চরাচর-স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে সন্তোষ গুপ্ত by আতাউর রহমান
'মৃত্যুর জানাজা মোরা কিছুতেই করিব না পাঠ/কবরেরও ঘুম ভাঙ্গে জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট'- এই অমর পঙ্ক্তিমালা প্রথমে দেখা গেছে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি শাসকদের গুলিতে নিহত লাশের ছবির ক্যাপশন হিসেবে। পরে কোনো কোনো সাপ্তাহিকের ব্যানার শিরোনামে এবং সবশেষে কিছু কিছু পোস্টারেও।
এই অমর পঙ্ক্তিমালার রচয়িতা ছিলেন কবি-সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষ গুপ্ত। ১৯৭২ সালের অনেক আগে থেকেই চলি্লশের দশকের শেষ ভাগ থেকেই তিনি ছিলেন দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক। সাধারণ মানুষের জন্য সহজ পাঠযোগ্য সংবাদ তৈরি, স্বচ্ছন্দ অনুবাদ, শুদ্ধ ভাষা প্রয়োগ এবং ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে যথার্থ শিরোনাম দিয়ে ঠিক সময়ে সংবাদ প্রকাশ করার বিষয়গুলো তিনি আমাদের হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। সম্পাদকীয় বিভাগের চেয়ে তিনি বেশি সময় দিতেন আমাদের নিউজ ডেস্কে। আসলে নিউজ ডেস্কই ছিল সম্ভবত তাঁর প্রাণ। হাতের মুঠোয় সিগারেট, সামনে ধূমায়িত চা নিয়ে বা না নিয়ে তিনি যখন-তখনই বসে যেতেন শিফট ইনচার্জ বা একজন শিক্ষানবিস রিপোর্টার বা সহসম্পাদকের পাশের খালি চেয়ারে। আর এ সময়টি ছিল তাঁর কাছ থেকে শব্দার্থ, বাক্যবিন্যাস, শিরোনাম- এককথায় পুরো খবরটি তৈরি করার কৌশল জেনে নেওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ। সংবাদ তৈরি, শিরোনাম, ছবির ক্যাপশন গদ্যে বা কবিতায় লেখার জন্য তাঁর দ্বারস্থ হয়নি এমন সহসম্পাদক বা শিফট ইনচার্জ সে সময় সংবাদে কেউ ছিল বলে জানা নেই।
আমাদের শিক্ষাগুরু সন্তোষ গুপ্ত ছিলেন আপাদমস্তক একজন কাজের মানুষ। কিন্তু কোথায় বসে কাজ করবেন, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। তবে নিউজ ডেস্কে বসেই তিনি অধিকাংশ সময় লিখতেন সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, রাজনৈতিক ভাষ্য, অনিরুদ্ধের কলাম, সাহিত্য সমালোচনা, কবিতা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ, দেখতেন চিঠিপত্র এমনকি বিজ্ঞাপনও অনুবাদ করতেন। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর অনুজ সহকর্মীদের শোনাতেন মাটি ও মানুষের কথা, তাঁর আজীবনের বিশ্বাস- সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তারে সংগ্রাম-লড়াইয়ের অনিবার্যতার কথা, আবার কখনো কখনো শোনাতেন কলকাতার চাকরি ত্যাগ করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের কথাও। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম আর তাঁর স্মৃতিশক্তি ও সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি-ইতিহাস-বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি দেখে বিস্মিত হতাম।
সব্যসাচী লেখক-সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি বরিশালের ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে। সন্তোষ গুপ্তের সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে সংবাদে যোগদানের মাধ্যমে। জেল থেকে ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়ার পর আবার তিনি সংবাদে ফিরে আসেন। পরে ১৯৬৪-৬৫ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দুই দফা তিনি কাজ করেন দৈনিক আজাদে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজাদে কাজ শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই আবার তিনি সংবাদে ফিরে আসেন। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন সংবাদে।
জীবনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমার প্রায় পাঁচ দশকই তিনি কাটিয়েছেন সাংবাদিকতায়, বিশ্বাস করেছেন স্বাধীনতা ও সাম্যবাদী আদর্শে, ধর্মনিরপেক্ষতায় ও মানবতাবাদে এবং আমৃত্যু করে গেছেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চা। প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, 'সারাটা জীবন তিনি পদচারণ করেছেন সাংবাদিকতা ও শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে। এই কলমকে তিনি ব্যবহার করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, উপনিবেশবাদের বিপক্ষে, সামরিকবাদের বিপক্ষে, আবার এই কলমকে নিয়োগ করেছেন শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তিনি কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন চিত্র সমালোচনা। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন আবেগ এবং চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রে চোখ। তিনি আবেগ দিয়ে শব্দ শানিত করেছেন এবং চোখ দিয়ে বিবেচনা করেছেন রং ও রেখা, আবার শিল্পের স্বভাব দিয়ে রাজনীতিকে বিবেচনা করেছেন।'
আতাউর রহমান
আমাদের শিক্ষাগুরু সন্তোষ গুপ্ত ছিলেন আপাদমস্তক একজন কাজের মানুষ। কিন্তু কোথায় বসে কাজ করবেন, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। তবে নিউজ ডেস্কে বসেই তিনি অধিকাংশ সময় লিখতেন সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, রাজনৈতিক ভাষ্য, অনিরুদ্ধের কলাম, সাহিত্য সমালোচনা, কবিতা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ, দেখতেন চিঠিপত্র এমনকি বিজ্ঞাপনও অনুবাদ করতেন। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর অনুজ সহকর্মীদের শোনাতেন মাটি ও মানুষের কথা, তাঁর আজীবনের বিশ্বাস- সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তারে সংগ্রাম-লড়াইয়ের অনিবার্যতার কথা, আবার কখনো কখনো শোনাতেন কলকাতার চাকরি ত্যাগ করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের কথাও। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম আর তাঁর স্মৃতিশক্তি ও সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি-ইতিহাস-বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি দেখে বিস্মিত হতাম।
সব্যসাচী লেখক-সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি বরিশালের ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে। সন্তোষ গুপ্তের সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে সংবাদে যোগদানের মাধ্যমে। জেল থেকে ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়ার পর আবার তিনি সংবাদে ফিরে আসেন। পরে ১৯৬৪-৬৫ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দুই দফা তিনি কাজ করেন দৈনিক আজাদে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজাদে কাজ শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই আবার তিনি সংবাদে ফিরে আসেন। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন সংবাদে।
জীবনের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমার প্রায় পাঁচ দশকই তিনি কাটিয়েছেন সাংবাদিকতায়, বিশ্বাস করেছেন স্বাধীনতা ও সাম্যবাদী আদর্শে, ধর্মনিরপেক্ষতায় ও মানবতাবাদে এবং আমৃত্যু করে গেছেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চা। প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, 'সারাটা জীবন তিনি পদচারণ করেছেন সাংবাদিকতা ও শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে। এই কলমকে তিনি ব্যবহার করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে, উপনিবেশবাদের বিপক্ষে, সামরিকবাদের বিপক্ষে, আবার এই কলমকে নিয়োগ করেছেন শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তিনি কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন চিত্র সমালোচনা। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন আবেগ এবং চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রে চোখ। তিনি আবেগ দিয়ে শব্দ শানিত করেছেন এবং চোখ দিয়ে বিবেচনা করেছেন রং ও রেখা, আবার শিল্পের স্বভাব দিয়ে রাজনীতিকে বিবেচনা করেছেন।'
আতাউর রহমান
No comments