বিশেষ সাক্ষাৎকার : লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)-রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই
প্রধানমন্ত্রী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক একটি তৃতীয় শক্তির কথাও শোনা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব ও মোশাররফ বাবলু
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল না ব্যর্থ?
মাহবুবুর রহমান : মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের চুলচেরা হিসাব করলে আমি অত্যন্ত হতাশ, মর্মাহত। আমি মনে করি, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন। এটা ঠিক, এটা অনেক প্রত্যাশার সরকার। সরকার এসেছিল, অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশার পারদ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সরকার গঠনের আগে ও পরে নানা কথার ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশার সৃষ্টি করতে পেরেছিল মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ। তাদের নির্বাচনী ইশতেহার, নির্বাচনী প্রচার- সব কিছুর ভেতর দিয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল মানুষের মনে। অত্যন্ত দুঃখের কথা, সরকার সব বিষয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তো এক কথায় ব্যর্থ বলে দিলে তো হবে না। ব্যর্থতার সূচক দেখতে হবে। শুরুতেই আসি দুর্নীতি প্রসঙ্গে। এই সরকারের আগে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। আরেকবার হলে তো ডবল হ্যাটট্রিক হয়ে যেত। নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ছিল, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা। এটা তো আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুর্নীতির মতো ক্ষতিকর কিছু নেই। এর মতো খারাপ কিছু হতে পারে না। দুর্নীতি যক্ষ্মা রোগের মতো সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কুরে কুরে খায়। বিষয়টি খুব যৌক্তিকভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছিল মহাজোট। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ তখন খুব সচেতন ছিল। মানুষ বুঝতে পেরেছিল, দুর্নীতির কারণে দেশ অধোগতির দিকে যাচ্ছে, ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। গোটা বিশ্বে আমরা নিন্দিত হচ্ছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নান্দনিকতা অর্জনের বদলে নিন্দিত হতে যাচ্ছে। আমি তো মনে করি, আগের সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল একটা বড় পয়েন্ট। আমিও মনে করি, এটা ছিল আগের সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের এটা বড় কৃতিত্ব যে বিষয়টি তারা ঠিকমতো চিহ্নিত করতে পেরেছিল। নির্বাচনের আগে তারা এ বিষয়টি মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে দুর্নীতির যে রূপ প্রত্যক্ষ করলাম, তার তুলনা আগের কোনো সময়ের সঙ্গে দেওয়া যাবে না। এই দুর্নীতি নিয়ে বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কী বলছেন, দিন-তারিখ উল্লেখ করে এর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, সরকারের অর্থমন্ত্রী রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলের একটি সেমিনারে বলেছেন, বাংলাদেশের সর্বত্র দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারের সব বিভাগ তো বটেই; সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এক কথায় তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে- সরকারের প্রতিটি সংস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়ে তিনি কিভাবে এ কথা বলেন তা ভাবনার উদ্রেক করে। আমি তো দেখছি দুর্নীতি বন্ধের যে অঙ্গীকার মহাজোট করেছিল, তা রক্ষা করতে পারেনি। বরং মহাজোট সরকারের আমলে দুর্নীতি ব্যাপক বেড়েছে। একেবারে টাটকা ইস্যু পদ্মা সেতুর কথাই ধরা যাক। এটা তো একটা স্বপ্নের সেতু। দাতা সংস্থারা এগিয়ে এসেছিল। আমাদের প্রস্তুতিও কম ছিল না। কিন্তু সেই সেতু আজ প্রশ্নের মুখে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এখানে তারা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। পদ্মা সেতু এখন আটকে আছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের কপালে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে। কথায় বলে, মাছের পতন ধরে মাথায়, পানি সব সময় নিচের দিকে গড়ায়। দুর্নীতিও ঠিক তাই। দুর্নীতি শীর্ষপর্যায় থেকেই শুরু হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। আরেকটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে সাবেক রেলমন্ত্রীর কেলেঙ্কারি। তাঁকে 'উজিরে খামাখা' করে রাখা হয়েছে। শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটকে আছে, প্রিন্স অব ডেনমার্কের দর্শকপ্রিয় একটি সংলাপ, 'দেয়ার ইজ সামথিং রটেন সামহয়্যার ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।' আজ যদি শেকসপিয়ার বেঁচে থাকতেন, তাহলে নাটকের দৃশ্য বদলে প্রিন্স অব ডেনমার্ককে বাংলাদেশ সফরে পাঠিয়ে নতুন সংলাপ লিখতেন, 'এভরিথিং ইজ রটেন এভরিহয়্যার ইন বাংলাদেশ।' দুর্নীতি দমন ছিল মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার থেকে সরকার সরে গেছে। এটা সরকারের একটা ব্যর্থতা।
এই সময়ের একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে বিদ্যুতের রেন্টাল, কুইক রেন্টাল। দুর্নীতির একটা নগ্ন কৌশল এটা। এর জন্য সংসদে ইনডেমনিটি বিল আনা হয়েছে। দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই দায়মুক্তি হচ্ছে দুর্নীতির দায়মুক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো ইনডেমনিটি শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সব ইনডেমনিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে আইনগতভাবে। শেয়ারবাজার নিয়ে যদি বলি, সেখানেও দেখব সরকার ব্যর্থ। কত মানুষকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে তো সেনাবাহিনীর কথা জানি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যান বিদেশে, শান্তি মিশনে। সেখান থেকে টাকা উপার্জন করে নিয়ে এসে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়েছেন তাঁরা। শেয়ারবাজার নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ একটা রিপোর্টও দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া সেই রিপোর্টের প্রতিফলন তো কোথাও দেখছি না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিড়ালকেই মাছ পাহারায় বসানো হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় সরকার ব্যর্থ।
সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ ছিল গণতন্ত্রকে ধারণ করা, লালন করা, সজীব রাখা। গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো। বাংলাদেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- সব গণতন্ত্রের জন্য। গণতন্ত্র ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মোটিভেটিং ফোর্স। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি। গণতন্ত্রে সব কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সংসদ। সেই সংসদ সাড়ে তিন বছর ধরে অকার্যকর। কথা উঠতে পারে, বিরোধী দল সংসদে না এলে কী করার আছে? এভাবে সহজ জবাব দেওয়া যাবে না। বিরোধী দল সংসদে না গেলে নিশ্চয় বিরোধী দল এর জন্য দায়ী থাকবে। বিচারের ভার তো জনগণের হাতে। জনগণ বিচার করবে। কিন্তু সংসদ যে সাড়ে তিন বছর অকার্যকর হয়ে আছে, সংসদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই, আইন পাসের বাইরে বড় অনেক সমস্যা আছে সেগুলো সংসদে উপস্থাপন হচ্ছে না। অনেক চুক্তি হচ্ছে। চুক্তিগুলো সংসদে আসছে না। এগুলো নিয়ে তো বিতর্ক হওয়া উচিত হচ্ছে না। সাধারণ কিছু কাজ হচ্ছে। নিয়মিত অধিবেশন আহ্বান করা হচ্ছে। বাজেট পেশ হচ্ছে, পাস হচ্ছে। এসব রুটিন কাজের বাইরে কী হচ্ছে? তবে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন নিয়ে অবশ্যই কথা বলার আছে। বিএনপি যে এত দিন সংসদে গেল না, এটা জনগণ পছন্দ করছে বলে মনে হয় না। তবে বিএনপিকে সংসদে নেওয়ার পরিবেশ সরকার নিশ্চিত করতে পারছে না।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহবুবুর রহমান : এ বিষয়টি আমি আমার মতো করে বলতে চাই। জনগণ মহাজোটকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে মহাজোট। এই ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের আগে অবশ্যই একটি বিষয় মনে রাখতে হবে- যে প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য কারা উপযুক্ত। এখানে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পারঙ্গমতা, সততা, ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে ভাবতে হবে। মন্ত্রিসভা যাঁদের নিয়ে গঠন করা হবে, তাঁদের হতে হবে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল। পরীক্ষিত হতে হবে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে শুধু বয়স্কদের নিয়ে তরুণদের বাদ দিলেই মন্ত্রিসভা ভালো হবে না। আমি মনে করি, মন্ত্রিসভায় নবীন-প্রবীণের সমন্বয় থাকতে হবে। আমি নিশ্চিত করেই বলব, এ সরকারের মন্ত্রিসভার বাছাই ঠিক হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কারো নাম বলতে চাই না। বাংলাদেশের এই ৪১ বছরের ইতিহাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এমন নিন্দিত মন্ত্রিসভা দেখা যায়নি। আবারও বলছি, এই বাছাইটি ঠিক হয়নি। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগে অনেক সৎ, যোগ্য, অভিজ্ঞ মানুষ আছেন। হ্যাঁ, অনেককে উপদেষ্টা করা হয়েছে। এই উপদেষ্টা পরিষদও প্রশ্নবিদ্ধ। উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে এক ধরনের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। উপদেষ্টা ও মন্ত্রীদের মধ্যে একটা সংঘাতময় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যেন। উপদেষ্টা পরিষদের কারণে মন্ত্রীরা কোনো দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। ফলে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বোপরি আমার মনে হয়, বর্তমান সরকারের যে মন্ত্রিসভা, এর সদস্য নির্বাচন সঠিক হয়নি। অনেক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা দক্ষ। কিন্তু অনেকে একেবারেই যোগ্যতার ছাপ রাখতে পারেননি।
কালের কণ্ঠ : এ সরকারের কাছে জনগণের আরেকটি প্রত্যাশা ছিল- সুশাসন। এটা মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকারও। সুশাসন কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে সরকার?
মাহবুবুর রহমান : সরকার এ ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ব্যর্থ। সুশাসন বলতে আমরা যা বুঝি, তা সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। আমি তো গভর্ন্যান্সেরই মানুষ, সামরিক আমলা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সামরিক ও বেসামরিক- উভয় প্রশাসনই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি, সুশাসনই একটা দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে। আজ জাতি হিসেবে, দেশ হিসেবে সামনের দিকে যেতে পারছি না। হামাগুড়ি খাচ্ছি। একটা অন্ধকার টানেলের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। আলো দেখতে পাচ্ছি না। এর অনেক কারণ আছে। বড় কারণ হচ্ছে, সুশাসনের অভাব। এখানে জবাবদিহিতা নেই। এখানে স্বচ্ছতার অভাব। দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে। প্রশাসনকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে। প্রশাসনে ঢালাও পদোন্নতি হচ্ছে। পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে। এভাবে প্রমোশন দিয়ে পদায়ন করতে গিয়ে ওএসডির সংখ্যা বাড়ছে। ওদিকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে বসার জন্য বিশেষ যোগ্যতা হচ্ছে বিশেষ জায়গা। ঢাকার সব থানার ওসি নাকি একটি বিশেষ জায়গার বাসিন্দা! প্রশাসনের সব জায়গায় রুলস অব বিজনেস সাংঘাতিকভাবে উপেক্ষিত, পদদলিত। কাজেই সুশাসন সুদূরপরাহত। সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
মাহবুবুর রহমান : এটা তো কঠিন বাস্তব। বাজার এখন এমন একটা জায়গা, যেখানে বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। বাজারদর প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে। মহাজোটের অঙ্গীকার ছিল, ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে, বিনা মূল্যে সার দেবে। বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখবে। পারেনি। মূল্যস্ফীতি কিন্তু অসম্ভব হারে বেড়েছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে। অন্তত বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বর্তমান মহাজোট সরকারের চেয়ে আগের (১৯৯৬ থেকে ২০০১) আওয়ামী লীগ সরকার অনেক দক্ষতা দেখাতে পেরেছিল। এবারে সে কাজটি করতে পারেনি। আগের বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেত। টিসিবি নিয়ে অনেক দিন সরকার কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি। একেকজন একেক ধরনের কথা বলেছেন। আমি যেভাবে বলতে চাই তা হচ্ছে, সরকার যদি তাদের এজেন্ডায় ব্যবসায় নামে তাহলে ব্যবসাটা অন্য রকম হবে। জনগণের পক্ষের ব্যবসা হবে না। সে ক্ষেত্রে জনগণ প্রতারিত হবে, বঞ্চিত হবে। কিন্তু সরকার যদি মনে করে, ব্যবসায়ীরা আরেকটা সমাজ। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনগণের পক্ষে জনগণের মন্ত্রী, জনগণের সরকার বিষয়টি জনকল্যাণের দিক বিবেচনা করেই কাজ করবে। কিন্তু সরকার ও ব্যবসা একাকার হয়ে গেলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। তখনই সিন্ডিকেটের কথা আসবে। সিন্ডিকেট হবে। বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ। মধ্যস্বত্বভোগীদের উত্থান হবে। হচ্ছেও তাই। এখন এসে বাজার একটা স্থিতি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গত তিন বছরে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সাফল্যের কোনো চিহ্ন রাখতে পারেনি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, বিকল্প বাজার ব্যবস্থা চালু করে সরকার মানুষকে যে স্বস্তি দিতে পারত, তা পারেনি। সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকেই ভাবতে হতো। টিসিবিকে সক্রিয় করলেই সিন্ডিকেট ভেঙে যেত। কোন অদৃশ্য কারণে সরকার টিসিবিকে সক্রিয় করতে চায়নি, সেটা সরকারের ভেতরের নীতিনির্ধারকরাই বলতে পারবেন। আমি বলব, সরকারের ব্যর্থতার আরেকটি জায়গা হচ্ছে বাজার।
কালের কণ্ঠ : সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু বারবার বলা হয়েছে বা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
মাহবুবুর রহমান : সরকার বারবার বলার চেষ্টা করেছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের চোখ ফেরাতে এর বিকল্প তো সরকারের কাছে নেই। এটাও ঠিক, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। শিল্প গড়ে উঠছে। রপ্তানি হচ্ছে। এটা বলা যাবে, কিছু লোক ভালো অবস্থানে আছে। বড় বড় শপিং মল গড়ে উঠেছে। আজকের ঈদ বাজারের দিকে তাকালে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোনো অভাব নেই। কিন্তু এটা দিয়ে এই সমীকরণ টানা যাবে না যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। হ্যাঁ, হয়তো ঢাকার কিছু লোকের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। কিছু লোকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে সেটাকে দেশের সব লোকের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে?
মাহবুবুর রহমান : আমাদের তো সংসদীয় গণতন্ত্র। সংসদীয় গণতন্ত্র অবলম্বন করে পৃথিবীর অনেক দেশ উন্নতির পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা তো বিলেতের ওয়েস্টমিনস্টার টাইপ গণতন্ত্র অনুসরণ করি। সেই বিলেতে বিরোধী দল শুধু বিরোধিতা করার জন্য নয়, সেখানে বিরোধী দল সরকারেরই একটা অংশ। সেখানে বলা হয়, 'হার ম্যাজেস্টিস অপজিশন'। বিরোধী দলকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে। এ ব্যাপারে বিরোধী দলকে তার দায়িত্ববোধ, সচেতনতা, সরকারে বিরোধী দলের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে বুঝে পালন করতে হবে। এখানে সরকারেরও একটি ভূমিকা আছে। সরকার যদি মনে করে, বিরোধী দল মানেই বিরোধী, সে শত্রু- এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিএনপির ভূমিকা প্রসঙ্গে আসি। শুরুতে বিএনপি নির্বাচনের ফল মানতে চায়নি। কিন্তু তার পরও শপথ নিল। সংসদে গেল। সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের অনেক চেষ্টা করেছে। বিএনপি চেয়েছিল সংসদে বিরোধী দল হিসেবে তারা দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু সরকারি দলের কাছ থেকে যেভাবে আচরণ তারা আশা করেছিল, সে আচরণ তারা পায়নি। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি শুরুতেই সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এর পরও আমি মনে করি, বিরোধী দল আরো দায়িত্বশীল হতে পারত। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সংসদে যাওয়া উচিত ছিল বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। তবে এখানে সরকারেরও কিছু দায়িত্ব ছিল। বিরোধী দলকে সংসদে টেনে ধরে রাখার দায়িত্ব সরকারি দল পালন করতে পারেনি বা এটাও বলা যায়, পালন করেনি। বিরোধী দল সংসদে না গেলে, নেওয়ার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা যথার্থ কি না? আমি মনে করি, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোও বিরোধী দলের ভূমিকা। এ ব্যাপারে বিএনপি যথেষ্ট উদ্যোগী। বিএনপি নিজেদের কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করছে। দেশজুড়ে বিএনপির যে ব্যাপ্তি এখন, যেভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, সভা-সমিতি হচ্ছে, তাতে আমি মনে করি, বিএনপির জনসমর্থন বাড়ছে। মানুষের অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করা বিরোধী দলের কাজ। সে কাজে বিএনপি সফল। সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা, ভুল ধরিয়ে দেওয়া- সংসদে এসব কাজ করা না গেলেও বাইরে করা হচ্ছে। রোজার পর নিশ্চয় এ কাজে নতুন বেগ আসবে, নতুন গতি পাবে।
কালের কণ্ঠ : আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসন্ন এমন কথা আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়? এই নতুন ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
