বৈ জ্ঞা নি ক ক ল্প কা হি নী-কেপলার টুটুবি by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
সাতজনের ছোট দলটি নিঃশব্দে হেঁটে যেতে থাকে। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। পৃথিবী হলে এখানে পাখির ডাক থাকত, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক থাকত। গাছের পাতার মাঝে বাতাসের শিরশির শব্দ থাকত। দূর থেকে কোনো একজন নিঃসঙ্গ ভবঘুরের গানের সুর ভেসে আসত। এখানে কিছু নেই। ইহিতার কাছে এই নৈঃশব্দটুকু অসহ্য মনে হয়।
ইহিতা দূরে তাকাল। সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে, লাল এই গ্রহে দূরে নিষ্প্রাণ সূর্যটিকে কেমন যেন অপরিচিত মনে হয়। ঠিক পৃথিবীর মতোই খুব ধীরে ধীরে সন্ধে নেমে আসবে। একটু পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে যাবে। মঙ্গল গ্রহের কুৎসিত চাঁদ দুটি আকাশে থাকবে কি না কে জানে, থাকলেই সেটা কতটুকু আলো দিতে পারবে সেটাই বা কে জানে। শৈশবে এ গ্রহটিকে নিয়ে সে কত পড়াশোনা করেছে, তখন কি সে কল্পনা করেছিল একটি নির্বোধ কম্পিউটারের কারণে এ গ্রহটিতে নির্বাসিত হয়ে যাবে?
একটি ঢালু পাহাড়ের নিচে এসে সুহা বলল, ‘আমরা এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। ক্লদ মনে হয় একটু ক্লান্ত হয়ে গেছে।’
ক্লদ বলল, ‘উঁহু। আমি ক্লান্ত হইনি। আমি কখনো ক্লান্ত হই না।’
ইহিতা বলল, ‘চমৎকার! কিন্তু পরিশ্রম করলে ক্লান্ত হওয়াটা দোষের কিছু নয়। তুমি যদি ক্লান্ত হও, তাহলে আমাদের বলো। আমরা তোমাকে ট্রান্সপোর্টারে বসিয়ে নিয়ে যাব। কোনো পরিশ্রম ছাড়াই তখন যেতে পারবে।’
টুরান বলল, ‘আমাদের একটা বাই ভার্বাল থাকলে চমৎকার হতো, অনেক তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম।’
টর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হতভাগা ট্রিনিটি আমাদের ছোট একটা স্কাউটশিপে করে এখানে পাঠিয়েছে, খাবার আর পানি নিয়েই টানটানি, এখানে বাই ভার্বাল কেমন করে পাঠাবে?’
নীহা আপনমনে তার কুগুরাভ সমীকরণ সমাধান খুঁজে যাচ্ছিল, তার চারপাশে সবাই কে কী বলছে ভালো করে শুনছিল না। হঠাৎ করে সে বলল, ‘আমার অনেকক্ষণ থেকে একধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। আমি কেন জানি আমার ভাবনায় মনোযোগ দিতে পারছি না।’
‘কেন?’
‘আমার-আমার...’ নীহা তার ব্যাকটিকে শেষ না করে থেমে গেল।
ইহিতা জানতে চাইল, ‘তোমার কী?’
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কেউ আমাদের চোখে চোখে রাখছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাদের লক্ষ করছে। কেমন জানি অশুভ একটা অনুভূতি।’
সুহা বলল, ‘সেটি হতেই পারে। আমরা সবাই তেজস্ক্রিয় প্রাণীকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছি।’
নীহা মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, সে রকম নয়। আমার অনুভূতিটি অনেক বাস্তব। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে অন্ধকার—মনে হচ্ছে অন্ধকারের বাইরে অনেকগুলো চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’
টুরান কষ্ট করে একটু হাসির মতো শব্দ করল, বলল, ‘তেজস্ক্রিয় প্রাণী নিয়ে ভয় আমার ভেতরেও আছে। কিন্তু অশুভ অনুভূতি বা অন্ধকারে চোখ—এগুলো তোমার কল্পনা। কারণ তেজস্ক্রিয় প্রাণী যদি কাছাকাছি আসে, তাহলে আমাদের মিটারে আমরা রিডিং পাব। এই দেখো, এখানে কোনো রিডিং নেই।’ বলে টুরান তেজস্ক্রিয়তা মাপার ছোট যন্ত্রটি নীহাকে দেখাল।
ঠিক তখন তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্রটা থেকে হঠাৎ করে কট কট করে একধরনের শব্দ হতে থাকে। সবাই বস্ফািরিত চোখে মিটারটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে কাঁটাটি নড়ছে, কিছু আলো জ্বলতে-নিভতে থাকে আর শব্দটা দ্রুততর হতে থাকে।
ইহিতা নিচু গলায় বলল, ‘নীহার ধারণা সঠিক। প্রাণীগুলো আমাদের দিকে আসছে।’
নীহা আর্তচিৎকার করে বলল, ‘সর্বনাশ!’
সুহা বলল, ‘আমরা কী করব?’
ইহিতা বলল, ‘প্রাণীগুলোকে ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে।’
‘কীভাবে?’
‘অস্ত্র দিয়ে।’ ইহিতা ডানে-বামে তাকাল, বলল, ‘পেছনে বড় পাথরগুলো আছে, এখানে দাঁড়াই, তাহলে শুধু সামনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নাও। শোনো, খুব কাছে না আসা পর্যন্ত গুলি করো না। গুলি যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়।’
সবাই ছুটে বিশাল পাথরটাকে পেছনে রেখে দাঁড়াল। ইহিতা হেলমেটের সুইচ টিপে সেটাকে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য সংবেদনশীল করার চেষ্টা করে। অবলাল আলোতে কিছু দেখতে পেল না কিন্তু আলট্রাভায়োলেট তরঙ্গে যেতেই সে প্রাণীগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পায়। অনেকগুলো প্রাণী গুঁড়ি মেরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রাণীর শরীরের যে জায়গা থেকে অতিবেগুনি রশ্মি বের হচ্ছে, শুধু সেই অংশটুকু দেখতে পাচ্ছে, তাই প্রকৃত আকারটা বোঝা যাচ্ছে না। অনুমান করা যায় প্রাণীটি আকারে খুব উঁচু নয়—হাত-পা থাকতে পারে, দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘তোমাদের হেলমেট অতিবেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নাও।’
নীহা জানতে চাইল, ‘তাহলে কী হবে?’
‘প্রাণীগুলো দেখতে পাবে।’
নীহার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই তাদের হেলমেটের গগলস অতিবেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নিল, সঙ্গে সঙ্গে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসা প্রাণীগুলো দেখতে পায়। টর চাপাস্বরে একটা কুৎসিত গালি দিয়ে বলল, ‘আরেকটু কাছে আয় হতভাগারা—অনেক দিন কারও ওপর গুলি চালাইনি।’
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘সাবধান, প্রয়োজন না হলে গুলি করো না।’
‘কেমন করে বুঝব প্রয়োজন নেই!’
‘যদি দেখো প্রাণীগুলো থেমে গেছে। যদি দেখো, এদিকে এগিয়ে না এসে ইতস্তত অন্যদিকে যাচ্ছে।’
‘কেন থেমে যাবে? কেন ইতস্তত অন্যদিকে যাবে?’
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘জানি না। শুধু দেখো, যায় কি না।’
সবাই অস্ত্র তাক করে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে ঠিক তখন যেন ইহিতার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যই প্রাণীগুলোর গতি কমে আসে, প্রাণীগুলোর অনেকগুলো থেমে যায়, অনেকগুলো ইতস্তত এদিক-সেদিক হাঁটতে থাকে।
টুরান ফিসফিস করে বলল, ‘কী হয়েছে?’
ইহিতা বলল, ‘সবাই চুপ। কেউ একটা কথা বলবে না। একটা শব্দ করবে না। কোনো কিছু না নড়লে প্রাণীগুলো দেখতে পায় না। কেউ নড়বে না। একেবারে কাছে এলেও নড়বে না।’
সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রাণীগুলো ইতস্তত এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। একটা প্রাণী তাদের কাছাকাছি এসে ডানদিকে সরে যায়, সেখান থেকে হঠাৎ করে ঘুরে সোজাসুজি তাদের দিকে এগিয়ে আসে। সুহা ফিসফিস করে বলল, ‘সর্বনাশ!’
অন্য কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই দেখল কিছু একটা দুলতে দুলতে তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি আসার পর প্রথম প্রাণীটার অবয়ব স্পষ্ট দেখা যায়। রেডিয়েশন মিটারটি নিঃশব্দ করে রাখা আছে বলে সেটি শব্দ করছে না কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রচণ্ড রেডিয়েশনে তার কাঁটাটি থরথর করে কাঁপছে।
প্রাণীটি আরও কাছে এগিয়ে আসে, এটি পৃথিবীর কোনো প্রাণীর মতো নয়। মনে হয় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে একটি অতিকায় কুৎসিত ক্লেদাক্ত কীট তৈরি করা হয়েছে। ধারালো দাঁতের পেছনে লকলকে জিব। চোখ আছে কি নেই বোঝা যায় না। প্রাণীটি খুব কাছে এসে তাদের পরীক্ষা করে দেখল, তারপর একটু বাম দিকে সরে দুলতে দুলতে নড়তে নড়তে সরে গেল। হঠাৎ করে তারা মাটিতে একটা কম্পন অনুভব করে সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো প্রাণী একসঙ্গে ঘুরে গেল, তারপর ছুটতে ছুটতে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘এখনো কেউ কোনো শব্দ করো না। কেউ একটুও নড়ো না। প্রাণীগুলো আগে একেবারে সরে যাক।’
যখন প্রাণীগুলো একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন নীহা একটা দীর্ঘশ্বাসকে বুক থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘খুব বাঁচা বেঁচে গেছি।’
টর বলল, ‘একটা গুলি পর্যন্ত করতে পারলাম না।’
‘তুমি গুলি করতে চাইছিলে?’
‘হ্যাঁ। অনেক দিন কোনো অস্ত্র ব্যবহার করিনি, হাত নিশপিশ করছিল।’
সবাই একধরনের সন্দেহের চোখে টরের দিকে তাকিয়ে থাকে। টুরান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি একটা কথা বলতে পারি?’
সবাই এবার ঘুরে টুরানের দিকে তাকাল, সুহা বলল, ‘বলো।’
টুরান বলল, ‘তোমাদের মনে আছে, আমরা যখন মহাকাশযানে করে আমাদের যাত্রা ঠিক শুরু করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন ইহিতা আমাদের সবার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাইছিল?’
সবাই মাথা নাড়ল। টুরান বলল, ‘আমি একধরনের গোয়ার্তুমি করে ইহিতাকে কথা বলতে দিইনি। তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। অপমানসূচক কথা বলেছিলাম।’
ইহিতা নিচু গলায় বলল, ‘তুমি এমন কিছু অপমানসূচক কথা বলোনি।’
‘বলেছিলাম। আমার খুব কাছাকাছি থাকা একটি মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই থেকে আমি পুরোপুরি নারী জাতির বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলাম, কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারতাম না—কোনো মেয়ের কথাও শুনতে চাইতাম না। বিষয়টা খুবই বড় নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল।’
কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে টুরানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কী বলতে চাইছে।
‘ইহিতা তখন যে কথাগুলো বলতে চাইছিল, আমি এখন তোমাদের সঙ্গে সেই কথাগুলো বলতে চাই।’
টর জিজ্ঞেস করল, ‘সেই কথাগুলো কী?’
‘আমরা সাতজন মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা পথ পাড়ি দিচ্ছি, এইমাত্র একটা খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। সামনে পাব কি না জানি না। বিপদ আসবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ রকম অসম্ভব বিপজ্জনক অবস্থা হলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়—সব সময় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেওয়া যায় না—তার সময় থাকে না। তখন খুব দ্রুত মোটামুটি সঠিক একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটা খুবই জরুরি।’
টর বলল, ‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলতে চাইছ!’
‘তুমি বুঝতে পারছ না কারণ, আমি এখনো কথাটি বলিনি।’
‘তাড়াতাড়ি বলে ফেল।’
টুরান বলল, ‘আমি যদি ঠিক করে অনুমান করে থাকি, তাহলে ইহিতা আমাদের বলতে চেয়েছিল, মানুষের একটা দল হিসেবে আমাদের একটা দলপতি থাকা দরকার। যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শুধু তা-ই না, দলপতিকে মেনে নিলে আমরা সবাই তার সিদ্ধান্তটি কোনোরকম প্রশ্ন না করে মেনে নিতে পারব।’
টুরান একটু থামল এবং সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এই মুহূর্তে আমাদের একজন দলপতি দরকার। আমি দলপতি হিসেবে ইহিতার নাম প্রস্তাব করছি। একটু আগে ইহিতা আমাদের যে কথাগুলো বলেছে, তার প্রত্যেকটি কথা সত্যি বের হয়েছে। সে আমাদের ভয়ংকর বিপদে নিজে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।’
টর বলল, ‘আমাদের মাঝে দুজন রবোমানব আছে, তুমি কেমন করে জানো ইহিতা একজন রবোমানব না?’
টুরান থতমত খেয়ে বলল, ‘সেটা আমি জানি না। কেউই জানে না।’
নুট একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি জানি, ইহিতা রবোমানব না।’
টর মাথা ঘুরিয়ে নুটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি জানো না। তুমি অনুমান করছ।’
নুট বলল, ‘না। আমি জানি। আমার টুরানের প্রস্তাবটা খুব পছন্দ হয়েছে। আমিও ইহিতাকে আমাদের দলপতি হিসেবে গ্রহণ করছি।’
নীহা বলল, ‘আমিও।’
সুহা বলল, ‘আমিও তাকে দলপতি হিসেবে চাই।’
ক্লদ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আলাপটা বোঝার চেষ্টা করল। সে এমনিতে খুবই ছটফটে ছেলে, কিন্তু একটু আগে এত কাছে থেকে তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো দেখার পর থেকে সে হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণ ইহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমিও চাই।’
টর বলল, ‘তার মানে বাকি রয়েছি শুধু আমি?’
কেউ কোনো কথা বলল না। টর বলল, ‘আমার অবশ্যি কোনো পথ বাকি থাকল না। আমাকেও মেনে নিতে হচ্ছে।’
টুরান বলল, ‘চমৎকার।’
ইহিতা বলল, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মঙ্গল গ্রহের এই পাহাড়ের নিচে, এই ধূলিঝড়ের মাঝে, তেজস্ক্রিয় প্রাণীদের আনাগোনার মাঝে আমরা বসে বসে একটা নাটক করছি! কিন্তু আমি এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করব না। সময় খুব মূল্যবান। আমি সময়টা বাঁচাতে চাই। আমাকে যেহেতু দলপতির দায়িত্ব দিয়েছে, আমি সেই দায়িত্ব নিচ্ছি—শুধু এই বিপজ্জনক পথের অংশটুকুতে। যদি ঠিকভাবে মানুষের আবাসস্থলে পৌঁছাতে পারি, তখন অন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
‘সেটি তখন দেখা যাবে।’ টুরান বলল, ‘তা ছাড়া আমরা একটি খেলার টিম তৈরি করছি না যে একেক খেলায় একেকজন দলপতি হবে।’
ইহিতা বলল, ‘সেই আলোচনা থাকুক। তোমরা সবাই এখনই রওনা দাও। দ্রুত আমি আসছি।’
নীহা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ?’
‘সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। সবাই হাঁটতে শুরু করো।’
সবাই হাঁটতে হাঁটতে দেখল, ইহিতা পিঠ থেকে তার ব্যাকপেক নামিয়ে মাটিতে উবু হয়ে কিছু একটা করছে। কী করছে কেউ অনুমান করতে পারল না।
ইহিতা তার কাজ শেষ করে একটু জোরে হেঁটে ছোট দলটির সঙ্গে যোগ দিল। টর জিজ্ঞেস করল, ‘কাজ শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
টর আশা করছিল, ইহিতা বলবে, সে কী করেছে, ইহিতা বলল না। তখন টর নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পেছনে কী করে এসেছ?’
‘এমন কিছু নয়।’
‘তার মানে তুমি আমাদের বলতে চাইছ না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘টর, তোমার একটা বিষয় বুঝতে হবে। তোমরা আমাকে তোমাদের দলপতি বানিয়েছ, এখন আমার ওপর কিছু বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছে। শুধু আমাকে বেঁচে থাকলে হবে না—তোমাদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সে জন্য আমাকে কিছু বাড়তি কাজ করতে হবে। আমি সেটা করছি। যখন তোমাদের এটা জানার প্রয়োজন হবে, আমি তোমাদের জানাব।’
টর কিছু বলল না, ইহিতার কথাটা তার খুব পছন্দ হলো বলে মনে হয় না।
ছোট দলটি চার ঘণ্টা হাঁটার পর ইহিতা বলল, ‘আমরা এখন বিশ্রাম নেব।’ নীহা বলল, ‘তোমার এই অসাধারণ সিদ্ধান্তের জন্য অনেক ধন্যবাদ ইহিতা। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনো দিন বুঝি একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলবে না।’
ইহিতা বলল, ‘শক্তি থাকতে থাকতে আমি যতটুকু সম্ভব পথ অতিক্রম করে ফেলতে চাইছিলাম।’
ক্লদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, টুরান এতক্ষণ তাকে ট্রান্সপোর্টারে শুইয়ে এনেছে, এবারে তাকে নিচে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস, মঙ্গল গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বল অনেক কম, তা না হলে ক্লদকে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যেত।’
সুহা টুরানের হাত স্পর্শ করে বলল, ‘আমি যে তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না! কতটুকু পথ ক্লদকে ট্রান্সপোর্টারে করে এনেছ!’
টুরান পাথরে পা ছড়িয়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ দেওয়ার তুমি আরও ভালো সুযোগ পাবে—এবারে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া যাক।’
ইহিতা বলল, ‘সবাইকে মনে করিয়ে দিই—এবার যখন রওনা দেব, তখন কিন্তু আর থামাথামি নেই। রওনা দেওয়ার আগে সবাই খানিকটা স্নায়ু-উত্তেজক পানীয় খেয়ে নিয়ো। তাহলে খিদেও পাবে না, ক্লান্তও হবে না। ঘুমাতেও হবে না।’
নীহা বলল, ‘যখন রওনা দেব, তখন সেটা দেখা যাবে। এই মুহূর্তে আমার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একটু ঘুমাই, যখন রওনা দেবে তখন ডেকে তুলো।’
সুহা বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও। তোমাকে দেখে আমার হিংসা হচ্ছে।’
‘কেন? হিংসা হচ্ছে কেন?’
‘এ রকম একটা পরিবেশে যার ঘুম পায়, তাকে দেখে হিংসা হতেই পারে!’
নীহা চোখ বন্ধ করতে করতে বলল, ‘তোমাকে কুগুরাভ সমস্যাটা শিখিয়ে দেব—তার সমাধানের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই!’
একটি ঢালু পাহাড়ের নিচে এসে সুহা বলল, ‘আমরা এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। ক্লদ মনে হয় একটু ক্লান্ত হয়ে গেছে।’
ক্লদ বলল, ‘উঁহু। আমি ক্লান্ত হইনি। আমি কখনো ক্লান্ত হই না।’
ইহিতা বলল, ‘চমৎকার! কিন্তু পরিশ্রম করলে ক্লান্ত হওয়াটা দোষের কিছু নয়। তুমি যদি ক্লান্ত হও, তাহলে আমাদের বলো। আমরা তোমাকে ট্রান্সপোর্টারে বসিয়ে নিয়ে যাব। কোনো পরিশ্রম ছাড়াই তখন যেতে পারবে।’
টুরান বলল, ‘আমাদের একটা বাই ভার্বাল থাকলে চমৎকার হতো, অনেক তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম।’
টর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হতভাগা ট্রিনিটি আমাদের ছোট একটা স্কাউটশিপে করে এখানে পাঠিয়েছে, খাবার আর পানি নিয়েই টানটানি, এখানে বাই ভার্বাল কেমন করে পাঠাবে?’
নীহা আপনমনে তার কুগুরাভ সমীকরণ সমাধান খুঁজে যাচ্ছিল, তার চারপাশে সবাই কে কী বলছে ভালো করে শুনছিল না। হঠাৎ করে সে বলল, ‘আমার অনেকক্ষণ থেকে একধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। আমি কেন জানি আমার ভাবনায় মনোযোগ দিতে পারছি না।’
‘কেন?’
‘আমার-আমার...’ নীহা তার ব্যাকটিকে শেষ না করে থেমে গেল।
ইহিতা জানতে চাইল, ‘তোমার কী?’
‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কেউ আমাদের চোখে চোখে রাখছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাদের লক্ষ করছে। কেমন জানি অশুভ একটা অনুভূতি।’
সুহা বলল, ‘সেটি হতেই পারে। আমরা সবাই তেজস্ক্রিয় প্রাণীকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছি।’
নীহা মাথা নাড়ল, বলল, ‘না, সে রকম নয়। আমার অনুভূতিটি অনেক বাস্তব। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে অন্ধকার—মনে হচ্ছে অন্ধকারের বাইরে অনেকগুলো চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’
টুরান কষ্ট করে একটু হাসির মতো শব্দ করল, বলল, ‘তেজস্ক্রিয় প্রাণী নিয়ে ভয় আমার ভেতরেও আছে। কিন্তু অশুভ অনুভূতি বা অন্ধকারে চোখ—এগুলো তোমার কল্পনা। কারণ তেজস্ক্রিয় প্রাণী যদি কাছাকাছি আসে, তাহলে আমাদের মিটারে আমরা রিডিং পাব। এই দেখো, এখানে কোনো রিডিং নেই।’ বলে টুরান তেজস্ক্রিয়তা মাপার ছোট যন্ত্রটি নীহাকে দেখাল।
ঠিক তখন তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্রটা থেকে হঠাৎ করে কট কট করে একধরনের শব্দ হতে থাকে। সবাই বস্ফািরিত চোখে মিটারটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে কাঁটাটি নড়ছে, কিছু আলো জ্বলতে-নিভতে থাকে আর শব্দটা দ্রুততর হতে থাকে।
ইহিতা নিচু গলায় বলল, ‘নীহার ধারণা সঠিক। প্রাণীগুলো আমাদের দিকে আসছে।’
নীহা আর্তচিৎকার করে বলল, ‘সর্বনাশ!’
সুহা বলল, ‘আমরা কী করব?’
ইহিতা বলল, ‘প্রাণীগুলোকে ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে।’
‘কীভাবে?’
‘অস্ত্র দিয়ে।’ ইহিতা ডানে-বামে তাকাল, বলল, ‘পেছনে বড় পাথরগুলো আছে, এখানে দাঁড়াই, তাহলে শুধু সামনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নাও। শোনো, খুব কাছে না আসা পর্যন্ত গুলি করো না। গুলি যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়।’
সবাই ছুটে বিশাল পাথরটাকে পেছনে রেখে দাঁড়াল। ইহিতা হেলমেটের সুইচ টিপে সেটাকে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য সংবেদনশীল করার চেষ্টা করে। অবলাল আলোতে কিছু দেখতে পেল না কিন্তু আলট্রাভায়োলেট তরঙ্গে যেতেই সে প্রাণীগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পায়। অনেকগুলো প্রাণী গুঁড়ি মেরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রাণীর শরীরের যে জায়গা থেকে অতিবেগুনি রশ্মি বের হচ্ছে, শুধু সেই অংশটুকু দেখতে পাচ্ছে, তাই প্রকৃত আকারটা বোঝা যাচ্ছে না। অনুমান করা যায় প্রাণীটি আকারে খুব উঁচু নয়—হাত-পা থাকতে পারে, দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘তোমাদের হেলমেট অতিবেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নাও।’
নীহা জানতে চাইল, ‘তাহলে কী হবে?’
‘প্রাণীগুলো দেখতে পাবে।’
নীহার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই তাদের হেলমেটের গগলস অতিবেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নিল, সঙ্গে সঙ্গে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসা প্রাণীগুলো দেখতে পায়। টর চাপাস্বরে একটা কুৎসিত গালি দিয়ে বলল, ‘আরেকটু কাছে আয় হতভাগারা—অনেক দিন কারও ওপর গুলি চালাইনি।’
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘সাবধান, প্রয়োজন না হলে গুলি করো না।’
‘কেমন করে বুঝব প্রয়োজন নেই!’
‘যদি দেখো প্রাণীগুলো থেমে গেছে। যদি দেখো, এদিকে এগিয়ে না এসে ইতস্তত অন্যদিকে যাচ্ছে।’
‘কেন থেমে যাবে? কেন ইতস্তত অন্যদিকে যাবে?’
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘জানি না। শুধু দেখো, যায় কি না।’
সবাই অস্ত্র তাক করে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে ঠিক তখন যেন ইহিতার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যই প্রাণীগুলোর গতি কমে আসে, প্রাণীগুলোর অনেকগুলো থেমে যায়, অনেকগুলো ইতস্তত এদিক-সেদিক হাঁটতে থাকে।
টুরান ফিসফিস করে বলল, ‘কী হয়েছে?’
ইহিতা বলল, ‘সবাই চুপ। কেউ একটা কথা বলবে না। একটা শব্দ করবে না। কোনো কিছু না নড়লে প্রাণীগুলো দেখতে পায় না। কেউ নড়বে না। একেবারে কাছে এলেও নড়বে না।’
সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রাণীগুলো ইতস্তত এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। একটা প্রাণী তাদের কাছাকাছি এসে ডানদিকে সরে যায়, সেখান থেকে হঠাৎ করে ঘুরে সোজাসুজি তাদের দিকে এগিয়ে আসে। সুহা ফিসফিস করে বলল, ‘সর্বনাশ!’
অন্য কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই দেখল কিছু একটা দুলতে দুলতে তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি আসার পর প্রথম প্রাণীটার অবয়ব স্পষ্ট দেখা যায়। রেডিয়েশন মিটারটি নিঃশব্দ করে রাখা আছে বলে সেটি শব্দ করছে না কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রচণ্ড রেডিয়েশনে তার কাঁটাটি থরথর করে কাঁপছে।
প্রাণীটি আরও কাছে এগিয়ে আসে, এটি পৃথিবীর কোনো প্রাণীর মতো নয়। মনে হয় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে একটি অতিকায় কুৎসিত ক্লেদাক্ত কীট তৈরি করা হয়েছে। ধারালো দাঁতের পেছনে লকলকে জিব। চোখ আছে কি নেই বোঝা যায় না। প্রাণীটি খুব কাছে এসে তাদের পরীক্ষা করে দেখল, তারপর একটু বাম দিকে সরে দুলতে দুলতে নড়তে নড়তে সরে গেল। হঠাৎ করে তারা মাটিতে একটা কম্পন অনুভব করে সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো প্রাণী একসঙ্গে ঘুরে গেল, তারপর ছুটতে ছুটতে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ‘এখনো কেউ কোনো শব্দ করো না। কেউ একটুও নড়ো না। প্রাণীগুলো আগে একেবারে সরে যাক।’
যখন প্রাণীগুলো একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন নীহা একটা দীর্ঘশ্বাসকে বুক থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘খুব বাঁচা বেঁচে গেছি।’
টর বলল, ‘একটা গুলি পর্যন্ত করতে পারলাম না।’
‘তুমি গুলি করতে চাইছিলে?’
‘হ্যাঁ। অনেক দিন কোনো অস্ত্র ব্যবহার করিনি, হাত নিশপিশ করছিল।’
সবাই একধরনের সন্দেহের চোখে টরের দিকে তাকিয়ে থাকে। টুরান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি একটা কথা বলতে পারি?’
সবাই এবার ঘুরে টুরানের দিকে তাকাল, সুহা বলল, ‘বলো।’
টুরান বলল, ‘তোমাদের মনে আছে, আমরা যখন মহাকাশযানে করে আমাদের যাত্রা ঠিক শুরু করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন ইহিতা আমাদের সবার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাইছিল?’
সবাই মাথা নাড়ল। টুরান বলল, ‘আমি একধরনের গোয়ার্তুমি করে ইহিতাকে কথা বলতে দিইনি। তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। অপমানসূচক কথা বলেছিলাম।’
ইহিতা নিচু গলায় বলল, ‘তুমি এমন কিছু অপমানসূচক কথা বলোনি।’
‘বলেছিলাম। আমার খুব কাছাকাছি থাকা একটি মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই থেকে আমি পুরোপুরি নারী জাতির বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলাম, কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারতাম না—কোনো মেয়ের কথাও শুনতে চাইতাম না। বিষয়টা খুবই বড় নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল।’
কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে টুরানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কী বলতে চাইছে।
‘ইহিতা তখন যে কথাগুলো বলতে চাইছিল, আমি এখন তোমাদের সঙ্গে সেই কথাগুলো বলতে চাই।’
টর জিজ্ঞেস করল, ‘সেই কথাগুলো কী?’
‘আমরা সাতজন মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা পথ পাড়ি দিচ্ছি, এইমাত্র একটা খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। সামনে পাব কি না জানি না। বিপদ আসবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এ রকম অসম্ভব বিপজ্জনক অবস্থা হলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়—সব সময় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেওয়া যায় না—তার সময় থাকে না। তখন খুব দ্রুত মোটামুটি সঠিক একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটা খুবই জরুরি।’
টর বলল, ‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলতে চাইছ!’
‘তুমি বুঝতে পারছ না কারণ, আমি এখনো কথাটি বলিনি।’
‘তাড়াতাড়ি বলে ফেল।’
টুরান বলল, ‘আমি যদি ঠিক করে অনুমান করে থাকি, তাহলে ইহিতা আমাদের বলতে চেয়েছিল, মানুষের একটা দল হিসেবে আমাদের একটা দলপতি থাকা দরকার। যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শুধু তা-ই না, দলপতিকে মেনে নিলে আমরা সবাই তার সিদ্ধান্তটি কোনোরকম প্রশ্ন না করে মেনে নিতে পারব।’
টুরান একটু থামল এবং সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এই মুহূর্তে আমাদের একজন দলপতি দরকার। আমি দলপতি হিসেবে ইহিতার নাম প্রস্তাব করছি। একটু আগে ইহিতা আমাদের যে কথাগুলো বলেছে, তার প্রত্যেকটি কথা সত্যি বের হয়েছে। সে আমাদের ভয়ংকর বিপদে নিজে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।’
টর বলল, ‘আমাদের মাঝে দুজন রবোমানব আছে, তুমি কেমন করে জানো ইহিতা একজন রবোমানব না?’
টুরান থতমত খেয়ে বলল, ‘সেটা আমি জানি না। কেউই জানে না।’
নুট একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি জানি, ইহিতা রবোমানব না।’
টর মাথা ঘুরিয়ে নুটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি জানো না। তুমি অনুমান করছ।’
নুট বলল, ‘না। আমি জানি। আমার টুরানের প্রস্তাবটা খুব পছন্দ হয়েছে। আমিও ইহিতাকে আমাদের দলপতি হিসেবে গ্রহণ করছি।’
নীহা বলল, ‘আমিও।’
সুহা বলল, ‘আমিও তাকে দলপতি হিসেবে চাই।’
ক্লদ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আলাপটা বোঝার চেষ্টা করল। সে এমনিতে খুবই ছটফটে ছেলে, কিন্তু একটু আগে এত কাছে থেকে তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো দেখার পর থেকে সে হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণ ইহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমিও চাই।’
টর বলল, ‘তার মানে বাকি রয়েছি শুধু আমি?’
কেউ কোনো কথা বলল না। টর বলল, ‘আমার অবশ্যি কোনো পথ বাকি থাকল না। আমাকেও মেনে নিতে হচ্ছে।’
টুরান বলল, ‘চমৎকার।’
ইহিতা বলল, ‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মঙ্গল গ্রহের এই পাহাড়ের নিচে, এই ধূলিঝড়ের মাঝে, তেজস্ক্রিয় প্রাণীদের আনাগোনার মাঝে আমরা বসে বসে একটা নাটক করছি! কিন্তু আমি এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করব না। সময় খুব মূল্যবান। আমি সময়টা বাঁচাতে চাই। আমাকে যেহেতু দলপতির দায়িত্ব দিয়েছে, আমি সেই দায়িত্ব নিচ্ছি—শুধু এই বিপজ্জনক পথের অংশটুকুতে। যদি ঠিকভাবে মানুষের আবাসস্থলে পৌঁছাতে পারি, তখন অন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
‘সেটি তখন দেখা যাবে।’ টুরান বলল, ‘তা ছাড়া আমরা একটি খেলার টিম তৈরি করছি না যে একেক খেলায় একেকজন দলপতি হবে।’
ইহিতা বলল, ‘সেই আলোচনা থাকুক। তোমরা সবাই এখনই রওনা দাও। দ্রুত আমি আসছি।’
নীহা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথা থেকে আসছ?’
‘সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। সবাই হাঁটতে শুরু করো।’
সবাই হাঁটতে হাঁটতে দেখল, ইহিতা পিঠ থেকে তার ব্যাকপেক নামিয়ে মাটিতে উবু হয়ে কিছু একটা করছে। কী করছে কেউ অনুমান করতে পারল না।
ইহিতা তার কাজ শেষ করে একটু জোরে হেঁটে ছোট দলটির সঙ্গে যোগ দিল। টর জিজ্ঞেস করল, ‘কাজ শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ হয়েছে।’
টর আশা করছিল, ইহিতা বলবে, সে কী করেছে, ইহিতা বলল না। তখন টর নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পেছনে কী করে এসেছ?’
‘এমন কিছু নয়।’
‘তার মানে তুমি আমাদের বলতে চাইছ না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘টর, তোমার একটা বিষয় বুঝতে হবে। তোমরা আমাকে তোমাদের দলপতি বানিয়েছ, এখন আমার ওপর কিছু বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছে। শুধু আমাকে বেঁচে থাকলে হবে না—তোমাদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সে জন্য আমাকে কিছু বাড়তি কাজ করতে হবে। আমি সেটা করছি। যখন তোমাদের এটা জানার প্রয়োজন হবে, আমি তোমাদের জানাব।’
টর কিছু বলল না, ইহিতার কথাটা তার খুব পছন্দ হলো বলে মনে হয় না।
ছোট দলটি চার ঘণ্টা হাঁটার পর ইহিতা বলল, ‘আমরা এখন বিশ্রাম নেব।’ নীহা বলল, ‘তোমার এই অসাধারণ সিদ্ধান্তের জন্য অনেক ধন্যবাদ ইহিতা। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর কোনো দিন বুঝি একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলবে না।’
ইহিতা বলল, ‘শক্তি থাকতে থাকতে আমি যতটুকু সম্ভব পথ অতিক্রম করে ফেলতে চাইছিলাম।’
ক্লদ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, টুরান এতক্ষণ তাকে ট্রান্সপোর্টারে শুইয়ে এনেছে, এবারে তাকে নিচে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস, মঙ্গল গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বল অনেক কম, তা না হলে ক্লদকে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যেত।’
সুহা টুরানের হাত স্পর্শ করে বলল, ‘আমি যে তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না! কতটুকু পথ ক্লদকে ট্রান্সপোর্টারে করে এনেছ!’
টুরান পাথরে পা ছড়িয়ে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ দেওয়ার তুমি আরও ভালো সুযোগ পাবে—এবারে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া যাক।’
ইহিতা বলল, ‘সবাইকে মনে করিয়ে দিই—এবার যখন রওনা দেব, তখন কিন্তু আর থামাথামি নেই। রওনা দেওয়ার আগে সবাই খানিকটা স্নায়ু-উত্তেজক পানীয় খেয়ে নিয়ো। তাহলে খিদেও পাবে না, ক্লান্তও হবে না। ঘুমাতেও হবে না।’
নীহা বলল, ‘যখন রওনা দেব, তখন সেটা দেখা যাবে। এই মুহূর্তে আমার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একটু ঘুমাই, যখন রওনা দেবে তখন ডেকে তুলো।’
সুহা বলল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও। তোমাকে দেখে আমার হিংসা হচ্ছে।’
‘কেন? হিংসা হচ্ছে কেন?’
‘এ রকম একটা পরিবেশে যার ঘুম পায়, তাকে দেখে হিংসা হতেই পারে!’
নীহা চোখ বন্ধ করতে করতে বলল, ‘তোমাকে কুগুরাভ সমস্যাটা শিখিয়ে দেব—তার সমাধানের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই!’
No comments