বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বাংলাদেশের
কৃষিভিত্তিক সমাজের জনজীবন এশিয়ার অনেক সমাজ থেকেই ভিন্ন। এই সমাজের
বৈশিষ্ট্য মূলত গ্রামীণ সহজ সারল্য। তবে সব সমাজে যেমন, তেমনি বাংলাদেশের
সমাজেও চোর-ডাকাত, লম্পট, গুন্ডা-বদমাশ চিরকালই কিছু ছিল। একসময় অধিকাংশ
মানুষের উপজীবিকা ছিল কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক কার্যক্রম। গ্রামপ্রধান সমাজে
আরও ছিল তাঁতি, জেলে, কামার, কুমার, কুটিরশিল্পী, ছোট ব্যবসায়ী ও অন্যান্য
পেশাজীবী সম্প্রদায়। এখন ভূমিহীন কৃষক পরিবারের অনেক নারী-পুরুষ পেটের
দায়ে শহরে শ্রমিকের কাজ করে কোনোমতে দুই বেলা দুই মুঠো অন্নের সংস্থান
করতে পারছে। বিশ্বায়নের ধাক্কায় তথাকথিত উন্নয়নের নামে বাঙালি ও
অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবনে পরিবর্তন এলেও সমাজের মূল চরিত্র বিশেষ
বদলায়নি। মানুষের পোশাক-আশাক দেখে বোঝা যাবে না বস্তুত চার ভাগের তিন ভাগ
মানুষ দরিদ্র অথবা অসচ্ছল। এমন একটি জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেবেন যেসব
রাজনৈতিক নেতা, তাঁরা তো মোটামুটি তাঁদের মতো মানুষই হবেন। তাঁদের
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ হবেন গ্রাম বা মফস্বলের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত,
কেউবা শহুরে মধ্যবিত্ত। অল্পসংখ্যক বিত্তবান বা শিল্পপতি থাকা অস্বাভাবিক
নয়।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে জানি অনেক দিন থেকে। আগে তাঁর সম্পর্কে শুনেছি তাঁর এলাকার মানুষের মুখে। পরে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে। অকপট আচরণ ও জীবনযাপনে সারল্যই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো তিনি তাঁর গ্রামীণ সারল্য অক্ষুণ্ন রেখেছেন। তিনি তাঁর গ্রাম ভাটি অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে নাগরিক কৃত্রিমতা গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঘরানার মানুষ আজ বিলুপ্তির পথে। আড়ালে-আবডালে এখনো কেউ কেউ আছেন প্রবীণদের মধ্যে এবং তা আছেন আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাম কোনো কোনো সংগঠনে।
গ্রামের তৃণমূল থেকে জনগণের মধ্যে রাজনীতি করে আবদুল হামিদ স্পিকার ও রাষ্ট্রপতির মতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সাড়ে চার দশকে যত নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে বিজয়ী হয়ে তিনি সাংসদ হয়েছেন। বস্তা বস্তা কালোটাকা ও হোন্ডা-গুন্ডাওয়ালা পেশিশক্তির প্রয়োজন হয়নি। তিনি প্রার্থী হয়েছেন, মানুষ তাঁকে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির তিনি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত হপ্তায় তিনি গিয়েছিলেন তাঁর এলাকায়। সেখানে এক সমাবেশে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্য নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য দেন।
প্রটোকল বলে একটা জিনিস আছে, যা রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের পালন করা বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপি যখন কোনো সভায় উপস্থিত থাকেন, সেখানে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। সে জন্য বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বলয়ের ব্যবস্থা করা হয় আমাদের দেশের রীতি অনুযায়ী, যাতে যে কেউ মঞ্চের সামনে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে সমাবেশে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বক্তব্য দেওয়ার সময় জনগণকে উদ্দেশ করে ওই বেড়ার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন:
‘আমাকে বন্দী কইরা রাখা হইছে। আর আপনাদের রাখা হইছে বেড়া দিয়া।’ [ প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০১৫]
