সরকার একা কেন স্বর্গে যাবে!: স্পিকার by সাজিদুল হক

বলদা হাওর, আলালের হাওর, আঙ্গানের হাওর, চিন্নির হাওর, তলার হাওর, বড় হাওর। এসব হাওরের প্রতিটি বাঁক তার চেনা। শৈশব থেকেই হাওরের দুর্গম এলাককে জয় করেছেন। এই হাওরের বুকে টানা ১৩ ঘণ্টা সাঁতরে কাটানোর কথা এখনো বলেন বুক ফুলিয়ে।
‘ভাটির শাদুর্ল‘ নাম দিয়েছে তাকে ভাটির লোকেরাই। এরা যেনো আর কাউকে চেনে না। তাই তারা বার বার সিল মারে তার ব্যালটে। ফলে তিনিই টানা আটবার ইটনা মিঠামইনের সংসদ সদস্য।

স্বভাবসুলভ হাস্যরস ছড়ানো মানুষটি প্রয়োজনে দারুন কঠোর হতে সময় নেন না। সুইচ টিপে নিয়ন্ত্রণ করেন বাঘা রাজনীতিকদের। তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট।

সুযোগ পেলেই ছুটে যান নিজ এলাকায়। হাওরের ‍বাতাস তাকে টানে। টানে সেখানকরা জল মাটির সোঁদা গন্ধ। গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রায় পক্ষ কাল তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রত্যন্ত হাওর এলাকায়। এলাকার মানুষের টানে গিয়েছেন নিজ নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন আর অষ্টগ্রাম উপজেলায়। সত্তরোর্ধ বয়সে শীতটা মাঝে মাঝে কাহিল করে ফেলে। তা হলেও হাওর বাওরে শীতেই তো জমে দারুণ। মাছ ধরা, শীতের পিঠা, নবান্ন এসব কিছুই তাকে টেনে নেয় সেই এলাকায়। কনকনে শীত উপেক্ষা করে আনন্দে কাটে সময়। সময় কাটান গান-কীর্তনের আসরেও।

ইটনা সফরের এই সময়টিতে সফরসঙ্গী হন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক। সেখানে নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের দিনগুলোর কথা বাংলানিউজকে বলেন আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে আসে ওই জনপদের সমস্যা, সম্ভাবনা, দুর্দশার কথা।  কিছুটা বলেছেন নিজের মনের দুঃখ কষ্ট, আর হাওরের মানুষ নিয়ে তার সেইসব স্বপ্নের কথা যা আজও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।  

যাত্রা শুরু
গোধূলি লগ্ন চলছে তখন। সন্ধ্যার খানিক আগেই করিমগঞ্জের চামড়াঘাট এলাকায় পৌঁছালাম। গন্তব্য প্রত্যন্ত হাওর এলাকা ইটনা। সেখানেই জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট ছুটি কাটাচ্ছেন। ধনু নদীতে ট্রলার ছাড়তেই বুঝে গেলাম শীতের শীব্রতা। ট্রলারের লোকজন বললেন ইটনা যেতে লাগবে দুই ঘণ্টা। চারিদিকে নিবিড় প্রশান্তিময় এক পরিবেশ। পাখিরা ফিরছে নীড়ে। ট্রলার চলছে আর বাড়ছে শীতের তীব্রতা। সফরসঙ্গীরা অনেকেই ট্রলারের ছোট্ট রুমে আশ্রয় নিয়েছে। শীত এক পর্যায়ে আমাকেও ঠেলে পাঠালো সেখানে। ততক্ষণে রাত নেমেছে। আবারই বাইরে বের হয়ে মনে হলো-জীবন যেন পূর্ণ আমার। লালচে চাঁদটা যেন এক পাশ থেকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।   

‘আরে বাবা সাংঘাতিক আইছে’
দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম ইটনা বাজারের ঘাটে। ট্রলার ভিড়তেই কানে এলো, ‘সর, সর স্পিকারের মে(হ)মান আইছে।’

ঘাটের পাশেই নব নির্মিত ‘ইটনা ডাকবাংলো’। উদ্বোধন ফলকে তারিখ দেখলাম ৩০ ডিসেম্বর। উদ্বোধক ‘জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদ’। আরে আমিতো যাবো তারই কাছে। উপরে নীচে প্রচুর মানুষ। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই আমাদের কয়েকশ মানুষ ঠেলে যেতে হলো। উঠতেই চোখে পড়লো ভুবন ভোলানো সেই হাসি। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে পুরো শরীর ঢাকা। বললেন, “আরে বাবা সাংঘাতিক (সাংবাদিক) আইছে। খুব খুশি হইলাম।”

বললাম, “আমি গত মাসে বলেছিলাম আসবো, চলে এলাম।” উত্তরে বললেন, “ইউ আর ভেরি প্রম্পট ইয়ংম্যান। আই লাইক ইট।” এরপর নিজেই বললেন ফ্রেশ হয়ে আসতে।

হামিদ ‘ভাই’কে নিয়ে শ্লোক
এখানে এসে শুনলাম আবুদল হামিদকে নিয়ে একটি শ্লোক। “লাগে চাচা, ডাহি (ডাকি) ভাই। তাইনে আমরার হামিদ ভাই” (সম্পর্কে চাচা, ডাকি ভাই, তিনি আমাদের হামিদ ভাই)।’ পরে শুনলাম এই শ্লোকের সৃষ্টি রহস্য। আবদুল হামিদের সঙ্গে রাজনীতি যারা করেছেন, তাদের অনেকেরই ছেলে এমনকি নাতি একজন তার কর্মী। তাই মজা করে এই শ্লোক।

কীর্তন আসরে স্পিকার
ডাকবাংলোতেই একজন বললেন, “স্যার ডাকতাছে।” যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বললেন, “কীর্তন শুনি, চলেন।” এমন সুযোগ যাতে কোনভাবেই ফসকে না যায় সেজন্য প্রায় দৌড়েই তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রিকশায় ওঠার আগে দেখালেন ইটনা বাজার। বললেন, “এই যে বাজার, এইডা পার্মানেন্ট না। বর্ষায় পানি আসলে থাকে না।” রিকশা যাচ্ছে ইটনা পূর্ব গ্রাম। পাঁচ মিনিটের রাস্তা। এর মধ্যে চার থেকে পাঁচবার রিকশা থেকে খবর নিলের আমরা ঠিক আছি কিনা।

কীর্তন আসরে কাছাকাছি পৌছাতেই কানে এলো, “হামিদ ভাই আইছে, হামিদ ভাই আইছে।” রিকশা থেকে নেমে সবার সঙ্গে হাত মেলালেন। মানুষের ঢল তাকে দেখবার জন্য। প্যান্ডেলের ভেতরে চলছে সাতক্ষীরার রাজীব দাসের কীর্তন। মাঝপথে থামিয়ে আয়োজকরা তাদের ‘হামিদ ভাই’কে নিয়ে গেলেন মাঝখানে। সবার আগ্রহ তার কথা শোনার।
 
সরকার একা কেন স্বর্গে যাবে?
যথারীতি হাস্যরস আর স্বভাবসুলভ হাসিসহ বক্তব্য দিলেন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা নাট মন্দির নির্মাণে টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি চাইলে বললেন, “প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারবো না। কত দেবো সেটা বলতে পারবো না। তবে দেবো। সরকারের পাশাপশি আপনারও এগিয়ে আসেন। আর ধর্মীয় কাজে টাকা দিলে স্বর্গে যাওয়া যায়। তাহলে আপনারা শুধু সরকারকে স্বর্গে নেবেন কেন? আপনারাও সহযোগী হন।” হাসির রোল পড়লো চারিদিকে এক ফাঁকে বললেন, “আমার সঙ্গে ঢাকার সাংবাদিকরা আছেন। তারা যে কষ্ট করে এই হাওর এলাকায় আসছে, তার জন্য অনেক ধন্যবাদ।”  

আমার তিন সতীনের ঘর
ডাকবাংলোয় এসে আমাকে পাশে নিয়ে বসলেন। শুরু করলেন নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোঁজ-খবর। আসছে বদলির তদবিরসহ হরেক রকম তদবির থাকে। এর ফাঁকেই কথা বলা চলছে বাংলানিউজের সঙ্গেও। প্রচুর লোক তখন চারপাশে।

