মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যাঃ পাশ্চাত্যের নীরবতা
পবিত্রতম মাস রমজান অতিবাহিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা এখন রোজা পালনে ব্যস্ত। কিন্তু এ মাসেও মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা-নির্যাতন থেমে নেই। পাশাপাশি মসজিদে আজান দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নামাজ পড়তে দেয়া হচ্ছে না।
রমজান মাসে তারাবি নামাজ পড়ানোর অভিযোগে কয়েকজন ইমামকে আটক করা হয়েছে বলে এরইমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে। গত প্রায় দুই মাস ধরে চলা মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান নিহত হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গারা দাবি করেছেন।
গত ২৮ জুন একদিনের হামলায় নিহত হয়েছে সাড়ে ছয়শ' রোহিঙ্গা মুসলমান। কিন্তু এসব খবর বিশ্বের মিডিয়ায় খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলমান হওয়ার কারণেই পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় এসব খবর গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং একই কারণে পশ্চিমা বিশ্ব এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে।
মিয়ানমার স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার মাত্র ১৪ বছর পর মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এরপর ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমেও বেসামরিক পোশাকের সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল থেইন সেইন হচ্ছেন সাবেক সামরিক জান্তা। তিনি ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে সেদেশ থেকে বের করে দেয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন অথবা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার পরিচালিত আশ্রয় শিবিরে পাঠানোই রোহিঙ্গা সমস্যার 'একমাত্র সমাধান'। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়নের ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। গত কয়েক দশক ধরেই ওই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।
সেই ১৯৪২ সালের কথা। সে বছর ২৮ মার্চ উগ্র বৌদ্ধরা রাখাইনে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭০ সালের পর থেকে সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। এর আগেই যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান সরকারি চাকুরি নিয়েছিল তারাও ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের পাশাপাশি হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করাই দেশটির সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য।
রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বিতাড়নের কৌশল হিসেবে ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রকাশ করে। এই আইনে মিয়ানমারে তিন ধরনের নাগরিকত্বের বিধান রাখা হয়। এগুলো হলো-পূর্ণাঙ্গ,সহযোগী এবং অভিবাসী নাগরিক। ওই আইনে বলা হয়,১৮২৩ সালে মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে সেদেশে বাস করা ১৩৫টি গোত্রভুক্ত মানুষই মিয়ানমারের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। রোহিঙ্গারা এর অন্তর্ভূক্ত নয় বলে তারা ঘোষণা করে। সামরিক সরকার দাবি করে, রোহিঙ্গা বলে কোন গোত্র বা জনগোষ্ঠী তাদের দেশে নেই এবং কখনো ছিলোও না। রোহিঙ্গা মুসলমানরা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে গিয়ে অবৈধভাবে বসতি গড়ে তুলেছে বলে তারা দাবি করে।
নাগরিকত্ব আইনে 'সহযোগী নাগরিক' হিসেবে কেবল ওই সব ব্যক্তিকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, যারা ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব অ্যাক্টে এর আগেই আবেদন করে রেখেছিল। এ ছাড়া 'অভিবাসী নাগরিক' হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আইনে কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, মিয়ানমারের স্বাধীনতার আগে সেদেশে প্রবেশ করার বিষয়ে দলিল-প্রমাণ পেশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় ভাষায় দক্ষ হতে হবে। শত শত বছর ধরে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেদেশে প্রবেশের বিষয়ে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার শর্ত ছিল একেবারেই অযৌক্তিক। এ ছাড়া, রোহিঙ্গা মুসলমানরা সাধারণত বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন এবং নির্যাতিত ও বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই নিরক্ষর। কাজেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রভাষায় নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল,তা ছিল রোহিঙ্গা বিরোধী। রোহিঙ্গাদেরকে যে, কোনোভাবেই নাগরিকত্ব দেয়া হবে না, সে বিষয়ে তারা আগে থেকেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। কাজেই নতুন আইনেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পায়নি। ফলে আইন অনুযায়ী তারা হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় রাষ্ট্রবিহীন এক বড় জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা মুসলমান সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নাগরিক অধিকারতো দূরের কথা, গোটা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলকেই এক ধরনের কারাগারে পরিণত করে রাখা হয়েছে। নিজ গ্রামের বাইরে যাওয়ার অধিকারটুকু পর্যন্ত তাদের নেই। মিয়ানমারের অন্য কোনো অঞ্চলে যাওয়াতো কল্পনাই করতে পারে না রোহিঙ্গারা। পাশের গ্রামে যাওয়ার জন্যও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকার কাছ থেকে ট্রাভেল পাস নিতে হয়।
