আজ-কাল-পরশু- প্রত্যাশিত নেতা দেশ কবে পাবে? by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন: ‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন। এঁরা চলে গেলে বাংলাদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ তিনি রংপুরে এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।
এরশাদের বক্তব্য অনেকটা মাইনাস টু ফর্মুলারই প্রতিধ্বনি।
এরশাদের বক্তব্য অনেকটা মাইনাস টু ফর্মুলারই প্রতিধ্বনি।
ভাগ্য ভালো, এই মন্তব্য নাগরিক সমাজের কোনো নেতা করেননি বা কোনো সংবাদপত্রের কলামিস্টও লেখেননি। যদি তা হতো, আওয়ামী সমর্থক কলামিস্টরা নাগরিক সমাজের নেতাদের তুলাধোনা করে ফেলতেন। আর বলতেন, ‘এই মুখচেনা সুশীল সমাজের লোকেরা পেছনের দরজা দিয়ে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে চাইছে।’ যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেল। ভিন্ন ভাষায় মাইনাস টুর এই দাবি তুলেছেন খোদ এরশাদ।
মহাজোটের অন্যতম নেতারই যদি এ ধারণা হয়, তাহলে জোটের বাইরে অন্য দলের নেতা, সিভিল সোসাইটির নেতা বা কলামিস্টরা এ রকম কথা বললে খুব বেশি দোষ হবে কি? মহাজোটের একজন নেতা হিসেবে তিনি অন্তত একজন নেত্রীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আরেকজন নেত্রীর শাসনকালও তিনি ভালোভাবে নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই তাঁর মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহাজোটের একজন নেতা হিসেবে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন।
এরশাদ আরও বলেছেন, ‘এঁরা চলে গেলে বাংলাদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এই কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ এবং আলোচনার দাবি রাখে। যেমন, দুই নেত্রীর শাসনকালে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। খালেদা জিয়ার কথা এখানে বেশি আনতে চাই না। কারণ, তিনি অতীত। গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি বলেই তো তিনি নির্বাচনে দৃষ্টান্তমূলকভাবে পরাজিত হয়েছেন। জনগণ তাঁকে তাঁর ব্যর্থতার জন্য উচিত শিক্ষা দিয়েছে। সেই শিক্ষা যদি তিনি উপলব্ধি করতে পারেন এবং নিজেকে ও দলকে সংশোধন করতে পারেন, তাহলে জনগণ তাঁকে ও তাঁর দলকে আবার সুযোগ দিতেও পারে। তবে তিনি যে নিজেদের সংশোধন করতে পেরেছেন, তা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।
আরেকজন নেত্রী এখন ক্ষমতায়। তিনি দল ও সরকার পরিচালনা করছেন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মতো। পরিবারতন্ত্র ও স্তাবকদের মিলিত রূপ হলো ক্ষমতাসীন দলের গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীর মনে যে ইচ্ছা জাগে, তার বাস্তবায়ন করে মন্ত্রিসভা। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে ‘দেশপ্রেমিক’ বললে দল ও সরকারকে তা মেনে নিতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত আরেকজন মন্ত্রী তদন্তের সুবিধার্থে পদত্যাগ করলে পরদিনই তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। মন্ত্রী করেছেন বটে, কিন্তু বস্তাভর্তি টাকার কোনো কার্যকর তদন্ত আর হচ্ছে না। আর সেই গাড়ির নিখোঁজ ড্রাইভারের ব্যাপারেও সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। যে ড্রাইভার দুর্নীতির মূল হোতা কে, তা বলতে পারতেন। তাই তিনি আজও নিখোঁজ।
টিভি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডেরও কোনো কূলকিনারা সরকার এখনো করতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘৪৮ ঘণ্টা’ এখনো শেষ হয়নি। অনেকে দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে নাকি সরকারের একটি মহলের দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ ছিল।
ইলিয়াস আলীকে কী বলা যায়? প্রয়াত? নাকি নিখোঁজ?
গত কয়েক দিনের সংবাদপত্রের প্রথম পাতা দেখলেই পাঠক জানতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে কী রকম সুশাসন চলছে। শনিবারের খবর হলো: এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, ‘সরকারকে দেওয়া করের চাইতে পুলিশকে বেশি ঘুষ দেয় বাংলাদেশের মানুষ। পুলিশ হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের কারখানা। দুর্নীতিই তাদের চেইন অব কমান্ড। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার বিনিময়ে সব অপরাধের বিচার থেকে রেহাই পায় পুলিশ।’ (যুগান্তর, ১১ আগস্ট)। বিএনপি আমলেও পুলিশের চিত্র প্রায় একই। ঘুরেফিরে দুই নেত্রী।
যুগান্তর আরও লিখেছে, দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ। সরকারের কঠোর নজরদারির অভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক প্রতারক চক্র। তাদের প্রতারণার কিছু নমুনা: ডেসটিনি: তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা পাচার, যুবক: চার হাজার দুই শ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ইউনিপেটুইউ: সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট, আইটিসিএল: ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ। (যুগান্তর, ১১ আগস্ট)।
দুর্নীতির আখড়া প্রাইভেট এয়ারলাইনস। চোরাচালান, আদম পাচার আর জমি দখলের মহোৎসব। (যুগান্তর, ১০ আগস্ট)।
উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্প: আইন ভেঙে দুই সাংসদের ব্যবসা। ৭৯টি ভবনের মধ্যে ৭৭টি ভবনের কাজ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দুই সাংসদ। (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট)।
জাল-জালিয়াতি করে দীর্ঘ এক যুগ বিমান ব্যবসা চালিয়েছে জিএমজি। (যুগান্তর, ৯ আগস্ট)
এক কোটি ভিজিএফ কার্ড আওয়ামী নেতাদের দখলে। (আমার দেশ, ৭ আগস্ট)
এসইসির তদন্ত প্রতিবেদন: ৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পাঁচ পরিবার, দুই ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠান ৪৩৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। হিসাবে জমা আছে আরও ২৫০ কোটি টাকা। তদন্ত করে প্রতিবেদন গোপন করেছে এসইসি। (প্রথম আলো, ৮ আগস্ট)।
বেপরোয়া চাঁদাবাজি। চট্টগ্রামে সার উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধ। (দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম, ৮ আগস্ট)
গত এক সপ্তাহের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম থেকে পাঠক অনুভব করতে পারবেন, বর্তমান সরকার দেশকে কী সুশাসন উপহার দিয়েছে। এটা এক সপ্তাহের চিত্র। সারা বছরের চিত্র সংকলন করলেও প্রায় একই চিত্র পাওয়া যাবে।
এরশাদ বলেছেন: ‘দুই নেত্রী চলে গেলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এখন চলছে গণতন্ত্রের নামে প্রধানমন্ত্রীর একানায়কতন্ত্র। আওয়ামী লীগ বা সরকারের নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে পাঠক দেখতে পাবেন, কী পদ্ধতিতে এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে। কনসালটেশন নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যে গণতন্ত্রে রয়েছে, তা কি দেখা যায়? অবশ্য পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা। কারণ, সরকারটা এক ব্যক্তির নয়। একটি দলের। তদুপরি মহাজোটের। ব্যক্তির চেয়ে দল ও জোট অনেক বড়। যদিও পরিবারতন্ত্রের কারণে আজকাল দুই দলেই দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে। এর ফলে দল পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। দলে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। এটা খুব উদ্বেগজনক। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, দুই নেত্রীই তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থেই এমন কিছু কাজ করেছেন ও করছেন, যার ফলে পুরো দলই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থে ও ব্যক্তি প্রতিহিংসায় পুরো দলকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা দলীয় নেতারা কীভাবে দেখছেন জানি না।