মাহবুবুর রহমান : বিষয়টি আমি আমার মতো করে বলতে চাই। আমি মনে করি, গণতন্ত্রের শক্তিই হচ্ছে মূল শক্তি। গণতান্ত্রিক শক্তির বাইরে কোনো শক্তি আমরা গ্রহণ করতে পারি না। হ্যাঁ, অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। আসলে এসব কথার পেছনে কাজ করছে সরকারের ব্যর্থতা। সরকারের ব্যর্থতার কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা অস্থিরতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। আছে সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এ অস্থির অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষ পরিত্রাণ চাইবে। সরকার যদি আজ সুশাসন দিতে পারত, সরকার কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারত, তাহলে এই তৃতীয় শক্তি কিংবা আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের কথা আসত না। বাংলাদেশে যেহেতু সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন ছিল, স্বাভাবিকভাবেই এখানে তৃতীয় শক্তির ব্যাখ্যা নানাভাবে করা যায়।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচার প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
মাহবুবুর রহমান : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জনগণের দাবি। এটা হওয়া উচিত। এটা মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। বিচার শুরু না করলে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো। যুদ্ধাপরাধ ভয়ংকর অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ। পৃথিবীতে যেখানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই অপরাধীদের চিহ্নিত করে কাঠগড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাংলাদেশে ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে। এখানে গণহত্যা হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে বাহিনী দণ্ডিত হলো তাদের বিচার আমরা করতে পারিনি। বাংলাদেশে যারা জড়িত ছিল সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের বিচার হচ্ছে। আমাদের কথা হচ্ছে, বিচারের বাণী যেন নীরবে-নিভৃতে না কাঁদে। আমরা চাই, বিচারটা যেন স্বচ্ছ হয়, ন্যায়সংগত হয়। এখানে অনেকের অনেক অবজারভেশন আছে। সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে বিচার করতে হবে। আমি আবারও বলতে চাই, যুদ্ধাপরাধ কখনো পুরনো হয় না, তামাদি হয় না। আমি চাই এই বিচার হোক। এই বিচার করা সরকারের একটা বড় দায়িত্ব।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
মাহবুবুর রহমান : খুবই সুন্দর প্রশ্ন। দেড় বছর একেবারে কম সময় নয়। একটা কথা আছে, মর্নিং শোজ দ্য ডে। কিন্তু এটা তো আর মর্নিং নয়। এখন তো বিকেল। সরকারের জন্য পড়ন্ত বেলা। এই গোধূলি বেলায় কী আর দেখব? তার পরও কিছু একটা করে দেখানো একেবারে অসম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, সরকার কিছু একটা করে দেখাবে, এটা একেবারেই অলৌকিক ব্যাপার। কিন্তু মিরাকল ডু হ্যাপেন। অলৌকিক ঘটনা এখনো ঘটে। প্রথম কথা হচ্ছে, সরকার যে মানুষের মঙ্গল করতে চায়, সরকারের নিজের মধ্যে এই বিশ্বাস আনতে হবে। সরকার যে ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আনতে চায়, বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সেই ভাবমূর্তির উন্নয়ন ঘটাতে চায়- এ বিষয়গুলো সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে। এটা হচ্ছে পূর্বশর্ত। এই পূর্বশর্ত পূরণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি সংকল্পের ব্যাপার আছে। ধ্যান-ধারণার ব্যাপার আছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, প্রত্যাশা করতে চাই, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে। সব শেষ হয়ে গেছে, এটা এখনই বলা যাবে না। সরকার এখনো অনেক কিছু করতে পারে। সে জন্য প্রথমেই জনগণকে আস্থায় আনতে হবে। জনগণকে বিশ্বাসে নিয়ে, জনগণের বিশ্বাস অর্জন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে এখনো কল্যাণ সম্ভব। এখনো যোগ্য লোকদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা সম্ভব। দেশে অনেক জ্ঞানী ও গুণী মানুষ আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কালের কণ্ঠ : সম্প্র্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। বিরোধী দল সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
মাহবুবুর রহমান : আগেও বলেছি, গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশ। গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। বিষয়টি এখন একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকারের আচরণে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্র্রতি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বিএনপি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না তত্ত্বাবধায়ক সরকার? সরকারের প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেখুন, নির্বাচনকালীন সরকার যে ব্যবস্থাতেই আসুক না কেন, সংকট কিন্তু একটা আছে। এ সংকট হচ্ছে আস্থার। আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সংলাপের বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি। এই যে গণতন্ত্রের কথা বললাম, এর বটমলাইন হচ্ছে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এখন এই নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আদৌ একটি নির্বাচন হবে- এটাই সন্দেহ হয়ে দেখা দিয়েছে। আগামী নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে সংকট আছে। সরকার বা প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বললেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে অনড়। সরকারের শরিকরাও বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। এটা এখন একটা বড় রাজনৈতিক সংকট। এ সংকট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আলোচনা তো হতেই হবে। গণতন্ত্রে যদি আমরা বিশ্বাসী হই, তাহলে গণতন্ত্রের ভাষা আলোচনায় আস্থা রাখতে হবে। আলোচনা করতে হবে। তবে দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রেখে আমরা নির্বাচন চাই না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিএনপিও দলীয় অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি এখন সবার কাছে পরিষ্কার বলে মনে করি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
লে. জে. মাহবুবুর রহমান : আপনাদের ধন্যবাদ। কালের কণ্ঠের পাঠকদের আমার অভিনন্দন।
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল না ব্যর্থ?