কিন্তু সেই ট্রাভেল পাস পাওয়াও অত্যন্ত কঠিন। এ জন্য নাসাকা বাহিনীকে দিতে হয় বড় অঙ্কের ঘুষ। ট্রাভেল পাসে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে গ্রামে ফিরতে না পারলে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার অধিকার হারাতে হয় এবং তখন ঠাঁই হয় কারাগারে। যাইহোক, এরপর ১৯৯০ সালে আরাকান রাজ্যে স্থানীয় আইন জারি করা হয়। আইনটিতে আরাকানে বাস করা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই আইন অনুযায়ী এই অঞ্চলে বাস করা রোহিঙ্গাদের বিয়ের আগে সরকারি অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এই অনুমোদন দেয়ার দায়িত্বেও রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা। সেই বিয়ের অনুমোদন পাওয়া খুবই কঠিন। সরকারের নির্ধারিত ফি'র পাশপাশি এ জন্য বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয় নাসাকা বাহিনীকে। তার পরও বিয়ের অনুমতি পেতে অধিকাংশ সময় বছরের পর বছর চলে যায়। তাই রোহিঙ্গাদের পক্ষে বৈধভাবে বিয়ে করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া, আবেদনের সঙ্গে হবু নবদম্পতিকে মুচলেকা দিয়ে বলতে হয় যে, তারা দুইয়ের বেশি সন্তান নেবে না।
দীর্ঘদিন ধরে বৈধভাবে বিয়ে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হওয়ায় রোহিঙ্গাদের পারিবারিক জীবন হয়ে পড়েছে অমানবিক। বিয়ের জন্য তথাকথিত অনুমোদন পাওয়ার আগেই যেসব রোহিঙ্গা মুসলিম ধর্মমতে বিয়ে করছে, তারা সন্তান নিতে পারছে না।
রোহিঙ্গাদের জন্য এখন সরকারি চাকরি তাদের জন্য নিষিদ্ধ। রাখাইনের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। কিন্তু চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রেও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অতি গুরুতর অসুস্থ রোগীকেও গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গারা বৈষম্যের শিকার। আরাকানের খুব কম সংখ্যক মুসলমানই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হতে পেরেছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এমনিতেই স্কুলের সংখ্যা খুব কম। আর গ্রামের বাইরের স্কুলে পড়তে যেতে চাইলেও সেই ট্রাভেল পাস নেয়ার কঠিন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। আর পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করে কোনভাবে উচ্চ শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার অনুমতি পায় না রোহিঙ্গারা। এই হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা। কিন্তু এসব কিছু জেনেও পাশ্চাত্যসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। মুসলমান হওয়ার কারণেই তারা এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। এ অবস্থায় অন্ততঃ মুসলিম বিশ্বের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ আশা করছে নিগৃহিত রোহিঙ্গা মুসলমানেরা।
গত ২৮ জুন একদিনের হামলায় নিহত হয়েছে সাড়ে ছয়শ' রোহিঙ্গা মুসলমান। কিন্তু এসব খবর বিশ্বের মিডিয়ায় খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলমান হওয়ার কারণেই পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় এসব খবর গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং একই কারণে পশ্চিমা বিশ্ব এমনকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে।
মিয়ানমার স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার মাত্র ১৪ বছর পর মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এরপর ২০১০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমেও বেসামরিক পোশাকের সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল থেইন সেইন হচ্ছেন সাবেক সামরিক জান্তা। তিনি ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে সেদেশ থেকে বের করে দেয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন অথবা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার পরিচালিত আশ্রয় শিবিরে পাঠানোই রোহিঙ্গা সমস্যার 'একমাত্র সমাধান'। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়নের ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। গত কয়েক দশক ধরেই ওই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।
সেই ১৯৪২ সালের কথা। সে বছর ২৮ মার্চ উগ্র বৌদ্ধরা রাখাইনে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭০ সালের পর থেকে সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। এর আগেই যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান সরকারি চাকুরি নিয়েছিল তারাও ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের পাশাপাশি হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করাই দেশটির সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য।
রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বিতাড়নের কৌশল হিসেবে ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রকাশ করে। এই আইনে মিয়ানমারে তিন ধরনের নাগরিকত্বের বিধান রাখা হয়। এগুলো হলো-পূর্ণাঙ্গ,সহযোগী এবং অভিবাসী নাগরিক। ওই আইনে বলা হয়,১৮২৩ সালে মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে সেদেশে বাস করা ১৩৫টি গোত্রভুক্ত মানুষই মিয়ানমারের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। রোহিঙ্গারা এর অন্তর্ভূক্ত নয় বলে তারা ঘোষণা করে। সামরিক সরকার দাবি করে, রোহিঙ্গা বলে কোন গোত্র বা জনগোষ্ঠী তাদের দেশে নেই এবং কখনো ছিলোও না। রোহিঙ্গা মুসলমানরা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে গিয়ে অবৈধভাবে বসতি গড়ে তুলেছে বলে তারা দাবি করে।
