‘পোকায় খাওয়া’ বিভাগেও খুশি ময়মনসিংহবাসী by সোহরাব হাসান
ময়মনসিংহ বিভাগ হওয়ায় আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ
|
‘পোকায়
খাওয়া’ পাকিস্তান নিয়ে যেমন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মনোবেদনা ছিল, তেমনি
ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের নেতাদেরও মনোবেদনা আছে নবগঠিত অষ্টম বিভাগে
বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলা না থাকায়। কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল নতুন বিভাগে
আসেনি। তারা রাজধানীকেন্দ্রিক ঢাকা বিভাগেই থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি সহজভাবে
নিতে পারেনি ময়মনসিংহবাসী।
শুক্রবার ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে আলাপকালে এক সাংবাদিক বন্ধু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, অনেকেই এখন ক্ষমতা পেয়ে ময়মনসিংহের ঐতিহ্য ও গুরুত্ব ভুলে গেছেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এটিই ছিল ভারতবর্ষের বৃহত্তম জেলা। যঁারা ময়মনসিংহ বিভাগে আসেননি, আশা করি তঁারা ভবিষ্যতে মৈমনসিংহ গীতিকার গৌরবও দাবি করবেন না। আরেক সাংবাদিক জানালেন, বিভাগ হওয়ার আগেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৮টি বিভাগীয় অফিস ময়মনসিংহে আছে। তাই কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মানুষের এখানে না এসে উপায় নেই।
‘পোকায় খাওয়া’ বিভাগ পেয়েও খুশি ময়মনসিংহের মানুষ। খুশি নাগরিক আন্দোলনের নেতারাও। আর সেই খুশির বার্তাটি সবাইকে জানাতেই তাঁরা গত রোববার বিজয় মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। টাউন হল মাঠ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বিজয় মিছিলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমদ উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান। নাগরিক আন্দোলনের নেতাদের দাবি, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের মন্ত্রী ও নেতাদের সহযোগিতা পেলে অনেক আগেই ময়মনসিংহ বিভাগ বাস্তবায়িত হতো।
১৯৮৯ সালে ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই হিসাবে সংগঠনের বয়স ২৬ বছর। এই দীর্ঘ সময় ধরে তারা ময়মনসিংহের মানুষের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছে, এখনো করছে। এ জন্য তাদের হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও দিতে হয়েছে। সব সময় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছে, এমন নয়। তাদের ভাষায়, অনেকেই বিরোধী দলে থাকতে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তা মনে রাখেননি।
গত বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় যখন সহকর্মী কামরান পারভেজকে নিয়ে জেলা নাগরিক আন্দোলনের অফিসে যাই, দেখি সেখানে নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন ছাড়াও প্রদীপ ভৌমিক, আতিউর রহমান, এইচ এম খালেকুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
তাঁদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের ২৬ বছরের আন্দোলনের ফল কি শুধুই বিভাগ ঘোষণা? বিভাগীয় প্রশাসনের তেমন ক্ষমতা নেই। জবাবে নূরুল আমিন জানালেন, বিভাগ প্রতিষ্ঠা ছাড়াও আমরা ময়মনসিংহবাসীর অনেকগুলো দাবি সামনে নিয়ে এসেছি। আমরা ময়মনসিংহ শহরে দুটি বাইপাস করাতে পেরেছি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হয়েছে, তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেল যোগাযোগ হয়েছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত চার লেন করার দাবি পূরণ হয়েছে। ময়মনসিংহের জলাবদ্ধতাও অনেকটা কমেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলটি চালু হয়েছে। মেডিকেল কলেজের ৫০০ শয্যা ১০০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। হালুয়াঘাটে স্থলবন্দর হয়েছে, ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম আন্তনগর ট্রেন চলছে।
ময়মনসিংহের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো। প্রায় সব উপজেলার সঙ্গে বাস যোগাযোগ আছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন সড়কের কাজও শেষ হওয়ার পথে। সড়কটি প্রশস্ত হওয়ায় যানজট নেই। যানজটের কারণে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে যেতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা, ময়মনসিংহে আড়াই-তিন ঘণ্টায়ই যাওয়া যায়। ময়মনসিংহের যাত্রীরা সময় হিসাব করেন ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুরের। এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। কিন্তু গাজীপুর থেকে ঢাকা? যানজট না থাকলে এক ঘণ্টা, থাকলে কত সময় লাগবে কেউ বলতে পারে না।