বন্দিত্ব বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন জনগণের সঙ্গে দূরত্ব। সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজভাবে মেশার বিধিনিষেধ। জনগণের নেতারা সুখ-দুঃখে জনগণের মধ্যে থাকবেন, সেটা প্রত্যাশিত। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে অনেকবার তিনি অবাধ মেলামেশার অসুবিধার কথা দুঃখ করে বলেছেন। আমাকেও তিনি অনেকবার বঙ্গভবনে বলেছেন, কী সব উপলক্ষ-টুপলক্ষে আসেন, এমনিতেই আইসেন, গপ্প-সপ্প করতাম।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ে উন্নতি করবেন, রাজনীতিবিদেরা দেশ ও জনগণের সেবায় নিবেদিত থাকবেন, সেটাই প্রত্যাশিত।
সারল্যের চেয়ে বড় ভূষণ আর মানুষের হয় না। সোজাসাপ্টা কথার মূল্য সাজিয়ে-গুছিয়ে পোশাকি বক্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি তাঁর জনগণের মধ্যে ওই অনুষ্ঠানে আরও কিছু কথা বলেছেন, যার তাৎপর্য অসামান্য। ওই সভায় তাঁর পুত্রও, যিনি তাঁর ছেড়ে দেওয়া আসনে নির্বাচিত হয়েছেন, উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি কৃষকের সন্তান হয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছি। আজ রাষ্ট্রপতির সন্তান হইছে আপনাদের এমপি। আমি সারা জীবন সততার সঙ্গে রাজনীতি করছি। মামলা-হুলিয়া-পরোয়ান নিয়ে রাজনীতি করেছি। আদর্শের সঙ্গে কোনো সময় বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় আমি তিন উপজেলার বেশির ভাগ ঘরে গেছি। এখন আর তা সম্ভব না। সারা জীবন তো আমি রাষ্ট্রপতি থাকব না। সে সময় আবার আপনারা আমার কাছে যেতে পারবেন। তখন কোনো বাধা থাকবে না।’ [ দৈনিক সমকাল, ১২ অক্টোবর ২০১৫]
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ কাউকে সমালোচনা করে নয়, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলেছেন, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। যেভাবেই হোক, এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। মানুষের কল্যাণে জনপ্রতিনিধিদের কাজ করতে হবে।
‘আমি কৃষকের সন্তান’—এ যে কত বড় স্বীকারোক্তি এবং মহৎ উচ্চারণ, তা নতুন শহুরে ভদ্রলোকদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পরে গ্রাম থেকে যাঁরা একটি পায়জামা-শার্ট ও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঢাকায় এসেছিলেন এবং আল্লাহর রহমতে আজ যাঁদের গচ্ছিত বিদেশের ব্যাংকে অঢেল টাকা এবং চালান পাজেরো, বিএমডব্লিউ, কোমরে ও ব্রিফকেসে কয়েকটি পিস্তল, তাঁদের মুখ দিয়ে এমন অলক্ষুনে কথা কস্মিনকালেও বেরোতে পারে না: আমি কৃষকের সন্তান।
জাতীয় জীবনে প্রতিটি পেশাজীবীর আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিল্প-কলকারখানার মালিকদের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করে না। তাঁদের জগৎ আলাদা। তাঁরা সেই জগতে তাঁদের মেধা, দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। শিল্প-কারখানার মালিকেরা হাজার হাজার মানুষকে কর্মের সংস্থান করেন। অন্যান্য পেশার মানুষও তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।
একজন রাজনীতিবিদ ওই অর্থে কোনো পেশাজীবী নন। জীবিকার জন্য রাজনীতি করেন না। অর্থ উপার্জনের জন্যও নয়। জনগণের সার্বিক কল্যাণ তাঁর লক্ষ্য। সে জন্য তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়। জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। জনাব আবদুল হামিদের মতো হুলিয়া-পরোয়ানা মাথায় নিয়ে চলতে হয়। এ কালের অনেক জনপ্রতিনিধিও জেলে যান। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য পালিয়ে বেড়ান। তবে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রামের কারণে নয়। ফৌজদারি মামলার আসামি হিসেবে। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে জনগণকে খুন-জখম করার অভিযোগে। এই প্রজাতির রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধির সঙ্গে খুনি-ডাকাত-রাহাজান-দস্যুদের পার্থক্য কোথায়?
সত্যিকারের রাজনীতিক যাঁরা, তাঁরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের আবেগ-অনুভূতি অনুধাবন করেন। যেমন পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধিকার অর্জন এবং স্বশাসিত একটি শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, মানুষ তাঁদের ভোট দিয়ে ১৯৭০-এ নির্বাচিত করেন।
ছয় দফা আন্দোলনে যে নেতা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তাঁকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের প্রধান অস্ত্র ও শক্তি ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনা। আমি কাছে থেকে দেখে যতটা জানি, বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তার কোনো নেতারই হাঁকানোর জন্য সবচেয়ে দামি জিপ এবং দু-তিনটি পিস্তল কোমরে থাকত না। সুতরাং কোনো পথচারী বা নিষ্পাপ কিশোরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার প্রশ্নই আসেনি। বরং কোনো দুর্বৃত্ত গুলি ছুড়লে জনপ্রতিনিধি সেখানে ছুটে যেতেন। তখন রাজনীতি ছিল নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের লড়াই।
ব্যবসায়ীদের কেউ রাজনীতিতে আসতেই পারেন, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তানি আমলেও সামন্ত পরিবার থেকে এসেছেন। বাংলাদেশে অরাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ শুরু হয় সামরিক শাসনের সময় থেকে। অন্য জায়গা থেকে কেউ রাজনীতিতে আসতে পারবেন না তা নয়, কিন্তু রাজনীতি জিনিসটাই ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেলে সেটা অন্য ব্যাপার। জনগণ তাতে ক্ষমতাহীন-অভিভাবকহীন হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি সেই ইঙ্গিতই করেছেন।
সফল ব্যবসায়ীদের যোগ্যতার ঘাটতি নেই। তাঁদের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই। একজন রাজনীতিক ভালো প্রশাসক নাও হতে পারেন। রাজনীতিবিদ মানুষ, তাই তাঁর ভুল হওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি তিনি জনগণের স্বার্থের বিষয়গুলো ভালো বোঝেন, তাহলে তাঁর অন্য সব গুণ কম থাকলেও ক্ষতি নেই। একজন ভালো রাজনীতিক তিনিই, যাঁর রয়েছে দূরদৃষ্টি। কী নীতি গ্রহণ করলে অত বছর পর অবস্থা এই রকম হতে পারে, সে জ্ঞান থাকা চাই। কোন কাজে কত ভাগ মানুষ উপকৃত হবে আর কোন কর্মসূচিতে কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা অঙ্ক না কষেই একজন রাজনীতিক বলতে পারেন।
আগের রাজনীতিবিদদের জনসেবার বিনিময়ে চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না। এখন চাওয়ার এবং পাওয়ার শেষ নেই। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যাঁরা গৃহহীন, জনসেবা করতে করতে যাঁরা নিজেদের জন্য মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই করতে পারেননি, সে রকম কারও জন্য তাঁর এলাকার পৌরসভায় একখণ্ড খাস জমি সরকার থেকে বরাদ্দ দিলে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু গয়রহ সবাইকে, এমপি হলেই, রাজউকের প্লট দিতে হবে—এ কোন নিয়ম? সব মানুষকেই শুল্কযোগ্য পণ্যে শুল্ক দিতে হয়। এমপিরা কেন গাড়ি আনবেন বিনা শুল্কে? এবং আনবেন সবচেয়ে দামি গাড়ি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতে?
জনপ্রতিনিধিদের অনাচার ও দুর্নীতি যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেরা বিত্তের পাহাড় গড়েন, জনগণ আর যদি কিছুই করতে না পারে, তাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে ঘৃণাটা করতে পারে। প্রতিদিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের কারও বুকে হতাশা, কারও বুকের ভেতরে জ্বলে আগুন। তাদের কথা না ভেবে জনপ্রতিনিধিরা যদি কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘোরেন এবং সবার ওপরে ছড়ি ঘোরাতে চান, তাহলেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা এবং রাজনীতিকদের বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ে উন্নতি করবেন, রাজনীতিবিদেরা দেশ ও জনগণের সেবায় নিবেদিত থাকবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। বহু আগেই বাংলার কবি বলে গেছেন: বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। যে যার জায়গা থেকে ভূমিকা রাখলে সেটাই সবচেয়ে সুন্দর ব্যবস্থা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে জানি অনেক দিন থেকে। আগে তাঁর সম্পর্কে শুনেছি তাঁর এলাকার মানুষের মুখে। পরে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে। অকপট আচরণ ও জীবনযাপনে সারল্যই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো তিনি তাঁর গ্রামীণ সারল্য অক্ষুণ্ন রেখেছেন। তিনি তাঁর গ্রাম ভাটি অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে নাগরিক কৃত্রিমতা গ্রহণ করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঘরানার মানুষ আজ বিলুপ্তির পথে। আড়ালে-আবডালে এখনো কেউ কেউ আছেন প্রবীণদের মধ্যে এবং তা আছেন আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাম কোনো কোনো সংগঠনে।
গ্রামের তৃণমূল থেকে জনগণের মধ্যে রাজনীতি করে আবদুল হামিদ স্পিকার ও রাষ্ট্রপতির মতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সাড়ে চার দশকে যত নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে বিজয়ী হয়ে তিনি সাংসদ হয়েছেন। বস্তা বস্তা কালোটাকা ও হোন্ডা-গুন্ডাওয়ালা পেশিশক্তির প্রয়োজন হয়নি। তিনি প্রার্থী হয়েছেন, মানুষ তাঁকে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতির তিনি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত হপ্তায় তিনি গিয়েছিলেন তাঁর এলাকায়। সেখানে এক সমাবেশে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্য নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য দেন।
প্রটোকল বলে একটা জিনিস আছে, যা রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের পালন করা বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতো ভিভিআইপি যখন কোনো সভায় উপস্থিত থাকেন, সেখানে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। সে জন্য বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বলয়ের ব্যবস্থা করা হয় আমাদের দেশের রীতি অনুযায়ী, যাতে যে কেউ মঞ্চের সামনে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে সমাবেশে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বক্তব্য দেওয়ার সময় জনগণকে উদ্দেশ করে ওই বেড়ার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন:
‘আমাকে বন্দী কইরা রাখা হইছে। আর আপনাদের রাখা হইছে বেড়া দিয়া।’ [ প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০১৫]
বন্দিত্ব বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন জনগণের সঙ্গে দূরত্ব। সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজভাবে মেশার বিধিনিষেধ। জনগণের নেতারা সুখ-দুঃখে জনগণের মধ্যে থাকবেন, সেটা প্রত্যাশিত। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে অনেকবার তিনি অবাধ মেলামেশার অসুবিধার কথা দুঃখ করে বলেছেন। আমাকেও তিনি অনেকবার বঙ্গভবনে বলেছেন, কী সব উপলক্ষ-টুপলক্ষে আসেন, এমনিতেই আইসেন, গপ্প-সপ্প করতাম।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ে উন্নতি করবেন, রাজনীতিবিদেরা দেশ ও জনগণের সেবায় নিবেদিত থাকবেন, সেটাই প্রত্যাশিত।
সারল্যের চেয়ে বড় ভূষণ আর মানুষের হয় না। সোজাসাপ্টা কথার মূল্য সাজিয়ে-গুছিয়ে পোশাকি বক্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি তাঁর জনগণের মধ্যে ওই অনুষ্ঠানে আরও কিছু কথা বলেছেন, যার তাৎপর্য অসামান্য। ওই সভায় তাঁর পুত্রও, যিনি তাঁর ছেড়ে দেওয়া আসনে নির্বাচিত হয়েছেন, উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি কৃষকের সন্তান হয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছি। আজ রাষ্ট্রপতির সন্তান হইছে আপনাদের এমপি। আমি সারা জীবন সততার সঙ্গে রাজনীতি করছি। মামলা-হুলিয়া-পরোয়ান নিয়ে রাজনীতি করেছি। আদর্শের সঙ্গে কোনো সময় বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় আমি তিন উপজেলার বেশির ভাগ ঘরে গেছি। এখন আর তা সম্ভব না। সারা জীবন তো আমি রাষ্ট্রপতি থাকব না। সে সময় আবার আপনারা আমার কাছে যেতে পারবেন। তখন কোনো বাধা থাকবে না।’ [ দৈনিক সমকাল, ১২ অক্টোবর ২০১৫]
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ কাউকে সমালোচনা করে নয়, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলেছেন, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। যেভাবেই হোক, এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। মানুষের কল্যাণে জনপ্রতিনিধিদের কাজ করতে হবে।
‘আমি কৃষকের সন্তান’—এ যে কত বড় স্বীকারোক্তি এবং মহৎ উচ্চারণ, তা নতুন শহুরে ভদ্রলোকদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পরে গ্রাম থেকে যাঁরা একটি পায়জামা-শার্ট ও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঢাকায় এসেছিলেন এবং আল্লাহর রহমতে আজ যাঁদের গচ্ছিত বিদেশের ব্যাংকে অঢেল টাকা এবং চালান পাজেরো, বিএমডব্লিউ, কোমরে ও ব্রিফকেসে কয়েকটি পিস্তল, তাঁদের মুখ দিয়ে এমন অলক্ষুনে কথা কস্মিনকালেও বেরোতে পারে না: আমি কৃষকের সন্তান।
জাতীয় জীবনে প্রতিটি পেশাজীবীর আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিল্প-কলকারখানার মালিকদের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করে না। তাঁদের জগৎ আলাদা। তাঁরা সেই জগতে তাঁদের মেধা, দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। শিল্প-কারখানার মালিকেরা হাজার হাজার মানুষকে কর্মের সংস্থান করেন। অন্যান্য পেশার মানুষও তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।
একজন রাজনীতিবিদ ওই অর্থে কোনো পেশাজীবী নন। জীবিকার জন্য রাজনীতি করেন না। অর্থ উপার্জনের জন্যও নয়। জনগণের সার্বিক কল্যাণ তাঁর লক্ষ্য। সে জন্য তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়। জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। জনাব আবদুল হামিদের মতো হুলিয়া-পরোয়ানা মাথায় নিয়ে চলতে হয়। এ কালের অনেক জনপ্রতিনিধিও জেলে যান। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য পালিয়ে বেড়ান। তবে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রামের কারণে নয়। ফৌজদারি মামলার আসামি হিসেবে। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে জনগণকে খুন-জখম করার অভিযোগে। এই প্রজাতির রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধির সঙ্গে খুনি-ডাকাত-রাহাজান-দস্যুদের পার্থক্য কোথায়?
সত্যিকারের রাজনীতিক যাঁরা, তাঁরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের আবেগ-অনুভূতি অনুধাবন করেন। যেমন পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধিকার অর্জন এবং স্বশাসিত একটি শোষণমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, মানুষ তাঁদের ভোট দিয়ে ১৯৭০-এ নির্বাচিত করেন।
ছয় দফা আন্দোলনে যে নেতা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তাঁকে যাঁরা সমর্থন দিয়েছেন, তাঁদের প্রধান অস্ত্র ও শক্তি ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনা। আমি কাছে থেকে দেখে যতটা জানি, বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তার কোনো নেতারই হাঁকানোর জন্য সবচেয়ে দামি জিপ এবং দু-তিনটি পিস্তল কোমরে থাকত না। সুতরাং কোনো পথচারী বা নিষ্পাপ কিশোরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার প্রশ্নই আসেনি। বরং কোনো দুর্বৃত্ত গুলি ছুড়লে জনপ্রতিনিধি সেখানে ছুটে যেতেন। তখন রাজনীতি ছিল নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের লড়াই।
ব্যবসায়ীদের কেউ রাজনীতিতে আসতেই পারেন, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তানি আমলেও সামন্ত পরিবার থেকে এসেছেন। বাংলাদেশে অরাজনৈতিক ব্যক্তি, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ শুরু হয় সামরিক শাসনের সময় থেকে। অন্য জায়গা থেকে কেউ রাজনীতিতে আসতে পারবেন না তা নয়, কিন্তু রাজনীতি জিনিসটাই ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেলে সেটা অন্য ব্যাপার। জনগণ তাতে ক্ষমতাহীন-অভিভাবকহীন হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি সেই ইঙ্গিতই করেছেন।
সফল ব্যবসায়ীদের যোগ্যতার ঘাটতি নেই। তাঁদের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই। একজন রাজনীতিক ভালো প্রশাসক নাও হতে পারেন। রাজনীতিবিদ মানুষ, তাই তাঁর ভুল হওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি তিনি জনগণের স্বার্থের বিষয়গুলো ভালো বোঝেন, তাহলে তাঁর অন্য সব গুণ কম থাকলেও ক্ষতি নেই। একজন ভালো রাজনীতিক তিনিই, যাঁর রয়েছে দূরদৃষ্টি। কী নীতি গ্রহণ করলে অত বছর পর অবস্থা এই রকম হতে পারে, সে জ্ঞান থাকা চাই। কোন কাজে কত ভাগ মানুষ উপকৃত হবে আর কোন কর্মসূচিতে কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা অঙ্ক না কষেই একজন রাজনীতিক বলতে পারেন।
আগের রাজনীতিবিদদের জনসেবার বিনিময়ে চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না। এখন চাওয়ার এবং পাওয়ার শেষ নেই। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যাঁরা গৃহহীন, জনসেবা করতে করতে যাঁরা নিজেদের জন্য মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই করতে পারেননি, সে রকম কারও জন্য তাঁর এলাকার পৌরসভায় একখণ্ড খাস জমি সরকার থেকে বরাদ্দ দিলে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু গয়রহ সবাইকে, এমপি হলেই, রাজউকের প্লট দিতে হবে—এ কোন নিয়ম? সব মানুষকেই শুল্কযোগ্য পণ্যে শুল্ক দিতে হয়। এমপিরা কেন গাড়ি আনবেন বিনা শুল্কে? এবং আনবেন সবচেয়ে দামি গাড়ি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতে?
জনপ্রতিনিধিদের অনাচার ও দুর্নীতি যদি সীমা ছাড়িয়ে যায়, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেরা বিত্তের পাহাড় গড়েন, জনগণ আর যদি কিছুই করতে না পারে, তাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে ঘৃণাটা করতে পারে। প্রতিদিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের কারও বুকে হতাশা, কারও বুকের ভেতরে জ্বলে আগুন। তাদের কথা না ভেবে জনপ্রতিনিধিরা যদি কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘোরেন এবং সবার ওপরে ছড়ি ঘোরাতে চান, তাহলেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা এবং রাজনীতিকদের বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ে উন্নতি করবেন, রাজনীতিবিদেরা দেশ ও জনগণের সেবায় নিবেদিত থাকবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। বহু আগেই বাংলার কবি বলে গেছেন: বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। যে যার জায়গা থেকে ভূমিকা রাখলে সেটাই সবচেয়ে সুন্দর ব্যবস্থা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments