেগেছে কেন, শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত-অশান্ত কেন- এ সব কিছুর উত্তর একটাই : এটা করছে সেই গোষ্ঠী : (ক) যারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চায় না, (খ) যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে চায়। সর্বশেষ বৌদ্ধ কিয়াঙ ও বৌদ্ধপল্লীর হামলার পেছনেও ওই কেষ্টা বেটাই চোর। কিন্তু আমি বলি কী, কেষ্টা বেটাকে সব কিছুতে চোর ঠাওরাতেন যে মা-ঠাকরুন, তিনি তো আপনাদের মতো এত লেখাপড়া জানা বিএ-এমএ-পিএইচডি ছিলেন না, তাঁর জমানাটাও ছিল এক শ বছর আগের জমানা। আপনারা এই ডিজিটাল যুগেও যদি জন্ডিস রোগীর মতো সব কিছু হলদে দেখেন, অ শুনলেই মনে করেন অজগরটি আসছে ধেয়ে, তাহলে তো মহামুসিবত।
একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি- যাঁর সততা-নিষ্ঠার ওপর দেশবাসীর অগাধ আস্থা- তিনিও বৌদ্ধপল্লীতে গিয়ে বলে বসলেন, প্রশাসনের এখানে-সেখানে নাকি কোনো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের বা সংগঠনের লোকজন এখনো ঘাপটি মেরে বসে আছে। বেশ তো, তা-ই যদি হয় তাহলে প্রশাসন ঘাপটির মোকাবিলায় চুপটি করে বসে আছে কেন? কেউ যদি দেশদ্রোহিতামূলক, সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত থাকে, তাহলে তাকে ঘাড় ধরে বের করে এনে সর্বসমক্ষে শূলে চড়ান না কেন? মানা করেছে কে? আপনি যেভাবে কথাটি বললেন, আপনার বক্তব্য তো শোনা গেল রাজনৈতিক নেতার মতো। কিন্তু আপনি তো নেতা নন; আপনি প্রজাতন্ত্রের একটি কসম-খাওয়া সর্বোচ্চ পদের বেতনভুক আধিকারিক। সবিনয়ে জানতে চাই, এটা কি ঠিক হলো? আপনার বাকি সব কথা খুবই সুন্দর, স্পষ্ট ও সময়োপযোগী হয়েছে। কিন্তু...।
যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, যাঁরা ক্ষমতায় নেই- তবে যাওয়ার আশা রাখেন, তাঁদের সবার কাছে একটা বিনীত অনুরোধ : কোদালকে কোদাল বলতে শিখুন। দেখবেন, দীর্ঘমেয়াদে (হয়তো মধ্যমেয়াদেও) অবশ্যই জিতবেন। দেশের লোক বেইমান না। তারা অন্ধ না। তারা বোবাও না। তারা সব দেখে, সব শুনে ও বোঝে। আপনাদের ভালো-মন্দ সব কাজের সঠিক মূল্যায়ন সঠিক সময়ে তারা ঠিকই করতে জানে। শুধু সহজে কিছু বলে না। কারণ যুগ যুগ ধরে দারুণ ডাইরেক্টর সাহেব তাদের একটা 'রোলই' দিয়ে রেখেছেন...সেটা বোবা-কালার রোল। তবে মনে রাখবেন, ড্রপসিন পড়া মাত্র এরাই কিন্তু গর্জে ওঠে : এই শা...রা, তিনটা ঘণ্টা যা কষ্ট দিলি, কিচ্ছু কইতে পারিনি। কাল থেকে মজুরি না বাড়ালে আর ভালো চা-নাশতা না দিলে উষ্ঠা মারি তোদের নাটকে। শিল্পকলা একাডেমী ছেড়ে চলে যাবই যাব মহিলা সমিতিতে।
বিনয়ে গলে গিয়ে নয়, ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে পাথর হয়ে গিয়ে কয়টি প্রশ্ন করতে চাই। ধরে নিন, 'এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল', লেখাপড়া জানে না, ডাকাবুকো, আছে বলতে বাঙালের গোঁ আর পাঁচ বছর মেয়াদি একটি ভোট, আপনাদের গাড়ি আটকে জানতে চাইল : (১) ইব্রাহিম খালেদের শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্টে যেসব দুর্নীতিবাজের নাম এসেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না; (২) সাগর-রুনির হত্যাকারী গ্রেপ্তারের ৪৮ ঘণ্টা কখন শেষ হবে; (৩) ইলিয়াস আলী এবং আমিনুল ইসলামের মামলার তদন্ত কি অনন্তকাল ধরে চলবে; (৪) ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজের শতবর্ষী হোস্টেল পুড়িয়ে যারা ছাই করল এবং যাদের কথা প্রত্যক্ষদর্শীরা বলল, যাদের ছবি এলো পত্র-পত্রিকায়, তারা কেন গ্রেপ্তার হলো না; (৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে যারা লড়াই করল ও যাদের কারো কারো লাল বৃত্তায়িত সুস্পষ্ট ছবি প্রত্যেক কাগজে ছাপা হলো, তাদের বিরুদ্ধে আজও কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না; (৬) হলমার্ক কেলেঙ্কারির খলমার্কা নায়ক ও তার পৃষ্ঠপোষকরা এবং জাতির 'ডেস্টিনি' নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলল, সেই ডেসটিনি গ্রুপের ওস্তাদোকা ওস্তাদরা কী করে এত দিন বহাল তবিয়তে থাকতে পারল এবং তাদের জেলে ঢোকাতে এত লজ্জা, এত সংকোচ কেন; (৭) রামু-উখিয়া-পটিয়াতে যারা দোষী...যারা বড়ুয়াসমাজবিরোধী, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক স্লোগান-বক্তৃতা দিয়ে, মিছিল-সমাবেশ করে, ট্রাক-বাস ভর্তি বাঙালি এনে, রোহিঙ্গা এনে আগুন লাগিয়ে বাংলাদেশের ১৬ কোটি শান্তিপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক মানুষের কলিজায় আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছে, দেশের সযত্নে লালিত অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে বিশ্বের দরবারে ভূলুণ্ঠিত করেছে, দল-মত নির্বিশেষে সেইসব দুর্বৃত্তকে কেন আটক করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না; অ্যান্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, (৮) স্বপ্নের পদ্মা সেতুটি হবে তো?
খালি হানজাবিরা লই গেছে, আর কেষ্টা বেটাই চোর বলার দিন শেষ হয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে, বাংলাদেশের কোটি কোটি সোজা-সরল মানুষকে গরু-ছাগল-ভেড়া ভাবার দিন। লোকে এখন আর 'ব্লেইম-গেইম' দেখতে চায় না, অ্যাকশন দেখতে চায়, দেখতে চায় রেজাল্ট।
০৬.১০.১২
No comments