বিদেশি পরামর্শে রেলডুবি by পার্থ সারথি দাস
ব্রিটিশরাজের সময় কুলাউড়া রেলস্টেশন থেকে শাহবাজপুর হয়ে আসাম পর্যন্ত রেললাইন বসে। মৌলভীবাজারের জুড়ি, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলী, বড়লেখা, মুড়াউল, শাহবাজপুরসহ বিভিন্ন স্টেশন পাড়ি দিত ট্রেন। কয়লার ইঞ্জিনের কু-উ-উ হুইসেল আর ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দে মাতোয়ারা হতো চারদিক।
তখনকার দিনে ট্রেন দেখে মানুষ সময়ের হিসাব রাখত, যেন ট্রেন ঘড়ি। লোকে ট্রেনটিকে ডাকত 'লাতুর ট্রেন' নামে। এই লাতুর ট্রেন এখন শুধুই স্মৃতি। বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পরামর্শে 'লোকসান' দেখিয়ে ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বছর দশেক আগে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র নিশ্চিত করেছে, একই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এ রকম আরো বহু শাখা পথ। তার পরও কিন্তু রেল লাভের মুখ দেখেনি। ঋণ পাওয়ার শর্তে দাতাদের পরামর্শ মানতে গিয়ে রেলের দুর্দশাই ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
মূলত বাণিজ্যের তাগিদেই বেসরকারি কম্পানিকে দিয়ে বাংলাদেশে রেলপথ তৈরি ও পরিচালনা শুরু করেছিল ব্রিটিশ সরকার। পরে পাকিস্তান সরকার এগুলো অধিগ্রহণ করে। আর বাংলাদেশ আমলে একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয় এসব জনপ্রিয় শাখা পথ, যেগুলো প্রায় শতাব্দীজুড়ে গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতির সঙ্গে শহর ও বন্দরের যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম ছিল।
এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসকাপ) সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট পরিবহন গবেষক ড. এম রহমতউল্ল্যাহর মতে, সরকারের অবাস্তব নীতির কারণেই আজও রেল লোকসান টানছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি, ইঞ্জিন ও কোচ কেনার জন্য রেলে দশকের পর দশক তেমন কোনো বিনিয়োগ ছিল না। টানা লোকসানের পরও ২০ বছর ধরে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন রেল কর্মকর্তাদেরই। কিন্তু আমাদের দেশে রেলওয়ের প্রশাসনিক কাঠামোয় সব সিদ্ধান্ত নেন আমলারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর শুধু একবার রেল লাভের মুখ দেখেছিল। বাকি ৪০ বছরই ধুঁকেছে। অবশেষে লোকসানের রাস টানতে নতুন মন্ত্রণালয় হওয়ার পর রেলের ভাড়া গত ১ অক্টোবর থেকে বাড়ানো হয়েছে।
গত অর্থবছরে (২০১১-১২) রেলে লোকসান ছিল এক হাজার ৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে সব মিলিয়ে ছয় কোটি ৬১ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হয়। রেলপথ কমানোর পরও শুধু এক দশকেই এ খাতে লোকসান হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নতুন রেলপথ চালু হলে রাজস্ব বাড়ত সরকারের। আর যে বিদেশি ঋণের আশায় সংকোচনের আত্মঘাতী কর্মসূচি নিয়েছিল বিগত সরকারগুলো, গত তিন দশকেও সেই ঋণ মেলেনি। ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনায় ৯১৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ চালুর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এর আওতায় বর্তমান সরকার চার বছরে পরিত্যক্ত কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটিসহ আরো কয়েকটি লাইন চালুর প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ভারতীয় ঋণের আওতায় রেলের জন্য যে ১২টি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার, তার একটি হচ্ছে এ শাখা পথ। গত জুনে সরকার ১১৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন করে। তবে অর্থ ছাড় না হওয়ায় এখনো এর কাজ শুরু হয়নি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সরকার খুলনা থেকে মংলা, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম, ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর, কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া রেলপথ নির্মাণ, পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা এবং কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া রেলপথ আবার চালুর জন্য ছয়টি প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর আওতায় ৩২১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১৭৩ কিলোমিটার পথ সংস্কার করার কথা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্পমাত্রায় পরিবেশদূষণ, কম জ্বালানি খরচ, ভূমির পরিমিত ব্যবহার এবং বেশি যাত্রী ও মালামাল পরিবহন সুবিধার কারণে পৃথিবীর সব দেশেই রেলপথ, যাত্রী ও ট্রেন বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র। এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল রেলওয়েরই নিবেদিতপ্রাণ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, আশির দশকে বিশ্বব্যাংক স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসির (স্যাপ) ফাঁদে পড়ে দেশ। এ কারণেই রেলের এই হাল। স্যাপের আওতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রেলওয়ের কয়েকটি প্রকল্পের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে ১৯৯২ সালে। এই পরামর্শ ও এডিবির চুক্তির কারণে ১৯৯২ সালে জনবল কমানো হয় রেলের। রেলওয়ের সংস্থাপন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুরুর দিকে ৫৮ হাজার পদ ছিল। ১৯৭৩ সালে তা কমে হয় ৫২ হাজার। ১৯৯২ সালে তা দাঁড়ায় ৪০ হাজার ২৬৪টিতে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫১৪টিই এখন শূন্য। ২০১০ সালের নভেম্বরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেও দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিভিন্ন মামলার কারণে শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে।
ইঞ্জিন ও কোচ নেই : রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি রেল ইঞ্জিনের আয়ু (লাইফ টাইম) ২০ বছর। অথচ বাংলাদেশে ২০ বছর বা এর চেয়ে কম বয়সী ইঞ্জিন মাত্র ২৮ শতাংশ। বাকিগুলোর তিন ভাগের এক ভাগের বয়স ৪০ পেরিয়ে গেছে। একই অবস্থা বগি বা কোচের ক্ষেত্রেও। পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানোর কারণে প্রতিদিনই পথে থমকে যাচ্ছে ট্রেন। সময়সূচি ভেঙে পড়ছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রতিদিন রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে আন্তনগর, মেইল ও লোকাল এই তিন ধরনের যাত্রীবাহী ২৭৪টি ট্রেন চলাচল করে। রেলওয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে রেলের ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, এখন আছে ২৫৮টি। ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে যাত্রীবাহী কোচ ছিল এক হাজার ৬৪৩টি, এখন আছে এক হাজার ২৭১টি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের পর রেলওয়ের ওপর খৰ নেমে আসে ঋণের প্রতিশ্রুতিদাতাদের পরামর্শে। অলাভজনক আখ্যা দিয়ে রেলওয়ের অনেক শাখা লাইন বন্ধ করার আয়োজন শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে পূর্বাঞ্চলের ফেনী-বিলোনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শাল্লা, হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ; পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-মোগলহাট, রূপসা-বাগেরহাট, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া, ভেড়ামারা-রায়টা ও পাঁচুরিয়া-পুকুরিয়া পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশির দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয় নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুটও।
রেলে বিনিয়োগ বৈষম্যের শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত সড়ক, রেলওয়ে, জল ও আকাশপথে সরকারের মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ৫২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সড়ক খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮ শতাংশ, রেলওয়েতে ২৪ শতাংশ, বাকিটা নৌ ও বিমানের জন্য। ২০০২-০৫ সাল পর্যন্ত রেলওয়েতে ১২ শতাংশের বিপরীতে সড়কে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮৬ শতাংশ।
রেলওয়ের উন্নয়নের কথা বলে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছে। এসব পরামর্শে প্রশাসনিক জটিলতা ও অপচয় বাড়া ছাড়া রেলওয়ের কোনো উপকার হয়নি। প্রতিশ্রুত ঋণও আসেনি। এডিবির পরামর্শে এ পর্যন্ত তিনবার রেলওয়ের সংস্কার হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ঋণ দেওয়ার আগেই সংস্কারের শর্ত জুড়ে দেয় এডিবি। এ পর্যন্ত তাদের পরামর্শে তিনবার রেলে সংস্কারকাজ করা হয়েছে। বর্তমানে আরেক দফা সংস্কারের নামে রেলওয়েকে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া চলছে। রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের জন্য সারা দেশে ছয়টি কারখানা রয়েছে। সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এখন পর্যন্ত কেউ বিনিয়োগ করেনি।
এডিবির পরামর্শে রেলওয়েকে প্রথমে করা হয় রেলওয়ে বোর্ড, পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষের সব ধরনের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়। এর থেকেই শুরু হয় অব্যবস্থাপনা। কাগজে-কলমে রেলওয়ের মহাপরিচালক থাকলেও তাঁর কাছে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না।
এডিবির পরামর্শে এরশাদ সরকারের আমলে রেলকে দুই ভাগ (পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল) করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের কারণে জটিলতা বেড়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে সমস্যাও দেখা দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে রেলওয়ের অন্তত ৮৪টি ট্রেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া হয় এডিবির পরামর্শে। উদ্দেশ্য ছিল লোকসান কমানো এবং যাত্রীসেবার মান বাড়ানো। এর পরও লোকসান বেড়েছে। যাত্রীসেবাও তলানিতে।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রেলকে আমরা আধুনিক করে গড়ে তুলতে চাইছি। ২০১৩ সালের মধ্যে ২০ সেট কমিউটার ট্রেন, ১১টি ইঞ্জিন, ৮১টি তেলবাহী ট্যাংকার, ২২০টি কনটেইনারবাহী ফ্ল্যাট ওয়াগন যোগ হবে বলে আশা করছি। নতুন রেলপথ নির্মাণে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। সরকারের নেওয়া কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে রেলের চেহারাই পাল্টে যাবে।'
সংকট জিইয়ে রেখেই চলছে আধুনিকায়ন
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র নিশ্চিত করেছে, একই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এ রকম আরো বহু শাখা পথ। তার পরও কিন্তু রেল লাভের মুখ দেখেনি। ঋণ পাওয়ার শর্তে দাতাদের পরামর্শ মানতে গিয়ে রেলের দুর্দশাই ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
মূলত বাণিজ্যের তাগিদেই বেসরকারি কম্পানিকে দিয়ে বাংলাদেশে রেলপথ তৈরি ও পরিচালনা শুরু করেছিল ব্রিটিশ সরকার। পরে পাকিস্তান সরকার এগুলো অধিগ্রহণ করে। আর বাংলাদেশ আমলে একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয় এসব জনপ্রিয় শাখা পথ, যেগুলো প্রায় শতাব্দীজুড়ে গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতির সঙ্গে শহর ও বন্দরের যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম ছিল।
এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসকাপ) সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট পরিবহন গবেষক ড. এম রহমতউল্ল্যাহর মতে, সরকারের অবাস্তব নীতির কারণেই আজও রেল লোকসান টানছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি, ইঞ্জিন ও কোচ কেনার জন্য রেলে দশকের পর দশক তেমন কোনো বিনিয়োগ ছিল না। টানা লোকসানের পরও ২০ বছর ধরে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন রেল কর্মকর্তাদেরই। কিন্তু আমাদের দেশে রেলওয়ের প্রশাসনিক কাঠামোয় সব সিদ্ধান্ত নেন আমলারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর শুধু একবার রেল লাভের মুখ দেখেছিল। বাকি ৪০ বছরই ধুঁকেছে। অবশেষে লোকসানের রাস টানতে নতুন মন্ত্রণালয় হওয়ার পর রেলের ভাড়া গত ১ অক্টোবর থেকে বাড়ানো হয়েছে।
গত অর্থবছরে (২০১১-১২) রেলে লোকসান ছিল এক হাজার ৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে সব মিলিয়ে ছয় কোটি ৬১ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হয়। রেলপথ কমানোর পরও শুধু এক দশকেই এ খাতে লোকসান হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নতুন রেলপথ চালু হলে রাজস্ব বাড়ত সরকারের। আর যে বিদেশি ঋণের আশায় সংকোচনের আত্মঘাতী কর্মসূচি নিয়েছিল বিগত সরকারগুলো, গত তিন দশকেও সেই ঋণ মেলেনি। ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনায় ৯১৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ চালুর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এর আওতায় বর্তমান সরকার চার বছরে পরিত্যক্ত কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটিসহ আরো কয়েকটি লাইন চালুর প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ভারতীয় ঋণের আওতায় রেলের জন্য যে ১২টি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার, তার একটি হচ্ছে এ শাখা পথ। গত জুনে সরকার ১১৭ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন করে। তবে অর্থ ছাড় না হওয়ায় এখনো এর কাজ শুরু হয়নি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সরকার খুলনা থেকে মংলা, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম, ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর, কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া রেলপথ নির্মাণ, পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা এবং কালুখালি-ভাটিয়াপাড়া রেলপথ আবার চালুর জন্য ছয়টি প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর আওতায় ৩২১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১৭৩ কিলোমিটার পথ সংস্কার করার কথা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্পমাত্রায় পরিবেশদূষণ, কম জ্বালানি খরচ, ভূমির পরিমিত ব্যবহার এবং বেশি যাত্রী ও মালামাল পরিবহন সুবিধার কারণে পৃথিবীর সব দেশেই রেলপথ, যাত্রী ও ট্রেন বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র। এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল রেলওয়েরই নিবেদিতপ্রাণ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, আশির দশকে বিশ্বব্যাংক স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসির (স্যাপ) ফাঁদে পড়ে দেশ। এ কারণেই রেলের এই হাল। স্যাপের আওতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রেলওয়ের কয়েকটি প্রকল্পের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে ১৯৯২ সালে। এই পরামর্শ ও এডিবির চুক্তির কারণে ১৯৯২ সালে জনবল কমানো হয় রেলের। রেলওয়ের সংস্থাপন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুরুর দিকে ৫৮ হাজার পদ ছিল। ১৯৭৩ সালে তা কমে হয় ৫২ হাজার। ১৯৯২ সালে তা দাঁড়ায় ৪০ হাজার ২৬৪টিতে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫১৪টিই এখন শূন্য। ২০১০ সালের নভেম্বরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেও দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিভিন্ন মামলার কারণে শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে।
ইঞ্জিন ও কোচ নেই : রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি রেল ইঞ্জিনের আয়ু (লাইফ টাইম) ২০ বছর। অথচ বাংলাদেশে ২০ বছর বা এর চেয়ে কম বয়সী ইঞ্জিন মাত্র ২৮ শতাংশ। বাকিগুলোর তিন ভাগের এক ভাগের বয়স ৪০ পেরিয়ে গেছে। একই অবস্থা বগি বা কোচের ক্ষেত্রেও। পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানোর কারণে প্রতিদিনই পথে থমকে যাচ্ছে ট্রেন। সময়সূচি ভেঙে পড়ছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রতিদিন রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে আন্তনগর, মেইল ও লোকাল এই তিন ধরনের যাত্রীবাহী ২৭৪টি ট্রেন চলাচল করে। রেলওয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে রেলের ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, এখন আছে ২৫৮টি। ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে যাত্রীবাহী কোচ ছিল এক হাজার ৬৪৩টি, এখন আছে এক হাজার ২৭১টি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের পর রেলওয়ের ওপর খৰ নেমে আসে ঋণের প্রতিশ্রুতিদাতাদের পরামর্শে। অলাভজনক আখ্যা দিয়ে রেলওয়ের অনেক শাখা লাইন বন্ধ করার আয়োজন শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে পূর্বাঞ্চলের ফেনী-বিলোনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শাল্লা, হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ; পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-মোগলহাট, রূপসা-বাগেরহাট, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া, ভেড়ামারা-রায়টা ও পাঁচুরিয়া-পুকুরিয়া পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশির দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয় নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুটও।
রেলে বিনিয়োগ বৈষম্যের শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত সড়ক, রেলওয়ে, জল ও আকাশপথে সরকারের মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ৫২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সড়ক খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮ শতাংশ, রেলওয়েতে ২৪ শতাংশ, বাকিটা নৌ ও বিমানের জন্য। ২০০২-০৫ সাল পর্যন্ত রেলওয়েতে ১২ শতাংশের বিপরীতে সড়কে সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮৬ শতাংশ।
রেলওয়ের উন্নয়নের কথা বলে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়ে আসছে। এসব পরামর্শে প্রশাসনিক জটিলতা ও অপচয় বাড়া ছাড়া রেলওয়ের কোনো উপকার হয়নি। প্রতিশ্রুত ঋণও আসেনি। এডিবির পরামর্শে এ পর্যন্ত তিনবার রেলওয়ের সংস্কার হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ঋণ দেওয়ার আগেই সংস্কারের শর্ত জুড়ে দেয় এডিবি। এ পর্যন্ত তাদের পরামর্শে তিনবার রেলে সংস্কারকাজ করা হয়েছে। বর্তমানে আরেক দফা সংস্কারের নামে রেলওয়েকে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া চলছে। রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের জন্য সারা দেশে ছয়টি কারখানা রয়েছে। সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এখন পর্যন্ত কেউ বিনিয়োগ করেনি।
এডিবির পরামর্শে রেলওয়েকে প্রথমে করা হয় রেলওয়ে বোর্ড, পরে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে কর্মকর্তাদের নিয়োগ-বদলি পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষের সব ধরনের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়। এর থেকেই শুরু হয় অব্যবস্থাপনা। কাগজে-কলমে রেলওয়ের মহাপরিচালক থাকলেও তাঁর কাছে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না।
এডিবির পরামর্শে এরশাদ সরকারের আমলে রেলকে দুই ভাগ (পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল) করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের কারণে জটিলতা বেড়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে সমস্যাও দেখা দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে রেলওয়ের অন্তত ৮৪টি ট্রেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া হয় এডিবির পরামর্শে। উদ্দেশ্য ছিল লোকসান কমানো এবং যাত্রীসেবার মান বাড়ানো। এর পরও লোকসান বেড়েছে। যাত্রীসেবাও তলানিতে।
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রেলকে আমরা আধুনিক করে গড়ে তুলতে চাইছি। ২০১৩ সালের মধ্যে ২০ সেট কমিউটার ট্রেন, ১১টি ইঞ্জিন, ৮১টি তেলবাহী ট্যাংকার, ২২০টি কনটেইনারবাহী ফ্ল্যাট ওয়াগন যোগ হবে বলে আশা করছি। নতুন রেলপথ নির্মাণে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। সরকারের নেওয়া কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে রেলের চেহারাই পাল্টে যাবে।'
সংকট জিইয়ে রেখেই চলছে আধুনিকায়ন
No comments