নাগরিকত্ব আইনে 'সহযোগী নাগরিক' হিসেবে কেবল ওই সব ব্যক্তিকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, যারা ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব অ্যাক্টে এর আগেই আবেদন করে রেখেছিল। এ ছাড়া 'অভিবাসী নাগরিক' হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আইনে কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, মিয়ানমারের স্বাধীনতার আগে সেদেশে প্রবেশ করার বিষয়ে দলিল-প্রমাণ পেশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় ভাষায় দক্ষ হতে হবে। শত শত বছর ধরে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেদেশে প্রবেশের বিষয়ে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার শর্ত ছিল একেবারেই অযৌক্তিক। এ ছাড়া, রোহিঙ্গা মুসলমানরা সাধারণত বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন এবং নির্যাতিত ও বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই নিরক্ষর। কাজেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রভাষায় নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল,তা ছিল রোহিঙ্গা বিরোধী। রোহিঙ্গাদেরকে যে, কোনোভাবেই নাগরিকত্ব দেয়া হবে না, সে বিষয়ে তারা আগে থেকেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল। কাজেই নতুন আইনেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পায়নি। ফলে আইন অনুযায়ী তারা হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় রাষ্ট্রবিহীন এক বড় জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা মুসলমান সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নাগরিক অধিকারতো দূরের কথা, গোটা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলকেই এক ধরনের কারাগারে পরিণত করে রাখা হয়েছে। নিজ গ্রামের বাইরে যাওয়ার অধিকারটুকু পর্যন্ত তাদের নেই। মিয়ানমারের অন্য কোনো অঞ্চলে যাওয়াতো কল্পনাই করতে পারে না রোহিঙ্গারা। পাশের গ্রামে যাওয়ার জন্যও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকার কাছ থেকে ট্রাভেল পাস নিতে হয়।
কিন্তু সেই ট্রাভেল পাস পাওয়াও অত্যন্ত কঠিন। এ জন্য নাসাকা বাহিনীকে দিতে হয় বড় অঙ্কের ঘুষ। ট্রাভেল পাসে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে গ্রামে ফিরতে না পারলে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার অধিকার হারাতে হয় এবং তখন ঠাঁই হয় কারাগারে। যাইহোক, এরপর ১৯৯০ সালে আরাকান রাজ্যে স্থানীয় আইন জারি করা হয়। আইনটিতে আরাকানে বাস করা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই আইন অনুযায়ী এই অঞ্চলে বাস করা রোহিঙ্গাদের বিয়ের আগে সরকারি অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এই অনুমোদন দেয়ার দায়িত্বেও রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা। সেই বিয়ের অনুমোদন পাওয়া খুবই কঠিন। সরকারের নির্ধারিত ফি'র পাশপাশি এ জন্য বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিতে হয় নাসাকা বাহিনীকে। তার পরও বিয়ের অনুমতি পেতে অধিকাংশ সময় বছরের পর বছর চলে যায়। তাই রোহিঙ্গাদের পক্ষে বৈধভাবে বিয়ে করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া, আবেদনের সঙ্গে হবু নবদম্পতিকে মুচলেকা দিয়ে বলতে হয় যে, তারা দুইয়ের বেশি সন্তান নেবে না।
দীর্ঘদিন ধরে বৈধভাবে বিয়ে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হওয়ায় রোহিঙ্গাদের পারিবারিক জীবন হয়ে পড়েছে অমানবিক। বিয়ের জন্য তথাকথিত অনুমোদন পাওয়ার আগেই যেসব রোহিঙ্গা মুসলিম ধর্মমতে বিয়ে করছে, তারা সন্তান নিতে পারছে না।
রোহিঙ্গাদের জন্য এখন সরকারি চাকরি তাদের জন্য নিষিদ্ধ। রাখাইনের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। কিন্তু চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কারণে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রেও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অতি গুরুতর অসুস্থ রোগীকেও গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গারা বৈষম্যের শিকার। আরাকানের খুব কম সংখ্যক মুসলমানই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হতে পেরেছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এমনিতেই স্কুলের সংখ্যা খুব কম। আর গ্রামের বাইরের স্কুলে পড়তে যেতে চাইলেও সেই ট্রাভেল পাস নেয়ার কঠিন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। আর পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করে কোনভাবে উচ্চ শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার অনুমতি পায় না রোহিঙ্গারা। এই হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা। কিন্তু এসব কিছু জেনেও পাশ্চাত্যসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। মুসলমান হওয়ার কারণেই তারা এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। এ অবস্থায় অন্ততঃ মুসলিম বিশ্বের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ আশা করছে নিগৃহিত রোহিঙ্গা মুসলমানেরা।
No comments