মাহবুবুর রহমান : মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের চুলচেরা হিসাব করলে আমি অত্যন্ত হতাশ, মর্মাহত। আমি মনে করি, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ আমার সঙ্গে একমত হবেন। এটা ঠিক, এটা অনেক প্রত্যাশার সরকার। সরকার এসেছিল, অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশার পারদ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সরকার গঠনের আগে ও পরে নানা কথার ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশার সৃষ্টি করতে পেরেছিল মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ। তাদের নির্বাচনী ইশতেহার, নির্বাচনী প্রচার- সব কিছুর ভেতর দিয়ে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল মানুষের মনে। অত্যন্ত দুঃখের কথা, সরকার সব বিষয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তো এক কথায় ব্যর্থ বলে দিলে তো হবে না। ব্যর্থতার সূচক দেখতে হবে। শুরুতেই আসি দুর্নীতি প্রসঙ্গে। এই সরকারের আগে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। আরেকবার হলে তো ডবল হ্যাটট্রিক হয়ে যেত। নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ছিল, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা। এটা তো আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে দুর্নীতির মতো ক্ষতিকর কিছু নেই। এর মতো খারাপ কিছু হতে পারে না। দুর্নীতি যক্ষ্মা রোগের মতো সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কুরে কুরে খায়। বিষয়টি খুব যৌক্তিকভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছিল মহাজোট। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ তখন খুব সচেতন ছিল। মানুষ বুঝতে পেরেছিল, দুর্নীতির কারণে দেশ অধোগতির দিকে যাচ্ছে, ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। গোটা বিশ্বে আমরা নিন্দিত হচ্ছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নান্দনিকতা অর্জনের বদলে নিন্দিত হতে যাচ্ছে। আমি তো মনে করি, আগের সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল একটা বড় পয়েন্ট। আমিও মনে করি, এটা ছিল আগের সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের এটা বড় কৃতিত্ব যে বিষয়টি তারা ঠিকমতো চিহ্নিত করতে পেরেছিল। নির্বাচনের আগে তারা এ বিষয়টি মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে দুর্নীতির যে রূপ প্রত্যক্ষ করলাম, তার তুলনা আগের কোনো সময়ের সঙ্গে দেওয়া যাবে না। এই দুর্নীতি নিয়ে বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কী বলছেন, দিন-তারিখ উল্লেখ করে এর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, সরকারের অর্থমন্ত্রী রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলের একটি সেমিনারে বলেছেন, বাংলাদেশের সর্বত্র দুর্নীতি হচ্ছে। সরকারের সব বিভাগ তো বটেই; সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদও দুর্নীতিগ্রস্ত বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এক কথায় তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে- সরকারের প্রতিটি সংস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়ে তিনি কিভাবে এ কথা বলেন তা ভাবনার উদ্রেক করে। আমি তো দেখছি দুর্নীতি বন্ধের যে অঙ্গীকার মহাজোট করেছিল, তা রক্ষা করতে পারেনি। বরং মহাজোট সরকারের আমলে দুর্নীতি ব্যাপক বেড়েছে। একেবারে টাটকা ইস্যু পদ্মা সেতুর কথাই ধরা যাক। এটা তো একটা স্বপ্নের সেতু। দাতা সংস্থারা এগিয়ে এসেছিল। আমাদের প্রস্তুতিও কম ছিল না। কিন্তু সেই সেতু আজ প্রশ্নের মুখে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এখানে তারা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। পদ্মা সেতু এখন আটকে আছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের কপালে কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে। কথায় বলে, মাছের পতন ধরে মাথায়, পানি সব সময় নিচের দিকে গড়ায়। দুর্নীতিও ঠিক তাই। দুর্নীতি শীর্ষপর্যায় থেকেই শুরু হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। আরেকটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে সাবেক রেলমন্ত্রীর কেলেঙ্কারি। তাঁকে 'উজিরে খামাখা' করে রাখা হয়েছে। শেকসপিয়ারের হ্যামলেট নাটকে আছে, প্রিন্স অব ডেনমার্কের দর্শকপ্রিয় একটি সংলাপ, 'দেয়ার ইজ সামথিং রটেন সামহয়্যার ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।' আজ যদি শেকসপিয়ার বেঁচে থাকতেন, তাহলে নাটকের দৃশ্য বদলে প্রিন্স অব ডেনমার্ককে বাংলাদেশ সফরে পাঠিয়ে নতুন সংলাপ লিখতেন, 'এভরিথিং ইজ রটেন এভরিহয়্যার ইন বাংলাদেশ।' দুর্নীতি দমন ছিল মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার থেকে সরকার সরে গেছে। এটা সরকারের একটা ব্যর্থতা।
এই সময়ের একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে বিদ্যুতের রেন্টাল, কুইক রেন্টাল। দুর্নীতির একটা নগ্ন কৌশল এটা। এর জন্য সংসদে ইনডেমনিটি বিল আনা হয়েছে। দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই দায়মুক্তি হচ্ছে দুর্নীতির দায়মুক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো ইনডেমনিটি শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সব ইনডেমনিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে আইনগতভাবে। শেয়ারবাজার নিয়ে যদি বলি, সেখানেও দেখব সরকার ব্যর্থ। কত মানুষকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে তো সেনাবাহিনীর কথা জানি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যান বিদেশে, শান্তি মিশনে। সেখান থেকে টাকা উপার্জন করে নিয়ে এসে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারিয়েছেন তাঁরা। শেয়ারবাজার নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ একটা রিপোর্টও দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া সেই রিপোর্টের প্রতিফলন তো কোথাও দেখছি না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিড়ালকেই মাছ পাহারায় বসানো হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় সরকার ব্যর্থ।
সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ ছিল গণতন্ত্রকে ধারণ করা, লালন করা, সজীব রাখা। গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো। বাংলাদেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- সব গণতন্ত্রের জন্য। গণতন্ত্র ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মোটিভেটিং ফোর্স। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি। গণতন্ত্রে সব কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সংসদ। সেই সংসদ সাড়ে তিন বছর ধরে অকার্যকর। কথা উঠতে পারে, বিরোধী দল সংসদে না এলে কী করার আছে? এভাবে সহজ জবাব দেওয়া যাবে না। বিরোধী দল সংসদে না গেলে নিশ্চয় বিরোধী দল এর জন্য দায়ী থাকবে। বিচারের ভার তো জনগণের হাতে। জনগণ বিচার করবে। কিন্তু সংসদ যে সাড়ে তিন বছর অকার্যকর হয়ে আছে, সংসদের কোনো কর্মকাণ্ড নেই, আইন পাসের বাইরে বড় অনেক সমস্যা আছে সেগুলো সংসদে উপস্থাপন হচ্ছে না। অনেক চুক্তি হচ্ছে। চুক্তিগুলো সংসদে আসছে না। এগুলো নিয়ে তো বিতর্ক হওয়া উচিত হচ্ছে না। সাধারণ কিছু কাজ হচ্ছে। নিয়মিত অধিবেশন আহ্বান করা হচ্ছে। বাজেট পেশ হচ্ছে, পাস হচ্ছে। এসব রুটিন কাজের বাইরে কী হচ্ছে? তবে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন নিয়ে অবশ্যই কথা বলার আছে। বিএনপি যে এত দিন সংসদে গেল না, এটা জনগণ পছন্দ করছে বলে মনে হয় না। তবে বিএনপিকে সংসদে নেওয়ার পরিবেশ সরকার নিশ্চিত করতে পারছে না।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহবুবুর রহমান : এ বিষয়টি আমি আমার মতো করে বলতে চাই। জনগণ মহাজোটকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে মহাজোট। এই ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের আগে অবশ্যই একটি বিষয় মনে রাখতে হবে- যে প্রতিশ্রুতি জনগণকে দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য কারা উপযুক্ত। এখানে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পারঙ্গমতা, সততা, ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে ভাবতে হবে। মন্ত্রিসভা যাঁদের নিয়ে গঠন করা হবে, তাঁদের হতে হবে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল। পরীক্ষিত হতে হবে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে শুধু বয়স্কদের নিয়ে তরুণদের বাদ দিলেই মন্ত্রিসভা ভালো হবে না। আমি মনে করি, মন্ত্রিসভায় নবীন-প্রবীণের সমন্বয় থাকতে হবে। আমি নিশ্চিত করেই বলব, এ সরকারের মন্ত্রিসভার বাছাই ঠিক হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কারো নাম বলতে চাই না। বাংলাদেশের এই ৪১ বছরের ইতিহাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এমন নিন্দিত মন্ত্রিসভা দেখা যায়নি। আবারও বলছি, এই বাছাইটি ঠিক হয়নি। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগে অনেক সৎ, যোগ্য, অভিজ্ঞ মানুষ আছেন। হ্যাঁ, অনেককে উপদেষ্টা করা হয়েছে। এই উপদেষ্টা পরিষদও প্রশ্নবিদ্ধ। উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে এক ধরনের দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। উপদেষ্টা ও মন্ত্রীদের মধ্যে একটা সংঘাতময় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যেন। উপদেষ্টা পরিষদের কারণে মন্ত্রীরা কোনো দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। ফলে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। সর্বোপরি আমার মনে হয়, বর্তমান সরকারের যে মন্ত্রিসভা, এর সদস্য নির্বাচন সঠিক হয়নি। অনেক মন্ত্রী আছেন, যাঁরা দক্ষ। কিন্তু অনেকে একেবারেই যোগ্যতার ছাপ রাখতে পারেননি।
কালের কণ্ঠ : এ সরকারের কাছে জনগণের আরেকটি প্রত্যাশা ছিল- সুশাসন। এটা মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকারও। সুশাসন কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে সরকার?
মাহবুবুর রহমান : সরকার এ ক্ষেত্রেও পুরোপুরি ব্যর্থ। সুশাসন বলতে আমরা যা বুঝি, তা সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি। আমি তো গভর্ন্যান্সেরই মানুষ, সামরিক আমলা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সামরিক ও বেসামরিক- উভয় প্রশাসনই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি, সুশাসনই একটা দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে। আজ জাতি হিসেবে, দেশ হিসেবে সামনের দিকে যেতে পারছি না। হামাগুড়ি খাচ্ছি। একটা অন্ধকার টানেলের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। আলো দেখতে পাচ্ছি না। এর অনেক কারণ আছে। বড় কারণ হচ্ছে, সুশাসনের অভাব। এখানে জবাবদিহিতা নেই। এখানে স্বচ্ছতার অভাব। দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে। প্রশাসনকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে। প্রশাসনে ঢালাও পদোন্নতি হচ্ছে। পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে। এভাবে প্রমোশন দিয়ে পদায়ন করতে গিয়ে ওএসডির সংখ্যা বাড়ছে। ওদিকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে বসার জন্য বিশেষ যোগ্যতা হচ্ছে বিশেষ জায়গা। ঢাকার সব থানার ওসি নাকি একটি বিশেষ জায়গার বাসিন্দা! প্রশাসনের সব জায়গায় রুলস অব বিজনেস সাংঘাতিকভাবে উপেক্ষিত, পদদলিত। কাজেই সুশাসন সুদূরপরাহত। সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
