বিটিআরসির বিরুদ্ধে গ্রামীণফোনের রিট-৩৮৪ কোটি টাকা দাবির বৈধতা কী-জানতে চান হাইকোর্ট

তিন হাজার ৩৪ কোটি টাকা বকেয়া রাজস্ব দাবির বিরুদ্ধে মামলার পর তিন বছর আগের কেনা স্পেকট্রামের জন্য মার্কেট কম্পিটিশন ফ্যাক্টর বা এমসিএফ অনুযায়ী আরো ৩৮৪ কোটি টাকা দাবি এবং ভ্যাট-সংশ্লিষ্ট শর্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপোরেটর গ্রামীণফোন লিমিটেড। আদালত গতকাল বুধবার গ্রামীণফোনের এ-সংক্রান্ত একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই ধরনের দাবি ও শর্ত কেন অবৈধ হবে না জানতে চেয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন। একই সঙ্গে আদালত এসব বিষয় কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।


গ্রামীণফোনসহ দেশের চারটি মোবাইল ফোন অপারেটরের লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রথম কিস্তির টাকা জমা দেওয়ার শেষ সময়ের মাত্র চার দিন আগেই এই মামলা এবং আদালতের আদেশ হলো। লাইসেন্স নবায়নের নীতিমালা অনুসারে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে চার মোবাইল ফোন অপারেটরকে টাকা জমা দিতে হবে।
বিচারপতি ফরিদ আহমেদ ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। মামলায় গ্রামীণফোনের পক্ষে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী অংশ নেন।
কেন এমসিএফ : মোবাইল অপারেটরদের টু-জি (দ্বিতীয় প্রজন্ম) লাইসেন্স নবায়নের জন্য গত ২০ জানুয়ারি বিটিআরসি একটি খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করে বিষয়টি সম্পর্কে জনমত আহ্বান করে। ওই খসড়া নীতিমালার যেসব শর্তে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটররা আপত্তি জানায়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইউএফ বা ইউটিলাইজেশন ফ্যাক্টর। এই ইউএফ শর্তের মাধ্যমে মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহক যত বেশি, স্পেকট্রামের জন্য তত বেশি টাকা আদায়ের বিধান রাখা হয়। মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা ওই সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন, গ্রাহক বৃদ্ধির জন্য যেখানে প্রশংসা ও পুরস্কার পাওয়ার কথা, সেখানে কেন দণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। খসড়া নীতিমালা প্রকাশের পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট চার মোবাইল ফোন অপারেটর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্ন রাখেন গ্রামীণফোনের সিইও ওডভার এবং হেশজেদাল বাংলালিংকের সিইও আহমেদ আবু দোমা।
পরে গত ৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ নীতিমালার কিছু সংশোধনী এনে নীতিগতভাবে চূড়ান্ত করা হয়। সংশোধনীর মধ্যে বিটিআরসি প্রস্তাবিত ইউটিলাইজেশন ফ্যাক্টর না রেখে তার বদলে রাখা হয় মার্কেট কম্পিটিশিন ফ্যাক্টর। অর্থাৎ বেশি গ্রাহক যাদের, তাদের বেশি টাকা দিতে হবে এ শর্তের কার্যত কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিটিআরসি গত ১১ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত এ নীতিমালা প্রকাশ করে। এ নীতিমালায় মোবাইল অপারেটরদের কার কত এমসিএফ তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। গ্রামীণফোনের ১.৪৮ শতাংশ, বাংলালিংকের ১.৬ শতাংশ, রবির দশমিক ৯৯ শতাংশ ও সিটিসেলের দশমিক ৩৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ফলে গ্রামীণফোনকে তাদের ১৪ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামের জন্য তিন হাজার ২৪১ কোটি দুই লাখ টাকা, বাংলালিংককে তাদের ১২ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামের জন্য এক হাজার ৯৭১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, রবিকে তাদের ১২ দশমিক ৮ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামের জন্য এক হাজার ৯০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও সিটিসেলকে তাদের ব্যবহারযোগ্য ৮০০ ব্যান্ডের ১০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রামের জন্য ৪৫০ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে।
এরপর বিটিআরসি ১৭ অক্টোবর বিটিআরসি ওই এমসিএফ অনুয়ায়ীই গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের কাছে তিন বছর আগে বরাদ্দ স্পেকট্রাম থেকে বাড়তি ৪৩১ কোটি টাকার দাবি করে চিঠি দেয়। গ্রামীণফোন এ চিঠি পাওয়ার পর জানায়, এ দাবি ন্যায়সংগত নয়।
এদিকে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ দাবি 'সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর রেগুলেটর অ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইনস-২০১১' অনুসারেই আইনসম্মতভাবেই করা হয়েছে। এই গাইডলাইন সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রস্তুত হয়েছে এবং এটি অনুসরণে বিটিআরসি বাধ্য। বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়ে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক বিটিআরসিকে চিটি দিলে সংশ্লিষ্ট নীতিমালার ধারাগুলো উল্লেখ করে ২০ অক্টাবর তার জবাব দেয় বিটিআরসি।
ভ্যাট দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন : এ ছাড়া লাইসেন্স নবায়নের জন্য টাকা জমা দিতে ভ্যাট প্রদানের দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে সে বিষয়েও গ্রামীণফোন ও অন্য অপারেটররা আগে থেকেই ব্যাখ্যা দাবি করে আসছিল। এ বিষয়ে তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় লাইসেন্স নবায়ন নীতিমালা সংশোধন করে বিষয়টি এই মর্মে স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, কোনো ধরনের বিয়োজন ছাড়াই বিটিআরসি বা সরকারকে লাইসেন্স নবায়নের ফি ও স্পেকট্রামের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। বিন্তু তার পরও মোবাইল অপারেটররা এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ব্যাখা দাবি করে আসছিল।
গতকাল আদালত থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা জারির পর গ্রামীণফোন এক বিবৃতিতে তা সংবাদমাধ্যমকে জানায়। এর আগে গত ২০ অক্টোবর গ্রামীণফোনের কাছে তিন হাজার ৩৪ কোটি টাকা দাবি করে বিটিআরসির দেওয়া চিঠির কার্যকারিতার ওপর আট সপ্তাহ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিটিআরসির দেওয়া ওই চিঠির ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে না, তার কারণ জানতে চেয়ে রুল জারি হয়। গ্রামীণফোনের এক আবেদনে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমিন্বত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
গ্রামীণফোনের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম আগের ওই মামলায় অংশ নেন।

No comments

Powered by Blogger.