জিজ্ঞেস করি, নাগরিক আন্দোলনের ২৬ বছরে অনেকগুলো সরকার এসেছে। কাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন? নেতারা বললেন, সব সরকারই কিছু না কিছু দাবি পূরণ করেছে। ১৯৯৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ময়মনসিংহে এলে তাঁর কাছে নাগরিক আন্দোলনের নেতারা বিভাগের দাবিটি প্রথম পেশ করেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। আজ দেরিতে হলেও শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর বিভাগ বাস্তবায়ন করলেন।
আপনারা এখন কী নিয়ে আন্দোলন করছেন? জবাবে নূরুল আমিন বললেন, ময়মনসিংহ পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা, ব্রহ্মপুত্রের ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ, ব্রহ্মপুত্র নদের খনন; নদী বাঁচাতে না পারলে মানুষ ও শহর কোনোটাই বাঁচানো যাবে না। এ ছাড়া তাঁরা ময়মনসিংহে একটি বিমানবন্দর, শিক্ষা বোর্ড, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ জামালপুর ডাবল রেললাইন, দেওয়ানগঞ্জ দ্বিতীয় যমুনা সেতু প্রতিষ্ঠাও তাঁদের দাবির মধ্যে আছে। তাঁরা আশা করছেন, বিভাগের পর একটি নতুন শিক্ষা বোর্ডও হবে। আবার ভয়ও আছে। রংপুর বিভাগের শিক্ষা বোর্ড যেমন দিনাজপুরে চলে গেছে, তেমনি ময়মনসিংহের শিক্ষা বোর্ড যেন কিশোরগঞ্জে চলে না যায়।
শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত কেমন জিজ্ঞেস করলে আন্দোলনের সহসভাপতি ইউসুফ খান পাঠান বললেন, আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হয়েছে, বলব না। তবে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চুরি বেড়েছে। অনেক বছর আগে আমরা শহরে ৬০টি ডিফেন্স পার্টি করেছিলাম। এখনো ২০-২৫টি ডিফেন্স পার্টি কাজ করছে। এগুলো নাগরিক উদ্যোগ। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
জিজ্ঞেস করি, দেশে যখন রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র, তখন আপনারা কাদের নিয়ে নাগরিক আন্দোলন করছেন? সাধারণ সম্পাদক জানান, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলই আমাদের আন্দোলনে আছে। তবে দলীয় রাজনীতি কোনোভাবেই নাগরিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করছে না। সবার একটাই লক্ষ্য, ময়মনসিংহের উন্নয়ন।
নাগরিক আন্দোলনের আরেক নেতা জানালেন, ময়মনসিংহে রাজনৈতিক হানাহানি তুলনামূলক কম। এমনকি বছরের প্রথম তিন মাস বিরোধী দলের ডাকে দেশব্যাপী যে হরতাল-অবরোধ হলো, তাতেও ময়মনসিংহে পেট্রলবোমায় কয়েকজন আহত হলেও কেউ মারা যাননি। এখানো বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মিছিল করতে পারেন। তবে তা দলীয় কার্যালয় থেকে দেড় শ গজের মধ্যেই সীমিত থাকে।
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—তিন দলেই গ্রুপিং আছে। আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ও তাঁর ছেলে মোহিত-উর রহমান, অপর গ্রুপে আছেন পৌর মেয়র ইকরামুল হক ও জহিরুল হক ও কাজী আজাদ জাহান শামীম। জহিরুল হক দলের সহসভাপতি হলেও এখন নিষ্ক্রিয়। শেষোক্ত দুজনকে কমিটিতেই রাখা হয়নি।
বিএনপির দুই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যথাক্রমে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ও আবু ওয়াহাব আকন্দ। প্রথম গ্রুপের নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর থাকলেও দ্বিতীয় গ্রুপের নেতা-কর্মীরা নিরাপদে আছেন। অনেকে ক্ষমতাসীনদের খুশি করে ঠিকাদারিও করছেন। জাতীয় পার্টির বিভাজনটি হয়েছে সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া সাংসদ এম এ হান্নানকে নিয়ে। তিনি এরশাদের সমর্থক। তাঁর গ্রেপ্তারে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি রওশন সমর্থকেরাও খুশি। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৪ সালে, ১১ বছর আগে। সেই থেকে সবকিছু সভাপতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
কেবল ঢাকা নয়, গোটা বাংলাদেশ যে ডিজিটাল হয়ে গেছে, সেটি ময়মনসিংহ গিয়ে দেখলাম। সর্বত্র ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার ও ফলক। রাস্তার দুই পাশে, মোড়ে মোড়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ছবিসংবলিত ব্যানার ঝুলছে। যুবলীগের এক নেতা ব্রহ্মপুত্র পাড়ে অবস্থিত জয়নুল আবেদিন উদ্যানকে ব্যানারের স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র করে ফেলেছেন।
বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর অনেকে এর কৃতিত্ব দাবি করলেও নাগরিক আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানই বেশি। তবে তাঁরা বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সহযোগিতার কথাও স্বীকার করলেন। সংসদে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার পর রওশন এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমরা তো প্রদেশ চাই’। তাঁকে বোঝানো হলো প্রদেশ না হওয়া পর্যন্ত বিভাগের দাবিকে সমর্থন করুন। এরপর তিনি বিভাগের দাবিটি সংসদে তুলে ধরেন। রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ সদর থেকে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন।
নাগরিক আন্দোলন অফিস থেকে আমরা যাই পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হকের কার্যালয়ে। শহরের অসহনীয় যানজট, ময়লা–আবর্জনার সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, গত সাড়ে চার বছরে শহরের অনেক উন্নতি হয়েছে, নাগরিক সেবা বেড়েছে। আবার অনেক কিছু করতে পারেননি বরাদ্দের অভাবে। কী কী উন্নয়ন হয়েছে? মেয়র বললেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে, আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই শহর ডুবে যেত। ২০ কিলোমিটার সড়কে ফুটপাত নির্মিত হয়েছে। নয় কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। শহরবাসীর বিনোদনের জন্য নতুন পার্ক এবং সৌন্দর্যবর্ধনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
আর কী কী করতে পারেননি? তাঁর জবাব, খালগুলো খনন করা যায়নি। নগরের কোথাও কোথাও এখনো ময়লা-আবর্জনা আছে, পানি সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। কেন হয়নি? মেয়র বললেন, পাঁচ লাখ বাসিন্দার এই পৌরসভার বার্ষিক বাজেট মাত্র ২০ কোটি টাকা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬০০ জন। ফলে সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। অন্যান্য মেয়রের মতো তিনিও সাধ্য বাড়ানোর ঝুঁকি নেননি। অর্থাৎ গত সাড়ে চার বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স এক পয়সাও বাড়ানো হয়নি। তাহলে সেবা বাড়বে কীভাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
শুক্রবার ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে আলাপকালে এক সাংবাদিক বন্ধু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, অনেকেই এখন ক্ষমতা পেয়ে ময়মনসিংহের ঐতিহ্য ও গুরুত্ব ভুলে গেছেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এটিই ছিল ভারতবর্ষের বৃহত্তম জেলা। যঁারা ময়মনসিংহ বিভাগে আসেননি, আশা করি তঁারা ভবিষ্যতে মৈমনসিংহ গীতিকার গৌরবও দাবি করবেন না। আরেক সাংবাদিক জানালেন, বিভাগ হওয়ার আগেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৮টি বিভাগীয় অফিস ময়মনসিংহে আছে। তাই কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মানুষের এখানে না এসে উপায় নেই।
‘পোকায় খাওয়া’ বিভাগ পেয়েও খুশি ময়মনসিংহের মানুষ। খুশি নাগরিক আন্দোলনের নেতারাও। আর সেই খুশির বার্তাটি সবাইকে জানাতেই তাঁরা গত রোববার বিজয় মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। টাউন হল মাঠ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বিজয় মিছিলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, সাংসদ সালাহউদ্দিন আহমদ উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান। নাগরিক আন্দোলনের নেতাদের দাবি, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের মন্ত্রী ও নেতাদের সহযোগিতা পেলে অনেক আগেই ময়মনসিংহ বিভাগ বাস্তবায়িত হতো।
১৯৮৯ সালে ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই হিসাবে সংগঠনের বয়স ২৬ বছর। এই দীর্ঘ সময় ধরে তারা ময়মনসিংহের মানুষের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেছে, এখনো করছে। এ জন্য তাদের হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও দিতে হয়েছে। সব সময় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছে, এমন নয়। তাদের ভাষায়, অনেকেই বিরোধী দলে থাকতে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তা মনে রাখেননি।
