সাম্প্রতিক- সার্বভৌমত্ব, দুদক ও নব্য মানবাধিকার by শাহ্দীন মালিক

শুধু কথায় যেমন চিড়া ভেজে না, সে রকমই শুধু মানবাধিকারের কথা বললে পাঠক আকৃষ্ট হবেন না। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন কিচ্ছা বলব। সেই সঙ্গে ইদানীংকালে দেশপ্রেমিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করার ঘটনা, আমাদের ঘাড়ে বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া জগদ্দল পাথর, যাতে এই স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ল বলে এবং কান টানলে মাথা আসে নীতির ফলে দুদককেও টেনে আনব।


অতএব একটা জগাখিচুড়ি লেখা। ইদানীংকালটাই গোলমেলে, তাই কেমনে স্বচ্ছ-সাবলীল হবে?
১১ এপ্রিলের প্রথম আলোর দশম পৃষ্ঠায় আলী ইমাম মজুমদার সাহেবের লেখা, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন, গন্তব্য কোথায়?’ পড়তে পড়তে দেশাত্মবোধে আপ্লুত হয়ে পড়লাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে ব্যাটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা যেমন—ইউএসএআইডি, ডিফিড ইত্যাদির চাপেই তো আমাদের স্বনামধন্য দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে বিলুপ্ত করতে হয়েছিল। আলী ইমাম মজুমদার কোনো বিদেশি দাতা সংস্থার নাম উল্লেখ করেননি। তবে লিখেছেন, ‘...সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস ও বলবৎ করে।’
এখনকার পদ্মা সেতুর মতো তখনো এই বদখত বিদেশিরা কিন্তু কারও দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেনি। আর বেয়াদব বিদেশিরা তখন অভিযোগ এনেছিল, গোটা এবং খোদ দুর্নীতি দমন ব্যুরোর বিরুদ্ধে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের একটি অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান নিয়ে এত বড় অপবাদ! কিন্তু কী করা যায়, বিদেশি টাকা না পেলে সিঙ্গাপুর-নিউইয়র্ক ইত্যাদি ভালো ভালো জায়গায় যাওয়া যায় না—ওখানে বাড়িঘরও কেনার সুযোগ-সুবিধা অনেক কমে যায়। তাই চাপে পড়ে দুদক আইন হলো, কমিশন হলো। ভাগ্যিস তখনকার বিএনপি-জামায়াত আমলে সাচ্চা দেশপ্রেমিক লোকের অভাব ছিল না। তিন-তিনজনকে পাওয়া গেল দুদকে বসানোর জন্য।
বিদেশিরা বলল, আর অমনি আমরা দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম—এটা তো হতে পারে না। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কলুষিত দুই বছর ছাড়া আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরো প্রায় ৫০ বছর ধরে (প্রতিষ্ঠার ১৯৫৭ থেকে বিলুপ্তির ২০০৪ পর্যন্ত) আর ইদানীংকালে দুদক (প্রতিষ্ঠার ২০০৪ থেকে আজতক) বিদেশিদের সর্বতোভাবে ভুল প্রমাণ করে চলছে।
২০০৪ সালে দুদক প্রতিষ্ঠার পর তখন নিযুক্ত চেয়ারম্যান ও দুই সদস্য, যাঁর যাঁর স্বীয় ক্ষমতার সীমানা নির্ধারণ ও পুরোনো ব্যুরোর কাকে কাকে নতুন কমিশনে নেওয়া হবে, সেই জটিল সমস্যা নিরসনে এত ব্যস্ত ছিলেন যে ঘুষখোরদের খুঁজতে যাওয়ার মতো তুচ্ছ কাজে মনোযোগ দেওয়ার সময়ই পাননি। ব্যাপারটা আলী ইমাম মজুমদার সাহেবও তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন—বলা বাহুল্য, অধমের মতো এত চাঁছাছোলা ভাষায় নয়। বাড়িয়ে বলা অধমের বদ অভ্যাস—তাই বলছি, দুদকের প্রথম জামানায় প্রধান ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, যিনি আশির দশকের শেষ ভাগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমলের নির্ভেজাল, পূত-পবিত্র সব নির্বাচনের সময় কিছুকাল নির্বাচন কমিশনার এবং পরে তাঁর কাজে এরশাদ সাহেব এতই তুষ্ট হয়েছিলেন যে তাঁকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োজিত করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এরশাদ সাহেব ১৯৯০ সালে ডিসেম্বরে চলে যাওয়ার পর সিইসি বিচারপতি সুলতান হোসেন খান সেই ডিসেম্বর মাসও পার করতে পারেননি। তাঁকেও চলে যেতে হয়েছিল।
তবে, বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে তাঁকেই দুদকের প্রধান করে বিদেশিদের দেওয়া দুর্নীতির দুর্নাম ঘোচানোর গুরুদায়িত্ব দিয়েছিল, যেটা তিনি সম্পূর্ণ সাফল্যজনকভাবে পালন করেছিলেন। তাঁর আমলে দুদক বড় কোনো আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতির বিরুদ্ধে সফল মামলা করছিল বলে মনে পড়ছে না।
আলী ইমাম মজুমদার সাহেবের উল্লিখিত লেখার একটা অংশের সঙ্গে আমাদের ভীষণ দ্বিমত। তিনি ধরে নিচ্ছেন, দুদক আসলেই দুর্নীতি রোধে চেষ্টা করবে। অতীতে অধমেরও এমন একটা ধারণা ছিল। এখন ভুল ভেঙেছে। সুলতান হোসেন খানের সময়ের দুদকের মতো বর্তমান দুদকেরও প্রধান কাজ হলো বিদেশি দাতা সংস্থা, মিডিয়া, টিআইবির মতো আজেবাজে প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের যে বদনাম দেয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রমাণ করা যে এ দেশে কোনো দুর্নীতি হয় না। তাই দুদকের কোনো মামলা-মোকদ্দমা করার দরকার নেই। হঠাৎ হঠাৎ দু-চারটা দুর্নীতির হদিস যে একেবারে পাওয়া যায় না, তা নয়। তবে সেগুলো নির্ঘাত করে বিরোধী দলের লোকজন, বিরোধী রাজনীতিবিদ, বিরোধী আমলা, বিরোধী ব্যবসায়ী।
ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে বা নিজ গুণেই অনেক সময় প্রতিষ্ঠানকেও পদক দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের পদক পাওয়া বা খেতাব পাওয়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের কথা তুললে আশঙ্কা হয়, কট্টরপন্থী আওয়ামী পাঠকেরা না আবার তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। আর অতিশয় মান্যবর আইন প্রতিমন্ত্রীর একেবারে চোখ-কান বন্ধ করা অনুসারীরা হয়তো গ্রামীণ ব্যাংকের উদাহরণ টানার মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাবেন। তবে দুদককে নিশ্চয় এখন দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি ও পুরস্কার দেওয়া যায়। দুদক সম্পূর্ণ এককভাবে দেশ থেকে দুর্নীতি বিদায় করেছে। দেশে যেহেতু তেমন কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না, সেহেতু দুর্নীতির মামলা করছে না। অতএব, দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই একটা ঘোষণা দেবেন—সেই আশায় রইলাম।


বন্ধু তার দুঃখের কথা বলছিল। ঈদের আগে ঘুষ অনেক বেশি দিতে হচ্ছে। বন্ধুর সরকারের সঙ্গে ব্যবসা। অতএব, দেনা-পাওনার জন্য ঘন ঘন সরকারি অফিসে যেতে হয়, দেন-দরবার করতে হয়। ঈদের আগে পাওনা আদায় করার তাগাদা থাকে—কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দিতে হয়।
সে সুবাদে বন্ধুটির সরকারের কাছে তার পাওনা টাকার খোঁজে সরকারি অফিসে যাওয়া-আসা। ফাইলগুলো এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে যাওয়ার জন্য ধাক্কা দিতে হবে। কর্মকর্তার দাবি, ‘ঈদ সামনে, এখন টাকা বেশি লাগবে।’ বন্ধুর আকুতি-মিনতি, ‘সব টেবিলে এত টাকা দিতে হলে আমার কর্মচারীদের ঈদের বোনাস দেওয়ার টাকা থাকবে না।’
‘ঈদ কি শুধু আপনার কর্মচারীরা করবে? আমরা ঈদ করব না? আমাদের ঈদ করার অধিকার নেই? আমাদেরও ঈদ করার মানবাধিকার আছে। সবকিছুর দাম বাড়তি। অতএব, টাকা বেশি লাগবে ফাইল ছাড়তে।’
বন্ধুর অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ শুনে পুলকিত হয়েছিলাম। পাঠকও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন—আমরা নতুন মানবাধিকার আবিষ্কার করেছি। ঈদের সময় ঘুষ না দিলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে।
এই মানবাধিকার রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হতে হলে অবশ্য বন্ধুটির মতো সরকারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নামতে হবে। এই বয়সে সেটা আর তো বোধহয় সম্ভব নয়। অবশ্য এর চেয়ে বড় বাধা হলো—কেউ তো আর দলে নেবে না। সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে হলে তো হয় ‘জয় বাংলা’ বা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এ নাম লেখাতে হবে। অতএব থাক!
এর চেয়ে এই নতুন মানবাধিকারের আবিষ্কারক হিসেবে বর্তমান সরকার যাতে কোনো আন্তর্জাতিক সনদ পায়, সেই চেষ্টায় মনোনিবেশ করা দরকার।


এত অতলগহ্বরে আমরা কীভাবে নেমে গেলাম? বলা বাহুল্য, সব কৃতিত্ব এই সরকারের নয়। এর আগের সরকার জাতিকে উপহার দিয়েছিল হাওয়া ভবন। একটা ভবন থেকে এত বেশি অকাজ-কুকাজ যে হতে পারে, তা আমরা হাওয়া ভবনের আগে নিশ্চয় জানতাম না।
নব্বইয়ের দশকটা তুলনামূলকভাবে হয়তো একটু ভালো ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আশির দশকে আমাদের নর্দমা থেকে পানি পান করা শুরু হয়েছিল।
আশপাশের অনেক দেশে অনেকবার গেছি। আজকাল যা-ই কম। কিন্তু দু-চার বছর পর পর গিয়ে পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ার মতো দেশের সংখ্যা কম নয়। অবনতি হয়—এমন দেশও আছে। কিন্তু এত বেশি অবনতি?
গাজীপুর এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সম্প্রতি ৪৭টা মানুষের মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার খবর অনেক পাঠক নিশ্চয় লক্ষ করেছেন। বলা হচ্ছে, ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে এসব খুন করা হচ্ছে। যারা ট্রেনের ছাদে চড়ে যাতায়াত করে, তাদের কাছে কয়টাই বা টাকা থাকে। অন্য খবরে পড়লাম গত পাঁচ বছরে ঢাকায় আট সহস্রাধিক বেওয়ারিশ লাশ দাফনের কথা। এসব মৃতদেহের অনেকগুলোতে আঘাতের চিহ্ন। কিছু মস্তকবিহীন।
ঘুষের সঙ্গে এই সবকিছু অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যারা ঘুষ খায়, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে না—যারা ঘুষ দেয় তারাও নয়। তাই চতুর্দিকে বেহাল অবস্থা।
বেওয়ারিশ লাশ, ট্রেনলাইনের পাশে শবের কাফেলা, গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত দেশের মতো সংস্কারবিহীন সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে ঈদে বাড়ি ফেরা—সবই একই সূত্রে গাঁথা। ঘুষ এখন মানবাধিকার।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট ও শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।

No comments

Powered by Blogger.