মাহবুবুর রহমান : এটা তো কঠিন বাস্তব। বাজার এখন এমন একটা জায়গা, যেখানে বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। বাজারদর প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে। মহাজোটের অঙ্গীকার ছিল, ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে, বিনা মূল্যে সার দেবে। বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখবে। পারেনি। মূল্যস্ফীতি কিন্তু অসম্ভব হারে বেড়েছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে। অন্তত বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বর্তমান মহাজোট সরকারের চেয়ে আগের (১৯৯৬ থেকে ২০০১) আওয়ামী লীগ সরকার অনেক দক্ষতা দেখাতে পেরেছিল। এবারে সে কাজটি করতে পারেনি। আগের বাণিজ্যমন্ত্রী কথা বললেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেত। টিসিবি নিয়ে অনেক দিন সরকার কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি। একেকজন একেক ধরনের কথা বলেছেন। আমি যেভাবে বলতে চাই তা হচ্ছে, সরকার যদি তাদের এজেন্ডায় ব্যবসায় নামে তাহলে ব্যবসাটা অন্য রকম হবে। জনগণের পক্ষের ব্যবসা হবে না। সে ক্ষেত্রে জনগণ প্রতারিত হবে, বঞ্চিত হবে। কিন্তু সরকার যদি মনে করে, ব্যবসায়ীরা আরেকটা সমাজ। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনগণের পক্ষে জনগণের মন্ত্রী, জনগণের সরকার বিষয়টি জনকল্যাণের দিক বিবেচনা করেই কাজ করবে। কিন্তু সরকার ও ব্যবসা একাকার হয়ে গেলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। তখনই সিন্ডিকেটের কথা আসবে। সিন্ডিকেট হবে। বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ। মধ্যস্বত্বভোগীদের উত্থান হবে। হচ্ছেও তাই। এখন এসে বাজার একটা স্থিতি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গত তিন বছরে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সাফল্যের কোনো চিহ্ন রাখতে পারেনি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, বিকল্প বাজার ব্যবস্থা চালু করে সরকার মানুষকে যে স্বস্তি দিতে পারত, তা পারেনি। সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকেই ভাবতে হতো। টিসিবিকে সক্রিয় করলেই সিন্ডিকেট ভেঙে যেত। কোন অদৃশ্য কারণে সরকার টিসিবিকে সক্রিয় করতে চায়নি, সেটা সরকারের ভেতরের নীতিনির্ধারকরাই বলতে পারবেন। আমি বলব, সরকারের ব্যর্থতার আরেকটি জায়গা হচ্ছে বাজার।
কালের কণ্ঠ : সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু বারবার বলা হয়েছে বা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
মাহবুবুর রহমান : সরকার বারবার বলার চেষ্টা করেছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের চোখ ফেরাতে এর বিকল্প তো সরকারের কাছে নেই। এটাও ঠিক, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। শিল্প গড়ে উঠছে। রপ্তানি হচ্ছে। এটা বলা যাবে, কিছু লোক ভালো অবস্থানে আছে। বড় বড় শপিং মল গড়ে উঠেছে। আজকের ঈদ বাজারের দিকে তাকালে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোনো অভাব নেই। কিন্তু এটা দিয়ে এই সমীকরণ টানা যাবে না যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। হ্যাঁ, হয়তো ঢাকার কিছু লোকের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। কিছু লোকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে সেটাকে দেশের সব লোকের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে?
মাহবুবুর রহমান : আমাদের তো সংসদীয় গণতন্ত্র। সংসদীয় গণতন্ত্র অবলম্বন করে পৃথিবীর অনেক দেশ উন্নতির পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা তো বিলেতের ওয়েস্টমিনস্টার টাইপ গণতন্ত্র অনুসরণ করি। সেই বিলেতে বিরোধী দল শুধু বিরোধিতা করার জন্য নয়, সেখানে বিরোধী দল সরকারেরই একটা অংশ। সেখানে বলা হয়, 'হার ম্যাজেস্টিস অপজিশন'। বিরোধী দলকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে। এ ব্যাপারে বিরোধী দলকে তার দায়িত্ববোধ, সচেতনতা, সরকারে বিরোধী দলের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে বুঝে পালন করতে হবে। এখানে সরকারেরও একটি ভূমিকা আছে। সরকার যদি মনে করে, বিরোধী দল মানেই বিরোধী, সে শত্রু- এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিএনপির ভূমিকা প্রসঙ্গে আসি। শুরুতে বিএনপি নির্বাচনের ফল মানতে চায়নি। কিন্তু তার পরও শপথ নিল। সংসদে গেল। সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের অনেক চেষ্টা করেছে। বিএনপি চেয়েছিল সংসদে বিরোধী দল হিসেবে তারা দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু সরকারি দলের কাছ থেকে যেভাবে আচরণ তারা আশা করেছিল, সে আচরণ তারা পায়নি। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি শুরুতেই সাংঘাতিকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এর পরও আমি মনে করি, বিরোধী দল আরো দায়িত্বশীল হতে পারত। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সংসদে যাওয়া উচিত ছিল বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। তবে এখানে সরকারেরও কিছু দায়িত্ব ছিল। বিরোধী দলকে সংসদে টেনে ধরে রাখার দায়িত্ব সরকারি দল পালন করতে পারেনি বা এটাও বলা যায়, পালন করেনি। বিরোধী দল সংসদে না গেলে, নেওয়ার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা যথার্থ কি না? আমি মনে করি, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোও বিরোধী দলের ভূমিকা। এ ব্যাপারে বিএনপি যথেষ্ট উদ্যোগী। বিএনপি নিজেদের কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করছে। দেশজুড়ে বিএনপির যে ব্যাপ্তি এখন, যেভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, সভা-সমিতি হচ্ছে, তাতে আমি মনে করি, বিএনপির জনসমর্থন বাড়ছে। মানুষের অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করা বিরোধী দলের কাজ। সে কাজে বিএনপি সফল। সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা, ভুল ধরিয়ে দেওয়া- সংসদে এসব কাজ করা না গেলেও বাইরে করা হচ্ছে। রোজার পর নিশ্চয় এ কাজে নতুন বেগ আসবে, নতুন গতি পাবে।
কালের কণ্ঠ : আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসন্ন এমন কথা আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়? এই নতুন ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