নিজের নির্বাচনী এলাকা সম্পর্কে বললেন, “আমার নির্বাচনী এলাকার দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পূর্ব দিকে হবিগঞ্জ, উত্তরে সুনামগঞ্জ, পশ্চিমে নেত্রকোনা। আগে পাঁচটা থানা ছিলো। এখন তিনটা-অষ্টগ্রাম, মিঠামইন আর ইটনা।”

“আমার নির্বাচনী এলাকা বিশাল এলাকা নিয়ে, কিশোরগঞ্জে ছয়জন এমপি আছেন। এর মধ্যে পাঁচজন আছেন ৬০ ভাগ এলাকা নিয়ে আর আমার ৪০ ভাগ এলাকা। আমার এলাকা অনেক বড়। ইটনা থেকে রায়টুটিই প্রায় ২০ মাইল। আর অন্য এলাকাতো আছেই। সব এলাকায় যাইতে পারি না। কাজও সমানভাবে করতে পারি না। এক এলাকায় করলে আরেক এলাকা বলে, আমাদের এখানে কাজ হয় না। অষ্টগ্রাম-মিঠামইন-ইটনা এইডা তিন সতীনের মতো। আমার তিন সতীনের ঘর।”

লেখাপড়া ও রাজনীতির শুরু
প্রাইমারির পড়াশোনা বাড়ি থেকে করেছি। হাইস্কুল ভৈরবে। পরে কিশোরগঞ্জর গুরুদয়াল কলেজ। কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলাম, জিএস ছিলাম। কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম আমি।

আমার কর্মীসভা অন্যের জনসভা
এর মধ্যেই বলে উঠলেন, “এখানে মানুষ যা আসার তার কিছুই আসেনি। যেমন আপনারা যারা বাইরে থেকে আসছেন, তারা হয়তো মনে করবেন জনপ্রিয়তার ধস নেমেছে। অন্যজেলার কর্মীসভা মানে আমার এখানে জনসভা। যোগাযোগের অসুবিধার কারণে এখানে লোকজনতো আসতে পারে না।”

“এবার আমি এখানে জনসভা করিনি। কারণ জনসভা হলেই দলীয় কর্মীরা লোক আনতে তাড়া লাগাবে। এখন কাজের সময়। এজন্য মত বিনিময় সভা করছি। স্থানীয় লোকজন যারা পারছে আসছে। কাজের সময় জনসভা করলে ক্ষতি; এলাকার মানুষের কাজের ক্ষতি হবে।”

কথার ফাঁকে ফাঁকে অন্যদের খবরও নিচ্ছিলেন হাওর এলাকার সবার ‘হামিদ ভাই’। ঢাকা থেকে আমাদের আসতে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা সে খবরটাও নিলেন।

বললেন, “আপনারা বোটে (ট্রলার) আসছেন বলে কষ্ট কম হয়েছে। স্পিডবোটে আসলে ঠাণ্ডা বেশি লাগতো। আমি বোটে কভার করতে পারি না। এজন্য কষ্ট হলেও স্পিডবোটে আসি। আসছি ১৮ তারিখ। যাবো ১ তারিখ। ১৩ দিন হয়েছে। সব এলাকা দেখতে পারিনি। ৫০ ভাগ এলাকায় মাত্র গিয়েছি। তাও শুধু ইউনিয়ন হেডকোয়ার্টারে। ২৪ টা ইউনিয়নের মধ্যে ইটনার ৪টি বাদ পড়েছে। এখানে নয়টা ইউনিয়ন। মিঠামইনে ইউনিয়ন ৭টা, যেতে পেরেছি ৪টায়। অষ্টগ্রামে ইউনিয়ন ৮টা, ৪টায় যেতে পেরেছি। ঠাণ্ডার কারণে সবগুলোতে যেতে পারছি না। তবুও চেষ্টা করছি...। দু:সাহস করে থেকে গেলাম আরকি।” সব জায়গায় না যেতে পারার একটা কষ্টও যেন ফুটে উঠলো আবদুল হামিদের চোখে।

এর ফাঁকে স্থানীয় একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাকে স্কুল পরিদর্শনের ও চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। মনকাড়া এক হাসি দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, “চা না খাই। তুমার এইডা দেইখ্যা গেলেইতো হইলো। চা আয়োজনের খরচ কইরা লাভডা কি? এইডাই ভালা তোমার স্কুল দেইখ্যা গেলাম।”

বলেই আমার দিকে ফিরে বললেন, “কাল যেতে হবে ধারা ইউনিয়নে। ওখানে একটি হাইস্কুল করছি। একদম হাওরের মধ্যে। আমাদের এখানে স্কুলগুলো অন্যভাবে করতে হয়। কারণ একতলা পর্যন্ত রুম করা যায় না। বর্ষার সময় পানিতে ডুবে যায়। বিল্ডিং হয় তিনতলা। আমার এখানে ব্যবহার হয় দুইতলা। এই হলো অবস্থা।”

এর ফাঁকে তার ব্যক্তিগত সহকারী হাবলুকে ডেকে বললেন, “চা নি খাওয়াইতে পারো। যারা কফি খায় তারারে কফি দাও। আমি চা খাবো।”

কথার ফাঁকে কিছুক্ষণ আগে ঘুরে আসা কির্তন আসরের কথাও বললেন। বললেন, “মহিলারা আমারে ভোট দেয়, কিন্তু তাদের সঙ্গে দেখা হয় না। এ ধরণের অনুষ্ঠানে গেলে দেখা হয়। সামাজিক অনুষ্ঠানতো, সবাই আসে।”

অনুষ্ঠানে টাকা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতির না দেওয়ার বিষয়ে বললেন, “এভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ঠিক না। বললাম দিবো, কিন্তু দিতে যদি না পারি। আগে দেখি কতটাকা ম্যানেজ করতে পারি তার পরে দেখবো। ওদের লাগবে ১২ লাখ টাকা, আমাকে আগে দেখতে হবে টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে।”

‘চতুর্মুখী আক্রমণের মধ্যে আছি’
বর্ষায় হাওরের রূপ নিয়ে বললেন, “বর্ষার সময় ইট ইজ লাইক মালদ্বীপ। প্রত্যেক গ্রাম একটা দ্বীপ। ফ্রম ওয়ান ভিলেজ টু এনাদার ভিলেজ ইউ নিড বোট টু গো। আদারওয়াইজ সুইমিং। আমি নিজেও গেছিতো। ৪-৫ মাইল সাঁতরাইছি।এজন্যই এখনও বেঁচে আছি।”

আরো বললেন, “এখানে নদী ভাঙন আছে।একটা পুরো গ্রামই চলে যায় নদীর মধ্যে। বর্ষাকালে নদী ভাঙন হয় না। পানি উপর দিয়ে যায়। শুকনার সময় এটা হয়। বর্ষাকালে হইলো...সব গ্রামেতো প্রতিরক্ষা দেওয়াল নেই। কিছু কিছু গ্রামে করা হয়েছে। অধিকাংশ গ্রামই প্রতিরক্ষাবিহীণ। বর্ষার সময় প্রচ- ঢেউ হলে আবার ভাঙন হয়।”

“আরেকটি বিষয় হলো, ৬ মাস আমরা পানি নীচে থাকি। তার মানে একটা টার্মে (সরকারের মেয়াদ) আমি কাজ করার জন্য সময় পাই সর্বোচ্চ দুই বছরের মতো। এর বেশি পাই না। এখন উজান এলাকায়তো সারাবছরই কম-বেশি কাজ হয়। এখানে কিছুই করার উপায় নাই। সব রাস্তা থাকে পানির নীচে। শুধু ইউনিয়ন হেডকোয়ার্টারের কিছু জায়গা থাকে, আর তাও যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকে। তবে এখন ইটনার পূর্ব গ্রাম থেকে পশ্চিম গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা আছে। এরপরেও আবার ঝামেলা আছে, কিছু পাড়া আছে যেগুলোর সাথে রাস্তার সংযোগ নাই। এগুলি করতে পারছি না। কিছু কিছু এলাকায় জলে ডোবা রাস্তা(সাবমার্জড রোড) আছে। আর যেসব জায়গায় সরু রাস্তা আছে, সেখানে ইট বিছিয়ে কোনোরকম একটা ব্যবস্থা করতে বলেছি।”

ইটনা বাজারের দিকে দেখিয়ে বললেন, “এই বাজারটাও বর্ষায় বিলীন হয়ে যাবে। এখানে থাকবে না। এ হলো অবস্থা। বর্ষাকালে মানুষ মারা গেলে দাফন করারও জায়গা থাকে না। ঘেরাও দিলেও চিনে রাখার উপায় থাকে না। হিন্দুরাও পোড়ানোর জায়গা পায় না। জানাযা পড়ে লাশ ভাসিয়ে দিতে আমি নিজেও এক সময় দেখেছি। এখন আর সে অবস্থা নাই।এবার আমি কিছু টাকা নিছি। গোরস্থান আর শশ্মানের জন্য। জোর করে টাকা বরাদ্দ নিতে হয়েছে। তিন থানার জন্য ১৫ কোটি টাকা নিয়েছি। প্রটেকশন ওয়াল তুলে এখন ব্যবস্থা নিয়েছি। আর দেখা যায় শশ্মান একটা আছে অনেক দূরে। কিন্তু বর্ষার সময় যে ঝড় ওঠে তাতে পোড়াবে ক্যামনে, সলিল সমাধি হয়ে যাবে।”

“কবরস্থানের জন্য টাকা দেওয়ার সরকারের নিয়ম নেই, এটা আরেক সমস্যা। স্পেশাল এলাকা বলে একটা থোক বরাদ্দ আনছি। সংসদে কথার ফাঁকে ফাঁকে অনেকবার বলছি। আমি লিখে দিয়েছি থোক বরাদ্দের টাকাটা এইকাজে ব্যবহার করবো। আর বিকল্প কিছু ছিলো না।”

“আমি এখানে আসলে আমার থাকার জায়গা ছাড়া আর কোনো জায়গা পাওয়া যায় না। এবার এসেই এই ডাকবাংলো উদ্বোধন করলাম। এটা না থাকলে, আপনারা যে আইছেন আপনাদের প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি বণ্টন করা লাগতো। বিভিন্ন লোকজনের বাড়িতে বণ্টণ করা লাগতো। তিন থানায় তিনটা এমন ডাকবাংলো করছি।”

“আমাদের ফসলের কথা শুনবেন, একটা সময় আসে যখন জমিতে পানি দেওয়া লাগে কিন্তু দিতে পারি না। অনেক সংগ্রাম করে পানি নিতে হয়। দূর থেকে পানি নিতে হয়। তিনটা মেশিন ব্যবহার করেও পানি নেওয়া লাগে। আবার দেখা গেলো, ফসল পাইক্যা গেলোগা, হঠাৎ কইরা বন্যা। সব ডুবায়ে গেলো। ফসলই আমার মাইর গেলো। একটা মাত্র ফসল, বোরো। আল্লাহর গজব পড়লে শিলাবৃষ্টি। চতুর্মুখী আক্রমণের মধ্যে আছি আর কি!”

‘সচিব সাহেবরা হাওর বোঝে না না’
“আমাদের দূর্ভাগ্য হলো কি, মন্ত্রণালয়ে যারা সচিব সাহেব বসেন, হাওরের এলাকা যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের এলাকা তারা সেটা জানে না। আমাদের দেশের যে মন্ত্রী হয় তারাও বোঝে না। দে ক্যান’ট রিয়ালাইজ ইট অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ড দিস। চামড়াঘাট থেকে এখানে আসতে অনেক সরকারি কর্মচারী ঝড়-তুফানে নৌকাডুবি-লঞ্চডুবিতে মারা গেছে। এটা রিস্কি এলাকা। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম তিনটাই রিস্কি এলাকা। এখানে কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করলে থাকতে চায় না। তাড়াতাড়ি কেমনে যাইবো, হেই তালে থাহে। আমার ইএনও সাহেব কয়, ‘দুই-আড়াই বছর হইছে, আর কত দিন থাকবো।’ হেয় যাইবার ভাও করতাছে। আমি তখন বললাম, আমি লোকটা কি এতই খারাপ? আমারে ছাইড়া যাইবার চান।”

শ্বশুরবাড়ি শুকনা এলাকায়!
আবারও ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। আলোচনায় আসলো শ্বশুর বাড়ি প্রসঙ্গও। বললেন, “আপনি যে রাস্তা (করিমগঞ্জ) দিয়ে আইছেন ওই রাস্তায়ই শ্বশুরবাড়ি।”
 
