১০০০ জন বনাম শেখ হাসিনার সরকার- সংবাদ ভাষ্য by মুনতাসীর মামুন
স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়। রাজনীতিবিদরা আমাদের থেকে অনেক চালাক-চতুর। যতই তাঁরা বলেন না কেন, নিজ থেকে দল বড়, দল থেকে দেশ বড়, সেটা যে অধিকাংশ ৰেত্রে মনের কথা নয় এটা সবারই জানা। বিষয়টা উল্টো হবে।
দেশ থেকে দল বড়, দল থেকে নিজে বড়। তত্ত্বাবধায়ক আমল এর প্রমাণ। সুতরাং স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়, এটি তাঁরা জানেন। তবুও চান্স নেন, বা নিজেকে বড় বা অপরিহার্য মনে করেন। এ কথা মনে হলো, ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকা-ের খবর পড়ে।একজন ছাত্রনেতা ফের ত্রিশোর্ধ কাউকে যদি দেখেন, নিভাঁজ কাপড় পরে, হাতে দু'টি মোবাইল ফোন নিয়ে ১১-১২টার দিকে জনা ১৫-২০ ছেলে নিয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছে তাহলেই বুঝে নেবেন সে একজন ছাত্রনেতা। আমরা এখন যাঁরা পুরনো আমলের তাঁদের কাছে এ চিত্রটা ভয়াবহ। কারণ, আমাদের সময় কোন ছাত্রনেতার বয়স আমাদের থেকে বেশি ছিল না, মোবাইল ফোন তো ছিল না, জুতা পায়ে থাকত কিনা সন্দেহ। আর মধ্যাহ্নে সে নাসত্মা করতে ক্যান্টিনে ঢুকত না। একটা মোবাইল মেইনটেইন করতে আমাদের অনেককে হিমশিম খেতে হয়। আর দু'তিনটা মোবাইল! ছাত্রনেতার যে বর্ণনা দিলাম তাতে নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে ছাত্র রাজনীতি এখন পেশা; নেশা বা আদর্শ নয়। না'হলে এর নেতাদের হাতে এত পয়সা আসে কোত্থেকে। সরকারী-বিরোধী দু'দলের ছাত্রনেতারা সব সময়ই ৰমতার সঙ্গে সংশিস্নষ্ট থাকে। আমাকে এক সাংবাদিক আফসোস করে বললেন, মিরপুরে একটি স্কুলে ৫০ হাজার টাকা ডোনেশন দিতে না পারায় ছেলে ভর্তি করতে পারেননি। গত দু'দশক সে আওয়ামী লীগের সমর্থক। শুধু চাঁদাবাজি আর বস্ন্যাকমেল করতে পারেনি। ঐ স্কুল আওয়ামী লীগের এমপির নিয়ন্ত্রণে। অথচ, বিএনপির এক নেতা ছাত্রলীগের নেতাকে লাখের কাছে টাকা দিয়ে ঢাকার সবচেয়ে নামী মেয়েদের স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করিয়েছে। কান পাতলেই শুনবেন, আওয়ামী লীগের নেতারা কিভাবে আওয়ামী সমর্থকদের কাজ না করে বিএনপির কাজ করে দিচ্ছে।
আসলে কথায় কথা আসে। মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
গত কয়েকদিন প্রায় সব ক'টি পত্রিকায় খবর এসেছে ছাত্রলীগ ভর্তি বাণিজ্যে মরণপণ লিপ্ত। অনেক কলেজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিৰামন্ত্রীর কি সময় হয়েছে এ খবরগুলো দেখার? হয়নি বোধহয়। হলে হয়ত জানতে পারতাম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে মন্ত্রীদের নিয়োগকর্তা প্রধানমন্ত্রী খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে তা জানা যায়। উদাহরণ দিচ্ছি।
আওয়ামী লীগ ৰমতায় আসার পর ভেবেছিলাম, গ্রাম কি গ্রামের বিএনপির মানুষজন শহরে ভিড় করবে যেমনটি আওয়ামী কমর্ীদের করতে হয়েছিল ২০০১ সালে। তেমন কিছু হলো না কারণ, প্রধানমন্ত্রী রাস টেনে ধরেছিলেন। ছাত্রলীগ সে নির্দেশ শোনেনি। পত্রপত্রিকায় ছাত্রলীগ সংক্রানত্ম যেসব খবর ছাপা হচ্ছিল তা দেখে এবং শুনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ঐ সংগঠনের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট থাকবেন না। কিন্তু মনে হয়, ছাত্রলীগ তা কেয়ার করে না।
মাঝখানে আওয়ামী সমর্থক বিভিন্ন নেতাকমর্ী টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ার পর যেসব ঘটনা পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল তা দেখে প্রধানমন্ত্রী চরম অসনত্মোষ প্রকাশ করেন। আপাতত টেন্ডার কেলেঙ্কারি সংক্রানত্ম খবরাখবর তেমন চোখে পড়ছে না।
সবচেয়ে অবাক হয়েছি যুবলীগের সংযম দেখে। সম্প্রতি, বাঙালী পাকিসত্মানীদের দল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃবর্গ যখন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে গিবত গাইতে লাগল তখন তারা এ খবরের কাগজে পূর্ণ পৃষ্ঠার একটি বিজ্ঞাপন ছেপেছিল, যাতে দেখানো হয়েছিল এসব উক্তির উৎস আইয়ুব খান। বিস্মিত ও খুশি হয়েছি, শুধু আমি নই, আমরা অনেকে। এ রকম রাজনীতিই তো চাই।
একটি দল ৰমতায় এলে দলের নেতাকমর্ীদের কিছু সুযোগসুবিধা দিতে হবে। বিশ্বজুড়ে এ নিয়ম প্রচলিত কিন্তু তা করতে হবে একটি কাঠামো বা নিয়ম-কানুনের মধ্যে। না করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরাও চাই যারা গত ৭ বছর মার খেয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে তারা কিছু পাক, কিছু না পেলেও সানত্ম্বনা পাক, খানিকটা পিঠ চাপড়ানি পাক। তা অবশ্য হয়নি। জনানত্মিকে বলি, অধিকাংশের ধারণা আওয়ামী লীগ নিতে যত অভ্যসত্ম, দিতে নয়। কিন্তু আমাদের আলোচনা সে প্রসঙ্গে নয়। ছাত্ররা কী পারে? কিছুই না। কারণ, ছাত্র হিসেবে সে সুবিধা দাবি করতে পারে না।
আজকের ছাত্র রাজনীতির এ দশার জন্য অবশ্যই দায়ী জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ ও তাঁদের সামরিক শাসন। সেই যে ধস নেমেছে আর কেউ তা রোধ করতে পারেনি বা চায়নি। আমাদের মনে আছে, কিন্তু সরকারী দলের রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত, বেগম জিয়া ছাত্রদলের ছেলেদের 'সোনার ছেলে' বলেছিলেন এবং সে সোনা যে কী সোনা তা তিনি কেন তাঁর মন্ত্রীরাও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বিএনপি জোটের পতনের অন্যতম কারণ ছাত্রদল।
সবার মনে প্রশ্ন জাগছে আওয়ামী লীগও কি সে পথে এগুচ্ছে? প্রতিদিন খবরে আসছে ছাত্রলীগ পরস্পরের মধ্যে মারামারি করছে। গতকাল একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মারা গেছে। তারা শিৰকদের লাঞ্ছিত করছে। তারা ভর্তি বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছে। এ অবস্থা চললে জনমত আওয়ামী লীগের বিরম্নদ্ধে যেতে বাধ্য। আর আমাদের কথা যদি বলেন, তা হলে বলব, আমরা ছাত্র রাজনীতির পৰে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে এখন যা চলছে তার সমর্থক আমরা নই। এবং এ অবস্থা চললে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জন্য জনমত প্রবল হয়ে উঠবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার গত এক বছরে উলেস্নখযোগ্য অনেক কিছু করেছে। অর্জন করেছে। এ দলকে ৰমতায় আনতে প্রচুর সমর্থক-কমর্ী গত সাত বছরে নিগৃহীত, সর্বস্বানত্ম, পঙ্গু হয়েছে। তারা কিছু পাওয়ার জন্য নয়, একটি আদর্শ বাসত্মবায়নের জন্য সব সয়েছে। এখন ছাত্রলীগের কতিপয় কর্মীর অছাত্রসুলভ কাজের জন্য সরকারের সব অর্জন, কমর্ী-সমর্থকদের সব ত্যাগ বিসর্জিত হবে তা হতে পারে না। অভিজ্ঞতাবলে, সরকার পতন/ব্যতিব্যসত্ম রাখতে হলে শিৰাঙ্গন থেকেই তা শুরম্ন করতে হয়। ছাত্রলীগের এসব ঘটনার পেছনে সে রকম কোন ব্যাপার আছে কিনা জানি না।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে সরকারের বিরম্নদ্ধাচরণ করে টিকে থাকা বেজায় কষ্ট। ছাত্রলীগের যারা ভর্তি বাণিজ্য বা ক্যাডারসুলভ কাজ করছে তাদের সংখ্যা সারাদেশে [একেবারে যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ] কত? হাজারখানেক। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে বাংলাদেশ সরকার বা শেখ হাসিনার সরকার এই এক হাজারকে দমন করতে পারছে না?
No comments