দুই নেত্রীর আমলেই গণতন্ত্রের চর্চা প্রধানত কয়েকটি নির্বাচনের মধ্যে সীমিত। এর মধ্যে সংসদ নির্বাচন প্রধান। কিন্তু দেশে বহু প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হয়নি। হতে দেওয়া হয়নি। অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে চলছে ঢাকা সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদগুলো। নির্বাচিত হয়েও উপজেলা পরিষদ সরকার কার্যকর করতে পারেনি। করতে চায়নি এমপিদের আবদার রক্ষায়। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, খোদ জাতীয় সংসদই দুই নেত্রীর আমলে কার্যকর হয়নি। যে গণতান্ত্রিক জাতীয় সংসদের জন্য এত দিনের লড়াই, তা দুই দলেরই অগণতান্ত্রিক আচরণে অকার্যকর রয়ে গেছে। গত দুই টার্ম জাতীয় সংসদ অকার্যকর রেখে আমরা আরও একটি সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ, দুই দলের কাছে গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন। কাজেই নির্বাচনটাই মুখ্য। নির্বাচিত হলে লুটপাটের ক্ষমতা পাওয়া যায়।
এরশাদ বলেছেন, ‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন।’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুই নেত্রী যদি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পারতেন, দেশে দুর্নীতি হ্রাস করতে পারতেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, সংঘাতময় রাজনীতি বন্ধ করতে পারতেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে পারতেন, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারতেন, তাহলে গত কুড়ি বছরে দেশের অনেক উন্নতি হতো। দুই নেত্রী তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দুই নেত্রীর আমলে দেশে কোনো উন্নতি হয়নি, তা কেউ দাবি করে না। কিছু উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। তবে তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। কুড়ি বছর কম সময় নয়। দেশের অনেকে মনে করেন, দেশকে বহুদূর এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে নেতৃত্বগুণ প্রয়োজন, তা এই দুই নেত্রীর মধ্যে নেই। নিছক পরিবারতন্ত্রের কারণে তাঁরা আজ দেশের প্রধান নির্বাহী হতে পেরেছেন। এই যদি আমাদের দেশের নেতৃত্বের কোয়ালিটি হয়, তাহলে দেশ সত্যিকার অর্থে পিছিয়ে না গেলেও এগোনোর সম্ভাবনা খুব কম। দেশবাসীকে এটা বুঝতে হবে। দেশবাসী যদি এই মানের নেতৃত্ব আবার নির্বাচিত করেন, দেশের অবস্থাও সে রকমই হবে। জনগণই কিন্তু নেতা নির্বাচন করেন। নেতারা বন্দুকের জোরে নেতৃত্বে আসেন না। কাজেই বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখলে নেতা নির্বাচনের সময় সেটা মনে রাখা দরকার। গত ২০ বছরের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা মনে রাখতে হবে।
‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন’—এই মন্তব্য করেছেন এমন একজন সেনাশাসক, যিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তাঁর আমলে দেশ সত্যিকার অর্থে অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। যদিও তাঁর শাসনামলে দেশে অনেক অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছিল, তবু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, গণতন্ত্রসহ সার্বিক অর্থে দেশ অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্বৈরাচারী শাসনকালের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা সংগ্রাম করে নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ অনেক শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছিল। আজ গণতান্ত্রিক আমলে (২০ বছর) দুই নেত্রী দেশের অবস্থা এমন করেছেন যে, পতিত স্বৈরাচারও বলার সুযোগ পেয়েছেন, ‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন।’ তিনি যে এ করম কঠোর কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন, তার জন্য দুই নেত্রীই দায়ী।
