১৭ পথে ট্রানজিট মাশুলের প্রস্তাব by জাহাঙ্গীর শাহ
সড়ক, রেল ও নৌপথে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দিতে মাশুল নির্ধারণ করেছে সরকার গঠিত বিশেষ কমিটি। এই কমিটি ১৭টি পথের প্রতিটিতেই পৃথক মাশুল ঠিক করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবকাঠামো না থাকায় আগামী তিন বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব নয়। পূর্ণাঙ্গ টানজিট দেওয়া হলে বছরে এক কোটি ৭৩ লাখ টন পণ্য বহন করা সম্ভব হবে।
আর আপাতত ট্রানশিপমেন্ট দেওয়া হলে সম্ভব হবে এর ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ লাখ টন পণ্য বহন করা যাবে। অবকাঠামো উন্নয়নে আগামী ১০ বছরে ৪৭ হাজার ৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। কমিটির অন্যতম সদস্য রহমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এই কমিটির সুপারিশ করা মাশুলের আলোকে আগামী মার্চ মাসে নৌ-প্রটোকল নবায়নের সময় দর-কষাকষি করতে পারে বাংলাদেশ। আর মাশুল চূড়ান্ত করার আগে আপাতত নৌ-প্রটোকলের আওতায় বিনা মাশুলে ট্রানজিট বন্ধ রাখাই যৌক্তিক হবে।
ট্রানজিট নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে গত ৪ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কোর কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত এপ্রিলে কমিটি সম্ভাব্য রুট বা পথ চিহ্নিত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে কমিটিকে মাশুল নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোর কমিটিতে ছিলেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ রহমত উল্লাহ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (শুল্ক) হুসেইন আহমেদ (পরে এনবিআরের সদস্য শাহ আলম খান), বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সাদিক আহমেদ।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে বিনা মাশুলে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু হয়েছে। এই পথটি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের জন্য আশুগঞ্জ বন্দর প্রস্তুত হতে আরও দুই-তিন বছর সময় লাগবে। কারণ আশুগঞ্জ নৌবন্দরে এখনো পণ্য ট্রানশিপমেন্ট (জাহাজ থেকে ট্রাকে ওঠানো) করার মতো অবকাঠামো নেই।
নতুন নৌ-প্রটোকলের সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিট দিতে বিদ্যমান প্রটোকলে কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রটোকলে বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজের ওপর নজরদারি করা, জাহাজের নিরাপত্তা, প্রশাসনিক মাশুল ও সেবামাশুল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এ বিষয়ে রহমত উল্লাহ আরও জানান, ট্রানজিট দিলে নির্ধারিত মাশুল ছাড়াও ভারতের যে পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে তার থেকে ভাগ চাওয়া উচিত হবে।
এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিটের উদ্যোগ কিছুটা স্তিমিত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য সহযোগিতাবিষয়ক কমিটি গত দুই মাসে মাত্র একটি বৈঠক করেছে। ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিটের পরিবর্তে নৌ-প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিটকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
১৭ পথে মাশুল: ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দিতে সড়ক, রেল ও নৌপথের জন্য ১৭ পথ প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি করে সড়ক ও রেলপথ এবং তিনটি নৌপথ চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক, রেল ও নৌপথে দুটি করে সম্ভাবনাময় আরও ছয়টি পথ চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিটি পথেই স্থির ও পরিবর্তনশীল—এ ধরনের মাশুল আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর পরিবর্তনশীল মাশুল পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। স্থির মাশুলে কাস্টমস ও স্থলবন্দর ব্যবহার করা এবং বিদেশি যান বা জাহাজ প্রবেশ-মাশুল রাখা হয়েছে।
সড়ক: কলকাতা-পেট্রাপোল/বেনাপোল-ঢাকা-আখাউড়া-আগরতলা পথে ২৪ হাজার ৭০৫ টাকা, আগরতলা-আখাউড়া-চট্টগ্রাম পথে ১৮ হাজার ৯০৭ টাকা, শিলচর-সুতারকান্দি-চট্টগ্রাম বন্দর পথে ২৭ হাজার ৯৮ টাকা, শিলচর-সুতারকান্দি-পাটুরিয়া-বেনাপোল/পেট্রাপোল-কলকাতা পথে ৩১ হাজার ৮৩৭ টাকা, সামড্রুপ জংখার (ভুটান)-গোয়াহাটি-শিলং-তামাবিল-সিলেট-চট্টগ্রাম পথে ২৭ হাজার ৮৮০ টাকা, কাঠমান্ডু-কাকরভিটা/ফুলবাড়ী-বাংলাবান্ধা-মংলা/চট্টগ্রাম পথে ৩৮ হাজার ৩২৬ টাকা এবং থিম্পু-ফুয়েন্টসলিং-জয়গাঁও/বুড়িমারী-মংলা/চট্টগ্রাম পথে ৩৫ হাজার ১৩ টাকা টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
সড়ক পথগুলোর জন্য নয় টনের ট্রাক বিবেচনায় এনে ১০ ধরনের মাশুলের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে স্থির মাশুল হলো কাস্টমস ও স্থলবন্দর সেবা এবং বিদেশি যান প্রবেশ মাশুল। এ ছাড়া ভূমি ব্যবহার, ভূমি ক্ষতিজনিত, সড়ক বিভাগের প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, নিরাপত্তা, যানজট, পরিবেশদূষণ ও শব্দদূষণ মাশুল—এগুলো হবে পরিবর্তনশীল মাশুল।
সড়কপথগুলো মূল্যায়ন করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কপথের বেহাল দশার কারণে আগামী দুই-তিন বছর সাময়িকভাবে ট্রানশিপমেন্ট দেওয়া যেতে পারে।
রেল: প্রতিটি কনটেইনার ট্রেনে এক হাজার ৬৫০ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে—এমন হিসাব ধরেই মাশুলের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিলচর-মাহীসাশান/শাহবাজপুর-ঢাকা আইসিডি (ধীরাশ্রম)-বঙ্গবন্ধু সেতু-দর্শনা/গেদে-কলকাতা পথে ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৩ টাকা, শিলচর-মাহীসাশান/শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম বন্দর পথে ২৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ টাকা, আগরতলা-আখাউড়া-ঢাকা আইসিসিডি-বঙ্গবন্ধু সেতু-দর্শনা/গেদে-কলকাতা পথে ৩১ লাখ ২৭ হাজার ৮২৪ টাকা, আগরতলা-আখাউড়া-চট্টগ্রাম বন্দর পথে ১৪ লাখ ১০ হাজার ১৮২ টাকা, কলকাতা-পেট্রাপোল/বেনাপোল-খুলনা-মংলাবন্দর পথে ১০ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৫ টাকা, বীরগঞ্জ-রেক্সোয়াল-কটিহার-সিংহবাদ/রোহনপুর-খুলনা-মংলা বন্দর পথে ২৬ লাখ ২২ হাজার ৭০২ টাকা এবং জগবাণী-বিরাটনগর-রাধিকাপুর/বিরল-পার্বতীপুর-খুলনা-মংলা বন্দর পথে ৩১ লাখ ৩৩ হাজার ৩১৫ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
রেলপথের জন্য ১০ ধরনের মাশুলের কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ভূমি ব্যবহার, রেললাইন, রেল বিভাগের প্রশাসনিক, নিরাপত্তা, পরিবেশনদূষণ, দুর্ঘটনা, শব্দদূষণ ও রেল কনটেইনারজট মাশুল পরিবর্তন করা যাবে।
রেলপথগুলো মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ রেলট্র্যাক থাকায় ভারতের উত্তরা-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব নয়। এ ধরনের অবকাঠামো তৈরি করে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করতে আরও তিন বছর সময় লাগবে। এ ছাড়া রেলপথে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ওজনের সীমাবদ্ধতা থাকায় আরেকটি রেল সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
নৌপথ: ৮০০ টন পণ্য পরিবহন সম্ভব—এমন পণ্যবাহী জাহাজ বিবেচনায় এনে মাশুল হিসাব করা হয়েছে। কলকাতা-নামখানা-শেখবাড়িয়া-মংলা-কাউখালী-বরিশাল-চাঁদপুর-ভৈরববাজার/আশুগঞ্জ শেরপুর-জকিগঞ্জ-করিমগঞ্জ পথে ১০ লাখ ৮২ হাজার ১৫২ টাকা, কলকাতা-নামখানা-শেখবাড়িয়া-মংলা-কাউখালী-বরিশাল-চাঁদুপর-মাওয়া-পাটুরিয়া-সিরাজগঞ্জ-চিলমারী-ডাইকহাওয়া-ধুবরী-পাণ্ডু-শিলঘাট পথে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৭৩৭ টাকা এবং কলকাতা-নামখানা-শেখবাড়িয়া-মংলা-কাউখালী-বরিশাল-চাঁদপুর-আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথের জন্য আট লাখ ৪৭ হাজার ৩৩ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে আশগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের জন্য সড়কপথের হিসাব অনুযায়ী মাশুল পরিশোধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নৌপথের ডিজাইন (ড্রেজিংসহ), নৌ-সংস্থার প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, নিরাপত্তা, নৌ-কনটেইনারজট, পরিবেশদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ ও জ্বালানিমূল্য সমন্বয় বিবেচনায় এনে মাশুল হিসাব করা হয়েছে।
No comments