অট্টহাসি দিয়ে বললেন, “এইডা হয়ে গেছে। আমিতো এলাকা পছন্দ করি নাই। যারে পছন্দ করছি, তার বাড়ি ওই এলাকায় পড়ছে। আমি কি করতাম (কিশোরগঞ্জের ভাষায় এ বাক্যের অর্থ: “আমার কি করার আছে!’’)। সুবিধা হইছে, শ্বশুর বাড়ীর পরেই কিশোরগঞ্জ সদর।”

করিমগঞ্জ এলাকার এমপি জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর কথা উঠতেই বললেন, “ওদেরতো সুবিধা, সহালে আইসা বিহালে জায়গা (সকালে এসে বিকালে চলে যায়)। আমি পারি না। আসতেই রাত হয়। তারপর কাজ।”

এর মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই রাইতে কি মাছ মারা দ্যাখতে পারবো হ্যারা (ওরা)?”
উত্তর এলো:  ‘‘রাতে না সকালে।’’ বললেন, “তাইলে সকলে মাছ মারা দেইখ্যা, নাস্তা কইরা  পরে যাইয়েন।”

বললেন, “এখন আর সেরকম মাছ পাওয়া যায় না। আগে বহু মাছ পাওয়া যাইতো। রানী মাছ, খইলস্যা মাছ দেখি নাই বহুদিন। কৈ মাছও পাওয়া যায় না এখন।”

বললেন, “আমি যেসব জায়গায় সেখানে বলছি, কৃত্রিম জুস, বিদেশ থেকে আপেল, কমলা না খাওয়ার জন্য। এসব খাইলে যে, ক্যান্সার হয় সেটাও বলছি। তাছাড়া মাছ রক্ষার জন্য কারেন্ট জাল ব্যববহার বন্ধ করতে বলেছি। আরে কারেন্ট জাল ব্যবহার করলেতো মাছ শেষ হয়ে যাবে।”

এর ফাঁকেই সংসদে সম্প্রতি ৪র্থ শ্রেণীর নিয়োগ বিষয়ে জানতে চাইলেন একান্ত সচিব জয়নাল আবেদিনের কাছে (আমাদের সফরের মূল উদ্যোক্তা)। কথা বলতে বলতে এক নারী আসলেন বদলির তদবির নিয়ে। অনেক বছর ইটনায় আছেন। এখন যেতে চান।

সব শুনে বললেন, “আপনে গ্যালে বাচ্চাদের লেখাপড়া কিভাবে হবে? আপনিতো ভালো শিক্ষক। থাহেন আপনে। আগেও কইছেন, কিন্তু কিছু করতে পারি নাই।”

কথা প্রসঙ্গে হাঁস পালনের কথা উঠলে নিজেই বলা শুরু করলেন, “এখানে সহজে হাঁস পালা যায় না। যখন ঢেউ আসে সব অন্যদিকে নিয়ে যায়। আমাদের বাড়িতেও কিছু রাজহাঁস ছিলো। কিন্তু তুফানে কোই যে গেলো আর পাওয়া গেলো না।”

‘১৩ ঘণ্টা পানিতে ছিলাম’
কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই চলে গেলেন নিজের শৈশবের দুরন্তপনার বর্ণনায়। বললেন, “সাতাঁর দিয়ে বহুবার হাঁস ধরেছি। আমি একাধারে ১৩ ঘণ্টা পানিতে ছিলাম। মাটি স্পর্শ না করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাকস্ট্রোক সাঁতারে প্রথম ছিলাম। ফ্রি-স্টাইলে সেকেন্ড ছিলাম। বহুবার অনেক দূর থেকে সাঁতরে বাড়ি গিয়েছি। আর মিঠামইন বাজার থেকে সাঁতার দিয়ে প্রায়ই বাড়ি যেতাম। নদী এপার ওপার করছি ৫০-৬০ বার।”

“আমাদের এখানে সবাই সাঁতার জানে। তবে বয়স হলে আর পারা যায় না। সুইমিং ইজ দ্যা বেস্ট এক্সসারসাইজ। একারণে এখনও চলাফেরা করতে পারি। তবে ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারি না। অন্যকিছুতে সমস্যা হয় না। যে ঠাণ্ডা পড়ছে তাতে রুম হিটারেও কাজ হয় না। বাংলাদেশে যেভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন শুরু হইছে (হয়েছে), তাতে ভয় লাগে।”

“আমার এখানে হাওরের ব্যাপ্তি বিশাল কোথাও ১০ মাইল কোথাও ২০ মাইল। স্টিমারও অনেক সময় দেখা যায় না।”

‘লিডার কেক কাটবো আপনারা থাকবাইন’
“১ জানুয়ারি লিডারের জন্মদিন। হেয় তো যাইবোগা আইজ। ঢাহা তুন কেক আনাইছি। লিডার কাডবো। আপনারা থাকবাইন।” কথাগুলো এক দমে বললেন কবীর হোসেন। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী। লিডারকে জন্মদিনে পাবে না বলেই আগেভাগে পালন করতে চান তিনি। সবাইকে বললেন সেকথা। তাই ৩০ ডিসেম্বর নেতাকে দিয়ে জন্মদিনের কে কাটালো ইটনার মানুষজন।

নিজ হাতে কেক কেটে প্রায় সকলকে খাওয়ালেন আবদুল হামিদ। এতেই খুশি সবাই। আর যেনো কিছু চাওয়ার নেই। পাশে যেতেই বললেন, “হাওরের মানুষ বেশি কিছু চায় না। অনেকে অনেক অভিযোগ নিয়ে আসে। আমি হয়তো সব সমাধান করতে পারি না। তবে তার জন্য এদের কষ্ট নেই। আমাকে বলছে, এটাই তার সমাধান।”

তার কথার প্রতিধ্বনি পেলাম রিকশাচালক দুলাল মিয়ার কাছে। জানতে চাইলাম “আপনাদের সব সমস্যার সমাধান স্পিকার সাহেব করতে পারেন?” দুলাল মিয়া বললো, “হামিদ ভাইরে আমরা কইয়া ফালাই। তাইনের সময় কম। তয় একবার শুনছে যহন, কাম অইবো। দেরি হইলে হউক। সময় হইলে লিডার ঠিকই কাম করবো।”

‘মিষ্টি খাওনের টেহা পাডামুনে’
৩০ ডিসেম্বর ইটনা ছাড়বেন স্পিকার। সকাল থেকেই ডাকবাংলোয় প্রচুর মানুষের ভীড়। দুপুর একটায় গেলেন আগের দিন কথা দেওয়া স্কুল পরিদর্শনে। সঙ্গে আমিসহ আরো কয়েকশ’ মানুষ। সবাই এসেছেন ‘লিডার’কে বিদায় জানাতে।

ইটনা অক্সফোর্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুল। স্কুলের সাইন বোর্ড দেখিয়ে বললেন, “হাওর হইলে কি হইবো, এহানে অক্সফোর্ড আছে!”

দুর থেকে তখন কানে আসছে শিশুদের সমস্বরে চিৎকার, “স্পিকার সাহেবের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম।”

স্কুল প্রাঙ্গনে গিয়েই প্রধান শিক্ষককে বললেন, “বাচ্চাদের শীতে বাইরে আনছেন ক্যান। ভিতরে লইয়া যান।” এরপর শিশুদের উদ্দেশ্যে বললেন, “দেখলামতো তোমাদের, এখন যাও। শীত পড়ছে। আর কি, আমি মিষ্টি খাওয়ার টেহা পাডামুনে। যাও গিয়া।”

স্কুল থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলেন নৌকাঘাটের দিকে। যাবেন ধরলা। বোটে ওঠার আগে বললেন, “আমি যাই। আপনাদের কষ্ট করতে হলো অনেক। তবে বর্ষায় আইসেন। তখন দ্যাখবেন হাওরের রূপ।” বলেই তার সহকারী একান্ত সচিব কামরুল হাসান চৌধুরীকে বললেন, “কামরুল, এদের বর্ষায় হাওড়ে আনার বেবস্থা কইরো।”

যতদূর পারা যায় সবার সঙ্গে করমর্দন করে উঠলেন স্পিডবোটে। হাত নাড়তে থাকলেন ক্রমাগত। যতক্ষণ বোট দেখা যায় ততক্ষণ ঘাটে দাঁড়িয়ে রইলো ইটনার মানুষ। এরা সবাই ‘হামিদ ভাইয়ের লোক’।

No comments

Powered by Blogger.