লিবিয়ার মরুভূমিতে বিপন্ন বাংলাদেশিদের আকুতি-আমাদের বাঁচান by মেহেদী হাসান
লিবিয়ায় সরকারবিরোধী তীব্র বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থানকারী প্রায় সব ক্যাম্পে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোনসহ তাঁদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার পর পিটিয়ে মরুভূমিতে বৃষ্টির মধ্যে বের করে দেওয়া হয়েছে।
এক টুকরো রুটি কেনার অবস্থাও এখন তাঁদের নেই। বেশির ভাগই খোলা আকাশের নিচে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিপন্ন বাংলাদেশিরা দূতাবাসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাউমাউ করে কাঁদছেন আর উদ্ধারের জন্য মিনতি জানাচ্ছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সর্বশেষ অবস্থা জানতে গতকাল বুধবার বিকেল ৫টার দিকে ঢাকায় কালের কণ্ঠ কার্যালয় থেকে টেলিফোনে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাস সূত্র জানায়, লিবিয়ার পরিস্থিতি বর্ণনাতীত। হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থানকারী প্রায় সব ক্যাম্পেই লুটপাট হয়েছে। এরপর পথে বসেছেন বাংলাদেশিরা। লিবিয়ায় অবস্থানরত ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের বেশির ভাগের অবস্থাই এমন কি না জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র কালের কণ্ঠকে জানান, 'আমরা যত দূর জানতে পেরেছি, কয়েকজন ছাড়া সবার অবস্থাই এখন শোচনীয় পর্যায়ে। এক টুকরো রুটি কেনার অবস্থাও নেই বেশির ভাগ শ্রমিকের। তাঁরা মরুভূমিতে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছেন। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁদের কান্না ও বাঁচাও-বাঁচাও আকুতি শুনতে পাচ্ছি।'
দূতাবাস সূত্র জানান, 'কেউই তেমন কিছুই করতে পারছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নাগরিকদের লিবিয়া থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তুরস্ক তার সব নাগরিককে লিবিয়া থেকে ফেরত নিয়েছে। ভারতীয় নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে ভারত বিমান পাঠিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। অথচ বাংলাদেশ এখনো এ প্রক্রিয়া শুরুই করেনি।'
বাংলাদেশি শ্রমিকরা দূতাবাসে ফোন করে কী বলছেন তা জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানান, "বাংলাদেশে অনেকে বলছেন, এখানকার প্রবাসী শ্রমিকরা ভালো আছেন। কিন্তু সত্য হলো, তাঁদের কান্নায় আমরা ঘুমাতে পারছি না। নানা দিক থেকে দুঃসংবাদ আসছে। শ্রমিকরা বলছেন, 'আমরা আমাদের প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে চাই। আমাদের বাঁচান।'"
এ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন কি না জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানান, এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত নন। কেউ বলছে দুজন, কেউ বলছে চারজন নিহত হয়েছেন।
ত্রিপোলির অবস্থা জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানান, 'লিবিয়ার নেতা (গাদ্দাফি) মঙ্গলবার ভাষণে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাঁর পক্ষের লোকজন এর পর থেকে রাস্তায় মহড়া দিচ্ছে। দোকানপাট সব বন্ধ। পাঁচ দিনে জিনিসপত্রের দাম তিন গুণ হয়েছে। আগে যেখানে চার আনায় চার টুকরো রুটি পাওয়া যেত, এখন এক টুকরো রুটি কিনতে এক দিনার খরচ হচ্ছে। আমি নিজেই গতকাল বেশ কয়েক গুণ বেশি দামে চাল কিনেছি।'
সূত্র আরো বলেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশেরই খাবার ফুরিয়ে গেছে। তাদের খাবার সরবরাহ করত কম্পানি কর্তৃপক্ষ। কম্পানির লোকজন সব পালিয়ে গেছে। এখন শ্রমিকদের হাতে খাবার কেনার মতো অর্থও নেই।
কয়েক দিন ধরে সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত বেনগাজির অবস্থা জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানায়, 'সেখানে চলতি পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। প্রচণ্ড সংঘর্ষ হচ্ছে। সরকারবিরোধীরা সেখানে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে নতুন পতাকা উত্তোলন করেছে এবং লিবিয়াকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে বলে আমি শুনতে পেয়েছি।'
বাংলাদেশ দূতাবাস ও এর কর্মীদের কী অবস্থা জানতে চাইলে সূত্র জানান, 'সাধারণ শ্রমিকরা আমাদের কাছে ফোন করে কান্নাকাটি করে। আমরা তাদের যতটা সম্ভব সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরাও নীরবে কাঁদছি। শুধু এটুকু বলব, এখন লিবিয়ায় সব কিছুই অনিশ্চিত। আমরা নিয়মিত অফিসে আসছি।'
ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এলাকায় গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানায়, 'এখানে দুপুর ২টায় গুলির শব্দ শুরু হয়। আর তা চলে ভোর পর্যন্ত।'
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের ওই সূত্রকে শুভকামনা জানালে তিনি আবারও বলেন, 'বাংলাদেশিদের কান্না শুনে আমরা আর স্থির থাকতে পারছি না। আপনারা সরকারকে অনুরোধ করুন, যেন তারা আমাদের শ্রমিকদের বাঁচায়।'
সরকার উদ্বিগ্ন
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ার পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হওয়ায় সরকারের উদ্বেগ বাড়ছে। বেনগাজিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে যেতে পারছেন না। তবে আশপাশের শহর থেকে যে খবর আসছে, তার ভিত্তিতেই দূতাবাসকে করণীয় নির্ধারণ করতে হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দুপুরে ত্রিপোলিতে কোরীয় কম্পানি দাইয়ুর প্রধান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ বি এম নূরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর কম্পানিতে কর্মরত ১৭৯ জন শ্রমিককে পার্শ্ববর্তী দেশ তিউনিসিয়ায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিউনিসিয়া যাতে তাদের সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিদের আশ্রয় দেয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ও সহযোগিতা চেয়েছে কম্পানিটি। একইভাবে বেনগাজিতে অবস্থানরত কোরীয় আরো দুই কম্পানি হুন্দাই ও ডং-এ কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদেরও পাশের দেশ মিসর সীমান্তে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেনগাজিতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ত্রিপোলির রাষ্ট্রদূতকে আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী দূতাবাসের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টাও চলছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত এ বি এম নূরুজ্জামান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, তাঁর বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি নিরাপদ মনে করে দূতাবাসে অবস্থান করছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, দিনরাত গুলির কারণে সর্বত্র এখন ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে সমস্যার কারণে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সকালে তাঁকে বহনকারী গাড়িটি বাধাগ্রস্ত হয়। পরে তিনি দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছায় কাজ করে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশিদের মিসর ও তিউনিসিয়া সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেড ক্রসের কাছে তাদের পতাকাবাহী গাড়ি চেয়েছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কোনো দেশ থেকে বিপদগ্রস্ত মানুষদের অন্য দেশে নিয়ে গেলে তাদের ভিসার প্রয়োজন হবে না বলে জানা গেছে।
গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, ওই বৈঠকে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সার্বিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সংস্থাটিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে আইওএম কী ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবে, সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানতে চাইলে রাবাব ফাতিমা জানিয়েছেন, বিষয়টি তিনি আইওএমকে জানাবেন।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ফোনে জানানো হচ্ছে, শ্রমিকরা তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের যাতে ক্ষয়ক্ষতি না হয় এবং তাঁদের যাতে নিরাপদে রাখা যায়, সে জন্য সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে।
এদিকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা মুক্ত অবস্থায় আছেন। তিনি মঙ্গলবার রাতে টেলিফোনে সেখানে অবস্থানরত একজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সে সময় তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, সুযোগ পাওয়ামাত্রই তাঁরা যেন নিরাপদ স্থানে সরে যান।
ঢাকায় লিবীয় দূতাবাসের সামনে শুধুই হাহাকার
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সর্বশেষ অবস্থা জানতে গতকাল বুধবার বিকেল ৫টার দিকে ঢাকায় কালের কণ্ঠ কার্যালয় থেকে টেলিফোনে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাস সূত্র জানায়, লিবিয়ার পরিস্থিতি বর্ণনাতীত। হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থানকারী প্রায় সব ক্যাম্পেই লুটপাট হয়েছে। এরপর পথে বসেছেন বাংলাদেশিরা। লিবিয়ায় অবস্থানরত ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের বেশির ভাগের অবস্থাই এমন কি না জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র কালের কণ্ঠকে জানান, 'আমরা যত দূর জানতে পেরেছি, কয়েকজন ছাড়া সবার অবস্থাই এখন শোচনীয় পর্যায়ে। এক টুকরো রুটি কেনার অবস্থাও নেই বেশির ভাগ শ্রমিকের। তাঁরা মরুভূমিতে খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছেন। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁদের কান্না ও বাঁচাও-বাঁচাও আকুতি শুনতে পাচ্ছি।'
দূতাবাস সূত্র জানান, 'কেউই তেমন কিছুই করতে পারছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের নাগরিকদের লিবিয়া থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তুরস্ক তার সব নাগরিককে লিবিয়া থেকে ফেরত নিয়েছে। ভারতীয় নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে ভারত বিমান পাঠিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। অথচ বাংলাদেশ এখনো এ প্রক্রিয়া শুরুই করেনি।'
বাংলাদেশি শ্রমিকরা দূতাবাসে ফোন করে কী বলছেন তা জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানান, "বাংলাদেশে অনেকে বলছেন, এখানকার প্রবাসী শ্রমিকরা ভালো আছেন। কিন্তু সত্য হলো, তাঁদের কান্নায় আমরা ঘুমাতে পারছি না। নানা দিক থেকে দুঃসংবাদ আসছে। শ্রমিকরা বলছেন, 'আমরা আমাদের প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে চাই। আমাদের বাঁচান।'"
এ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন কি না জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানান, এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত নন। কেউ বলছে দুজন, কেউ বলছে চারজন নিহত হয়েছেন।
ত্রিপোলির অবস্থা জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানান, 'লিবিয়ার নেতা (গাদ্দাফি) মঙ্গলবার ভাষণে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাঁর পক্ষের লোকজন এর পর থেকে রাস্তায় মহড়া দিচ্ছে। দোকানপাট সব বন্ধ। পাঁচ দিনে জিনিসপত্রের দাম তিন গুণ হয়েছে। আগে যেখানে চার আনায় চার টুকরো রুটি পাওয়া যেত, এখন এক টুকরো রুটি কিনতে এক দিনার খরচ হচ্ছে। আমি নিজেই গতকাল বেশ কয়েক গুণ বেশি দামে চাল কিনেছি।'
সূত্র আরো বলেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশেরই খাবার ফুরিয়ে গেছে। তাদের খাবার সরবরাহ করত কম্পানি কর্তৃপক্ষ। কম্পানির লোকজন সব পালিয়ে গেছে। এখন শ্রমিকদের হাতে খাবার কেনার মতো অর্থও নেই।
কয়েক দিন ধরে সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত বেনগাজির অবস্থা জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানায়, 'সেখানে চলতি পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। প্রচণ্ড সংঘর্ষ হচ্ছে। সরকারবিরোধীরা সেখানে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে নতুন পতাকা উত্তোলন করেছে এবং লিবিয়াকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে বলে আমি শুনতে পেয়েছি।'
বাংলাদেশ দূতাবাস ও এর কর্মীদের কী অবস্থা জানতে চাইলে সূত্র জানান, 'সাধারণ শ্রমিকরা আমাদের কাছে ফোন করে কান্নাকাটি করে। আমরা তাদের যতটা সম্ভব সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরাও নীরবে কাঁদছি। শুধু এটুকু বলব, এখন লিবিয়ায় সব কিছুই অনিশ্চিত। আমরা নিয়মিত অফিসে আসছি।'
ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এলাকায় গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে দূতাবাস সূত্র জানায়, 'এখানে দুপুর ২টায় গুলির শব্দ শুরু হয়। আর তা চলে ভোর পর্যন্ত।'
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের ওই সূত্রকে শুভকামনা জানালে তিনি আবারও বলেন, 'বাংলাদেশিদের কান্না শুনে আমরা আর স্থির থাকতে পারছি না। আপনারা সরকারকে অনুরোধ করুন, যেন তারা আমাদের শ্রমিকদের বাঁচায়।'
সরকার উদ্বিগ্ন
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ার পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হওয়ায় সরকারের উদ্বেগ বাড়ছে। বেনগাজিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে যেতে পারছেন না। তবে আশপাশের শহর থেকে যে খবর আসছে, তার ভিত্তিতেই দূতাবাসকে করণীয় নির্ধারণ করতে হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দুপুরে ত্রিপোলিতে কোরীয় কম্পানি দাইয়ুর প্রধান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ বি এম নূরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর কম্পানিতে কর্মরত ১৭৯ জন শ্রমিককে পার্শ্ববর্তী দেশ তিউনিসিয়ায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিউনিসিয়া যাতে তাদের সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিদের আশ্রয় দেয়, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ ও সহযোগিতা চেয়েছে কম্পানিটি। একইভাবে বেনগাজিতে অবস্থানরত কোরীয় আরো দুই কম্পানি হুন্দাই ও ডং-এ কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদেরও পাশের দেশ মিসর সীমান্তে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেনগাজিতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ত্রিপোলির রাষ্ট্রদূতকে আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী দূতাবাসের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টাও চলছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত এ বি এম নূরুজ্জামান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, তাঁর বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি নিরাপদ মনে করে দূতাবাসে অবস্থান করছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, দিনরাত গুলির কারণে সর্বত্র এখন ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে সমস্যার কারণে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সকালে তাঁকে বহনকারী গাড়িটি বাধাগ্রস্ত হয়। পরে তিনি দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছায় কাজ করে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশিদের মিসর ও তিউনিসিয়া সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেড ক্রসের কাছে তাদের পতাকাবাহী গাড়ি চেয়েছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কোনো দেশ থেকে বিপদগ্রস্ত মানুষদের অন্য দেশে নিয়ে গেলে তাদের ভিসার প্রয়োজন হবে না বলে জানা গেছে।
গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, ওই বৈঠকে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সার্বিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য সংস্থাটিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে আইওএম কী ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবে, সে ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানতে চাইলে রাবাব ফাতিমা জানিয়েছেন, বিষয়টি তিনি আইওএমকে জানাবেন।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ফোনে জানানো হচ্ছে, শ্রমিকরা তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের যাতে ক্ষয়ক্ষতি না হয় এবং তাঁদের যাতে নিরাপদে রাখা যায়, সে জন্য সরকার সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে।
এদিকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা মুক্ত অবস্থায় আছেন। তিনি মঙ্গলবার রাতে টেলিফোনে সেখানে অবস্থানরত একজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সে সময় তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, সুযোগ পাওয়ামাত্রই তাঁরা যেন নিরাপদ স্থানে সরে যান।
ঢাকায় লিবীয় দূতাবাসের সামনে শুধুই হাহাকার
No comments