আবার চুরি হবে না তো আর্জেন্টিনার স্বপ্ন?
এদগার্দো কোডেসাল মেনদেজ—নামটি কি খুব
চেনা চেনা ঠেকছে? যাঁরা ফুটবলের খবর রাখেন, ফুটবল দেখেন অনেক দিন ধরে,
তাঁদের কাছে এই নামটা অজানা কিছু হওয়ার কথা নয়। আজ থেকে ২৪ বছর আগে, ১৯৯০
বিশ্বকাপের ফাইনালে এই কোডেসালই ছিলেন মাঠের হর্তাকর্তা-বিধাতা।
আর্জেন্টিনা-জার্মানির মধ্যকার সেই ফাইনালের পর থেকে আর্জেন্টাইনদের কাছে
তিনি চক্ষুশূল, বিশ্বের তাবত্ ফুটবলপ্রেমীর কাছে তিনি বিতর্কিত এক নাম। সেই
কোডেসাল আজ কোথায়?
>>নব্বইয়ের ফাইনালে ডিয়েগো ম্যারাডোনাও হলুদ কার্ড দেখেছিলেন কোডেসালের সঙ্গে তর্ক করে
সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে এই প্রজন্মের দর্শকদের জানিয়ে দেওয়া ভালো, এই কোডেসালের বাঁশির বিষেই ২৪ বছর আগের ফাইনালে স্বপ্ন পুড়েছিল আর্জেন্টিনার। ডিয়েগো ম্যারাডোনার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল অশ্রুধারা। আর এই কোডেসালই ফাইনালে দুই আর্জেন্টাইন ফুটবলারকে লাল কার্ড দেখিয়ে ম্যাচ থেকে পুরোপুরিই ছিটকে দিয়েছিলেন তাদের।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে কত রেফারিই তো এসেছেন, ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন, আবার প্রশংসিতও হয়েছেন, কিন্তু কোডেসাল এমন একজন বিরল চরিত্র যাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্ক কখনোই থেমে যায়নি। যেকোনো আড্ডায় নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রসঙ্গ এলেই মাঠের খেলার প্রসঙ্গ ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে কোডেসাল ও তাঁর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত-কেন্দ্রিক আলোচনা।
নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালের পরপরই ডিয়েগো ম্যারাডোনা কোডেসালকে অভিযুক্ত করেছিলেন আর্জেন্টিনার ‘স্বপ্ন চুরি’র ব্যাপারে। আর্জেন্টিনার তত্কালীন কোচ কার্লোস বিলার্দো আর্জেন্টাইনদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কোডেসালকে দেখলেই আইন নিজের হাতে তুলে নিন।’ আজ ২৪ বছর বাদে আর্জেন্টিনা-জার্মানির আরও একটি বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে সেই কোডেসাল আবারও নতুন করে আলোচনায় না এসে কি পারেন?
কোডেসালের বিপক্ষে আর্জেন্টাইনদের অভিযোগ মূলত জার্মানির জয়সূচক পেনাল্টিটি নিয়ে। পেদ্রো মনজন আর গুস্তাভো দেজোত্তির লাল কার্ড দুটিও অনেকের চোখেই ‘চরম বিতর্কিত’। একই সঙ্গে জার্মান অধিনায়ক লোথার ম্যাথাউজ ফাউল করে নিজেদের ডি-বক্সে আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েল ক্যালদেরনকে ফেলে দিলেও কোডেসালের নির্লিপ্ত ভূমিকা আর্জেন্টিনার ক্ষোভ-অভিযোগকে রূপ দেয় জিঘাংসায়। সেই জিঘাংসা আজ ২৪ বছর পরেও মিইয়ে যায়নি এতটুকুও।
আজ এত বছর পরে ইউটিউব নামক ইন্টারনেট অনুষঙ্গটির কল্যাণে জার্মানির পক্ষে যাওয়া সেই পেনাল্টিটি এখন দর্শকদের গবেষণার বিষয়। ভিডিওটি বারবার দেখে বেশির ভাগ মানুষই নিশ্চিত সেদিন জার্মান ফরোয়ার্ড ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান ‘অভিনয়ে’ অনেক বাঘা বাঘা অভিনেতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মনজনকে লাল কার্ড দেখানোর মুহূর্তটিতেও ক্লিন্সম্যানের ‘অভিনয়ে’ বাজেভাবেই প্রভাবিত হয়েছিলেন রেফারি কোডেসাল।
কোডেসাল এক মেক্সিকান রেফারি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি জন্মগতভাবে একজন উরুগুইয়ান। শৈশব-যৌবন প্রায় পুরোটাই উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে কাটানো কোডেসাল আশির দশকে স্থায়ীভাবে চলে আসেন মেক্সিকোয়। ১৯৯০ বিশ্বকাপের তিনটি ম্যাচ তিনি পরিচালনা করেন কনকাকাফ অঞ্চলের একজন রেফারি-প্রতিনিধি হিসেবে।
খুব বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ হয়নি কোডেসালের। নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালের পর তিনি আর কোনো দিনই আন্তর্জাতিক ফুটবল পরিচালনা করার সুযোগ পাননি। নব্বইয়ের ইতালি বিশ্বকাপে তিনি গ্রুপ পর্যায়ে ইতালি-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচটিসহ কোয়ার্টার ফাইনালে ক্যামেরন-ইংল্যান্ড ম্যাচটি পরিচালনা করেন। সেই ম্যাচে অবশ্য তিনি ছিলেন দারুণ প্রশংসিত। ক্যামেরুনের পক্ষে একটি আর ইংল্যান্ডের পক্ষে দুটি পেনাল্টি দিয়ে তিনি সেই ম্যাচে প্রশংসিত হয়েছিলেন ম্যাচের গতি-প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারার জন্য। আর সে কারণেই সেবার ফাইনালের রেফারি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ফাইনাল যে তাঁকে এভাবে ‘ইতিহাসে ঠাঁই’ করে দেবে, সেটা কি সেদিন এক মুহূর্তের জন্যও ভেবেছিলেন এই কোডেসাল?
একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। ঘটনাটা এই বাংলাদেশেরই। বাংলাদেশের মানুষ আর্জেন্টিনাকে কতটা ভালোবাসে সেই কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর বাঙালি ঘটিয়েছিল আবেগের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। কোডেসালের প্রতি ক্ষোভ রূপ নিয়েছিল জনগণের রোষে। বিক্ষোভ-মিছিল তো ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। পোস্টার ছাপানো হয়েছিল সারা দেশে। তাতে লেখা ছিল, ‘রেফারির কালো হাত জার্মানিকে জিতিয়ে দিল।’
কোডেসাল কতটা আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত, বাংলাদেশের এ ঘটনাটি দিয়েই বুঝে নিন না!
No comments