অসুখী দেশের সুখী রাজপুত্র- বীথি চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা থেকে
খুব শীত। সন্ধে নেমেছে একটু আগে। বিছানায় গুটিসুটি হয়ে খবর দেখছি। জ্যোতি বাবু সেদিন দুপুরে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেছেন। কাগজ-কলম দেয়া হয়েছে তাঁর শয্যা-পাশে। তিনি হাতে কলম ধরেছেন।
কাগজের ওপর দাগ কেটে লিখতে চেয়েছেন কিছু, পারেননি। কিছু কিছু কথা শুনলে বিদু্যত খেলে যায়। কিছু লিখে দিতে চেয়েছিলেন জ্যোতি বসু। কী লিখতে চেয়েছিলেন? এমন কোন কথা ছিল নাকি, যা তিনি অনেক দিন নিজের মনের মধ্যে রেখেছিলেন? তিনি কি কারুর উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা দিতে চেয়েছিলেন? নাকি নিজে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন হাসপাতাল থেকে? আর জানা হবে না। জ্যোতি বাবুকে কোনদিন খুব কাছ থেকে দেখিনি। তবুও তাঁকে চিনতে পেরেছিলাম। জ্যোতি বাবুর মৃতু্য ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো পৃথিবী থেকে একটি রূপকথা খসে পড়ল। বিদায় নিল এক আশ্চর্য রাজপুত্র। হঁ্যা বসুকে কোনদিন রাজপুত্র ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি। আমরা ইতিহাসবিদ নই, রাজনীতি বিশেষজ্ঞ নই, আমরা উপমহাদেশের আমজনতা। আমরা রবিনহুড আর ঠাকুমার ঝুলির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছি জ্যোতি বাবুকে।এক সুখী রাজপুত্রের একটা গল্প আছে। সবাই জানে, দুটি চড় ই পাখি আর একটি সোনা বাঁধানো রাজপুত্রের মূর্তিকে নিয়ে সেই গল্প। সবাই জানত সোনা আর পাথরে তৈরি সেই মূর্তিটি নি্#৬৩৭৪৩;্রাণ কিন্তু আসলে তা নয়। সেই মূর্তির মধ্যে একটা হৃদয় ছিল, সেই মূর্তির চোখ দিয়ে জল গড়াত মানুষের দুঃখ দেখে। দুটি চড় ই সেই মূর্তির মনের ভাব বুঝতে পেরে তার গা থেকে সোনার টুকরো খুলে নিয়ে বিলি করত গরিব মানুষের মধ্যে। তারপর একদিন মূর্তির গায়ের সোনা ফুরিয়ে গেল, তখন রাজপুত্র তার বহুমূল্য রত্নের চোখগুলো একে একে দিয়ে দিলেন। এরপর এমন হলো রাজপুত্রের কাছে আর কিছুই দেবার মতো থাকল না। অথচ সেদিনও একটি ুধাকাতর পরিবারের মানুষ কাঁদছে। শীতের রাত। সেদিন চড় ইরা চুহীন অন্ধ রাজপুত্রকে বর্ণনা করল মানুষের খেতে না পাওয়ার দুঃখ। শুনে রাজপুত্র অসহায়, বিষণ্ন। তার গভীর দুঃখ বুঝে দুই চড় ই গিয়ে ঝাঁপ দিল সেই না খাওয়া মানুষের কুটিরে জ্বলা আগুনের মধ্যে, যাতে সেই রাতে চড় ইয়ের মাংস খেয়ে কয়েকটি মানুষ বাঁচতে পারে। অর্থাৎ চড় ই দুটি রাজপুত্রের সর্বস্ব দিয়ে দেয়া এবং তারপরেও মানুষের দুঃখে কাতর হওয়া দেখে এতই প্রভাবিত হয়েছিল যে আগুনে ঝাঁপাতে তাদের ডানা কাঁপেনি।
জ্যোতি বাবুকে আমার ঠিক ওই সুখী রাজপুত্রের মতো মনে হয়, যিনি নিজে কোনদিন অর্থাভাবে না খেয়ে থাকেননি অথচ কোন ুধাতুর মুখ দেখলে তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। যিনি দারিদ্র্যের মোকাবেলা করেছেন তাঁর প েখিদের কষ্ট, ুধার্তের হাহাকার বোঝা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু জ্যোতি বাবুর ব্যবহারিক পরিস্থিতিটা ুধা, দারিদ্র্য, টাকার জন্য জীবনসংগ্রাম_ এসবের থেকে আলোকবর্ষ দূরে ছিল। তিনি অভিজাত, বড়লোক, উচ্চশিতি বাড়ির সন্তান। পড়াশোনাতে নিজেও খুব ভাল। প্রেসিডেন্সি কলেজের অলিন্দ চমকে ওঠে তাঁর বুদ্ধি দেখে। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে তিনি অনায়াসেই হয়ে যেতে পারতেন অভিজাত সমাজের একজন মান্যগণ্য সাহেব। কিন্তু তিনি তা হলেন না। তিনি দেখতে পেলেন সমাজের নিচের দিকের মানুষের ভাঙ্গাচোরা মুখগুলো। এইসব কথা খুব কিশে বা সহজ মনে হতে পারে। 'কিন্তু এটা কে না জানে/ সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়'। জ্যোতি বাবু যেভাবে নিজের পারিবারিক বিত্ত এবং শিাগত কৌলিন্যকে তুচ্ছ করলেন সেটা শুনতে সোজা হলেও কাজটা মোটেই সোজা নয়। সকলে পারে না নিশ্চিত জীবন ছেড়ে পুলিশের লাঠি, হাজতবাস, একটা ঝুঁকিপূর্ণ অনিশ্চয় পথ। এটা পারতে হলে লোভহীন হতে হয়। যাদের কিছু নেই তাদের প্রতি ভালবাসা থাকতে হয়। এমনও নয় যে বসু কোন সর্বহারার গ্লামারের মোহে রাজনীতি করেছেন। কোন মলিন ফতুয়া বা ভাঙ্গাচোরা ঘর তার ছিল না। সারাজীবন ইমেজ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাই ঘামাননি। কোন জননেতার প েনিজের ভাবমূর্তির বিষয়ে এতখানি উদাসীনতা খুবই দুর্লভ। তিনি কোথাও কোন নাম কিনতে চাননি, কোন স্বীকৃতির পিছনে ছোটেননি। ঠিক ওই মূর্তি রাজপুত্রের মতো। তাঁর গায়ে কেউ কাদা ছেটালে তিনি গ্রাহ্য করেননি। কোন ব্যক্তির বা সমষ্টির জন্য যখন তাঁর রাজনৈতিক জীবন তিগ্রস্ত হয়েছে, তখনও তিনি তাদের প্রতি কঠোর হতে পারেননি। কারণ নির্দয়ভাব তাঁর ধাতে ছিল না। ভালবাসার হিরের গয়না শরীরে নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন।
১৯৭৭। পশ্চিম বঙ্গ ঠিক এখনকার মতোই রক্তাক্ত, বিপর্যস্ত। সঙ্গে রয়েছে চরম অশিা, অনাহার, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সমাজের সর্বস্তরে বৈষম্য। পাড়া থেকে কলেজ, বাড়ি থেকে অফিস সর্বত্র একটাই নিয়ম চলছে মস্তানি। সাধারণ মানুষ ছিল তা যেন অনেকটা মাতৃস্নেহের মতো। যে স্নেহ নিজের কাজের সুফল চায়, স্বীকৃতির তোয়াক্কা করে না যেমন তাঁর আমলে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোয় প্রথম শ্রেণী থেকে ইংরেজী না পড়ানোর সরকারী নির্দেশের ভুল ব্যাখ্যা তিনি আজীবন নীরবে শুনেছেন। সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকায় সরকার বলেছিল যে কোন সরকারী অথবা সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয় ইচ্ছে করলে প্রথম শ্রেণীর পরিবর্তে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ইংরেজী পড়াতে পারবে অর্থাৎ প্রথম শ্রেণী থেকে ইংরেজী পড়া বাধ্যতামূলক রাখা হয়নি কিন্তু জোর করে ইংরেজী তুলেও দেয়া হয়নি। ফলত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত অধু্যষিত বাংলা স্কুলগুলো নিজেদের মান বজায় রাখতে প্রথম শ্রেণী বা প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকেই ইংরেজী বহাল রেখেছে। কিন্তু পরিকাঠামোহীন না খেতে পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলগুলোতে কাস সিক্স পর্যন্ত ইংরেজী ছিল না। একটু সহৃদয়ভাবে ভাবলেই বোঝা যায় যে, এটা মানুষের প্রতি কতটা আন্তরিক সিদ্ধান্ত। এটা ঠিক যে, শিার একেবারে শুরু থেকে শিশুদের অন্তত দুটি ভাষা শেখানোই উপযুক্ত ব্যবস্থা, কিন্তু কোন সুস্থ অর্থনীতি ছাড়া এই ব্যবস্থার প্রয়োগ সম্ভব নয়। যে বাচ্চার বাবা-মা টিপসই দেয়, যাদের গায়ে কাপড় নেই, অসুখে ওষুধ নেই, তাদের প েএকটি বিদেশী ভাষা_ যে ভাষা তাদের জীবনের কোথাও নেই, সেটা শেখা সম্ভব নয়। সেই ভাঙ্গাচোরা অর্থনীতির শিশুদের জ্যোতি বাবুর সরকার ইংরেজী না পড়ার ছাড় দিয়েছিলেন। কারণ মানুষের যত দারিদ্র্য ততই ইংরেজীর সঙ্গে দূরত্ব। এখনও নিম্নবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে ইংরেজী সবচেয়ে ভীতিপ্রদ বিষয়। ব্রিটিশ আমল থেকে কংগ্রেস, সিপিএম সব রাজত্বে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল্য পরীায় ইংরেজীতেই অকৃতকার্যের হার সবচেয়ে বেশি। গরিব মানুষের প্রাথমিক জ্ঞানই হতো না, পঁচিশ বছর আগে তাঁদের ওপরে ইংরেজী চাপালে, ইংরেজী অপরিহার্য কিন্তু তার থেকেও প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিা যাতে অন্তত সাধারণ মানুষ নিজের কোন অভিযোগপত্রের বয়ানটুকু নিজে পড়তে পারে। যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে জাত-পাত কুসংস্কার আসলে মানুষের তি করে, এটুকুর বেশি শিা পাওয়ার সাধ্য হতদরিদ্র মানুষের থাকে না এবং নূ্যনতম শিা মিটিয়ে দিতে পারে অনেক সমস্যা, এটা বসু বুঝেছিলেন। ইংরেজী তুলে দিয়ে শিার তি করেছেন এমন পল্লবগ্রাহী নিন্দা তিনি সহ্য করেছেন শুধু কিছু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে।
এমনটাই হলেন জ্যোতি বাবু্, নিজের সুনামকে তিনি ছেঁড়া রুমালের মতো ফেলে দিতে পারতেন। অহিংসা এবং ভালবাসা তাঁকে রূপকথার নায়ক রাজপুত্র করে দিয়েছে। অসুখী দেশ আমাদের, তাই একটা রাজপুত্র বড় দরকার এখানে।
হাসপাতালে শুয়ে কী লিখতে চেয়েছিলেন তিনি? জ্যোতি বাবু যিনি বিধানসভায় জয়লাভ করেই নিজের দলের অনুগামীদের বলেছিলেন_ হিংসা নয়। তিনি কি এটাই লিখতে চেয়েছিলেন যে, দলে দলে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা হোক, কিন্তু হিংসা বন্ধ হোক। হয়ত তিনি লিখতে পারেননি। এতে যে আমাদের খুব বড় তি হয়ে গেল। এই রক্তয়ী সময়ে তাঁর আদেশের বড় দরকার ছিল। তিনি কাজ বাকি রেখে চলে গেলেন। হয়ত তাঁর মনে সংশয়ও ছিল, তাঁর আদেশ আর কেউ নাও মানতে পারে।
দেশের এবং তাঁর অহিংস আদর্শের টলোমলো অবস্থার মধ্যে খুব ভিষণ্নভাবে চলে গেলেন বসু। আমাদের হৃৎপিন্ড উজাড় করে আমরা তাঁকে সেলাম করছি।
No comments