পলকের ফাইভ স্টার বাহিনী by সাবি্বর নেওয়াজ ও নবীউর রহমান পিপলু,

তারা পাঁচজন। ডন, শরিফ, সোহেল, আরিফ ও ফেরদৌস। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় তারা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। পাঁচজনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে 'ফাইভ স্টার বাহিনী'। সাধারণ মানুষের জমি, বাড়িঘর ও সরকারি জলমহাল দখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও এলাকাছাড়া করাসহ হেন অপরাধ নেই যার সঙ্গে এ বাহিনীর সম্পৃক্ততা নেই। এ বাহিনীর পাঁচজনই যেন হাতে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। রাতারাতি বনে গেছেন কোটিপতি। আর এ বাহিনীর ক্ষমতার উৎস হলেন নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সাংসদ জুনাইদ আহমেদ পলক।


তিনিই এ বাহিনীর সবকিছু সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি জাতীয় সংসদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তিনি। প্রথমবারের মতো সাংসদ হয়েছেন সিংড়া থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তরুণ এ রাজনীতিক। '৭৩ সালের পর এবারই প্রথম
আওয়ামী লীগ এ আসনটিতে জিতেছে। পরিবর্তনের আশায় এলাকার মানুষ বিপুল ভোটে পলককে নির্বাচিত করে। তবে সাংসদ হওয়ার পরই নিজেকে বদলে ফেলেন তিনি। পলকের নিয়ন্ত্রিত ফাইভ স্টার বাহিনী সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, পুকুর দখল, অপহরণ, বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতনসহ নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনে রীতিমতো রেকর্ড গড়েছে। বাধ্য হয়ে জেলা যুবলীগ ফাইভ স্টার বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিচার দাবি করে সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত করেছে। তবুও কিছুতেই কিছু হয়নি। দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এই বাহিনী।
সমকালের অনুসন্ধানে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সিংড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ফাইভ স্টার বাহিনীর নানা অপকর্মের প্রমাণ মিলেছে। এলাকার সাধারণ মানুষ, বিএনপি এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এ বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তবে রাজধানীর নিজ বাসায় বসে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে সাংসদ জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেছেন, 'সিংড়ায় ফাইভ স্টার বাহিনী নামে কোনো বাহিনীর অস্তিত্ব নেই।' এ বাহিনীর সদস্যদের নামসহ তাদের নানা অপকর্মের বিবরণ তুলে ধরা হলে তরুণ এ সাংসদ বলেন, তিনি এর কিছু কিছু ঘটনা শুনেছেন। সব জানেন না। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন।
দখল উৎসব :সিংড়ার কলম, চৌগ্রাম ও সুকাশ ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমপি হিসেবে শপথ গ্রহণের পরই এলাকার বিভিন্ন জলমহাল ও সম্পত্তি দখলে নিতে স্থানীয় ফাইভ স্টার ক্লাবকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয় ফাইভ স্টার বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্ব সিংড়ার পাঁচ সন্ত্রাসীর হাতে। ২০০৯ সালের প্রথমার্ধে অপ্রতিরোধ্য এই ফাইভ স্টার বাহিনী প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খাস পুকুর জবরদখল করে নিজেরাই অন্যের কাছে সাব-লিজ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করে। সিংড়া উপজেলার রামানন্দ খাজুরিয়া ইউনিয়নের ১৯ একর আয়তনের সৈয়দপুর পুকুর দু'বছর ধরে জবরদখল করে আছে তারা। এই পুকুর সাব-লিজ দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সৈয়দপুর গ্রামে সরেজমিন গেলে স্থানীয় জনতা ফাইভ স্টার বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন। তারা জানান, সিংড়া উপজেলার বিরাট এক অংশ জুড়ে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বিল 'চলনবিল'। এ ছাড়াও রয়েছে বিপুলসংখ্যক জলমহাল ও খাস পুকুর। এসব কারণে এ উপজেলায় প্রচুর মাছ চাষ হয়, যা থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় হয়। ফাইভ স্টার বাহিনীর মাধ্যমে উপজেলার বেশিরভাগ জলমহাল চলে গেছে সাংসদ পলকের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয়রা জানান, ১০ একর আয়তনের বালালদীঘি পুকুর, ডাহিয়া ইউনিয়নের ১১ একর আয়তনের হাতিগাড়া পুকুর, ইতালী ইউনিয়নের ৬ একরের সালমারা পুকুর, চৌগ্রাম ইউনিয়নের ১২ একর আয়তনের আরও ১০টি পুকুর উপজেলা প্রশাসন নিয়োগকৃত ইজারাদারদের তাড়িয়ে দিয়ে জবরদখল করেছে এই ফাইভ স্টার বাহিনী।
এসব ব্যাপারে সাংসদ জুনায়েদ আহমেদ পলক সমকালকে বলেন, জলমহালগুলোর বেশিরভাগই বিএনপির লোকজনের দখলে ছিল। তিনি এমপি হওয়ার পর সেগুলো দখলমুক্ত করা হয়েছে। এর পর তা প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মধ্যে নীতিমালা অনুসারে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এই বাহিনী জমি ও অন্যের বসতভিটাও দখল করে নিয়েছে। সিংড়া পৌর এলাকার চানপুর মহল্লায় পুলিশের এক দারোগার বাড়ি ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই বাহিনীর তিন সদস্য আরিফ, ডন ও ফেরদৌস তাদের নামে লিখে নেন। যোগাযোগ করা হলে ভয়ে ওই দারোগা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এলাকায় দোর্দণ্ড প্রতাপে চলা এই বাহিনীর সদস্যরা এখন গাড়ি-বাড়ির মালিক। বাহিনীর অন্যতম সদস্য থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফের রয়েছে ১৭ লাখ টাকা দামের একটি কার। ফেরদৌসের রয়েছে ২টি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কার।
প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে দমন করতেও এ বাহিনীকে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে সাংসদ পলকের বিরুদ্ধে।
সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু বিএনপি নয়, নিজ দলের লোকজনও এ বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচার দাবি করে ২০০৯ সালের ২১ আগস্ট সিংড়ায় যুবলীগের বের করা মিছিল ফাইভ স্টার বাহিনীর হামলার কবলে পড়ে। হামলায় থানা যুবলীগ সভাপতি জাহিদুর রহমান ভোলাসহ আহত ৫ যুবলীগ নেতাকর্মীকে চিকিৎসা নিতেও দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় ২৮ আগস্ট নাটোর প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ফাইভ স্টার বাহিনীর বিচার দাবি করেন জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
এসব ব্যাপারে সাংসদ পলক বলেন, বিরোধী দলের ওপর হামলার ঘটনা সত্য নয়। যুবলীগ সভাপতিকে কারা মেরেছে তাও তিনি জানেন না। আর বিদ্যুৎ খুনের মামলা বিচারাধীন। বিচারাধীন বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না।
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সিংড়ার শেরকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, সিংড়ায় যা হচ্ছে তা ওপেন সিক্রেট। খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এলাকার চিহ্নিত 'রাজাকার' আবুল কালাম আজাদের ছেলে আরিফ এখন ফাইভ স্টার বাহিনীর অন্যতম স্টার এবং এমপি পলকের ডান হাত। অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার সমকালকে বলেন, ফাইভ স্টার বাহিনী সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। কেউ তার কাছে কোনো অভিযোগ করেনি।
ফাইভ স্টারের বক্তব্য :সমকালের সঙ্গে ফাইভ স্টার বাহিনীর পাঁচ সদস্যেরই পৃথকভাবে কথা হয়। তারা এ বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। বাহিনীর অন্যতম সদস্য ফেরদৌস বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের নামে এসব কথা রটাচ্ছে। তবে ভাইয়ের খুনিরা তার দলের লোক বলে তিনি স্বীকার করেন। ডন বলেন, এ বাহিনী কেন, কোনো বাহিনীতেই তিনি নেই। আর শরীফ বলেন, তিনি সাংসদ পলকের ব্যাচমেট ও ঠিকাদার। সাংসদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কিছু লোক তার নামে অপবাদ দিচ্ছে। তবে জেলা যুবলীগ ফাইভ স্টার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছে বলে স্বীকার করেন। বাহিনীর অপর দু'সদস্য সোহেল এবং আরিফও এ বাহিনীর সঙ্গে নিজেরা সম্পৃক্ত নন বলে জানান।
টিআর-কাবিখার নিয়ন্ত্রণ :এমপি হওয়ার পর পলক টিআর-কাবিখার নিয়ন্ত্রণ নিজেই নেন। এখানে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ লুটে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ চক্রের প্রধান হিসেবে রয়েছেন পলকের বিশ্বস্ত পৌর কাউন্সিলর জালাল। এ ছাড়া বিএনপির এক ইউপি চেয়ারম্যান ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এই সিন্ডিকেটের সদস্য। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, তিনি কোনো কিছুর ভাগ নেন না। কুচক্রী কোনো মহল তার নামে এসব রটিয়ে থাকতে পারে।
তবে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে কোনো কাজ না করে বরাদ্দের অর্থ উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সত্য বলে স্বীকার করেন সিংড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি সমকালকে বলেন, তিনি নিজেও পরিদর্শন করে দেখেছেন এমন অনেক প্রকল্প রয়েছে যেখানে এক কোদাল মাটিও ফেলা হয়নি। অথচ বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। এর জবাবে সাংসদ বলেন, তিনি কেবল প্রকল্পের তালিকা জমা দিয়ে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য ডিও ইস্যু করেন। বাস্তবায়ন হলো কি-না তা দেখার দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের।
নির্বাচনের পর নামে-বেনামে সম্পত্তির পাহাড় : নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া সাংসদ পলকের হলফনামা থেকে দেখা গেছে, শেরকোল ইউনিয়নে তিনি কৃষি জমি ১ বিঘা ও ভিটা ১৮ শতাংশ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া সিংড়া বাজারে বাসগৃহ, দোকানঘর ২৩টি ও একটি গুদামঘর রয়েছে। এতে পলক তার বার্ষিক আয় ও ব্যয় ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমপি হওয়ার পর রাজধানীর পূর্বাচলে রাজউকের ৮ কাঠা প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। এ ছাড়া গত ৩৩ মাসে সিংড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে শ্বশুর আবুল কাসেমের নামে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকায় ৩৩ শতাংশ জায়গাসহ বিচিত্রা সিনেমা হল, সিংড়া বারইহাটি বিলে চাচা আবদুর রহমান ও চাচাতো ভাইয়ের নামে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় ৭০ বিঘা ফসলি জমি, সিংড়ার তেলিগ্রামে বউ ও ছেলের নামে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় ১৭ বিঘা জমি, সিংড়ার বারুহাস সড়কে মা ও দু'ছেলের নামে প্রায় ৩৫ লাখ টাকায় ৭ বিঘা জমি কিনেছেন ।
এ ব্যাপারে সাংসদ বলেন, তিনি বেনামে কোনো সম্পত্তি কেনেননি। বাবার জমি বিক্রি করে রাজনীতি করছেন। এমপি হওয়ার পর যে এক লাখ ৫০০ টাকা ভাতা পান তা দিয়েই তিনি চলেন। পূর্বাচলে প্লট পেয়েছেন। আর ২০ লাখ টাকা ঋণ করে ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি আমদানি করেছেন।
সিংড়ার সার্বিক ঘটনাবলির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমান খান সমকালকে বলেন, এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পর দলের অনেক নেতার মধ্যে এলাকার সর্বময় কর্তা হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা দলের চরম ক্ষতি ডেকে আনছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ দরকার।

No comments

Powered by Blogger.