সরকার আর কী কী করবে না? by সোহরাব হাসান

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাফ কথার মানুষ। তিনি সব সময় সোজাসাপটা কথা বলেন। এ জন্য দলের ভেতরেও অনেকে অস্বস্তি বোধ করেন; বিশেষ করে যারা গোঁজামিলের রাজনীতি চালিয়ে যেতে অভ্যস্ত। ২০১৩ সালের ৫ মের রাতে যখন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংগঠনটির জঙ্গি কর্মীরা রাজধানীজুড়ে তাণ্ডব চালান, তখন সৈয়দ আশরাফ সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর এই শক্ত ভাষা দলের শীর্ষ নেতৃত্বও নাকি পছন্দ করেননি।

সেই আশরাফুল ইসলাম সাহেব গত বুধবার জেলা প্রশাসকদের সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এসে যখন সাংবাদিকদের জানিয়ে দিলেন, সরকার জেলা পরিষদ নির্বাচন করার কথা ভাবছে না, তখন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়ার কারণ দেখি না। তিনি এও বলেছেন যে স্থানীয় সরকার ভালো, কিন্তু বেশি সরকার থাকা ভালো নয়। এ কারণেই কি স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় চারটি স্তরকে তিনটিতে নামিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার?
আসলে ভাবনার কারণ অন্য। ৫ জানুয়ারির একতরফা জাতীয় নির্বাচন ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক উপজেলা নির্বাচনের পর সম্ভবত সব পর্যায়েই নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছে।
সরকার এখন জেলা পরিষদ বাতিলের চিন্তা করলেও আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার উপশিরোনামে বলেছিল, ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা হবে। জেলা পরিষদকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা ও সব প্রকার উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের যন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’ (নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহার-২০০৮, দিনবদলের সনদ)।
বিগত পাঁচ বছরে সরকার জেলা পরিষদের নির্বাচন না করে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি বাদে ৬১টি জেলা পরিষদে দলীয় লোককে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, যাঁরা এখনো দায়িত্বে আছেন। সে সময় জেলা পরিষদে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথাও বলা হয়েছিল। এখন সরকার বলছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনই করবে না। নির্বাচিত সরকার ও নির্বাচনমুখী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?
একই ঘটনা ঘটেছে সোয়া কোটি লোকের বাসস্থান ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও। সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালে। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের কয়েক মাসের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে প্রার্থীই দেয়নি। ফলে বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা অনেকটা ওয়াক ওভার পেয়ে যান (যদিও কমিশনার পদগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন)।
নির্বাচিত হওয়ার পর সাদেক হোসেন খোকা বিএনপি শাসনামলের চার বছর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ও আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছর মেয়র পদে বহাল ছিলেন। খোকার মেয়াদ ২০০৭ সালে শেষ হলেও অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঢাকা সিটির নির্বাচন সামাল দিতে পারবে না, এই ভয়ে করেনি। আর নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন করেনি তাঁকে মোকাবিলা করার মতো নেতা আওয়ামী লীগে খুঁজে পায়নি বলে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মূল সমস্যাই হলো বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত না হলে কেউ নির্বাচনই দিতে চান না। চাইলেও নির্বাচনের আগেই ফল নিজের পক্ষে আনার নানা কারসাজি চালাতে থাকে।
এরপর একদিন সুবহে সাদিকে সরকারের মনে হলো, নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করে ফেলা দরকার। আর ঐশ্বরিক আদেশে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে দুই ভাগ হয়ে গেল। যাদের নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন, সেই ঢাকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজনই তারা উপলব্ধি করল না। সে সময় সরকারের হিসাব ছিল, বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সহজ হবে। তার পরও আওয়ামী লীগ দুজন জুতসই প্রার্থী খুঁজে না পেয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই থামিয়ে দিল আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার পর পৌনে দুই বছর পার হয়ে গেছে। ঢাকাবাসী এখন ধরেই নিয়েছে যে আওয়ামী লীগ যত দিন ক্ষমতায় আছে, তত দিন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে না। অর্থাৎ, সরকার নির্বাচনটি করবে না। আলোচিত পাঁচ সিটি করপোরেশন (রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর ও খুলনা) নির্বাচন দিয়ে যে ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি করবে না। আগামী এক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। সরকার তখন কী করবে? জুতসই প্রার্থী না পেলে কি সেই নির্বাচনও নানা ছলছুতায় ঠেকিয়ে রাখবে সরকার?
আইনি একটি বিচ্যুতির কারণেই সরকার স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারছে। মেয়াদ শেষে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার এককভাবে নির্বাচন কমিশনের হলেও স্থানীয় সরকার সংস্থার ক্ষেত্রে তারা সেটি করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ জরুরি। তদুপরি আছে সীমানাসংক্রান্ত জটিলতা। উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার আগে নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলেও সরকার সেটি কেড়ে নিয়েছে। এখন সরকার চাইলে নির্বাচন হবে, না চাইলে হবে না।
সরকার আপাতত আরও কী কী করছে না, কী কী করবে না, তার একটি সম্ভাব্য তালিকা দেওয়া যেতে পারে। ১. কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা, ২. দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করা, ৩. প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা, ৪. বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, ৫. রাজনৈতিক সন্ত্রাস বন্ধ করা, ৬. প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ করা, ৭. রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা, ৮. চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ৯. পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা এবং ১০. শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস ও দলীয়করণমুক্ত করা।
আমি যে ১০টি বিষয় এখানে তুলে ধরছি, প্রথমটি বাদে অন্য সব কটি আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহার থেকে নেওয়া।অর্থাৎ এসব করতে তারা জনগণের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু অঙ্গীকারের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল আছে কি না, সেটি দেশবাসী ভালো জানে।
আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ বলেই মনে করি। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতন পর্যন্ত মোটামুটি সব সরকারের আমলেই দেশের সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতো। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এসেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেয়। বিএনপির পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এল। তারাও বিএনপির পদাঙ্ক অনুসরণ করল। আবার আওয়ামী লীগের পর বিএনপি এসে একই রাস্তায় হাঁটল। আবার বিএনপির পর আওয়ামী লীগ। সেই একই পথ ও একই নীতি। কোনোভাবেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা যাবে না। দেশে ছাত্ররাজনীতি আছে, অথচ ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে না। এই অদ্ভুত ও উদ্ভট ব্যবস্থাই চলে আসছে দুই যুগ ধরে। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো মিল নেই?
সরকার ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন করছে না। অথচ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই ছাত্রজীবনে বিভিন্ন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি বা জিএস ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইডেন কলেজের (ইন্টারমিডিয়েট শাখা) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর জিএস ছিলেন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ডাকসুর ভিপি ছিলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ডাকসুর ভিপি ছিলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ইউকসুর ভিপি ছিলেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যুক্তরাজ্যে অধ্যয়নকালে এশীয় ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করেছেন। অথচ তাঁরাই নতুন ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচন করতে দিচ্ছেন না।
সরকারের এই না করার তালিকায় আরও যোগ হতে পারে, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে জাতীয় নির্বাচন না করা। অথচ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নেতা-নেত্রীরা বলেছিলেন, সংবিধান রক্ষার জন্য এই নির্বাচনটি করা জরুরি। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এ ব্যাপারে একটি বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আপনাদের বিরোধিতা ও বর্জন সত্ত্বেও ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারিও কিন্তু একটি নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। সেটি কী কারণে হয়নি, আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি কীভাবে হয়েছে, তা নিশ্চয়ই আপনাদের জানা। ৫ জানুয়ারির সঙ্গে ২২ জানুয়ারির ফারাক খুব বেশি নয়। ২২ জানুয়ারির নির্বাচনটি হয়ে গেলেও যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো না, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি হওয়ার পরও দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বিএনপির ভুলের কাফফারা তারা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। আপনাদের ভুলের খতিয়ান বাড়ছে বৈ কমছে না।
সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতারা ইতিমধ্যে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে তাঁরা কোনো সংলাপে যাবেন না। পাঁচ বছরের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বিএনপি নেত্রী গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেছেন। এখন আর গণতন্ত্রের ক্লাবে তাঁর ঢোকার সুযোগ নেই। সেই সুযোগ না থাকুক, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দিয়ে সরকার আরেকবার প্রমাণ নিতে পারে, কে কে গণতন্ত্রের ক্লাবে আছেন, আর কে নেই।
মাননীয় মন্ত্রীকে বলব, সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে গেলেও গণতন্ত্রের সর্বজনীন যে সংজ্ঞা আছে, অর্থাৎ জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন, সেটি কেউ বদলাতে পারে না।
গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিএনপির ভয়ে মহাজোট ওরফে ১৪–দলীয় সরকার ঢাকা সিটির নির্বাচন সাড়ে পাঁচ বছর ঠেকিয়ে রেখেছে, আর কত দিন তারা ঠেকিয়ে রাখবে, সরকারের মুখপাত্র হিসেবে তথ্যমন্ত্রী জানালে কৃতার্থ হব।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.