খুলছে জলকপাট, হচ্ছে কোথাও ভরাট by মলয় ভৌমিক
একদিকে
নদী ভরাট, অন্যদিকে খুলছে জলকপাট। নদী রক্ষা কমিশনের এমন বিপরীত কর্মের
খবর জানা গেল একই দিনের প্রথম আলো পাঠ করে। ১০ অক্টোবর প্রথম আলোর ‘সোনাই
নদে ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় থেকে জানা যাচ্ছে, হবিগঞ্জের মাধবপুরে
সোনাই নদের ওপর স্থাপিত ভবন নির্মাণের কাজ আবার শুরু হয়েছে নদী রক্ষা
কমিশনের অনুমতি নিয়েই। ওই দিনই বিশাল বাংলা পাতায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম
হলো ‘চারঘাটে খুলবে জলকপাট, পানিতে ভরে যাবে বড়াল’। রাজশাহীর চারঘাটে বড়াল
নদের উৎসমুখ পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহনমন্ত্রী ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের
চেয়ারম্যান এ সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানান আগের দিন।
নদী রক্ষা কমিশন ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের উল্টোপাল্টা কর্মকাণ্ড যে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষিজীবী ও পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে দেশে ভরাট হয়ে যাওয়া নদ-নদী খননের দাবি করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীও এ দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে নদী খননের কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা নানা সময়ে উল্লেখ করেছেন। এ লেখাটি লিখতে লিখতেই জানতে পারলাম, মেহেরপুরে ভৈরব নদও খনন করা শুরু হয়েছে।
নদ-নদীর স্লুইসগেট বা জলকপাট খোলা এবং খননের খবরে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগছে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে এসব কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করছে শঙ্কা। এই শঙ্কা দুটি দিক থেকে: প্রথমত, নদীর যে বিরাট অংশ ইতিমধ্যে জবরদখলকারীদের হাতে গেছে, সেই অংশগুলো এই খনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ধার হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ আছে। মাধবপুরে সোনাই নদের ওপর ভবন নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু হওয়ার খবরে এই সন্দেহ বেড়ে গেছে অনেকটাই।
বেশির ভাগ নদীই দখল হতে হতে এখন আর আগের মতো চওড়া নেই। নতুন করে খননের সময় যদি বর্তমানের ক্ষীণপ্রবাহটুকুই রেখে দেওয়া হয়, তাহলে জবরদখলকারীরা এর মধ্য দিয়ে একটা বৈধতা পেয়ে যেতে পারে। কাজেই অনেক প্রত্যাশার এই প্রকল্পগুলো যেন শেষ পর্যন্ত দখলবাজদের বৈধতা দেওয়ার প্রকল্পে রূপ না নেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলছেন নদীতীরের মানুষেরা।
দ্বিতীয়ত, নদীতীরের মানুষের সব থেকে বড় শঙ্কা হলো, নদী খনন করার পর তাতে পানি থাকবে কি না। পানির প্রাপ্যতা নিয়ে এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। যেমন রাজশাহীর চারঘাটে বড়াল নদের জলকপাট খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এর উৎসমুখে ভরাট হওয়া ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ কাজ সম্পন্ন হলেও পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? বড়াল হলো পদ্মার (গঙ্গা) শাখা নদ। উজানে ভারতের ফারাক্কায় নির্মিত ব্যারাজের মাধ্যমে পদ্মার পানির স্বাভাবিক প্রবাহের বিরাট অংশই নিয়ে ফেলা হচ্ছে ভাগিরথিতে। ফলে পানি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি থাকছে না পদ্মায়।
৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বড়াল নদের প্রায় পুরোটাই গেছে দেশের সব থেকে বড় জলাশয় চলনবিলের মধ্য দিয়ে। এ বিলের মধ্যে ছোট-বড় ১০টির মতো নদ–নদী প্রবাহিত হলেও চলনবিলের মূল পানির উৎস হলো আত্রাই ও বড়াল। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বড়াল নদের উৎসমুখ পরিদর্শন করেন ৯ অক্টোবর। ১০ অক্টোবর একটি কাজে আমি মধ্য চলনবিলের উপজেলা সিংড়ায় যাই। রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিশাল এলাকায় বিস্তৃত চলনবিল। এর মধ্যে বিলের একেবারে ভেতরে যে কটি উপজেলা রয়েছে, নাটোরের সিংড়া তার একটি। সিংড়া উপজেলা সদর আত্রাই নদের তীরে। আবার ‘বিলের নাম চলন, গ্রামের নাম কলম’ খ্যাত কলম গ্রামটিও সিংড়া সদরের সঙ্গেই। সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওহিদুর রহমান শেখ, চলনবিল মহিলা কলেজের অধ্যাপক মো. আমির হামজা, মোহম্মদ রোকনুজ্জামান ও মো. গোলাম মোস্তফার সঙ্গে বড়াল নদের জলকপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়ে কথা হয়। এর সুফল সম্পর্কে আমি তাঁদের মতামত জানতে চাই। সবাই বড়াল নদে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানান। অবশ্য তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হন যে বড়াল খনন করা হলে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে ইদানীং যে ‘পকেট বন্যা’ (বিভিন্ন পকেটে পানি আটকে থাকা) হচ্ছে, তার হাত থেকে কিছুটা রেহাই মিলতে পারে। কেননা, নদে প্রতিবন্ধকতা না থাকলে দ্রুত পানি ভাটিতে নেমে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বড়াল নদ নিয়ে ইতিপূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকাণ্ডে চলনবিলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। ‘বড়াল-ক্লোজার’ বা বড়ালের উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে। আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে পদ্মার পানি প্রত্যাহার শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। পানি প্রত্যাহার শুরুর দশ-এগারো বছর পর পদ্মা যখন মৃতপ্রায়, তখন ঠিক কী কারণে রাজশাহীর চারঘাটে উৎসমুখে বড়াল-ক্লোজার নির্মাণ করা হলো, তা কারও কাছেই বোধগম্য ছিল না। পদ্মার পানিতেই বড়াল সচল থাকত। সেই পদ্মায় যখন পানি নেই, তখন বড়ালের মুখ বেঁধে ফেলার অর্থ হলো বড়াল প্রবাহের শরীরে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া। অনেকেই বিশ্বাস করেন, নদী দখলদারদের সুযোগ করে দেওয়া অথবা প্রকল্পের মাধ্যমে কাউকে কাউকে ‘করে খাওয়া’র সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই আত্মঘাতী এই কর্মকাণ্ডটি হাতে নেওয়া হয়েছিল।
বড়াল-ক্লোজার নির্মাণের কারণে গত তিন দশকে কেবল বড়াল নদই কঙ্কালসার হয়নি, ফসল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে, উধাও হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম। এমনিতেই সময়ের বিবর্তনে চলনবিল ঐতিহ্য হারাচ্ছিল, এর মধ্যে বড়াল-ক্লোজারের ধাক্কায় সেখানকার মানুষ আজ এক ভিন্ন জীবন-জীবিকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে।
চলনবিলের এক প্রান্তে বাড়ি হলেও ওই বিলের মধ্যাঞ্চলে আমি প্রথম যাই ১৯৭০ সালে। আমি সে সময় নবম শ্রেণির ছাত্র। শীতকালে চাটমোহর উপজেলার অষ্টমনিষা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। ট্রেনে চড়ে নামতে হলো বড়াল ব্রিজ স্টেশনে। বোঝাই যাচ্ছে স্টেশনটির নামকরণ হয়েছে বড়াল নদের নামানুসারে। বড়াল অষ্টমনিষা গ্রামের বুক চিরে বেরিয়ে গেছে। শীতকালেও ওই নদের ভয়াল রূপ উজ্জ্বল হয়ে আছে আমার স্মৃতিতে। অবশ্য পলি জমায় এ সময়ের আগে থেকেই চলনবিল অনেক স্থানে জেগে উঠতে শুরু করেছিল। উত্তরাঞ্চলে খরিপ মৌসুমে ইরি-বোরোর আবাদ শুরু হয় এই সময় থেকেই। বড়ালের দুই পারে ইরি-বোরোর আবাদও আমার চোখে পড়েছে।
১৯৮৫-৮৬ সালে দেশব্যাপী মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজের অংশ হিসেবে আমাদের চলনবিল এলাকায় অনেকবার যেতে হয়। নাট্যকার মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা, অভিনেতা আজিজুল হাকিম, মাসুম রেজা, তপন দাশ, স্বদেশবন্ধু সরকারসহ অনেকেই আমরা চলনবিল এলাকায় কার্যকর মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হই। এ সময় আমাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই শামিল হতেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। চলনবিলের করতকান্দি গ্রাম নিয়ে দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত তাঁর সিরিজ প্রতিবেদনের কথা অনেকেরই মনে থাকতে পারে। আমরা চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলার গ্রামগুলোতে যখন কাজ করছিলাম, তখন বড়ালের উৎসমুখে দেওয়া জলকপাটের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ওই সময়ে প্রথম যে সমস্যাটি আমাদের চোখে পড়ে, তা হলো যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা। আগে চলনবিলে সারা বছর পানি থাকায় নৌকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া যেত, কিন্তু বড়াল-ক্লোজার নির্মাণের পর সেই সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেল। না নৌকা, না পায়ে হাঁটার সুবিধা। সব মিলিয়ে এলাকার মানুষের এক দুর্বিষহ অবস্থা আমাদের চোখে পড়ে।
ত্রিশ-বত্রিশ বছর পর আজ চলনবিলের পেট চিরে অনেক পাকা রাস্তা হয়েছে। জীবন-জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। নতুনভাবে অভ্যস্ত হওয়া জীবনে তাই বড়ালের জলকপাট খোলার ঘোষণা ওই এলাকার মানুষের মধ্যে বড় কোনো বার্তা নয়। বরং মানুষের মাঝে বাড়ছে সন্দেহ। এ সন্দেহ নদী রক্ষা কমিশনকেই দূর করতে হবে।
একদা চলনবিলই ছিল দেশে সব থেকে বড় মাছের অভয়াশ্রম। চলনবিলের বিরাট একটা অংশে সারা বছর পানি থাকায় এবং সেই পানিতে জলজ উদ্ভিদ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করায় জাল ফেলা সম্ভব হতো না। মা-মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারত। এখন প্রাকৃতিক সেই অভয়াশ্রম নেই। সিংড়া থেকে ফেরার সময় অনেক হতাশার মধ্যেও আশার বাণী শোনান চলনবিল মহিলা কলেজের অধ্যাপক তেলিগ্রামের আমির হামজা। তিনি জানান, সিংড়ায় ‘সিংড়াদহ’ ছাড়াও কড়েরগ্রাম এবং গুড় নদ এলাকার স্থানীয় মানুষের প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মাছের অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে নতুন করে। ছোট ছোট এই অভয়াশ্রমে সারা বছরই মাছ ধরা নিষেধ। বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়তার হাত।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। নাট্যকার।
নদী রক্ষা কমিশন ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের উল্টোপাল্টা কর্মকাণ্ড যে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষিজীবী ও পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে দেশে ভরাট হয়ে যাওয়া নদ-নদী খননের দাবি করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীও এ দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে নদী খননের কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা নানা সময়ে উল্লেখ করেছেন। এ লেখাটি লিখতে লিখতেই জানতে পারলাম, মেহেরপুরে ভৈরব নদও খনন করা শুরু হয়েছে।
নদ-নদীর স্লুইসগেট বা জলকপাট খোলা এবং খননের খবরে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগছে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে এসব কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করছে শঙ্কা। এই শঙ্কা দুটি দিক থেকে: প্রথমত, নদীর যে বিরাট অংশ ইতিমধ্যে জবরদখলকারীদের হাতে গেছে, সেই অংশগুলো এই খনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ধার হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ আছে। মাধবপুরে সোনাই নদের ওপর ভবন নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু হওয়ার খবরে এই সন্দেহ বেড়ে গেছে অনেকটাই।
বেশির ভাগ নদীই দখল হতে হতে এখন আর আগের মতো চওড়া নেই। নতুন করে খননের সময় যদি বর্তমানের ক্ষীণপ্রবাহটুকুই রেখে দেওয়া হয়, তাহলে জবরদখলকারীরা এর মধ্য দিয়ে একটা বৈধতা পেয়ে যেতে পারে। কাজেই অনেক প্রত্যাশার এই প্রকল্পগুলো যেন শেষ পর্যন্ত দখলবাজদের বৈধতা দেওয়ার প্রকল্পে রূপ না নেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলছেন নদীতীরের মানুষেরা।
দ্বিতীয়ত, নদীতীরের মানুষের সব থেকে বড় শঙ্কা হলো, নদী খনন করার পর তাতে পানি থাকবে কি না। পানির প্রাপ্যতা নিয়ে এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। যেমন রাজশাহীর চারঘাটে বড়াল নদের জলকপাট খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং এর উৎসমুখে ভরাট হওয়া ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ কাজ সম্পন্ন হলেও পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? বড়াল হলো পদ্মার (গঙ্গা) শাখা নদ। উজানে ভারতের ফারাক্কায় নির্মিত ব্যারাজের মাধ্যমে পদ্মার পানির স্বাভাবিক প্রবাহের বিরাট অংশই নিয়ে ফেলা হচ্ছে ভাগিরথিতে। ফলে পানি চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি থাকছে না পদ্মায়।
৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বড়াল নদের প্রায় পুরোটাই গেছে দেশের সব থেকে বড় জলাশয় চলনবিলের মধ্য দিয়ে। এ বিলের মধ্যে ছোট-বড় ১০টির মতো নদ–নদী প্রবাহিত হলেও চলনবিলের মূল পানির উৎস হলো আত্রাই ও বড়াল। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বড়াল নদের উৎসমুখ পরিদর্শন করেন ৯ অক্টোবর। ১০ অক্টোবর একটি কাজে আমি মধ্য চলনবিলের উপজেলা সিংড়ায় যাই। রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার বিশাল এলাকায় বিস্তৃত চলনবিল। এর মধ্যে বিলের একেবারে ভেতরে যে কটি উপজেলা রয়েছে, নাটোরের সিংড়া তার একটি। সিংড়া উপজেলা সদর আত্রাই নদের তীরে। আবার ‘বিলের নাম চলন, গ্রামের নাম কলম’ খ্যাত কলম গ্রামটিও সিংড়া সদরের সঙ্গেই। সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওহিদুর রহমান শেখ, চলনবিল মহিলা কলেজের অধ্যাপক মো. আমির হামজা, মোহম্মদ রোকনুজ্জামান ও মো. গোলাম মোস্তফার সঙ্গে বড়াল নদের জলকপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়ে কথা হয়। এর সুফল সম্পর্কে আমি তাঁদের মতামত জানতে চাই। সবাই বড়াল নদে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানান। অবশ্য তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হন যে বড়াল খনন করা হলে বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টিতে ইদানীং যে ‘পকেট বন্যা’ (বিভিন্ন পকেটে পানি আটকে থাকা) হচ্ছে, তার হাত থেকে কিছুটা রেহাই মিলতে পারে। কেননা, নদে প্রতিবন্ধকতা না থাকলে দ্রুত পানি ভাটিতে নেমে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বড়াল নদ নিয়ে ইতিপূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকাণ্ডে চলনবিলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। ‘বড়াল-ক্লোজার’ বা বড়ালের উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে। আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে পদ্মার পানি প্রত্যাহার শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। পানি প্রত্যাহার শুরুর দশ-এগারো বছর পর পদ্মা যখন মৃতপ্রায়, তখন ঠিক কী কারণে রাজশাহীর চারঘাটে উৎসমুখে বড়াল-ক্লোজার নির্মাণ করা হলো, তা কারও কাছেই বোধগম্য ছিল না। পদ্মার পানিতেই বড়াল সচল থাকত। সেই পদ্মায় যখন পানি নেই, তখন বড়ালের মুখ বেঁধে ফেলার অর্থ হলো বড়াল প্রবাহের শরীরে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া। অনেকেই বিশ্বাস করেন, নদী দখলদারদের সুযোগ করে দেওয়া অথবা প্রকল্পের মাধ্যমে কাউকে কাউকে ‘করে খাওয়া’র সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই আত্মঘাতী এই কর্মকাণ্ডটি হাতে নেওয়া হয়েছিল।
বড়াল-ক্লোজার নির্মাণের কারণে গত তিন দশকে কেবল বড়াল নদই কঙ্কালসার হয়নি, ফসল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে, উধাও হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম। এমনিতেই সময়ের বিবর্তনে চলনবিল ঐতিহ্য হারাচ্ছিল, এর মধ্যে বড়াল-ক্লোজারের ধাক্কায় সেখানকার মানুষ আজ এক ভিন্ন জীবন-জীবিকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে।
চলনবিলের এক প্রান্তে বাড়ি হলেও ওই বিলের মধ্যাঞ্চলে আমি প্রথম যাই ১৯৭০ সালে। আমি সে সময় নবম শ্রেণির ছাত্র। শীতকালে চাটমোহর উপজেলার অষ্টমনিষা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। ট্রেনে চড়ে নামতে হলো বড়াল ব্রিজ স্টেশনে। বোঝাই যাচ্ছে স্টেশনটির নামকরণ হয়েছে বড়াল নদের নামানুসারে। বড়াল অষ্টমনিষা গ্রামের বুক চিরে বেরিয়ে গেছে। শীতকালেও ওই নদের ভয়াল রূপ উজ্জ্বল হয়ে আছে আমার স্মৃতিতে। অবশ্য পলি জমায় এ সময়ের আগে থেকেই চলনবিল অনেক স্থানে জেগে উঠতে শুরু করেছিল। উত্তরাঞ্চলে খরিপ মৌসুমে ইরি-বোরোর আবাদ শুরু হয় এই সময় থেকেই। বড়ালের দুই পারে ইরি-বোরোর আবাদও আমার চোখে পড়েছে।
১৯৮৫-৮৬ সালে দেশব্যাপী মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজের অংশ হিসেবে আমাদের চলনবিল এলাকায় অনেকবার যেতে হয়। নাট্যকার মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা, অভিনেতা আজিজুল হাকিম, মাসুম রেজা, তপন দাশ, স্বদেশবন্ধু সরকারসহ অনেকেই আমরা চলনবিল এলাকায় কার্যকর মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হই। এ সময় আমাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই শামিল হতেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। চলনবিলের করতকান্দি গ্রাম নিয়ে দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত তাঁর সিরিজ প্রতিবেদনের কথা অনেকেরই মনে থাকতে পারে। আমরা চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলার গ্রামগুলোতে যখন কাজ করছিলাম, তখন বড়ালের উৎসমুখে দেওয়া জলকপাটের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ওই সময়ে প্রথম যে সমস্যাটি আমাদের চোখে পড়ে, তা হলো যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতা। আগে চলনবিলে সারা বছর পানি থাকায় নৌকায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া যেত, কিন্তু বড়াল-ক্লোজার নির্মাণের পর সেই সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেল। না নৌকা, না পায়ে হাঁটার সুবিধা। সব মিলিয়ে এলাকার মানুষের এক দুর্বিষহ অবস্থা আমাদের চোখে পড়ে।
ত্রিশ-বত্রিশ বছর পর আজ চলনবিলের পেট চিরে অনেক পাকা রাস্তা হয়েছে। জীবন-জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। নতুনভাবে অভ্যস্ত হওয়া জীবনে তাই বড়ালের জলকপাট খোলার ঘোষণা ওই এলাকার মানুষের মধ্যে বড় কোনো বার্তা নয়। বরং মানুষের মাঝে বাড়ছে সন্দেহ। এ সন্দেহ নদী রক্ষা কমিশনকেই দূর করতে হবে।
একদা চলনবিলই ছিল দেশে সব থেকে বড় মাছের অভয়াশ্রম। চলনবিলের বিরাট একটা অংশে সারা বছর পানি থাকায় এবং সেই পানিতে জলজ উদ্ভিদ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করায় জাল ফেলা সম্ভব হতো না। মা-মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারত। এখন প্রাকৃতিক সেই অভয়াশ্রম নেই। সিংড়া থেকে ফেরার সময় অনেক হতাশার মধ্যেও আশার বাণী শোনান চলনবিল মহিলা কলেজের অধ্যাপক তেলিগ্রামের আমির হামজা। তিনি জানান, সিংড়ায় ‘সিংড়াদহ’ ছাড়াও কড়েরগ্রাম এবং গুড় নদ এলাকার স্থানীয় মানুষের প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মাছের অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে নতুন করে। ছোট ছোট এই অভয়াশ্রমে সারা বছরই মাছ ধরা নিষেধ। বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে বাড়িয়ে দিয়েছে সহায়তার হাত।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। নাট্যকার।
No comments