জী ব নী গ্র ন্থ-আমার ছোটবেলা by কবীর চৌধুরী
হিমাংশুদের বাসা ছিল নবাবপুরে। একসময় ওদের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল; কিন্তু ত্রিশের দশকের শেষ দিকে পড়তির মুখে। বাবা কবিরাজ। তখনো কবিরাজি করেন, কিন্তু আর তা থেকে বিশেষ কিছু রোজগার হয় না। অর্থনৈতিক কারণেই হিমাংশু ইন্টারমিডিয়েটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। অথচ ও ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, মেধাবী, কষ্টসহিষ্ণু, পরিশ্রমী আর প্রচণ্ড আত্মমর্যাদার অধিকারী। দারিদ্র্যের সঙ্গে সারা জীবন সংগ্রাম করেছে।
একটার পর একটা ঝড় এসেছে জীবনে; কিন্তু কখনো ভেঙে পড়েনি, কারও কাছে মাথা নত করেনি, সামান্যতম অবজ্ঞা বা অপমানের তীব্র প্রতিবাদ করেছে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুর দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে হারিয়ে দিল। কুষ্ঠ হয়েছিল তার। কয়েক বছর আগে কলকাতায় হিমাংশুর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি যখন কলকাতায় যাই, তখন ওর ওখানে গিয়েছিলাম। ও তখন শয্যাশায়ী। মৃত্যুপথযাত্রী। আমার স্ত্রীও ছিল আমার সঙ্গে।
হিমাংশুর সঙ্গে আমার স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব কলেজজীবন পেরিয়ে আমার কর্মজীবন ও সংসারজীবনকেও আলিঙ্গন করে। যত দিন ও বেঁচে ছিল, তত দিন পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অম্লান ছিল।
হিমাংশু চমৎকার ছবি তুলতে পারত। সুযোগ-সুবিধা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা যদি সে লাভ করত, তাহলে সে যে এ উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রশিল্পী হতে পারত, সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ওদের বাড়ির কাছেই ছিল সে সময়কার নামকরা একটা ক্যামেরা ও ফটোগ্রাফির বিভিন্ন সরঞ্জামের দোকান। ফটো তোলাও হতো সেখানে। নাম ছিল খুব সম্ভব ইংরেজিতে Dass অথবা Doss স্টুডিও। প্রথম দিকে এ স্টুডিওর কিছু সহযোগিতা পেয়েছিল হিমাংশু। তাও ছিল অনুদার এবং স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু ওইটুকুই হিমাংশু তার নিষ্ঠা ও প্রতিভা দিয়ে কাজে লাগিয়েছিল। ওর ঝোঁক ছিল নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে। আজ এসব কাজ খুব সাধারণ মনে হয়, নিত্য দেখি; কিন্তু চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় তা অভিনব ছিল। নানা রকম আলোছায়ার খেলা, সিলুয়েট, ফুলের মধ্যে মানুষের মুখ, সুপার ইম্পোজ করা মন্তাজ ধরনের ছবি, সাবজেক্টের অসতর্ক মুহূর্তের ঘরোয়া ছবির পাশাপাশি যত্নসহকারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী মহড়া দিয়ে কম্পোজ করা আনুষ্ঠানিক ছবি প্রভৃতি সব ধরনের কাজে হিমাংশুর ছিল যেমন উৎসাহ তেমনি দক্ষতা। জীবিকা অর্জনের তাগিদে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সে ছবি তোলাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পুরানা পল্টনে একটা রাস্তার মোড়ে এক ভদ্রলোকের অব্যবহূত মোটর গ্যারেজকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে হিমাংশু সেখানে দোকান খুলেছিল। নাম দিয়েছিল মাই স্টুডিও। আমার বয়সী কারও কারও হয়তো আজও মাই স্টুডিওর কথা মনে আছে। ওই ছোট টিনের ঘরেই ছিল তার ডার্করুম, যাবতীয় আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম, নিজের তোলা চমৎকার কিছু ছবির ডিসপ্লে। কোনো পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল না সে। সাংবাদিক হিসেবে ছিল অজ্ঞাতপরিচয়। সম্পূর্ণ ফ্রিল্যান্সার। লোন উলফ। কিন্তু গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী, নিপুণ আলাপচারী হিমাংশু ছিল খুবই আত্মপ্রত্যয়ী। ওই অল্প বয়সে শুধু নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে সে সব প্রটোকল ভেঙে কঠিন জায়গায় গিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলে আনত। শুধু তা-ই নয়, তাদের সঙ্গে আলাপ করে অনেক সময় একটা ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও সক্ষম হতো। এইভাবে সে কী রকম করে হকির জাদুকর ধ্যান চাঁদ, আমাদের উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরোজিনী নাইডু, শেরেবাংলা ফজলুল হক প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, তাঁদের ছবি তুলেছিল, প্রদীপ্ত চোখে সে তার গল্প করেছে আমার কাছে। হিমাংশু আমাকে একদিন নিয়েও গিয়েছিল ধ্যান চাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ধ্যান চাঁদ ছিলেন ঢাকাতে মোতায়েন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সদস্য। সেদিনের কুর্মিটোলায় সেনাবাহিনীর একটি খেলার মাঠের পাশে আমার দেখা হয়েছিল ধ্যান চাঁদের সঙ্গে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হকি খেলোয়াড় হিসেবে তখন তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। কিন্তু ধ্যান চাঁদকে দেখে বা তাঁর সঙ্গে কথা বলে সেটা বোঝার উপায় ছিল না। সরোজিনী নাইডুর সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি কংগ্রেস আয়োজিত একটি রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ প্রাঙ্গণে স্বাধীনতা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে একটি চমৎকার উদ্দীপনাময় বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। এসব প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। শেরেবাংলার ছবি তোলা প্রসঙ্গে হিমাংশু আমাকে একটি মজার কাহিনি শুনিয়েছিল। সে একদিন শেরেবাংলার বাসায় গিয়েছে। আগে থেকে দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল। হিমাংশু বসার ঘরে আসন গ্রহণ করে খবর পাঠাতেই ফজলুল হক এসে হাজির হলেন। দু-এক কথা বলার পর হিমাংশু তার ক্যামেরা ঠিক করে ছবি তুলতে উদ্যত হলো। তক্ষুনি শেরেবাংলা হাত তুলে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আগে একটু সেন্ট মেখে আসি, কী বলো? বলেই সেই পুরোনো রসিকতাতে তাঁর বিখ্যাত ছাদ-ফাটানো হাসি।
সে সময়ের কথা বলছি যখন আমরা থাকি মাহুতটুলীর শরৎ চক্রবর্তী রোডে। তখন হিমাংশু প্রায় প্রতি বিকেলেই হেঁটে কিংবা সাইকেলে ওদের নবাবপুরের বাসা থেকে আমাদের বাসায় চলে আসত। ও না এলে আমি যেতাম। ছুটির দিনে ও চলে আসত। সকাল নয়টার মধ্যে। তারপর কত গল্প যে আমরা করতাম! কিসের গল্প, তা আজ মনেও নেই। সম্ভবত স্কুলের গল্প, বন্ধুবান্ধবের কথা, নতুন পড়া বইয়ের আলোচনা, খেলার হারজিত ইত্যাদি। তবে সময় যে কীভাবে গড়িয়ে যেত, দুজনের কেউই তা টের পেতাম না। শেষে যখন দুপুরের খাওয়ার সময় এগিয়ে আসত, তখন হিমাংশু উঠে পড়ত। আমি তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের বিশাল বটগাছটার কাছে গিয়ে থামতাম। তখন ও বলত, তুই এতটা পথ একা যাবি? চল, তোকে বাসায় পৌঁছে দিই। কত দিন এইভাবে যে আমরা আসা-যাওয়া করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। এখনো কি দুই কিশোরের মধ্যে এ রকম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে? নিশ্চয়ই ওঠে, শুধু আমরা জানতে পারি না।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি আর হিমাংশু ঠিক করেছিলাম যে আমরা দুজন সাইকেলে পূর্ববঙ্গ সফরে বেরোব। আমার বয়স তখন সবে পনেরো ছাড়িয়েছে। হিমাংশুর ষোলো। প্রথমে পরিকল্পনা করেছিলাম গোটা ভারত পরিক্রমার। পরে নিজেরাই নিজেদের বয়স, অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য ইত্যাদির বিশদ বিবেচনার পর আদিপরিকল্পনা বাতিল করে দিই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পূর্ববঙ্গের সামান্য একটু অংশ ভ্রমণ করেই আমাদের অ্যাডভেঞ্চার পর্বের ইতি টানতে হয়। কিন্তু ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার আগের ছোট একটা ইতিহাস আছে। তার কথা বলে নিই।
সাইকেলে করে আমরা দুজন আনাড়ি কিশোর এইভাবে ঘুরতে বেরোব—এটা আমাদের দুই পরিবারের বড়দের কারোরই ভালো লাগেনি। বিশেষ করে, আমার পরিবারের। আমি ছিলাম বাড়ির প্রথম সন্তান, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের আদরে লালিত কষ্ট সহ্য করার অভিজ্ঞতাহীন ছেলে। এইভাবে সাইকেলে ঘুরতে বেরোনোর কথা শুনে আমার মায়ের চোখে তো পানি টলমল করতে থাকল। বাবা তখন চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকেন। আমাদের দেশ-ভ্রমণের পরিকল্পনার খবর পেয়ে একটা অসামান্য চিঠি লিখেছিলেন। অনেক দিন পর্যন্ত আমি চিঠিটা যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম, এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। কিশোরজীবনে অ্যাডভেঞ্চারের স্থান, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন আর সাধ্য-সামর্থ্যকে বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় বিধানের অত্যাবশ্যকতা, মা-বাবা কেন সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন হন—এই সব কথা খুব সহজ ও সুন্দর করে লিখেছিলেন বাবা। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই ভ্রমণের অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে মিথ্যা আত্মাভিমান অথবা জেদের বশে যেন কিছু না করি। অর্থাৎ, সহজে যত দূর ঘুরতে পারি, তত দূরই যেন যাই, তার বেশি নয়।
একদিন কাকডাকা ভোরে আমরা দুই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঝোলার মধ্যে একপ্রস্থ করে শার্ট-প্যান্ট, গামছা-গেঞ্জি, টুথব্রাশ-টুথপেস্ট-চিরুনি, পানির ফ্লাস্ক, টর্চলাইট, ছোট একটা ছুরি, একটা শিশিতে একটু আয়োডিন, একটা ছোট নোটবই ও পেনসিল, আরও দু-চারটে টুকিটাকি জিনিস। শেষ মুহূর্তে আমি, আগে পড়া হলেও, ম্যাক্সিম গোর্কির মাদার বইটাও সঙ্গে নিয়ে নিলাম।
কতকাল আগের কথা! ১৯৩৮ সালের একেবারে গোড়ার দিকের ঘটনা। সব আজ ভালো করে মনেও নেই। আমরা কিছুমাত্র স্ট্রেন না করে সহজভাবে সাইকেল চালিয়েছিলাম। দুপুরে একটা গঞ্জে থেমে সস্তা হোটেলে ডাল-ভাত ও মাছ-তরকারি খেয়ে নিয়ে তারপর আবার চলতে শুরু করি। সন্ধ্যার আগে হঠাৎ ঝড় উঠে বৃষ্টি নামল। সে এক বিশ্রী ব্যাপার। বাতাস ঠেলে সাইকেল চালানো কষ্টকর হয়ে উঠল। পরের জনপদ থেকে আমরা তখনো তিন-চার মাইল দূরে। ভিজে সপসপে হয়ে আমরা যখন সেখানে এসে পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। সেটা ছিল ফরিদপুর শহরের কাছাকাছি একটা পুরোপুরি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। গৃহস্থ বাড়িতে শাঁখ বাজানো ও তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো হয়ে গেছে। গ্রামে ঢুকে একজন মাঝবয়সী চাষির কাছে খবর নিয়ে আমরা এক সমৃদ্ধ গোছের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলাম। বেশ সচ্ছল গৃহস্থ। হিন্দু। হিমাংশু আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল যে এই রকম গ্রামাঞ্চলে দুটি অল্প বয়সের ছেলে, একজন হিন্দু ও আরেকজন মুসলমান, ওই রকম গোলমেলে পরিচয়ে আমাদের কোনো বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কাজেই আমি হয়ে গেলাম হিমাংশুর ছোট সুধাংশু। চেহারা, পোশাক-আশাক ও কথাবার্তায় কে কোন ধর্মের, তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। শুধু আমাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন পানি বলে না ফেলি, হিমাংশুকে দাদা বলে সম্বোধন করি এবং এঁটো ডান হাতে কাঁসার গ্লাস তুলে নিয়ে পানি খাই। গৃহকর্তা সেই বাদলের রাতে আমাদের সমাদর করে আশ্রয় দিয়েছিলেন, শোয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বাইরের ঘরে টিনের আটচালায়, খেতে দিয়েছিলেন চিড়া-মুড়ি-কলা ও দুধ।
আমরা পরদিন খুব ভোরে ওই গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের কিশোর বয়সের সেই অ্যাডভেঞ্চার আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। শারীরিক ক্লান্তি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার অত্যাচারে মধ্যাহ্নের দিকেই আবার আমরা ঘরের পথ ধরি। সব মিলিয়ে আমরা বোধহয় সোয়া শ মাইলের মতো ঘুরেছিলাম। যা হোক, আজ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও ওই সাইকেল ভ্রমণের স্মৃতি আমার মনে বহুদিন উজ্জ্বল হয়ে ছিল। হিমাংশু ও আমার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ওই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একটা নতুন মাত্রিকতা যোগ করেছিল।
আমার স্কুলজীবনের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলার সুকুমার স্যারের কথা বেশ ভালো মনে আছে। লম্বা-চওড়া, বলিষ্ঠ দেহ, মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো, চমৎকার করে ধোয়া সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ভারী সুন্দর করে পড়াতেন। সেকালের প্রথা অনুযায়ী প্রায়ই নোট দিতেন। নতুন কবিতা শুরু করার সময় প্রাথমিক দু-একটা কথা বলার পর বলতেন, হ্যাঁ, এবার লিখে নাও।
হিমাংশুর সঙ্গে আমার স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব কলেজজীবন পেরিয়ে আমার কর্মজীবন ও সংসারজীবনকেও আলিঙ্গন করে। যত দিন ও বেঁচে ছিল, তত দিন পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব অম্লান ছিল।
হিমাংশু চমৎকার ছবি তুলতে পারত। সুযোগ-সুবিধা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা যদি সে লাভ করত, তাহলে সে যে এ উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রশিল্পী হতে পারত, সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ওদের বাড়ির কাছেই ছিল সে সময়কার নামকরা একটা ক্যামেরা ও ফটোগ্রাফির বিভিন্ন সরঞ্জামের দোকান। ফটো তোলাও হতো সেখানে। নাম ছিল খুব সম্ভব ইংরেজিতে Dass অথবা Doss স্টুডিও। প্রথম দিকে এ স্টুডিওর কিছু সহযোগিতা পেয়েছিল হিমাংশু। তাও ছিল অনুদার এবং স্বল্প সময়ের জন্য। কিন্তু ওইটুকুই হিমাংশু তার নিষ্ঠা ও প্রতিভা দিয়ে কাজে লাগিয়েছিল। ওর ঝোঁক ছিল নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে। আজ এসব কাজ খুব সাধারণ মনে হয়, নিত্য দেখি; কিন্তু চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকায় তা অভিনব ছিল। নানা রকম আলোছায়ার খেলা, সিলুয়েট, ফুলের মধ্যে মানুষের মুখ, সুপার ইম্পোজ করা মন্তাজ ধরনের ছবি, সাবজেক্টের অসতর্ক মুহূর্তের ঘরোয়া ছবির পাশাপাশি যত্নসহকারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী মহড়া দিয়ে কম্পোজ করা আনুষ্ঠানিক ছবি প্রভৃতি সব ধরনের কাজে হিমাংশুর ছিল যেমন উৎসাহ তেমনি দক্ষতা। জীবিকা অর্জনের তাগিদে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সে ছবি তোলাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। পুরানা পল্টনে একটা রাস্তার মোড়ে এক ভদ্রলোকের অব্যবহূত মোটর গ্যারেজকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে হিমাংশু সেখানে দোকান খুলেছিল। নাম দিয়েছিল মাই স্টুডিও। আমার বয়সী কারও কারও হয়তো আজও মাই স্টুডিওর কথা মনে আছে। ওই ছোট টিনের ঘরেই ছিল তার ডার্করুম, যাবতীয় আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম, নিজের তোলা চমৎকার কিছু ছবির ডিসপ্লে। কোনো পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল না সে। সাংবাদিক হিসেবে ছিল অজ্ঞাতপরিচয়। সম্পূর্ণ ফ্রিল্যান্সার। লোন উলফ। কিন্তু গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী, নিপুণ আলাপচারী হিমাংশু ছিল খুবই আত্মপ্রত্যয়ী। ওই অল্প বয়সে শুধু নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে সে সব প্রটোকল ভেঙে কঠিন জায়গায় গিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলে আনত। শুধু তা-ই নয়, তাদের সঙ্গে আলাপ করে অনেক সময় একটা ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও সক্ষম হতো। এইভাবে সে কী রকম করে হকির জাদুকর ধ্যান চাঁদ, আমাদের উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরোজিনী নাইডু, শেরেবাংলা ফজলুল হক প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, তাঁদের ছবি তুলেছিল, প্রদীপ্ত চোখে সে তার গল্প করেছে আমার কাছে। হিমাংশু আমাকে একদিন নিয়েও গিয়েছিল ধ্যান চাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ধ্যান চাঁদ ছিলেন ঢাকাতে মোতায়েন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সদস্য। সেদিনের কুর্মিটোলায় সেনাবাহিনীর একটি খেলার মাঠের পাশে আমার দেখা হয়েছিল ধ্যান চাঁদের সঙ্গে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হকি খেলোয়াড় হিসেবে তখন তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। কিন্তু ধ্যান চাঁদকে দেখে বা তাঁর সঙ্গে কথা বলে সেটা বোঝার উপায় ছিল না। সরোজিনী নাইডুর সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি কংগ্রেস আয়োজিত একটি রাজনৈতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ প্রাঙ্গণে স্বাধীনতা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তরুণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে একটি চমৎকার উদ্দীপনাময় বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। এসব প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। শেরেবাংলার ছবি তোলা প্রসঙ্গে হিমাংশু আমাকে একটি মজার কাহিনি শুনিয়েছিল। সে একদিন শেরেবাংলার বাসায় গিয়েছে। আগে থেকে দিনক্ষণ ঠিক করা ছিল। হিমাংশু বসার ঘরে আসন গ্রহণ করে খবর পাঠাতেই ফজলুল হক এসে হাজির হলেন। দু-এক কথা বলার পর হিমাংশু তার ক্যামেরা ঠিক করে ছবি তুলতে উদ্যত হলো। তক্ষুনি শেরেবাংলা হাত তুলে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আগে একটু সেন্ট মেখে আসি, কী বলো? বলেই সেই পুরোনো রসিকতাতে তাঁর বিখ্যাত ছাদ-ফাটানো হাসি।
সে সময়ের কথা বলছি যখন আমরা থাকি মাহুতটুলীর শরৎ চক্রবর্তী রোডে। তখন হিমাংশু প্রায় প্রতি বিকেলেই হেঁটে কিংবা সাইকেলে ওদের নবাবপুরের বাসা থেকে আমাদের বাসায় চলে আসত। ও না এলে আমি যেতাম। ছুটির দিনে ও চলে আসত। সকাল নয়টার মধ্যে। তারপর কত গল্প যে আমরা করতাম! কিসের গল্প, তা আজ মনেও নেই। সম্ভবত স্কুলের গল্প, বন্ধুবান্ধবের কথা, নতুন পড়া বইয়ের আলোচনা, খেলার হারজিত ইত্যাদি। তবে সময় যে কীভাবে গড়িয়ে যেত, দুজনের কেউই তা টের পেতাম না। শেষে যখন দুপুরের খাওয়ার সময় এগিয়ে আসত, তখন হিমাংশু উঠে পড়ত। আমি তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের বিশাল বটগাছটার কাছে গিয়ে থামতাম। তখন ও বলত, তুই এতটা পথ একা যাবি? চল, তোকে বাসায় পৌঁছে দিই। কত দিন এইভাবে যে আমরা আসা-যাওয়া করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। এখনো কি দুই কিশোরের মধ্যে এ রকম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে? নিশ্চয়ই ওঠে, শুধু আমরা জানতে পারি না।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি আর হিমাংশু ঠিক করেছিলাম যে আমরা দুজন সাইকেলে পূর্ববঙ্গ সফরে বেরোব। আমার বয়স তখন সবে পনেরো ছাড়িয়েছে। হিমাংশুর ষোলো। প্রথমে পরিকল্পনা করেছিলাম গোটা ভারত পরিক্রমার। পরে নিজেরাই নিজেদের বয়স, অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য ইত্যাদির বিশদ বিবেচনার পর আদিপরিকল্পনা বাতিল করে দিই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পূর্ববঙ্গের সামান্য একটু অংশ ভ্রমণ করেই আমাদের অ্যাডভেঞ্চার পর্বের ইতি টানতে হয়। কিন্তু ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার আগের ছোট একটা ইতিহাস আছে। তার কথা বলে নিই।
সাইকেলে করে আমরা দুজন আনাড়ি কিশোর এইভাবে ঘুরতে বেরোব—এটা আমাদের দুই পরিবারের বড়দের কারোরই ভালো লাগেনি। বিশেষ করে, আমার পরিবারের। আমি ছিলাম বাড়ির প্রথম সন্তান, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের আদরে লালিত কষ্ট সহ্য করার অভিজ্ঞতাহীন ছেলে। এইভাবে সাইকেলে ঘুরতে বেরোনোর কথা শুনে আমার মায়ের চোখে তো পানি টলমল করতে থাকল। বাবা তখন চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকেন। আমাদের দেশ-ভ্রমণের পরিকল্পনার খবর পেয়ে একটা অসামান্য চিঠি লিখেছিলেন। অনেক দিন পর্যন্ত আমি চিঠিটা যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম, এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। কিশোরজীবনে অ্যাডভেঞ্চারের স্থান, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন আর সাধ্য-সামর্থ্যকে বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় বিধানের অত্যাবশ্যকতা, মা-বাবা কেন সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন হন—এই সব কথা খুব সহজ ও সুন্দর করে লিখেছিলেন বাবা। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই ভ্রমণের অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে মিথ্যা আত্মাভিমান অথবা জেদের বশে যেন কিছু না করি। অর্থাৎ, সহজে যত দূর ঘুরতে পারি, তত দূরই যেন যাই, তার বেশি নয়।
একদিন কাকডাকা ভোরে আমরা দুই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঝোলার মধ্যে একপ্রস্থ করে শার্ট-প্যান্ট, গামছা-গেঞ্জি, টুথব্রাশ-টুথপেস্ট-চিরুনি, পানির ফ্লাস্ক, টর্চলাইট, ছোট একটা ছুরি, একটা শিশিতে একটু আয়োডিন, একটা ছোট নোটবই ও পেনসিল, আরও দু-চারটে টুকিটাকি জিনিস। শেষ মুহূর্তে আমি, আগে পড়া হলেও, ম্যাক্সিম গোর্কির মাদার বইটাও সঙ্গে নিয়ে নিলাম।
কতকাল আগের কথা! ১৯৩৮ সালের একেবারে গোড়ার দিকের ঘটনা। সব আজ ভালো করে মনেও নেই। আমরা কিছুমাত্র স্ট্রেন না করে সহজভাবে সাইকেল চালিয়েছিলাম। দুপুরে একটা গঞ্জে থেমে সস্তা হোটেলে ডাল-ভাত ও মাছ-তরকারি খেয়ে নিয়ে তারপর আবার চলতে শুরু করি। সন্ধ্যার আগে হঠাৎ ঝড় উঠে বৃষ্টি নামল। সে এক বিশ্রী ব্যাপার। বাতাস ঠেলে সাইকেল চালানো কষ্টকর হয়ে উঠল। পরের জনপদ থেকে আমরা তখনো তিন-চার মাইল দূরে। ভিজে সপসপে হয়ে আমরা যখন সেখানে এসে পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। সেটা ছিল ফরিদপুর শহরের কাছাকাছি একটা পুরোপুরি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। গৃহস্থ বাড়িতে শাঁখ বাজানো ও তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো হয়ে গেছে। গ্রামে ঢুকে একজন মাঝবয়সী চাষির কাছে খবর নিয়ে আমরা এক সমৃদ্ধ গোছের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলাম। বেশ সচ্ছল গৃহস্থ। হিন্দু। হিমাংশু আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল যে এই রকম গ্রামাঞ্চলে দুটি অল্প বয়সের ছেলে, একজন হিন্দু ও আরেকজন মুসলমান, ওই রকম গোলমেলে পরিচয়ে আমাদের কোনো বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কাজেই আমি হয়ে গেলাম হিমাংশুর ছোট সুধাংশু। চেহারা, পোশাক-আশাক ও কথাবার্তায় কে কোন ধর্মের, তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। শুধু আমাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন পানি বলে না ফেলি, হিমাংশুকে দাদা বলে সম্বোধন করি এবং এঁটো ডান হাতে কাঁসার গ্লাস তুলে নিয়ে পানি খাই। গৃহকর্তা সেই বাদলের রাতে আমাদের সমাদর করে আশ্রয় দিয়েছিলেন, শোয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বাইরের ঘরে টিনের আটচালায়, খেতে দিয়েছিলেন চিড়া-মুড়ি-কলা ও দুধ।
আমরা পরদিন খুব ভোরে ওই গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের কিশোর বয়সের সেই অ্যাডভেঞ্চার আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। শারীরিক ক্লান্তি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার অত্যাচারে মধ্যাহ্নের দিকেই আবার আমরা ঘরের পথ ধরি। সব মিলিয়ে আমরা বোধহয় সোয়া শ মাইলের মতো ঘুরেছিলাম। যা হোক, আজ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও ওই সাইকেল ভ্রমণের স্মৃতি আমার মনে বহুদিন উজ্জ্বল হয়ে ছিল। হিমাংশু ও আমার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ওই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একটা নতুন মাত্রিকতা যোগ করেছিল।
আমার স্কুলজীবনের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলার সুকুমার স্যারের কথা বেশ ভালো মনে আছে। লম্বা-চওড়া, বলিষ্ঠ দেহ, মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো, চমৎকার করে ধোয়া সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ভারী সুন্দর করে পড়াতেন। সেকালের প্রথা অনুযায়ী প্রায়ই নোট দিতেন। নতুন কবিতা শুরু করার সময় প্রাথমিক দু-একটা কথা বলার পর বলতেন, হ্যাঁ, এবার লিখে নাও।
No comments