মীমাংসিত সমুদ্রসীমানা ও গ্যাস অনুসন্ধান by বদরূল ইমাম
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের
সঙ্গে ভারতের সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার
সমুদ্রবক্ষ নিষ্কণ্টকভাবে পেতে সক্ষম হলো।ইতিপূর্বে ২০১২ সালে মিয়ানমারের
সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসা হয় অন্য আন্তর্জাতিক আদালত
ইটলসের প্রদত্ত রায়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে তার প্রতিবেশী দুই
দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিয়ে যে বিরোধ থেকে যায়, তার
বহিঃপ্রকাশ ঘটে কখনো বা রাজনৈতিক কলাকৌশলে আবার কখনো বা খোলা সামরিক
শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায়। বিশেষ করে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে এ
তিনটি দেশই বঙ্গোপসাগরকে তাদের মোক্ষম এলাকা হিসেবে বিবেচনা করে ও
অনুসন্ধান কার্যক্রমে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় একে অন্যের সীমানায়
বিরোধপূর্ণ মুখোমুখি অবস্থানে এসে পড়ে। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের
সমুদ্রসীমানার ভেতরে মিয়ানমারের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ
করতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বা তারও বহু আগে ১৯৭৪ সালে
ভারতের সমুদ্রসীমানাসংলগ্ন বাংলাদেশ সমুদ্র ব্লকে নিয়োজিত মার্কিন তেল
কোম্পানিকে ভারতের বাধা ও কাজ করতে না দেওয়ার ঘটনাগুলো কেবল কিছু উদাহরণ
মাত্র।
তিনটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুসুলভ হলেও অমীমাংসিত সমুদ্রসীমানা নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থে উপরিউক্ত নেতিবাচক মনোভাব ও তার বহিঃপ্রকাশ যে ঘটে চলত, তা বলাই বাহুল্য। এ বিরোধ দিনে দিনে আরও বড় হয়ে দেখা দিত এই কারণে যে বঙ্গোপসাগরে ইতিমধ্যে উন্মোচিত গ্যাস-তেল সম্পদ সবার মধ্যেই এর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলেছে। ভারত আেগ থেকেই তার অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দেশি ও বিদেশি অনুসন্ধানী কোম্পানির মাধ্যমে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। সম্প্রতি মিয়ানমার তার সমুদ্রবক্ষে প্রথমবারের মতো বিরাট পরিসরে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে চুক্তি স্বাক্ষরে উৎসাহিত করতে সক্ষম হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ তার সমুদ্রবক্ষে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানিগুলোকে অনুসন্ধান চালাতে আগ্রহী করতে পারেনি। বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানকাজ চালানোর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়ে কেন আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানিকে আনতে পারছে না, সেটি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। এর কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি হলো, বাংলাদেশের গ্যাস ব্লকগুলো নিষ্কণ্টক ছিল না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানার পূর্ব অংশে সব ব্লকের ওপর মিয়ানমারের দাবি ও পশ্চিম দিকে ভারত-সীমান্তবর্তী সব ব্লকে ভারতের দাবি—এসব সমুদ্র ব্লককে আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিতর্কিত ও বিনিয়োগে ঝুঁকিপূর্ণ করে রেখেছিল। তাই বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসা ছিল অত্যাবশ্যকীয়, যতটা না তা ছিল প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের জন্য।
বাংলাদেশ ২০০৮ সালে তার অগভীর ও গভীর সমুদ্র অঞ্চলে ১০টি অগভীর ও ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লক ঘোষণা করে এবং সেগুলোয় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দরপত্র আহ্বান করে। প্রথমত, এ আহ্বানে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় পুনর্বার ঘোষণা দেয় ও দরপত্র জমা দেওয়ার তারিখ পুনর্নির্ধারণ করে। কিন্তু তাতেও আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে বাংলাদেশ বিদেশি কোম্পানির জন্য শর্তগুলো অনেক ক্ষেত্রে শিথিল করে। কিন্তু তাতেও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় না। ইতিমধ্যে ২০১২ সালের মার্চ মাসে জার্মানিতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক কোর্টে (ইটলস) বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বাংলাদেশ তার মিয়ানমার সমুদ্রসীমানাসংলগ্ন প্রায় সব গ্যাস ব্লক হারায় এবং আন্তর্জাতিক আদালত সেগুলোকে মিয়ানমারের সীমানার ভেতর যুক্ত করে। যেসব গ্যাস ব্লক বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে হারায়, সেগুলো নিম্নরূপ: গভীর সমুদ্র ব্লক ১৩, ১৮, ২২, ২৩, ২৬, ২৭ ও ২৮। সম্মিলিতভাবে এই ব্লকগুলোর আয়তন প্রায় ২১ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাওয়ার পর বাংলাদেশে সরকারি মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী যে সমুদ্র বিজয় উৎসব করা হয়েছিল, তার আড়ম্বরে উপরিউক্ত ব্লকগুলো হারানোর বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়। তবে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যে এতগুলো ব্লক কীভাবে বাংলাদেশ হারাল।
উপরিউক্ত প্রশ্ন ও বিষয়টির ওপর বাংলাদেশ সরকারি প্রতিনিধির উত্তর ছিল স্পষ্ট। তাঁর মতে, বাংলাদেশ ২০০৮ সালে নতুন করে তার সমুদ্র ব্লকগুলো প্রতিষ্ঠা ও ঘোষণা দেওয়ার আগে কোনো আইনি পরামর্শ বা কারিগরি মতামত গ্রহণ করেনি, বরং আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই আন্তর্জাতিক বাজারে এ ঘোষণা দেয়। এক অর্থে তা ছিল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞা ও একপ্রকার উন্নাসিকতা। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে সাধারণ মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে বাংলাদেশ ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আইন ভঙ্গকারী হিসেবে নিজেকে দৃশ্যমান রাখল কোন যুক্তিতে।
এদিকে ৭ জুলাই ২০১৪ তারিখে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক অন্য আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক ভারত–বাংলাদেশ সমুদ্রসীমানা বিরোধ মীমাংসার রায় প্রদান করা হয় ও তার পরদিন তা প্রকাশ করা হয়। এই রায়ে বাংলাদেশ সম্যকভাবে লাভবান হয়। এ ক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী গ্যাস ব্লকগুলোর প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশের পক্ষে অটুট থাকে, কেবল পশ্চিম অংশে সামান্য অংশ ভারতের দিকে কাটা পড়ে। ভারতের দাবি ছিল বাংলাদেশের ঘোষিত ১৮০ ডিগ্রি (আজুমাথ) লাইনের পরিবর্তে ১৬২ ডিগ্রি লাইনকে দুই দেশের সীমানা হিসেবে চিহ্নিত করা হোক, যাতে লাইনটি অনেকটা পূর্ব দিকে হেলে পড়ে। সে ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশ থেকে অনেক অংশ সমুদ্র পেয়ে যাবে। কিন্তু আদালত তা গ্রহণযোগ্য মনে না করে ১৭৭ ডিগ্রি লাইনকে সীমানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা কিনা বাংলাদেশের দাবি করা ১৮০ ডিগ্রি লাইন থেকে মাত্র ৩ ডিগ্রি ব্যবধানে অবস্থিত। ফলে ভারত সীমানাসংলগ্ন বাংলাদেশের সমুদ্র ব্লকগুলো (অগভীর সমুদ্রে ১, ৫ এবং গভীর সমুদ্রে ৯, ১৪, ১৯) যাদের ওপর ভারতের দাবি বহুদিনের তা বাংলাদেশেরই থেকে যায়। উল্লেখ্য, আদালত সীমানা লাইন টানার ব্যাপারে ভারতের দাবি অনুযায়ী সমদূরত্বের নীতি অনুসরণ না করে বরং ন্যায্যতার নীতি অবলম্বন করে। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা বিরোধ রায় ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সীমানা বিরোধ রায় দুটি তুলনা করলে বলা যায় যে এই শেষোক্ত রায়টি বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি লাভ বয়ে নিয়ে আসে।
ভারত বাংলাদেশ সমুদ্রসীমানা বরাবর ব্লকগুলোয় ইতিপূর্বে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্তোসকে নিয়োগ করে কিন্তু বিরোধের কারণে অনুসন্ধানকাজ এগোতে পারেনি বলে জানা যায়। তদুপরি ভারতের জাতীয় তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি এই এলাকায় কাজ করে সাফল্য পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরে এই অংশে ভারতের বিশেষ আকর্ষণ থাকার কারণ হলো এর পশ্চিম দিকে মহানদী বেসিন এলাকায় আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো। আর এ সম্ভাবনা এখন বাংলাদেশের হাতে। একইভাবে মিয়ানমারের আরাকান সমুদ্র উপকূলে যে সিউ-ফিউ-মিয়া গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তা মিয়ানমারসংলগ্ন বাংলাদেশি ব্লকগুলোর জন্য ইতিবাচক সংকেতই বহন করে।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে যে বিষয়টির সমাপ্তি ঘটেছে, তা হলো অমীমাংসিত বিরোধ। এই রায় বাধ্যতামূলক ও এর বিরুদ্ধে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—যে যা-ই পেয়ে থাকুক না কেন, প্রতিটি দেশ নিজ নিজ সমুদ্রসীমায় এই রায়ের বদৌলতে নিষ্কণ্টক। সুখের কথা এই যে ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—সবাই এই রায়গুলোকে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক হতে দেখা যায়, যার কোনো কোনোটি যৌক্তিক আবার কোনো কোনোটি নেহাতই অযৌক্তিক। অধুনা সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া তালপট্টি দ্বীপ স্থানটি ভারতের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের সমূহ স্বার্থ বিসর্জিত হয়েছে—বিএনপির এই বক্তব্য যেমন অতিরঞ্জিত, তেমনই আওয়ামী লীগের কোনো কোনো ব্যক্তি তালপট্টির অস্তিত্ব কখনোই ছিল না বা তা চিরতরে বিলুপ্ত বলে যে দাবি করেন, তা নেহাতই অবৈজ্ঞানিক ও অপরিপক্ব রাজনীতি।
একটি কথা অনস্বীকার্য যে ভারত ও মিয়ানমার উভয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যে অনমনীয় ও অনড় অবস্থান নিয়ে বসে ছিল, তা কখনোই বাংলাদেশে জন্য শুভকর ফল বয়ে আনত না। বরং এই অনমনীয় অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার পথ থেকে সরে এসে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ উভয় দেশকেই আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যায়। সামরিক ও কূটনৈতিক চালে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাধর ভারতকে আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ যে বিজয় অর্জন করেছে, বিশ্বের অনেক দেশেই তা প্রশংসা কুড়াবে।
বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি তার উপকূলীয় দেশগুলোর জন্য কী সম্পদ লুকিয়ে রেখেছে, তা কেবল একনিষ্ঠভাবে বিজ্ঞান ও কারিগরিনির্ভর অনুসন্ধানের মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসাই এই জনপদের অন্যতম কাজ। বাংলাদেশ অনাদিকাল থেকে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সমুদ্র বাংলাদেশের এক বিশাল সম্ভাবনার জায়গা। বঙ্গোপসাগরের এই বিশাল অঞ্চলকে নতুনভাবে আলিঙ্গন করে বাংলাদেশ তার শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি করবে, এ আশা আমাদের সবার।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments