পুঁজিবাজারে বারবার দরপতন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা by আনোয়ার ইব্রাহীম

শেয়ারবাজারের সর্বশেষ পরিস্থিতিকে জাতীয় সংকট হিসেবে আখ্যায়িত করে তা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ করার পক্ষে মত দিয়েছেন দেশের শেয়ারবাজার ও অর্থনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ থেকে গত ১১ মাসে নানা উদ্যোগ বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারেনি। ফলে একদিন শেয়ারদর বাড়লে পরের দিনই তা ব্যাপক হারে কমছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা দ্রুতই কমে যাচ্ছে_ এমন সতর্কবার্তা দিয়ে তারা বলেছেন, বিষয়টির এখানেই সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।


অন্যথায় দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।আবারও দরপতন : ব্যাংকগুলোর এ সপ্তাহ থেকে ফের বিনিয়োগে ফেরার ঘোষণার পর গত বৃহস্পতিবার সূচক বাড়ে ২৮৬ পয়েন্ট ও রোববার ১০৯ পয়েন্ট। আবার বিএবির মিউচুয়াল ফান্ড গঠন নিয়ে বিভ্রান্তিতে সোমবার সূচক কমে ১৮০ পয়েন্ট। মঙ্গলবার এসইসির সঙ্গে বিএবির বৈঠক থেকে বিভ্রান্তির অবসান হবে_ এমন আশা করলেও হতাশ হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ওইদিন বিএবি সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে বিনিয়োগ করছে। এর
প্রতিক্রিয়ায় গতকাল বুধবার সূচক কমেছে ১৪৩ পয়েন্টেরও বেশি। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ২৫৭টি শেয়ারের মধ্যে ২৩৭টিরই দর কমেছে। ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এ নিয়ে গত ২৫ জুলাইয়ের পর মোট ৬০ কার্য দিবসের ৪১ দিন বাজারে দরপতন হয়েছে। বিপরীতে সূচক বেড়েছিল মাত্র ১৯ দিন। এ সময়ে ডিএসইর সাধারণ সূচক কমেছে ১৩০০ পয়েন্ট। গত জুলাইয়ের দৈনিক দেড় হাজার কোটি টাকার গড় লেনদেন এ মাসে নেমে এসেছে ৩৩৫ কোটি টাকায়। গতকালও ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৩৪৩ কোটি টাকার শেয়ার।
গত ১১ মাস ধরে দরপতন চলতে থাকায় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগের সিংহভাগই হারিয়েছেন। বিশেষত মার্জিন ঋণ (মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউস থেকে শেয়ার কেনার জন্য নেওয়া ঋণ) নিয়ে যারা বিনিয়োগ করেছেন, উল্টো তাদের ঘাড়ে বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসিতে পাঠানো ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্রোকারেজ হাউসের এক বিনিয়োগকারীর অভিযোগ থেকে জানা যায়, নিজের সঞ্চয়ের ৪৩ লাখ টাকাসহ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনে চরম লোকসানের শিকার হয়েছেন তিনি। লোকসানে নিজের পুরো সঞ্চয় খোয়ানোর পরও ব্যাংকের কাছে তার ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। একই অবস্থা লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর।
বিক্ষোভ : ফের দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় রাজধানীতে ডিএসই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা অভিযোগ করেন, বিনিয়োগে ফেরার আশ্বাস সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে ফেরেনি। এতে বিনিয়োগকারীরা যেকোনো উদ্যোগের বিষয়ে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, নানা পক্ষ থেকে অনেক প্রণোদনার কথা বলা হলেও সেগুলোর কোনোটাই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আর কারও কোনো উদ্যোগেই বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস নেই। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করে তিনি বলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে না।
ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ নামমাত্র : দেশের উভয় শেয়ারবাজার সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত এ সপ্তাহের প্রথম চার দিনে ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ ৩০ কোটি টাকার বেশি হবে না। গত চার দিনে ডিএসইতে মোট এক হাজার ৭২৯ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। একই সময়ে সিএসইতে লেনদেন হয় প্রায় পৌনে দুইশ' কোটি টাকার শেয়ার।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা :২০০৮ সালে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সরকারও নিজেদের উদ্যোগেই তা সমাধানে এগিয়ে এসেছিল_ এমন উদাহরণ টেনে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে ডেকে প্রধানমন্ত্রীর জানতে চাওয়া উচিত, কেন শেয়ারবাজার সমস্যা এতটা প্রলম্বিত হচ্ছে। কেনইবা এত উদ্যোগেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতামতের ভিত্তিতে জরুরিভাবে সমন্বিত ও বাস্তবায়নযোগ্য উদ্যোগ নেওয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। সরকার এ সংকটকে পাশ কাটিয়ে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেয়ারবাজার সমস্যা দিনে দিনে জটিল আকার ধারণ করছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক সিইও সালাউদ্দিন আহমেদ খান। গত ১১ মাসের সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের উদ্যোগগুলোকে 'কথাসর্বস্ব' হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এসব উদ্যোগের কোনোটাই বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে কাজ করেনি। এর প্রধান কারণ, বাজারের সমস্যাকে বিবেচনায় নিয়ে ওই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়নি। যেটুকুও বা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নে এতটাই দীর্ঘসূত্রতা হয়েছে, তাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আরও বৃদ্ধি করে। যার সর্বশেষ ফলাফল দরপতন। এমনকি অর্থমন্ত্রীর ওপর থেকে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
উদ্ভূত সমস্যায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করা উচিত মত দিয়ে সালাউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, 'আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, সরকারের সামনে যখন অনেক সমস্যা, তখন কেন সমাধানযোগ্য এ সমস্যাটি জিইয়ে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত, এখনই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এক টেবিলে ডেকে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া। প্রধানমন্ত্রী বা সরকার যদি এ সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না রাখে, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, সরকার অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে কি-না।'
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এসইসির চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও মনে করেন শেয়ারবাজার সংকট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের সৃষ্ট সংকট অর্থনীতিতে আর সাধারণ ক্ষতের পর্যায়ে নেই। ধীরে ধীরে এটি ক্যান্সারে রূপ নিচ্ছে। এ অবস্থায়ও ব্যবস্থা না নিলে এ ক্যান্সারে সরকারও আক্রান্ত হবে।
টানা ১১ মাসের শেয়ারবাজার সংকটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ছিয়ানব্বইয়ের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে এক যুগেরও বেশি সময় লেগেছে। তারা বলেন, এ অবস্থা উত্তরণে দেরি হলে দেশের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করা সরকারের স্বপ্ন কাগজে-কলমেই রয়ে যাবে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, ব্যাংকগুলোর পক্ষে এ বিনিয়োগ জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। একমাত্র শেয়ারবাজারই নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হলে সে সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে যাবে।
শেয়ারবাজার সমস্যা সমাধানে তাই পরোক্ষে হলেও সরকারের ভূমিকা রাখা উচিত বলে মত দেন এসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সন্দেহ নেই শেয়ারবাজার সমস্যা এখন জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। জাতীয় সমস্যা সমাধানে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। শেয়ারবাজারে সরাসরি সরকার হস্তক্ষেপ না করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন শেয়ারবাজার সমস্যা সমাধানের ওপর সরকারের ভাবমূর্তিও নির্ভর করছে। অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের অবদান নেই_ সরকারের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক ব্যক্তির এমন ধারণার বিরোধিতা করে তারা বলেন, গত দুই বছরে শিল্পে যে বিনিয়োগ হয়েছে, শেয়ারবাজার থেকে তার এক-পঞ্চমাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকগুলো যে অর্থায়ন করেছে, তার বৃহৎ অংশই গেছে শেয়ারবাজার থেকে। দেশে সক্রিয় অন্তত ২০ হাজার কোম্পানির মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সংখ্যা ৩০০টিরও কম। তারপরও এ শেয়ারবাজার থেকে মোট বিনিয়োগের এক-পঞ্চমাংশ বিনিয়োগ যাওয়াকে কোনোভাবে তুচ্ছ করা চলে না বলে মত দেন তারা। বরং আরও কোম্পানিকে আনা গেলে শিল্পায়নে অর্থের প্রধান উৎস হবে শেয়ারবাজার। কিন্তু শেয়ারবাজার ধ্বংস করে তা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় উদ্ভূত সংকট সমাধান করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

No comments

Powered by Blogger.