শীত ॥ শত বছরে এমন তীব্রতা দেখেনি দেশ- ০ তাপমাত্রা দেশজুড়ে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি গত এক শ’ বছরে- ০ সাইবেরিয়া থেকে আসছে এই হিমেল হাওয়া- ০ চীন, ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে চলছে এ তীব্র শীত- ০ মারা গেছে ২৫
রেকর্ডের হিসাবে ৪৫ বছর পর এবারই প্রথম শীতে তাপমাত্রা সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, একযোগে সারাদেশের তাপমাত্রা এত নিচে নেমে যাওয়া এবং তীব্র শীত হওয়ার ঘটনা বিগত এক শ’ বছরে দেখা যায়নি।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা ভারত এবং চায়না জুড়েই চলছে শীতের দাপট। এর কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ধেয়ে আসা পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবেই সাধারণত এটি হচ্ছে। এ বায়ুই উত্তরে হাওয়া হিসেবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত হয়ে উত্তর সীমান্ত দিয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রবেশ করছে। এর প্রভাবে একযোগে সারাদেশের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি।১৯৬৮ সালে শুধু শ্রীমঙ্গলে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রী এবং ১৯৫৫ সালে দিনাজপুরে তাপমাত্রা ৩ দশমিক ৯ ডিগ্রীতে নেমে এলেও তখন দেশের অন্যকোন এলাকায় তাপমাত্রা একযোগে এত কমে যায়নি। অথচ গত দুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রীর আশপাশে অবস্থান করছে। এছাড়া দেশের অধিকাংশ এলাকার তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রীর মধ্যেই রয়েছে। অন্যান্য বছর দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে শীতের প্রকোপ ততটা না থাকলেও এবারের শীতের হাত থেকে রেহাই মিলছে না। এসব এলাকার তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে এসেছে গত দুদিনে। ঢাকা আবহাওয়া অধিদফতরের উপপরিচালক শাহ আলম জানান, এ ধরনের ঘটনা সাধারণত দীর্ঘ সময় পরপর ঘটতে দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর এ ধরনের শীতের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ সময় পর হলেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভবিষ্যতে ঘটতে পারে।
বৃহস্পতিবার সারাদেশের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস- বৃদ্ধি ঘটলেও সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বরং কোথাও কোথাও তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে আরও কয়েক ডিগ্রী নিচে নেমে গেছে। এদিকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড আরও নিচে নেমে এসেছে। সৈয়দপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রীতে নেমে এসেছে। আগেরদিন বুধবার দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৩ দশমিক ২ ডিগ্রী রেকর্ড করা হয়। যা ছিল ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বৃহস্পতিবার এ তাপমাত্রা আরও কমে আসে। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর এত শীত আগে কখনও পড়েনি। এর আগে ১৯৬৮ সালে শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
সারাদেশে তীব্র শীতের কারণে নতুন করে আরও ২৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে নীলফামারীতে ৭জন, কুড়িগ্রামে ৬ জন, গাইবান্ধায় ৪ জন, রংপুরে দু’জন, মানিকগঞ্জে দু’জন এবং কুষ্টিয়া, নারায়গঞ্জ, বরিশাল ও ভৈরবে একজন করে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে শীতজনিত রোগে। শিশু ও বৃদ্ধরা শীতের অসহায় শিকারের কবলে পড়ছে। ইরি বোরো ধানের চারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ঘন কুয়াশা ও কোল্ড ইনজুরির কারণে অধিকাংশ বীজতলা হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। এছাড়া উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রধান ফসল আলুতে ব্যাপক পচনরোগে ধরছে। ফলে এবার আলুর উৎপাদন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ছে কৃষকরা।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায় আজ শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রা সামান্য কমে যেতে পারে। শনিবার থেকে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়তে পারে। তবে শীত এখনি কমছে না। বরং তা আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের অধিকাংশ এলাকার ওপর দিয়ে ওপর দিয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত বয়েছে। ক্রমেই তা নতুন নতুন এলাকায় বিস্তৃতি লাভ করছে। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সীতাকু-, রাঙামাটি, কুমিল্লাহ, শ্রীমঙ্গল, যশোর, কুষ্টিয়া অঞ্চলসহ সমগ্র রাজশাহী রংপুর বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলেনর ওপর দিয়ে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ রয়েছে। শৈত্যপ্রবাহ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
দেশের অধিকাংশ স্থানে সামান্য হ্রাস বৃদ্ধি ছাড়া তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। বুধবার ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার তা সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ ডিগ্রীতে। এ বিভাগের ময়মনসিংহের তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে ১ ডিগ্রী নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৭ ডিগ্রীতে। এছাড়া টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও মাদারীপুরে সামান্য হ্রাস বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ১, ৬ দশমিক ৩ ও ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে।
চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ এলাকার তাপমাত্রাও সামান্য হ্রাস বৃদ্ধি এবং কোথাও কোথাও অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। তবে আগের দিনে চেয়ে হাতিয়ায় প্রায় ৪ ডিগ্রী কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১ ডিগ্রীতে, টেকনাফের তাপমাত্রা প্রায় ৩ ডিগ্রী নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রীতে। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৬ ডিগ্রী কমে গিয়ে টেকনাফে তা রেকর্ড করা হয়েছে ২২ দশমিক ৭ ডিগ্রী। চট্টগ্রামের তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে কমে দাঁড়িয়েছে ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসে, সন্দ্বীপে কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪ ডিগ্রী, সীতাকু-ে ৫ দশমিক ৭ ডিগ্রী, রাঙামাটি ৬ ডিগ্রী, কুমিল্লা ৫ দশমিক ৩ ডিগ্রী, যা আগের দিনের চেয়ে কম, চাঁদপুরে ৭ দশমিক ৪ ডিগ্রী, মাইজদীকোর্টে ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রী, ফেনীতে কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ ডিগ্রী এবং সামান্য কমে কক্সবাজারে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে।
রাজশাহী বিভাগের তাপমাত্রা গত দুদিন ধরে ৫ ডিগ্রীর ধারের কাছে নেই। তা ৪ ডিগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। রাজশাহীতে তাপমাত্রা একটু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ ডিগ্রীতে, ঈশ্বদীতে একটু বেড়ে ৪ দশমিক ৪ ডিগ্রীতে পৌঁছেছে। তবে বগুড়ার তাপমাত্রা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রীতে। রংপুর বিভাগের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রীর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এদিন দিনাজপুরের তাপমাত্রা একটু বেড়ে ৪ দশমিক ৩ ডিগ্রীতে এলেও সৈয়দপুরে দেশের সর্বনিম্ন রয়েছে ৩ ডিগ্রী এবং রংপুরে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রীতে। খুলনা বিভাগের তাপমাত্রার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। এ বিভাগের সব এলাকার তাপমাত্রা ৪ থেকে ৮ ডিগ্রীর আশপাশেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। খুলনার তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৭ দশমিক ৬ ডিগ্রী, মংলায় ৮ ডিগ্রী, সাতক্ষীরায় ৭ দশমিক ১ ডিগ্রী, যশোরে ৫ দশমিক ২ ডিগ্রী এবং চুয়াডাঙ্গায় ৪ দশমিক ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বরিশাল বিভাগের তাপমাত্রাও ৭ ডিগ্রীর মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বরিশালে ৬ দশমিক ৫ ডিগ্রী, পটুয়াখালীতে ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রী খেপুপাড়ায় ৭ দশমিক ৭ ডিগ্রী এবং ভোলায় ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, প্রচ- শীতের কারণে গত ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ৬ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। এঁরা হলেন রৌমারী উপজেলার জাদুর চর ইউনিয়নের ধনার চর মধ্যপাড়া গ্রামের হযরত আলী (৬৫), রাজারহাট উপজেলার আয়শা বেওয়া (৬৫) আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এ ছাড়া রাজারহাট সদর ইউনিয়নের শান্তি নগর গ্রামের অছিরুদ্দিন (৬৫), দেবী চরণ গ্রামের দিনমজুর নবাব আলী (৬৭), বোতলার পাড় গ্রামের দিনমজুর শাহাবুদ্দিন ম-ল (৭০), মেকুরটারি গ্রামের বাচ্চু মিয়া (৬০) ও চাকিরপশার ইউনিয়নের চকরাটারী গ্রামের ছবির উদ্দিন (৮০) শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, শীতের তীব্রতা বাড়ায় মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে। হাড় কাঁপানো শীতে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন। শহরের রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও বস্তিবাসী ছিন্নমূল নিম্ন আয়ের মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা নীলফামারী থেকে জানান, এদিকে শীতের কামড়ে নীলফামারীর তিস্তা নদী বিধৌত ডিমলা উপজেলার গ্রামে ৪ জন ও ডোমার উপজেলায় ১ জন, জলঢাকা উপজেলায় ১ সৈয়দপুর উপজেলায় ১ সহ ৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ফলে গত তিন দিনে ১৩ জনের মৃত্যু হলো। এতের মধ্যে রয়েছে শুকুর মাহমুদ (৬০), সুধেন চন্দ্র রায় (৬২), আছিয়া বেওয়া (৭৫), ইউনুছ আলী (৬৫) কাশেম (৭০) ও সুলতান আলী (৬৫), দিনমজুর কোরবান আলী (৬০)। শীতের কারণে এই ৭জন মারা যান বলে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা স্বীকার করেছেন। শীতের দাপটে মানুষ জবুথবু। উত্তরে ও পশ্চিমী হাওয়া ঢুকে পড়ায় জনজীবন থমকে দিয়েছে। উত্তরে হাওয়ার তীব্রতা এতই বেশি যে তাতে শৈত্যপ্রবাহের চেয়েও শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। মানুষ শীতে কাঁপছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানান, শীতজনিত রোগে জেলার সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাঘাটার শিমুলতাইড় গ্রামের গফুর আলী (৭৫), সুন্দরগঞ্জ পৌর এলাকার সাইবেনী (৫০), আশরাফ আলী (৭০), পূর্ব ঝিনিয়া গ্রামের গোলা মিয়ার (৫০) মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
মানিকগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, প্রচ- শীতের কারণে জেলায় দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে ১০ মাসের শিশু আসিফ ও আজিজ পার্টিকেল বোর্ডের নৈশপ্রহরী শওকত আলী (৫৫)। বরিশাল থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়ে গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের পাশে অজ্ঞাতনামা একজন পাগলীর মৃত্যু হয়েছে। ভৈরব থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জেলায় শীতের দাপদের কারণে আব্দুল হাকিম নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। দৌলতপুর কুষ্টিয়া থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার ভোরে শীতের কবলে পড়ে পাতাজান নামের ৭২ বছরের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ঠাকুরগাঁও, সুনামগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, সান্তাহার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, প্রচ- শীতের কবলে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। খরকুটা জ্বালিয়ে দিনের বেলা পার হলেও রাত অতিবাহিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। শীতজনিত রোগে হাসপাতালের ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে।
No comments