মাহবুবুর রহমান : বিষয়টি আমি আমার মতো করে বলতে চাই। আমি মনে করি, গণতন্ত্রের শক্তিই হচ্ছে মূল শক্তি। গণতান্ত্রিক শক্তির বাইরে কোনো শক্তি আমরা গ্রহণ করতে পারি না। হ্যাঁ, অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। আসলে এসব কথার পেছনে কাজ করছে সরকারের ব্যর্থতা। সরকারের ব্যর্থতার কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা অস্থিরতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। আছে সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এ অস্থির অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষ পরিত্রাণ চাইবে। সরকার যদি আজ সুশাসন দিতে পারত, সরকার কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারত, তাহলে এই তৃতীয় শক্তি কিংবা আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের কথা আসত না। বাংলাদেশে যেহেতু সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন ছিল, স্বাভাবিকভাবেই এখানে তৃতীয় শক্তির ব্যাখ্যা নানাভাবে করা যায়।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচার প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
মাহবুবুর রহমান : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জনগণের দাবি। এটা হওয়া উচিত। এটা মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। বিচার শুরু না করলে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো। যুদ্ধাপরাধ ভয়ংকর অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ। পৃথিবীতে যেখানে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই অপরাধীদের চিহ্নিত করে কাঠগড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাংলাদেশে ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে। এখানে গণহত্যা হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে বাহিনী দণ্ডিত হলো তাদের বিচার আমরা করতে পারিনি। বাংলাদেশে যারা জড়িত ছিল সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের বিচার হচ্ছে। আমাদের কথা হচ্ছে, বিচারের বাণী যেন নীরবে-নিভৃতে না কাঁদে। আমরা চাই, বিচারটা যেন স্বচ্ছ হয়, ন্যায়সংগত হয়। এখানে অনেকের অনেক অবজারভেশন আছে। সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে বিচার করতে হবে। আমি আবারও বলতে চাই, যুদ্ধাপরাধ কখনো পুরনো হয় না, তামাদি হয় না। আমি চাই এই বিচার হোক। এই বিচার করা সরকারের একটা বড় দায়িত্ব।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
মাহবুবুর রহমান : খুবই সুন্দর প্রশ্ন। দেড় বছর একেবারে কম সময় নয়। একটা কথা আছে, মর্নিং শোজ দ্য ডে। কিন্তু এটা তো আর মর্নিং নয়। এখন তো বিকেল। সরকারের জন্য পড়ন্ত বেলা। এই গোধূলি বেলায় কী আর দেখব? তার পরও কিছু একটা করে দেখানো একেবারে অসম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, সরকার কিছু একটা করে দেখাবে, এটা একেবারেই অলৌকিক ব্যাপার। কিন্তু মিরাকল ডু হ্যাপেন। অলৌকিক ঘটনা এখনো ঘটে। প্রথম কথা হচ্ছে, সরকার যে মানুষের মঙ্গল করতে চায়, সরকারের নিজের মধ্যে এই বিশ্বাস আনতে হবে। সরকার যে ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আনতে চায়, বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, সেই ভাবমূর্তির উন্নয়ন ঘটাতে চায়- এ বিষয়গুলো সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে। এটা হচ্ছে পূর্বশর্ত। এই পূর্বশর্ত পূরণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি সংকল্পের ব্যাপার আছে। ধ্যান-ধারণার ব্যাপার আছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, প্রত্যাশা করতে চাই, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে। সব শেষ হয়ে গেছে, এটা এখনই বলা যাবে না। সরকার এখনো অনেক কিছু করতে পারে। সে জন্য প্রথমেই জনগণকে আস্থায় আনতে হবে। জনগণকে বিশ্বাসে নিয়ে, জনগণের বিশ্বাস অর্জন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে এখনো কল্যাণ সম্ভব। এখনো যোগ্য লোকদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা সম্ভব। দেশে অনেক জ্ঞানী ও গুণী মানুষ আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কালের কণ্ঠ : সম্প্র্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। বিরোধী দল সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
মাহবুবুর রহমান : আগেও বলেছি, গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশ। গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। বিষয়টি এখন একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকারের আচরণে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্র্রতি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বিএনপি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না তত্ত্বাবধায়ক সরকার? সরকারের প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দেখুন, নির্বাচনকালীন সরকার যে ব্যবস্থাতেই আসুক না কেন, সংকট কিন্তু একটা আছে। এ সংকট হচ্ছে আস্থার। আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সংলাপের বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি। এই যে গণতন্ত্রের কথা বললাম, এর বটমলাইন হচ্ছে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এখন এই নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আদৌ একটি নির্বাচন হবে- এটাই সন্দেহ হয়ে দেখা দিয়েছে। আগামী নির্বাচন কখন হবে, কিভাবে হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে সংকট আছে। সরকার বা প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বললেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে অনড়। সরকারের শরিকরাও বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। এটা এখন একটা বড় রাজনৈতিক সংকট। এ সংকট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আলোচনা তো হতেই হবে। গণতন্ত্রে যদি আমরা বিশ্বাসী হই, তাহলে গণতন্ত্রের ভাষা আলোচনায় আস্থা রাখতে হবে। আলোচনা করতে হবে। তবে দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রেখে আমরা নির্বাচন চাই না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিএনপিও দলীয় অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি এখন সবার কাছে পরিষ্কার বলে মনে করি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
লে. জে. মাহবুবুর রহমান : আপনাদের ধন্যবাদ। কালের কণ্ঠের পাঠকদের আমার অভিনন্দন।
No comments