সর্বোচ্চ ২০ গুণ বাড়ছে খাদ্য ব্যবসার লাইসেন্স ফি-মজুদের সময় ও পরিমাণ নির্ধারণ by আশরাফুল হক রাজীব

পাইকারি ও খুচরাসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ব্যবসার লাইসেন্স ফি বাড়ছে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত। একই সঙ্গে কোনো খাদ্যদ্রব্য কত দিন এবং কী পরিমাণে মজুদ করা যাবে, তা পুনর্নির্ধারণ করেছে সরকার। গতকাল বুধবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।


খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'খাদ্য মজুদের সময়, পরিমাণ ও ব্যবসার লাইসেন্স ফি পুনর্নির্ধারণ করেছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দু-এক দিনের মধ্যে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়েছে। এরপর অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে এসআরও জারি করা হবে।' পুরো প্রক্রিয়াটি দ্রুত শেষ করা হবে বলে জানান খাদ্যমন্ত্রী।
বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খাদ্য আমদানির লাইসেন্স ফি ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নবায়ন ফি ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। পাইকারি খাদ্য ব্যবসায়ী ও আড়তদারের লাইসেন্স ফি ৫০০ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। এখন থেকে এই ব্যবসার নবায়ন ফি আড়াই হাজার টাকা হবে, যা আগে ছিল ২৫০ টাকা। খুচরা খাদ্য ব্যবসার লাইসেন্স ফি ২০ গুণ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নবায়ন ফি ধরা হয়েছে ৫০০ টাকা। বর্তমানে এই ফি মাত্র ২৫ টাকা। মেজর কম্প্যাক্ট ময়দাকল ব্যবসার লাইসেন্স ফি ৫০০ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। এর লাইসেন্স নবায়ন ফি ২৫০ থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। রোলার ময়দাকল ব্যবসার লাইসেন্স ফি দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক হাজার, আটাচাক্কি পাঁচ গুণ বাড়িয়ে ৫০০, অটোমেটিক রাইস
মিল ১০ গুণ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা, মেজর রাইস মিল আট গুণ বাড়িয়ে চার হাজার এবং হাস্কিং রাইস মিল ব্যবসার জন্য লাইসেন্স ফি ১০ গুণ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। এসব ব্যবসার জন্য প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। নবায়ন ফি হবে লাইসেন্স ফির অর্ধেক।
কোন পণ্য কত দিন মজুদ করা যাবে
পাইকারি ব্যবসায়ীরা ধান ও চাল সর্বোচ্চ ৩০০ টন পর্যন্ত মজুদ করতে পারবেন। আর এই মজুদ রাখা যাবে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। খুচরা পর্যায়ে ১৫ টন সর্বোচ্চ ১৫ দিনের জন্য মজুদ রাখা যাবে। পাইকারি পর্যায়ে গম ও গমজাত দ্রব্য ২০০ টন মজুদ রাখা যাবে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। খুচরা পর্যায়ে গম মজুদ করা যাবে ১৫ দিনের জন্য ১০ টন। পরিশোধিত চিনি পাইকারি পর্যায়ে ৫০ টন মজুদ করা যাবে ৩০ দিনের জন্য। খুচরা পর্যায়ে পাঁচ টন মজুদ করা যাবে ২০ দিনের জন্য। ভোজ্য তেল সয়াবিন ও পামঅয়েল ৩০ টন মজুদ করা যাবে ৩০ দিনের জন্য। খুচরা পর্যায়ে পাঁচ টন মজুদ করা যাবে ২০ দিন। ডাল পাইকারি পর্যায়ে মজুদ করা যাবে ৫০ টন এক মাসের জন্য। খুচরা পর্যায়ে মজুদ করা যাবে সর্বোচ্চ পাঁচ টন ২০ দিন। আমদানিকারকরা এসব পণ্য মোট ৬০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। মেজর, অটো ও হাস্কিং চালকল ব্যবসায়ীরা ১৫ দিনে যে পরিমাণ ধান থেকে চাল তৈরি করতে পারেন, এর পাঁচ গুণ ধান মজুদ করতে পারবেন। এসব চালকল ১৫ দিনে যা উৎপাদন করতে পারে তার দ্বিগুণ চাল মজুদ রাখা যাবে।
খাদ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মজুদবিরোধী আইন পুনর্বহাল করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে ২১ বছর আগে আইনটি স্থগিত করা হয়েছিল। আইনটি পুনর্বহাল করার কারণেই সরকার ব্যবসায়ীরা কোন খাদ্যদ্রব্য কত দিন মজুদ করতে পারবেন তা নির্ধারণ করতে পেরেছে। একই সঙ্গে খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 'দি ইস্ট বেঙ্গল (ফুড স্টাফস) প্রাইস কন্ট্রোল অ্যান্ড এন্টি হোর্ডং অর্ডার, ১৯৫৩' এবং 'দি ইস্ট পাকিস্তান কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটিজ ঋ্যাক্ট, ১৯৫৬' দুটির মাধ্যমে সরকার মজুদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এসব বিধিবিধানে খাদ্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সও নিতে হতো। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে ১৯৯১ সালে নির্বাহী আদেশে এসব বিধিবিধানের কিছু অংশ স্থগিত করা হয়। এসব বিধিবিধানের অভাবে ২০ বছর ধরে সরকার মজুদকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একই সঙ্গে লাইসেন্স প্রথা তুলে দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। এসব কারণে বিধিবিধানগুলো পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে, যার আলোকে খাদ্যদ্রব্যের মজুদসহ বিভিন্ন বিষয় যুগোপযোগী করা হবে।
মহাজোট সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে, তার অন্যতম ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। গত দুই বছরেও সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। উল্টো গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশের বেশি। বর্তমানে বাজারে ৩৫ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য সরকারের কোনো দাওয়াই কাজ করছে না। চালের মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার বছরের শুরুতেই ওএমএস এবং ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল সরবরাহ শুরু করে। কিন্তু এতে বাজারদরের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। বাধ্য হয়ে ওএমএসের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি চলতি মাস থেকেই চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে চালকল মালিকরা বিশাল মজুদ গড়ে তুলেছেন।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খাদ্যশস্য ব্যবসা ও ডিলারশিপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সময় বিধিবদ্ধ আইন জারি করা হয়। তার মধ্যে মজুদবিরোধী আদেশ ১৯৫৩ এবং ১৯৫৬ সালের অ্যাক্ট অন্যতম। এ আইনের মাধ্যমেই খাদ্যশস্যের লাইসেন্স প্রবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা ও মজুদ নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় সরকারি আদেশ জারি করে লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা কী পরিমাণ খাদ্যশস্য কত দিন মজুদ রাখতে পারবেন তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বস্তুত লাইসেন্স প্রথা খাদ্যশস্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। লাইসেন্স ছাড়া কেউ খাদ্যশস্যের ব্যবসা করতে পারতেন না। মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সরকার ১৯৮৯ সালে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ও ব্যবসায়ীদের মজুদ রাখাসংক্রান্ত এসআরও বাতিল করে। ১৯৯১ সালে খাদ্যশস্যের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিএনপি সরকার। এরপর থেকেই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ওপর সরকারের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

No comments

Powered by Blogger.