এরশাদ বলেছেন, ‘এঁরা চলে গেলে বাংলাদেশে সুশাসন ও সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছি না। এঁরা চলে গেলেই তা নিশ্চিত হবে, এমন দাবি করা যায় না। এঁরা চলে গেলে কারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁদের যোগ্যতা, দক্ষতা, দেশপ্রেম, নেতৃত্বগুণসহ বহু কিছুর ওপর তা নির্ভর করছে। আমাদের রাজনীতির অঙ্গনের দিকে তাকালে নেতৃত্বের ব্যাপারে খুব আশাবাদী হওয়া যায় না। আবার রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে থেকেও অনেকে নেতৃত্ব মানতে চায় না। ভারতে ড. মনমোহন সিং একজন ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। এটা একটা জটিল সমস্যা। আমরা সবাই দেশের উন্নতি চাই। আবার গণতন্ত্রও চাই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সে রকম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব পাওয়ার সুযোগ বর্তমানে খুব সীমিত।
আমাদের দেশ কি সে রকম নেতৃত্ব কখনো পাবে, যাঁর নেতৃত্বে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
মহাজোটের অন্যতম নেতারই যদি এ ধারণা হয়, তাহলে জোটের বাইরে অন্য দলের নেতা, সিভিল সোসাইটির নেতা বা কলামিস্টরা এ রকম কথা বললে খুব বেশি দোষ হবে কি? মহাজোটের একজন নেতা হিসেবে তিনি অন্তত একজন নেত্রীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আরেকজন নেত্রীর শাসনকালও তিনি ভালোভাবে নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই তাঁর মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহাজোটের একজন নেতা হিসেবে তিনি উপলব্ধি করেছেন যে দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন।
এরশাদ আরও বলেছেন, ‘এঁরা চলে গেলে বাংলাদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এই কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ এবং আলোচনার দাবি রাখে। যেমন, দুই নেত্রীর শাসনকালে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। খালেদা জিয়ার কথা এখানে বেশি আনতে চাই না। কারণ, তিনি অতীত। গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি বলেই তো তিনি নির্বাচনে দৃষ্টান্তমূলকভাবে পরাজিত হয়েছেন। জনগণ তাঁকে তাঁর ব্যর্থতার জন্য উচিত শিক্ষা দিয়েছে। সেই শিক্ষা যদি তিনি উপলব্ধি করতে পারেন এবং নিজেকে ও দলকে সংশোধন করতে পারেন, তাহলে জনগণ তাঁকে ও তাঁর দলকে আবার সুযোগ দিতেও পারে। তবে তিনি যে নিজেদের সংশোধন করতে পেরেছেন, তা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।
আরেকজন নেত্রী এখন ক্ষমতায়। তিনি দল ও সরকার পরিচালনা করছেন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির মতো। পরিবারতন্ত্র ও স্তাবকদের মিলিত রূপ হলো ক্ষমতাসীন দলের গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীর মনে যে ইচ্ছা জাগে, তার বাস্তবায়ন করে মন্ত্রিসভা। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে ‘দেশপ্রেমিক’ বললে দল ও সরকারকে তা মেনে নিতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত আরেকজন মন্ত্রী তদন্তের সুবিধার্থে পদত্যাগ করলে পরদিনই তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। মন্ত্রী করেছেন বটে, কিন্তু বস্তাভর্তি টাকার কোনো কার্যকর তদন্ত আর হচ্ছে না। আর সেই গাড়ির নিখোঁজ ড্রাইভারের ব্যাপারেও সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। যে ড্রাইভার দুর্নীতির মূল হোতা কে, তা বলতে পারতেন। তাই তিনি আজও নিখোঁজ।
টিভি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডেরও কোনো কূলকিনারা সরকার এখনো করতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘৪৮ ঘণ্টা’ এখনো শেষ হয়নি। অনেকে দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে নাকি সরকারের একটি মহলের দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ ছিল।
ইলিয়াস আলীকে কী বলা যায়? প্রয়াত? নাকি নিখোঁজ?
গত কয়েক দিনের সংবাদপত্রের প্রথম পাতা দেখলেই পাঠক জানতে পারবেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে কী রকম সুশাসন চলছে। শনিবারের খবর হলো: এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, ‘সরকারকে দেওয়া করের চাইতে পুলিশকে বেশি ঘুষ দেয় বাংলাদেশের মানুষ। পুলিশ হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের কারখানা। দুর্নীতিই তাদের চেইন অব কমান্ড। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার বিনিময়ে সব অপরাধের বিচার থেকে রেহাই পায় পুলিশ।’ (যুগান্তর, ১১ আগস্ট)। বিএনপি আমলেও পুলিশের চিত্র প্রায় একই। ঘুরেফিরে দুই নেত্রী।
যুগান্তর আরও লিখেছে, দেশজুড়ে প্রতারণার ফাঁদ। সরকারের কঠোর নজরদারির অভাবে দেশের সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক প্রতারক চক্র। তাদের প্রতারণার কিছু নমুনা: ডেসটিনি: তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা পাচার, যুবক: চার হাজার দুই শ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ইউনিপেটুইউ: সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট, আইটিসিএল: ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ। (যুগান্তর, ১১ আগস্ট)।
দুর্নীতির আখড়া প্রাইভেট এয়ারলাইনস। চোরাচালান, আদম পাচার আর জমি দখলের মহোৎসব। (যুগান্তর, ১০ আগস্ট)।
উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্প: আইন ভেঙে দুই সাংসদের ব্যবসা। ৭৯টি ভবনের মধ্যে ৭৭টি ভবনের কাজ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দুই সাংসদ। (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট)।
জাল-জালিয়াতি করে দীর্ঘ এক যুগ বিমান ব্যবসা চালিয়েছে জিএমজি। (যুগান্তর, ৯ আগস্ট)
এক কোটি ভিজিএফ কার্ড আওয়ামী নেতাদের দখলে। (আমার দেশ, ৭ আগস্ট)
এসইসির তদন্ত প্রতিবেদন: ৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পাঁচ পরিবার, দুই ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠান ৪৩৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। হিসাবে জমা আছে আরও ২৫০ কোটি টাকা। তদন্ত করে প্রতিবেদন গোপন করেছে এসইসি। (প্রথম আলো, ৮ আগস্ট)।
বেপরোয়া চাঁদাবাজি। চট্টগ্রামে সার উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধ। (দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম, ৮ আগস্ট)
গত এক সপ্তাহের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম থেকে পাঠক অনুভব করতে পারবেন, বর্তমান সরকার দেশকে কী সুশাসন উপহার দিয়েছে। এটা এক সপ্তাহের চিত্র। সারা বছরের চিত্র সংকলন করলেও প্রায় একই চিত্র পাওয়া যাবে।
এরশাদ বলেছেন: ‘দুই নেত্রী চলে গেলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এখন চলছে গণতন্ত্রের নামে প্রধানমন্ত্রীর একানায়কতন্ত্র। আওয়ামী লীগ বা সরকারের নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে পাঠক দেখতে পাবেন, কী পদ্ধতিতে এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে। কনসালটেশন নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যে গণতন্ত্রে রয়েছে, তা কি দেখা যায়? অবশ্য পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা। কারণ, সরকারটা এক ব্যক্তির নয়। একটি দলের। তদুপরি মহাজোটের। ব্যক্তির চেয়ে দল ও জোট অনেক বড়। যদিও পরিবারতন্ত্রের কারণে আজকাল দুই দলেই দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে। এর ফলে দল পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। দলে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। এটা খুব উদ্বেগজনক। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, দুই নেত্রীই তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থেই এমন কিছু কাজ করেছেন ও করছেন, যার ফলে পুরো দলই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থে ও ব্যক্তি প্রতিহিংসায় পুরো দলকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা দলীয় নেতারা কীভাবে দেখছেন জানি না।
দুই নেত্রীর আমলেই গণতন্ত্রের চর্চা প্রধানত কয়েকটি নির্বাচনের মধ্যে সীমিত। এর মধ্যে সংসদ নির্বাচন প্রধান। কিন্তু দেশে বহু প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হয়নি। হতে দেওয়া হয়নি। অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে চলছে ঢাকা সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদগুলো। নির্বাচিত হয়েও উপজেলা পরিষদ সরকার কার্যকর করতে পারেনি। করতে চায়নি এমপিদের আবদার রক্ষায়। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, খোদ জাতীয় সংসদই দুই নেত্রীর আমলে কার্যকর হয়নি। যে গণতান্ত্রিক জাতীয় সংসদের জন্য এত দিনের লড়াই, তা দুই দলেরই অগণতান্ত্রিক আচরণে অকার্যকর রয়ে গেছে। গত দুই টার্ম জাতীয় সংসদ অকার্যকর রেখে আমরা আরও একটি সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ, দুই দলের কাছে গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন। কাজেই নির্বাচনটাই মুখ্য। নির্বাচিত হলে লুটপাটের ক্ষমতা পাওয়া যায়।
এরশাদ বলেছেন, ‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন।’ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুই নেত্রী যদি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পারতেন, দেশে দুর্নীতি হ্রাস করতে পারতেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, সংঘাতময় রাজনীতি বন্ধ করতে পারতেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে পারতেন, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারতেন, তাহলে গত কুড়ি বছরে দেশের অনেক উন্নতি হতো। দুই নেত্রী তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দুই নেত্রীর আমলে দেশে কোনো উন্নতি হয়নি, তা কেউ দাবি করে না। কিছু উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। তবে তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। কুড়ি বছর কম সময় নয়। দেশের অনেকে মনে করেন, দেশকে বহুদূর এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে নেতৃত্বগুণ প্রয়োজন, তা এই দুই নেত্রীর মধ্যে নেই। নিছক পরিবারতন্ত্রের কারণে তাঁরা আজ দেশের প্রধান নির্বাহী হতে পেরেছেন। এই যদি আমাদের দেশের নেতৃত্বের কোয়ালিটি হয়, তাহলে দেশ সত্যিকার অর্থে পিছিয়ে না গেলেও এগোনোর সম্ভাবনা খুব কম। দেশবাসীকে এটা বুঝতে হবে। দেশবাসী যদি এই মানের নেতৃত্ব আবার নির্বাচিত করেন, দেশের অবস্থাও সে রকমই হবে। জনগণই কিন্তু নেতা নির্বাচন করেন। নেতারা বন্দুকের জোরে নেতৃত্বে আসেন না। কাজেই বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখলে নেতা নির্বাচনের সময় সেটা মনে রাখা দরকার। গত ২০ বছরের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা মনে রাখতে হবে।
‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন’—এই মন্তব্য করেছেন এমন একজন সেনাশাসক, যিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তাঁর আমলে দেশ সত্যিকার অর্থে অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। যদিও তাঁর শাসনামলে দেশে অনেক অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছিল, তবু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, গণতন্ত্রসহ সার্বিক অর্থে দেশ অনেক পিছিয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্বৈরাচারী শাসনকালের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা সংগ্রাম করে নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ অনেক শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছিল। আজ গণতান্ত্রিক আমলে (২০ বছর) দুই নেত্রী দেশের অবস্থা এমন করেছেন যে, পতিত স্বৈরাচারও বলার সুযোগ পেয়েছেন, ‘দুই নেত্রী দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন।’ তিনি যে এ করম কঠোর কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন, তার জন্য দুই নেত্রীই দায়ী।
এরশাদ বলেছেন, ‘এঁরা চলে গেলে বাংলাদেশে সুশাসন ও সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছি না। এঁরা চলে গেলেই তা নিশ্চিত হবে, এমন দাবি করা যায় না। এঁরা চলে গেলে কারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁদের যোগ্যতা, দক্ষতা, দেশপ্রেম, নেতৃত্বগুণসহ বহু কিছুর ওপর তা নির্ভর করছে। আমাদের রাজনীতির অঙ্গনের দিকে তাকালে নেতৃত্বের ব্যাপারে খুব আশাবাদী হওয়া যায় না। আবার রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে থেকেও অনেকে নেতৃত্ব মানতে চায় না। ভারতে ড. মনমোহন সিং একজন ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। এটা একটা জটিল সমস্যা। আমরা সবাই দেশের উন্নতি চাই। আবার গণতন্ত্রও চাই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সে রকম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব পাওয়ার সুযোগ বর্তমানে খুব সীমিত।
আমাদের দেশ কি সে রকম নেতৃত্ব কখনো পাবে, যাঁর নেতৃত্বে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments