রাশিয়ার কাঁধে সিরিয়ার বোঝা by আলী রীয়াজ
স্কুলজীবনে
বিশ্ব ইতিহাসের যেসব ঘটনা অবশ্যপাঠ্য ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার অন্যতম।
এর কারণ ও ফলাফল দুই-ই গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়েছে। সেই পাঠের সুযোগে এ
কথা আমাদের অনেকের জানা আছে যে ‘সারায়েভোর ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ
নয়, উপলক্ষ মাত্র।’ ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের
ভাবি রাজা অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিন্যান্ড ও তাঁর স্ত্রী ডাচেস
অব হোহেনবার্গ সোফিকে সারায়েভোর রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে গাভ্রিলো
প্রিন্সিপ। সে ছিল গোপন এক গোষ্ঠীর সদস্য, যারা দক্ষিণ স্লাভ প্রদেশগুলোকে
ভেঙে নিয়ে যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে চাচ্ছিল। এই ঘটনার
পরিপ্রেক্ষিতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়া সার্বিয়াকে যে চরমপত্র দিয়েছিল, তাকে
কেন্দ্র করেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আকারে সার্বিয়া এত ছোট দেশ যে
অস্ট্রো-হাঙ্গেরির জন্য তাকে মোকাবিলা করা খুব কঠিন ছিল না। কিন্তু
সার্বিয়া হুমকির মুখে পড়ে শরণাপন্ন হয়েছিল রাশিয়ার। আর অস্ট্রিয়া
শরণাপন্ন হয় জার্মানির। এর পরের ঘটনাবলির বিস্তারিত বলাবাহুল্য—যুদ্ধে
জড়িয়ে পড়ে বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। কিন্তু এই দেশগুলোর মধ্যকার
সম্পর্ক, তৎকালীন রাজনীতি—এসবই জড়িয়ে পড়ার কারণ। ফার্দিন্যান্ডকে হত্যা
না করা হলে অন্য কোনো উপলক্ষে এই যুদ্ধ হতে পারত। কিন্তু তারপরেও ওই
হত্যাকাণ্ডকে বাদ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস লেখা যাবে না।
এখন সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার বোমাবর্ষণের ঘটনা শুরু হওয়ার পরে যাঁরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তাঁরা তাঁদের সেই কথিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে কোন ঘটনাকে চিহ্নিত করবেন? যদিও আমি এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত যে সিরিয়াকে কেন্দ্র
করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কল্পনাপ্রসূত মাত্র, তথাপি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এই ঘটনাবলির সূচনা হয়েছিল একটি দেয়াললিখনের কারণে। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সিরিয়ার দারা শহরের বাজার থেকে কেনা স্প্রে পেইন্ট দিয়ে কয়েকজন কিশোর একটি দেয়ালে লিখে দিয়েছিল, ‘জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়’ (আরবিতে লেখা এই দেয়াললিখনের ইংরেজি অনুবাদ—দ্য পিপল ওয়ান্ট টু টপল দ্য রেজিম)। আসাদ সরকার পরদিনই ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১৫ জন কিশোরকে আটক করে, তাদের ওপর চালানো হয় অত্যাচার। এই আটকের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে পথে নামে, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ফলে যদি আমার অনুমান ভুল প্রমাণিত হয় এবং বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ইতিহাসের ক্লাসে পড়বে—একটি দেয়াললিখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল।
সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ফলে ওই কিশোরেরা মুক্তি পায় বটে কিন্তু ১৮ মার্চে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় একজন বিক্ষোভকারী। সাড়ে চার বছর পরে সিরিয়ায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার বেসামরিক ব্যক্তি। বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে আছে সাড়ে ১২ হাজার শিশু, আট হাজার নারী। বিদ্রোহী যোদ্ধা মারা গেছে ৪৩ হাজারের বেশি। সরকারের পক্ষে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৯১ হাজার ৬৭৮, যার মধ্যে সরকারি সৈন্য ৫২ হাজার, কেবল লেবানন থেকে আসা হিজবুল্লাহ যোদ্ধা মারা গেছে কমপক্ষে ৯৭১ জন। নিহত ইরানিদের সংখ্যা আমরা জানি না। ২ কোটি ৩০ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছে এবং আরও ৬৫ লাখ হয়েছে গৃহহারা। অধিকাংশের গৃহ বলতে কিছু অবশিষ্ট আছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
এখন এই যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষ অনেক। যে কারণে নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় আছে ৩৭ হাজার মানুষ, যারা সিরিয়ায় ‘জিহাদ’ করতে গিয়েছিল বলে জানা গেছে। ৩ হাজার ২৫৮ জনের পরিচয় মেলেনি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে হিজবুল্লাহ ও ইরানিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে এই যুদ্ধে তারাও অংশ নিচ্ছে, যদিও তারা সিরীয় নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশি শক্তি উপস্থিত রয়েছে অনেক। সিরিয়ার যুদ্ধে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো, আছে রাশিয়া, ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহর সৈনিকেরা ও তুরস্ক। এসব বিদেশি শক্তির উপস্থিতি প্রত্যক্ষ, তার বাইরে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও পরোক্ষভাবে এখানে উপস্থিত—অর্থ এবং প্রভাব তাদের উপস্থিতির স্মারক। প্রতিবেশী সৌদি আরব, কাতার ও অন্য উপসাগরীয় দেশের পরোক্ষ উপস্থিতি অনস্বীকার্য। দেশের ভেতরে আছে বাশার আল–আসাদের সরকার, দানবীয় আকারে উপস্থিত আইসিস, আছে আল-কায়েদার অনুসারী জাবহাত আল নুসরা, ইসলামপন্থী বলে পরিচিত ইসলামিক ফ্রন্ট, যাতে আছে আহরার আল-শাম, আল-হক ব্রিগেড, দ্য ইসলাম আর্মি এবং আরও কয়েকটি গোষ্ঠী; সেক্যুলারপন্থী বলে পরিচিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ও কুর্দিশ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির সশস্ত্র অঙ্গ সংগঠন কুর্দিস্তান পিপলস প্রটেকশন ইউনিট। এর বাইরে আছে ছোট ছোট বিদ্রোহী দল, যারা আঞ্চলিকভাবে উপস্থিত ও সীমিত ক্ষমতার অধিকারী।
এসব গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। নিজ নিজ স্বার্থ বাস্তবায়নে তারা যখন লড়াইয়ে ব্যস্ত, তার পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু, ধ্বংসলীলা। কিন্তু সিরিয়ার মানুষ যারা সাড়ে চার বছর আগে পথে নেমেছিল, তাদের হয়ে কে লড়ছে? নিঃসন্দেহে প্রতিটি পক্ষ দাবি করবে যে তারাই সিরিয়ার নাগরিকদের স্বার্থে লড়ছে। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে এখন এই প্রশ্নই প্রায় তিরোহিত। সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে গত কয়েক বছরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো আইসিসের উত্থান। ইরাকে সূচনা হলেও সিরিয়ায় আইসিসের বিস্তার সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক সমাধানের অনুপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিভ্রান্তিকর পররাষ্ট্রনীতির কারণে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যে বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে, তাদের একাংশ হয় আল-নুসরা নতুবা আইসিস যোগদানের ফলে আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই শক্তিশালী হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে করে আশু ফলাফল হিসেবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আইসিসের মতো ভয়াবহ সংগঠন।
২০১২ সালে সিরিয়া প্রশ্নে সরকারি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে জেনেভায় যে আলোচনা হয়, তাতে মতৈক্য তৈরি হয়েছিল এবং যার ভিত্তিতে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের অভাব এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। ওই ইশতেহারে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল যে সিরিয়া সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই আলোচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং এই প্রক্রিয়া চলাকালেই সিরিয়ায় আইসিসের বিস্তার ঘটে। এ বছরের গ্রীষ্মকাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো এত দিন আসাদকে বাদ দেওয়ার যে পূর্বশর্ত দিয়েছিল, তা তারা দৃশ্যত বহাল রাখলেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা মেনে নিতে তারা রাজি এবং তার বিকল্পও নেই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে আঞ্চলিক শক্তিগুলো, বিশেষত ইরানকে বাদ দিয়ে সিরিয়া সমস্যার সমাধান আদৌ হবে কি না। এসব আলোচনায় রাশিয়া উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে গৌণ। আসাদ সরকারের প্রধান সমর্থক রাশিয়ার প্রত্যক্ষ, কার্যকর অংশগ্রহণ এই আলোচনার সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। কেননা, জাতিসংঘে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ রাশিয়া ও চীনের বাধার কারণে আটকে যেতে থাকে।
এরই মধ্যে লাখো লাখো শরণার্থীর স্রোত ইউরোপে পৌঁছালে ওই দেশগুলো সিরিয়া সমস্যার সমাধানকে অতি জরুরি বলেই বিবেচনা করে। সেই প্রেক্ষাপটেই রাশিয়া সিরিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সিরিয়ায় বিমান হামলার সূচনা করে। রাশিয়ার সামরিক অভিযানের লক্ষ্য যে আসাদ সরকারকে রক্ষা করা, সে বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। কেননা, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তা সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছেন। আর তা করতে হলে কেবল আইসিসকে মোকাবিলা করাই যথেষ্ট নয়, সম্ভবত আইসিসকে মোকাবিলার আগেই আসাদের অন্য প্রতিপক্ষদের একেবারে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। সেটা যে স্বল্প সময়ে সম্ভব হবে না, সেটা রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা বোঝেন। ফলে তাঁদের সামনে এখন বিকল্প দুটি; প্রথম বিকল্প দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধে লিপ্ত থেকে আসাদের সব প্রতিপক্ষের নির্মূল নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, আসাদ সরকার যে আশু বিপদের মুখে ছিল এবং যা তাকে আলোচনার ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল, তার অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া। প্রথম বিকল্পের পথে বাধা দুটি; যেখানেই দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশিদের সামরিক উপস্থিতি থেকেছে, সেখানে বিদেশি শক্তি এবং তার সমর্থিত সরকার শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়ার বিরোধিতা করছে না, কিন্তু তারা তাদের সমর্থক বিদ্রোহীদের একেবারে ত্যাগ করবে এমন আশা করা যায় না। ফলে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ পরিণত হবে। প্রক্সি যুদ্ধ স্বল্প মেয়াদের যুদ্ধ নয়।
রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সামরিক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের ফলে আসাদের ভাগ্য এবং সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কাঠামোবিষয়ক আলোচনায় রাশিয়া নিজের জন্য আগের তুলনায় একটা বড় আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে, এখন পর্যন্ত সেটা পুতিনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। দ্বিতীয়ত, সবার দৃষ্টি সিরিয়ায় নিবিষ্ট হওয়ার কারণে ইউক্রেনে রাশিয়ায় ব্যর্থতার যে কালো দাগ, তা থেকে বেরিয়ে এসে প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর নিজের দেশে ও তাঁর মিত্রদের দেখাতে পারবেন তাঁর সাফল্যের ঝুলি খালি নয়। তৃতীয়ত, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর একক এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধা দিতে সক্ষম হওয়ায় রাশিয়া এবং তার নেতা পুতিন ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল শক্তি ভারসাম্যের প্রত্যক্ষ অংশীদারে পরিণত হলেন।
এই অঞ্চলে ভারসাম্যের এই প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক শক্তিগুলো পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে আছে। সেখানে উপস্থিতির পরিণতি রাশিয়ার জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না, সেটা এই অঞ্চলে যুদ্ধ এবং সংঘাত দমনে সহায়ক হবে বলেও মনে হয় না। কেননা, সিরিয়ার এবং এই অঞ্চলের অনেক দেশের সমস্যারই কোনো সামরিক সমাধান নেই, দরকার রাজনৈতিক সমাধান; এবং তা বাইরের শক্তির চাপিয়ে দেওয়া সমাধান নয়, যে মানুষেরা ২০১১ সালে দেয়ালে ‘জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়’ লিখেছিল, তাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বের করতে হবে। এত দিন তার দায়দায়িত্ব বর্তাত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ওপর, এখন তার দায়িত্বের একটা বড় অংশ রাশিয়া স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিল।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
এখন সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার বোমাবর্ষণের ঘটনা শুরু হওয়ার পরে যাঁরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তাঁরা তাঁদের সেই কথিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে কোন ঘটনাকে চিহ্নিত করবেন? যদিও আমি এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত যে সিরিয়াকে কেন্দ্র
করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কল্পনাপ্রসূত মাত্র, তথাপি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এই ঘটনাবলির সূচনা হয়েছিল একটি দেয়াললিখনের কারণে। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ সিরিয়ার দারা শহরের বাজার থেকে কেনা স্প্রে পেইন্ট দিয়ে কয়েকজন কিশোর একটি দেয়ালে লিখে দিয়েছিল, ‘জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়’ (আরবিতে লেখা এই দেয়াললিখনের ইংরেজি অনুবাদ—দ্য পিপল ওয়ান্ট টু টপল দ্য রেজিম)। আসাদ সরকার পরদিনই ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী ১৫ জন কিশোরকে আটক করে, তাদের ওপর চালানো হয় অত্যাচার। এই আটকের বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে পথে নামে, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ফলে যদি আমার অনুমান ভুল প্রমাণিত হয় এবং বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ইতিহাসের ক্লাসে পড়বে—একটি দেয়াললিখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল।
সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ফলে ওই কিশোরেরা মুক্তি পায় বটে কিন্তু ১৮ মার্চে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় একজন বিক্ষোভকারী। সাড়ে চার বছর পরে সিরিয়ায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার বেসামরিক ব্যক্তি। বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে আছে সাড়ে ১২ হাজার শিশু, আট হাজার নারী। বিদ্রোহী যোদ্ধা মারা গেছে ৪৩ হাজারের বেশি। সরকারের পক্ষে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৯১ হাজার ৬৭৮, যার মধ্যে সরকারি সৈন্য ৫২ হাজার, কেবল লেবানন থেকে আসা হিজবুল্লাহ যোদ্ধা মারা গেছে কমপক্ষে ৯৭১ জন। নিহত ইরানিদের সংখ্যা আমরা জানি না। ২ কোটি ৩০ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছে এবং আরও ৬৫ লাখ হয়েছে গৃহহারা। অধিকাংশের গৃহ বলতে কিছু অবশিষ্ট আছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
এখন এই যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষ অনেক। যে কারণে নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় আছে ৩৭ হাজার মানুষ, যারা সিরিয়ায় ‘জিহাদ’ করতে গিয়েছিল বলে জানা গেছে। ৩ হাজার ২৫৮ জনের পরিচয় মেলেনি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে হিজবুল্লাহ ও ইরানিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে এই যুদ্ধে তারাও অংশ নিচ্ছে, যদিও তারা সিরীয় নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশি শক্তি উপস্থিত রয়েছে অনেক। সিরিয়ার যুদ্ধে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো, আছে রাশিয়া, ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহর সৈনিকেরা ও তুরস্ক। এসব বিদেশি শক্তির উপস্থিতি প্রত্যক্ষ, তার বাইরে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও পরোক্ষভাবে এখানে উপস্থিত—অর্থ এবং প্রভাব তাদের উপস্থিতির স্মারক। প্রতিবেশী সৌদি আরব, কাতার ও অন্য উপসাগরীয় দেশের পরোক্ষ উপস্থিতি অনস্বীকার্য। দেশের ভেতরে আছে বাশার আল–আসাদের সরকার, দানবীয় আকারে উপস্থিত আইসিস, আছে আল-কায়েদার অনুসারী জাবহাত আল নুসরা, ইসলামপন্থী বলে পরিচিত ইসলামিক ফ্রন্ট, যাতে আছে আহরার আল-শাম, আল-হক ব্রিগেড, দ্য ইসলাম আর্মি এবং আরও কয়েকটি গোষ্ঠী; সেক্যুলারপন্থী বলে পরিচিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ও কুর্দিশ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির সশস্ত্র অঙ্গ সংগঠন কুর্দিস্তান পিপলস প্রটেকশন ইউনিট। এর বাইরে আছে ছোট ছোট বিদ্রোহী দল, যারা আঞ্চলিকভাবে উপস্থিত ও সীমিত ক্ষমতার অধিকারী।
এসব গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। নিজ নিজ স্বার্থ বাস্তবায়নে তারা যখন লড়াইয়ে ব্যস্ত, তার পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু, ধ্বংসলীলা। কিন্তু সিরিয়ার মানুষ যারা সাড়ে চার বছর আগে পথে নেমেছিল, তাদের হয়ে কে লড়ছে? নিঃসন্দেহে প্রতিটি পক্ষ দাবি করবে যে তারাই সিরিয়ার নাগরিকদের স্বার্থে লড়ছে। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে এখন এই প্রশ্নই প্রায় তিরোহিত। সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে গত কয়েক বছরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো আইসিসের উত্থান। ইরাকে সূচনা হলেও সিরিয়ায় আইসিসের বিস্তার সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক সমাধানের অনুপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিভ্রান্তিকর পররাষ্ট্রনীতির কারণে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যে বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়েছে, তাদের একাংশ হয় আল-নুসরা নতুবা আইসিস যোগদানের ফলে আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই শক্তিশালী হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে করে আশু ফলাফল হিসেবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আইসিসের মতো ভয়াবহ সংগঠন।
২০১২ সালে সিরিয়া প্রশ্নে সরকারি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে জেনেভায় যে আলোচনা হয়, তাতে মতৈক্য তৈরি হয়েছিল এবং যার ভিত্তিতে একটি যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছিল, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের অভাব এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। ওই ইশতেহারে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল যে সিরিয়া সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান নেই, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই আলোচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং এই প্রক্রিয়া চলাকালেই সিরিয়ায় আইসিসের বিস্তার ঘটে। এ বছরের গ্রীষ্মকাল থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো এত দিন আসাদকে বাদ দেওয়ার যে পূর্বশর্ত দিয়েছিল, তা তারা দৃশ্যত বহাল রাখলেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা মেনে নিতে তারা রাজি এবং তার বিকল্পও নেই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে আঞ্চলিক শক্তিগুলো, বিশেষত ইরানকে বাদ দিয়ে সিরিয়া সমস্যার সমাধান আদৌ হবে কি না। এসব আলোচনায় রাশিয়া উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল তুলনামূলকভাবে গৌণ। আসাদ সরকারের প্রধান সমর্থক রাশিয়ার প্রত্যক্ষ, কার্যকর অংশগ্রহণ এই আলোচনার সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। কেননা, জাতিসংঘে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ রাশিয়া ও চীনের বাধার কারণে আটকে যেতে থাকে।
এরই মধ্যে লাখো লাখো শরণার্থীর স্রোত ইউরোপে পৌঁছালে ওই দেশগুলো সিরিয়া সমস্যার সমাধানকে অতি জরুরি বলেই বিবেচনা করে। সেই প্রেক্ষাপটেই রাশিয়া সিরিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সিরিয়ায় বিমান হামলার সূচনা করে। রাশিয়ার সামরিক অভিযানের লক্ষ্য যে আসাদ সরকারকে রক্ষা করা, সে বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। কেননা, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তা সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছেন। আর তা করতে হলে কেবল আইসিসকে মোকাবিলা করাই যথেষ্ট নয়, সম্ভবত আইসিসকে মোকাবিলার আগেই আসাদের অন্য প্রতিপক্ষদের একেবারে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। সেটা যে স্বল্প সময়ে সম্ভব হবে না, সেটা রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা বোঝেন। ফলে তাঁদের সামনে এখন বিকল্প দুটি; প্রথম বিকল্প দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধে লিপ্ত থেকে আসাদের সব প্রতিপক্ষের নির্মূল নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, আসাদ সরকার যে আশু বিপদের মুখে ছিল এবং যা তাকে আলোচনার ক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল, তার অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া। প্রথম বিকল্পের পথে বাধা দুটি; যেখানেই দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশিদের সামরিক উপস্থিতি থেকেছে, সেখানে বিদেশি শক্তি এবং তার সমর্থিত সরকার শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়ার বিরোধিতা করছে না, কিন্তু তারা তাদের সমর্থক বিদ্রোহীদের একেবারে ত্যাগ করবে এমন আশা করা যায় না। ফলে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ পরিণত হবে। প্রক্সি যুদ্ধ স্বল্প মেয়াদের যুদ্ধ নয়।
রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সামরিক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের ফলে আসাদের ভাগ্য এবং সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কাঠামোবিষয়ক আলোচনায় রাশিয়া নিজের জন্য আগের তুলনায় একটা বড় আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে, এখন পর্যন্ত সেটা পুতিনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। দ্বিতীয়ত, সবার দৃষ্টি সিরিয়ায় নিবিষ্ট হওয়ার কারণে ইউক্রেনে রাশিয়ায় ব্যর্থতার যে কালো দাগ, তা থেকে বেরিয়ে এসে প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর নিজের দেশে ও তাঁর মিত্রদের দেখাতে পারবেন তাঁর সাফল্যের ঝুলি খালি নয়। তৃতীয়ত, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর একক এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাধা দিতে সক্ষম হওয়ায় রাশিয়া এবং তার নেতা পুতিন ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল শক্তি ভারসাম্যের প্রত্যক্ষ অংশীদারে পরিণত হলেন।
এই অঞ্চলে ভারসাম্যের এই প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক শক্তিগুলো পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে আছে। সেখানে উপস্থিতির পরিণতি রাশিয়ার জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না, সেটা এই অঞ্চলে যুদ্ধ এবং সংঘাত দমনে সহায়ক হবে বলেও মনে হয় না। কেননা, সিরিয়ার এবং এই অঞ্চলের অনেক দেশের সমস্যারই কোনো সামরিক সমাধান নেই, দরকার রাজনৈতিক সমাধান; এবং তা বাইরের শক্তির চাপিয়ে দেওয়া সমাধান নয়, যে মানুষেরা ২০১১ সালে দেয়ালে ‘জনগণ এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চায়’ লিখেছিল, তাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বের করতে হবে। এত দিন তার দায়দায়িত্ব বর্তাত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ওপর, এখন তার দায়িত্বের একটা বড় অংশ রাশিয়া স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিল।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments