মানবতাবিরোধী অপরাধ-বিচার বিলম্বিত করার নানা তৎপরতা by এম বদি-উজ-জামান
একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ ১৪ জনের বিচার চলছে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
কিন্তু এ বিচার বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষ থেকে নানা অপকৌশল নেওয়া হচ্ছে। বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশি ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান পদ থেকে নিজামুল হক পদত্যাগ করার পর বিচার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার দাবি তোলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আইনের ৬(৬) ধারা অনুযায়ী, পুনরায় বিচার করার সুযোগ না থাকলেও জামায়াতের তিন নেতার পক্ষে পৃথক তিনটি আবেদন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আবার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষ থেকে প্রসিকিউটর প্রত্যাহারেরও আবেদন করা হয়েছে।
বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কথোপকথনের জের ধরে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারকাজ থমকে গেছে। বিলম্বিত হচ্ছে বিচারকাজ। এর জন্য আইনজীবী, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ আসামিপক্ষকেই দুষছে। তারা বলছে, এ বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়ে শুরু থেকেই আসামিপক্ষে নানা ধরনের অপকৌশল নেওয়া হচ্ছে। আরো অভিযোগ উঠেছে, বিচার বিলম্বিত নয়, বিচার ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা চলছে। একটি আবেদন খারিজ হওয়ার পর একই বিষয় নিয়ে বারবার আবেদন করা হয়েছে- এমন নজিরও রয়েছে। বিচার পুনরায় শুরু করার আবেদনও এ ধরনের নজির। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের আবেদনের ওপর দিনের পর দিন শুনানি হয়েছে। মূল মামলা বাদ দিয়ে এসব আবেদনের শুনানি হওয়ায় বিচার বিলম্বিত হয়েছে। আসামিপক্ষ এ কৌশল নিয়েছে জেনেশুনে। যদিও ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, মিজানুল ইসলামসহ আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তাঁরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আবেদন করা হয়ে থাকে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। গত ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এ দুটি ট্রাইব্যুনালে ১২ রাজনৈতিক নেতাসহ ১৪ জনের বিচার চলছে। কিন্তু আজও একজনের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষিত হয়নি। জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয় গত ৬ ডিসেম্বর। ট্রাইব্যুনাল-১-এ নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও সাঈদীর মামলার বিচার পুনরায় শুরু করার আবেদনে শুনানি শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ আদেশ দিয়েছেন- এ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকাজ মুলতবি থাকবে। আসামিপক্ষে শুনানিতে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক স্কাইপ কথোপকথনের বিভিন্ন অংশ তুলে ধরে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক অনৈতিক কাজ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করেছেন। বাইরে থেকে আদেশ লিখে এনে ট্রাইব্যুনালে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তাঁর সময়ে যে বিচার কার্যক্রম চলেছে, তা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ছিল না।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর পরই এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ, ট্রাইব্যুনাল আইন ও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জামায়াতের নেতাদের পক্ষে পৃথক তিনটি রিট আবেদন করা হয়। আবেদনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া আইনগতভাবে সঠিক নয় উল্লেখ করে তা বাতিল চাওয়া হয়। আবেদনে বলা হয়, কোনো অভিযোগ গঠন না করেই বেআইনিভাবে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই বছরই এসব আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট।
এর পরও বিচারপতি নিজামুল হকের প্রত্যাহার চেয়ে ট্রাইব্যুনালেই একাধিক আবেদন করে আসামিপক্ষ। তাদের আবেদনের মূল কথা, বিচারপতি নিজামুল হক আইনজীবী থাকাকালে গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের সদস্য ছিলেন। গণ-আদালতের বিচারের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে তিনি নিরপেক্ষ নন। তিনি একটি পক্ষ। বিচারপতি নিজামুল হকের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারক আদেশ দিলেও আসামিপক্ষে নতুন করে আবেদন করা হয়। বিচারপতি নিজামুল হককে শেষ পর্যন্ত আদেশ দিতে হয়। এসব আবেদনের ওপর কয়েক দিন শুনানি হয়। যদিও উভয় আদেশেই আবেদন খারিজ করা হয়।
বিচার বিলম্বিত করার আরো একটি নজির হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের শুরুর দিকে নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার আটকাদেশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর বিভিন্ন উপায়ে একাধিক আবেদন করা। এর পাশাপাশি তাঁদের জামিনের জন্য পৃথক আবেদন করা হয়। মাওলানা সাঈদীর জামিনের জন্য বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি আবেদন করা হয়। এক সাঈদীর পক্ষেই বিভিন্ন সময়ে শতাধিক আবেদন করা হয়। সাঈদীর মামলায় ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য না দিলেও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৫ ব্যক্তির বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আসামিপক্ষ বারবার আবেদন করে। তাদের থেকে অভিযোগ তোলা হয়, এসব সাক্ষীকে ঢাকায় এনে একটি স্থানে (সেফ হাউস) রেখে মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যেসব সাক্ষী সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়নি রাষ্ট্রপক্ষ তাদের হাজির করেনি।
কার্যত গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধুরী, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে এসব আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার বিভিন্ন রেকর্ডপত্র চেয়ে করা আবেদন খারিজ হওয়ার পরও প্রত্যেক আসামির পক্ষে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক আবেদন করা হয়েছে। আবেদন খারিজ হওয়ার পর তা পুনর্বিবেচনার জন্য আবার আবেদন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিচারকাজ সরাসরি সম্প্রচার করা, বিচারে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ চেয়ে আবেদন করা হয়। এসব আবেদনের ওপর শুনানি করতে দীর্ঘ সময় পার হয়েছে ট্রাইব্যুনালের। পাশাপাশি নিজেদের পক্ষে আদেশ না পাওয়ায় বিচার কার্যক্রম বর্জনও করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পৃথিবীর কোনো দেশেই পুনরায় বিচার করার বিধান নেই। আমাদের দেশেও নেই। আইন অনুযায়ী, যেখান থেকে শেষ, সেখান থেকে শুরু। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক পদত্যাগ করলেও বিচার যে পর্যায়ে ছিল সেখান থেকে চলবে। আদালত বিচার করবেন রেকর্ডপত্র দেখে। তাই একজন না থাকলে নতুন করে শুরু করতে হবে- এ আবেদন আইনত অযৌক্তিক।' তিনি বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এটা জেনেও শুধু বিচার বিলম্বিত করার জন্যই পুনরায় বিচারকাজ শুরু করার আবেদন করেছেন। এটা যে বিচার বিলম্বিত করার জন্যই, এর প্রমাণ হচ্ছে একই বিষয় নিয়ে পৃথক চারটি আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু কোনো দেশেই সাক্ষীকে আসামিপক্ষে জেরা করা ও সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে অভিযুক্তদের সে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচারকে গ্রহণযোগ্য ও মডেল হিসেবে দেখানোর জন্যই আসামিপক্ষকে বাড়তি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা এ সুযোগে শুরু থেকেই বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, বিচার পুনরায় শুরু করার আইনগত ভিত্তি না থাকার পরও আসামিপক্ষ যেসব আবেদন করেছে তা মূলত বিচার বিলম্বিত করার জন্যই।
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব সাংবাদিক হারুন হাবীব কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে যে বিচার চলছে তা সাধারণ কোনো বিচার নয়, এটা ইতিহাসের দায়বদ্ধতার বিচার। কিন্তু এ বিচারকে ভণ্ডুল করার জন্য শুরু থেকেই আসামিপক্ষ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা দেশে ও দেশের বাইরে অব্যাহতভাবে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। স্কাইপ সংলাপের জের ধরে বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এরপর বিচার পুনরায় শুরু করার জন্য একাধিক আবেদন প্রমাণ করে, বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য দেশে-বিদেশে নানা ধরনের অপচেষ্টা হচ্ছে। টাকা খরচ করা হচ্ছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিচারকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আসামিপক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে একেক ধরনের আবেদন দেওয়ার নজির দেশবাসী দেখেছে। আইনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য এটা একটা ঘৃণ্য অপচেষ্টা।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, শুরু থেকেই আসামিপক্ষ একটি ছক করে সামনে এগোচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরুতে তদন্ত সংস্থার প্রধান হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তিনি ছিলেন জামায়াতের লোক, যদিও তাঁকে সরানো হয়েছে। তিনি বলেন, মূলত প্রসিকিউশনের দুর্বলতার সুযোগে এসব করা হচ্ছে। সময়ক্ষেপণ করার জন্য সাক্ষীদের দিনের পর দিন জেরা করা হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই।
প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, বিচার বিলম্বিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষ থেকেই ১২৫টির বেশি আবেদন করা হয়েছে। সর্বশেষ স্কাইপ সংলাপ নিয়ে একাধিক আবেদন করা হলো।
বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কথোপকথনের জের ধরে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারকাজ থমকে গেছে। বিলম্বিত হচ্ছে বিচারকাজ। এর জন্য আইনজীবী, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ আসামিপক্ষকেই দুষছে। তারা বলছে, এ বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়ে শুরু থেকেই আসামিপক্ষে নানা ধরনের অপকৌশল নেওয়া হচ্ছে। আরো অভিযোগ উঠেছে, বিচার বিলম্বিত নয়, বিচার ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা চলছে। একটি আবেদন খারিজ হওয়ার পর একই বিষয় নিয়ে বারবার আবেদন করা হয়েছে- এমন নজিরও রয়েছে। বিচার পুনরায় শুরু করার আবেদনও এ ধরনের নজির। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের আবেদনের ওপর দিনের পর দিন শুনানি হয়েছে। মূল মামলা বাদ দিয়ে এসব আবেদনের শুনানি হওয়ায় বিচার বিলম্বিত হয়েছে। আসামিপক্ষ এ কৌশল নিয়েছে জেনেশুনে। যদিও ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, মিজানুল ইসলামসহ আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। তাঁরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আবেদন করা হয়ে থাকে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। গত ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এ দুটি ট্রাইব্যুনালে ১২ রাজনৈতিক নেতাসহ ১৪ জনের বিচার চলছে। কিন্তু আজও একজনের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষিত হয়নি। জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয় গত ৬ ডিসেম্বর। ট্রাইব্যুনাল-১-এ নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও সাঈদীর মামলার বিচার পুনরায় শুরু করার আবেদনে শুনানি শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ আদেশ দিয়েছেন- এ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকাজ মুলতবি থাকবে। আসামিপক্ষে শুনানিতে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক স্কাইপ কথোপকথনের বিভিন্ন অংশ তুলে ধরে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক অনৈতিক কাজ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করেছেন। বাইরে থেকে আদেশ লিখে এনে ট্রাইব্যুনালে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তাঁর সময়ে যে বিচার কার্যক্রম চলেছে, তা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ছিল না।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর পরই এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ, ট্রাইব্যুনাল আইন ও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জামায়াতের নেতাদের পক্ষে পৃথক তিনটি রিট আবেদন করা হয়। আবেদনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া আইনগতভাবে সঠিক নয় উল্লেখ করে তা বাতিল চাওয়া হয়। আবেদনে বলা হয়, কোনো অভিযোগ গঠন না করেই বেআইনিভাবে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই বছরই এসব আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট।
এর পরও বিচারপতি নিজামুল হকের প্রত্যাহার চেয়ে ট্রাইব্যুনালেই একাধিক আবেদন করে আসামিপক্ষ। তাদের আবেদনের মূল কথা, বিচারপতি নিজামুল হক আইনজীবী থাকাকালে গণতদন্ত কমিশনের সচিবালয়ের সদস্য ছিলেন। গণ-আদালতের বিচারের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাই ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে তিনি নিরপেক্ষ নন। তিনি একটি পক্ষ। বিচারপতি নিজামুল হকের অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই বিচারক আদেশ দিলেও আসামিপক্ষে নতুন করে আবেদন করা হয়। বিচারপতি নিজামুল হককে শেষ পর্যন্ত আদেশ দিতে হয়। এসব আবেদনের ওপর কয়েক দিন শুনানি হয়। যদিও উভয় আদেশেই আবেদন খারিজ করা হয়।
বিচার বিলম্বিত করার আরো একটি নজির হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের শুরুর দিকে নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার আটকাদেশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর বিভিন্ন উপায়ে একাধিক আবেদন করা। এর পাশাপাশি তাঁদের জামিনের জন্য পৃথক আবেদন করা হয়। মাওলানা সাঈদীর জামিনের জন্য বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি আবেদন করা হয়। এক সাঈদীর পক্ষেই বিভিন্ন সময়ে শতাধিক আবেদন করা হয়। সাঈদীর মামলায় ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য না দিলেও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৫ ব্যক্তির বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আসামিপক্ষ বারবার আবেদন করে। তাদের থেকে অভিযোগ তোলা হয়, এসব সাক্ষীকে ঢাকায় এনে একটি স্থানে (সেফ হাউস) রেখে মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যেসব সাক্ষী সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়নি রাষ্ট্রপক্ষ তাদের হাজির করেনি।
কার্যত গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধুরী, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে এসব আবেদন করা হয়। আসামিপক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার বিভিন্ন রেকর্ডপত্র চেয়ে করা আবেদন খারিজ হওয়ার পরও প্রত্যেক আসামির পক্ষে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক আবেদন করা হয়েছে। আবেদন খারিজ হওয়ার পর তা পুনর্বিবেচনার জন্য আবার আবেদন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিচারকাজ সরাসরি সম্প্রচার করা, বিচারে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ চেয়ে আবেদন করা হয়। এসব আবেদনের ওপর শুনানি করতে দীর্ঘ সময় পার হয়েছে ট্রাইব্যুনালের। পাশাপাশি নিজেদের পক্ষে আদেশ না পাওয়ায় বিচার কার্যক্রম বর্জনও করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পৃথিবীর কোনো দেশেই পুনরায় বিচার করার বিধান নেই। আমাদের দেশেও নেই। আইন অনুযায়ী, যেখান থেকে শেষ, সেখান থেকে শুরু। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক পদত্যাগ করলেও বিচার যে পর্যায়ে ছিল সেখান থেকে চলবে। আদালত বিচার করবেন রেকর্ডপত্র দেখে। তাই একজন না থাকলে নতুন করে শুরু করতে হবে- এ আবেদন আইনত অযৌক্তিক।' তিনি বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এটা জেনেও শুধু বিচার বিলম্বিত করার জন্যই পুনরায় বিচারকাজ শুরু করার আবেদন করেছেন। এটা যে বিচার বিলম্বিত করার জন্যই, এর প্রমাণ হচ্ছে একই বিষয় নিয়ে পৃথক চারটি আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু কোনো দেশেই সাক্ষীকে আসামিপক্ষে জেরা করা ও সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে অভিযুক্তদের সে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচারকে গ্রহণযোগ্য ও মডেল হিসেবে দেখানোর জন্যই আসামিপক্ষকে বাড়তি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা এ সুযোগে শুরু থেকেই বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, বিচার পুনরায় শুরু করার আইনগত ভিত্তি না থাকার পরও আসামিপক্ষ যেসব আবেদন করেছে তা মূলত বিচার বিলম্বিত করার জন্যই।
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব সাংবাদিক হারুন হাবীব কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে যে বিচার চলছে তা সাধারণ কোনো বিচার নয়, এটা ইতিহাসের দায়বদ্ধতার বিচার। কিন্তু এ বিচারকে ভণ্ডুল করার জন্য শুরু থেকেই আসামিপক্ষ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা দেশে ও দেশের বাইরে অব্যাহতভাবে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। স্কাইপ সংলাপের জের ধরে বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এরপর বিচার পুনরায় শুরু করার জন্য একাধিক আবেদন প্রমাণ করে, বিচার বিলম্বিত করার চেষ্টা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য দেশে-বিদেশে নানা ধরনের অপচেষ্টা হচ্ছে। টাকা খরচ করা হচ্ছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিচারকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আসামিপক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে একেক ধরনের আবেদন দেওয়ার নজির দেশবাসী দেখেছে। আইনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য এটা একটা ঘৃণ্য অপচেষ্টা।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, শুরু থেকেই আসামিপক্ষ একটি ছক করে সামনে এগোচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের শুরুতে তদন্ত সংস্থার প্রধান হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তিনি ছিলেন জামায়াতের লোক, যদিও তাঁকে সরানো হয়েছে। তিনি বলেন, মূলত প্রসিকিউশনের দুর্বলতার সুযোগে এসব করা হচ্ছে। সময়ক্ষেপণ করার জন্য সাক্ষীদের দিনের পর দিন জেরা করা হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই।
প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, বিচার বিলম্বিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষ থেকেই ১২৫টির বেশি আবেদন করা হয়েছে। সর্বশেষ স্কাইপ সংলাপ নিয়ে একাধিক আবেদন করা হলো।
No comments