গত বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় যখন সহকর্মী কামরান পারভেজকে নিয়ে জেলা নাগরিক আন্দোলনের অফিসে যাই, দেখি সেখানে নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন ছাড়াও প্রদীপ ভৌমিক, আতিউর রহমান, এইচ এম খালেকুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
তাঁদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের ২৬ বছরের আন্দোলনের ফল কি শুধুই বিভাগ ঘোষণা? বিভাগীয় প্রশাসনের তেমন ক্ষমতা নেই। জবাবে নূরুল আমিন জানালেন, বিভাগ প্রতিষ্ঠা ছাড়াও আমরা ময়মনসিংহবাসীর অনেকগুলো দাবি সামনে নিয়ে এসেছি। আমরা ময়মনসিংহ শহরে দুটি বাইপাস করাতে পেরেছি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হয়েছে, তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেল যোগাযোগ হয়েছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত চার লেন করার দাবি পূরণ হয়েছে। ময়মনসিংহের জলাবদ্ধতাও অনেকটা কমেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলটি চালু হয়েছে। মেডিকেল কলেজের ৫০০ শয্যা ১০০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া ত্রিশালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। হালুয়াঘাটে স্থলবন্দর হয়েছে, ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম আন্তনগর ট্রেন চলছে।
ময়মনসিংহের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো। প্রায় সব উপজেলার সঙ্গে বাস যোগাযোগ আছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন সড়কের কাজও শেষ হওয়ার পথে। সড়কটি প্রশস্ত হওয়ায় যানজট নেই। যানজটের কারণে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে যেতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা, ময়মনসিংহে আড়াই-তিন ঘণ্টায়ই যাওয়া যায়। ময়মনসিংহের যাত্রীরা সময় হিসাব করেন ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুরের। এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। কিন্তু গাজীপুর থেকে ঢাকা? যানজট না থাকলে এক ঘণ্টা, থাকলে কত সময় লাগবে কেউ বলতে পারে না।
জিজ্ঞেস করি, নাগরিক আন্দোলনের ২৬ বছরে অনেকগুলো সরকার এসেছে। কাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন? নেতারা বললেন, সব সরকারই কিছু না কিছু দাবি পূরণ করেছে। ১৯৯৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ময়মনসিংহে এলে তাঁর কাছে নাগরিক আন্দোলনের নেতারা বিভাগের দাবিটি প্রথম পেশ করেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। আজ দেরিতে হলেও শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর বিভাগ বাস্তবায়ন করলেন।
আপনারা এখন কী নিয়ে আন্দোলন করছেন? জবাবে নূরুল আমিন বললেন, ময়মনসিংহ পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা, ব্রহ্মপুত্রের ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ, ব্রহ্মপুত্র নদের খনন; নদী বাঁচাতে না পারলে মানুষ ও শহর কোনোটাই বাঁচানো যাবে না। এ ছাড়া তাঁরা ময়মনসিংহে একটি বিমানবন্দর, শিক্ষা বোর্ড, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ জামালপুর ডাবল রেললাইন, দেওয়ানগঞ্জ দ্বিতীয় যমুনা সেতু প্রতিষ্ঠাও তাঁদের দাবির মধ্যে আছে। তাঁরা আশা করছেন, বিভাগের পর একটি নতুন শিক্ষা বোর্ডও হবে। আবার ভয়ও আছে। রংপুর বিভাগের শিক্ষা বোর্ড যেমন দিনাজপুরে চলে গেছে, তেমনি ময়মনসিংহের শিক্ষা বোর্ড যেন কিশোরগঞ্জে চলে না যায়।
শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত কেমন জিজ্ঞেস করলে আন্দোলনের সহসভাপতি ইউসুফ খান পাঠান বললেন, আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হয়েছে, বলব না। তবে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চুরি বেড়েছে। অনেক বছর আগে আমরা শহরে ৬০টি ডিফেন্স পার্টি করেছিলাম। এখনো ২০-২৫টি ডিফেন্স পার্টি কাজ করছে। এগুলো নাগরিক উদ্যোগ। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
জিজ্ঞেস করি, দেশে যখন রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র, তখন আপনারা কাদের নিয়ে নাগরিক আন্দোলন করছেন? সাধারণ সম্পাদক জানান, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলই আমাদের আন্দোলনে আছে। তবে দলীয় রাজনীতি কোনোভাবেই নাগরিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করছে না। সবার একটাই লক্ষ্য, ময়মনসিংহের উন্নয়ন।
নাগরিক আন্দোলনের আরেক নেতা জানালেন, ময়মনসিংহে রাজনৈতিক হানাহানি তুলনামূলক কম। এমনকি বছরের প্রথম তিন মাস বিরোধী দলের ডাকে দেশব্যাপী যে হরতাল-অবরোধ হলো, তাতেও ময়মনসিংহে পেট্রলবোমায় কয়েকজন আহত হলেও কেউ মারা যাননি। এখানো বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মিছিল করতে পারেন। তবে তা দলীয় কার্যালয় থেকে দেড় শ গজের মধ্যেই সীমিত থাকে।
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—তিন দলেই গ্রুপিং আছে। আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ও তাঁর ছেলে মোহিত-উর রহমান, অপর গ্রুপে আছেন পৌর মেয়র ইকরামুল হক ও জহিরুল হক ও কাজী আজাদ জাহান শামীম। জহিরুল হক দলের সহসভাপতি হলেও এখন নিষ্ক্রিয়। শেষোক্ত দুজনকে কমিটিতেই রাখা হয়নি।
বিএনপির দুই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যথাক্রমে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ও আবু ওয়াহাব আকন্দ। প্রথম গ্রুপের নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর থাকলেও দ্বিতীয় গ্রুপের নেতা-কর্মীরা নিরাপদে আছেন। অনেকে ক্ষমতাসীনদের খুশি করে ঠিকাদারিও করছেন। জাতীয় পার্টির বিভাজনটি হয়েছে সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া সাংসদ এম এ হান্নানকে নিয়ে। তিনি এরশাদের সমর্থক। তাঁর গ্রেপ্তারে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি রওশন সমর্থকেরাও খুশি। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৪ সালে, ১১ বছর আগে। সেই থেকে সবকিছু সভাপতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
কেবল ঢাকা নয়, গোটা বাংলাদেশ যে ডিজিটাল হয়ে গেছে, সেটি ময়মনসিংহ গিয়ে দেখলাম। সর্বত্র ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার ও ফলক। রাস্তার দুই পাশে, মোড়ে মোড়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ছবিসংবলিত ব্যানার ঝুলছে। যুবলীগের এক নেতা ব্রহ্মপুত্র পাড়ে অবস্থিত জয়নুল আবেদিন উদ্যানকে ব্যানারের স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র করে ফেলেছেন।
বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর অনেকে এর কৃতিত্ব দাবি করলেও নাগরিক আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানই বেশি। তবে তাঁরা বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সহযোগিতার কথাও স্বীকার করলেন। সংসদে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার পর রওশন এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমরা তো প্রদেশ চাই’। তাঁকে বোঝানো হলো প্রদেশ না হওয়া পর্যন্ত বিভাগের দাবিকে সমর্থন করুন। এরপর তিনি বিভাগের দাবিটি সংসদে তুলে ধরেন। রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ সদর থেকে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন।
নাগরিক আন্দোলন অফিস থেকে আমরা যাই পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হকের কার্যালয়ে। শহরের অসহনীয় যানজট, ময়লা–আবর্জনার সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, গত সাড়ে চার বছরে শহরের অনেক উন্নতি হয়েছে, নাগরিক সেবা বেড়েছে। আবার অনেক কিছু করতে পারেননি বরাদ্দের অভাবে। কী কী উন্নয়ন হয়েছে? মেয়র বললেন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে, আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই শহর ডুবে যেত। ২০ কিলোমিটার সড়কে ফুটপাত নির্মিত হয়েছে। নয় কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। শহরবাসীর বিনোদনের জন্য নতুন পার্ক এবং সৌন্দর্যবর্ধনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
আর কী কী করতে পারেননি? তাঁর জবাব, খালগুলো খনন করা যায়নি। নগরের কোথাও কোথাও এখনো ময়লা-আবর্জনা আছে, পানি সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। কেন হয়নি? মেয়র বললেন, পাঁচ লাখ বাসিন্দার এই পৌরসভার বার্ষিক বাজেট মাত্র ২০ কোটি টাকা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬০০ জন। ফলে সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। অন্যান্য মেয়রের মতো তিনিও সাধ্য বাড়ানোর ঝুঁকি নেননি। অর্থাৎ গত সাড়ে চার বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স এক পয়সাও বাড়ানো হয়নি। তাহলে সেবা বাড়বে কীভাবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments