মত ও মন্তব্য-ঐতিহাসিক শত্রু যেখানে ঘনিষ্ঠ সহযোগী by হারুন হাবীব
ঐক্যের মাধ্যমে শান্তিকে আমন্ত্রণ জানানোর স্বীকৃতি হিসেবে নরওয়ের নোবেল কমিটি এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে- যাকে আমরা সংক্ষিপ্তাকারে ইইউ বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইইউর ভূমিকা ঐতিহাসিক নিঃসন্দেহে।
অন্যদিকে ঋণসংকটে জর্জরিত ইউরো জোন উদ্ধারেও সংস্থাটির যে ভূমিকা- তাকেও কৃতিত্ব না দেওয়ার কারণ নেই।
ইউরোপের প্রতিটি জনপদ সব দিক থেকে সমানভাবে এগিয়েছে- এমন দাবি আমার নেই। তবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সামাজিক ও রাজনৈতিক মনমানসিকতায় ইউরোপ যতটা এগিয়েছে, যতটা সফল হয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দা বা ঋণসংকট থেকে নিজেদের উদ্ধারে ততটা সফল হতে পারেনি। তার পরও বলতে হবে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে অন্তত শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ গেল ৬০ বছরে নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। সেদিক থেকে এই বিশ্ব-স্বীকৃতি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বিভাজনের বিপরীতে যে ঐক্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যা সুস্থতা এবং সুবিবেচনা আনার অত্যাবশ্যক শর্ত, আমার বিশ্বাস, একই সঙ্গে তা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঐক্য শান্তি আনে এবং সমৃদ্ধিকে এগিয়ে দেয়। অনৈক্য বা বিভক্তি সমৃদ্ধিকে দূরে সরিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য, শান্তি নিশ্চিত হলে গণতন্ত্রায়ণের পথে সামনে এগোনোর পথও প্রশস্ত হয়। শাশ্বত এই সত্যগুলো পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য।
ইউরোপ মহাদেশ যুগের পর যুগ যুদ্ধ-সহিংসতায় বিদ্ধ হয়েছে। লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে পড়শি মানুষের অন্ধ আক্রমণে। ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, সম্পত্তি। বাস্তুভিটা চ্যুত হয়েছে লাখো নিরপরাধ মানুষ। অর্থাৎ এ বিশ্বাসই অনেকটা বদ্ধমূল হতে বসেছিল যে রাষ্ট্র কিংবা জাতিবিদ্বেষ এবং একই সঙ্গে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে পিষ্ট ইউরোপ হয়তো আর কখনোই পারস্পরিক সহমর্মিতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামের সংস্থাটি যুগপ্রাচীন সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। এই সংস্থাটির চলার পথ খুব মসৃণ ছিল বা আজও আছে- ভাবার কারণ নেই। তার পরও ইইউর নেতৃত্বকে অস্বীকার বা অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। নানা সীমাবদ্ধতার পরও এই সংস্থাটি কয়েক যুগ ধরে লাগাতার প্রেরণা জুগিয়েছে, মহাদেশের মানুষকে মানবিক মূল্যবোধ ও একতাবদ্ধ হওয়ার প্রেরণায় জাগিয়ে তুলেছে। তারই স্বীকৃতি দিয়েছে নোবেল কমিটি।
নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে গত ৬০ বছরের নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ পুরস্কার নোবেল কমিটির মতে শান্তি, ঐক্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে ছয় দশকের অবদানের স্বীকৃতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নোবেল কমিটির শান্তি পুরস্কার অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কের ঊধর্ে্ব উঠতে পারেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে বিতর্ক শক্ত সমালোচনায় পরিণত হয়েছে। নারীর নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের অধিকার আদায়ে অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় ২০১১ সালে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন-সারলিফ এবং স্বদেশি লেমা বোয়িসহ ইয়েমেনের নারী অধিকার ও গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী তাওয়াকুল কারমানেকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে নোবেল কমিটি। এর আগে ১৯৯৯ সালে মেডিসিনস সানস ফ্রঁতিয়েরস একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। সমালোচনা সত্ত্বেও এসব পুরস্কার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
নোবেল কমিটির সভাপতি থর্বজেরন জাগল্যান্ডের বিবৃতিটি প্রণিধানযোগ্য; দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের দিনগুলোতে নরওয়ের নোবেল একাডেমী বেশ কয়েক ব্যক্তিকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে, যাঁরা জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের জন্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের সেই চেষ্টা বাস্তবরূপ পেয়েছে ১৯৪৫ সালের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর দুর্দশার পর একটি নতুন ইউরোপ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ৭০ বছরে জার্মানি ও ফ্রান্স যুদ্ধে জড়িয়েছে তিনবার। আর এখন এ দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ অকল্পনীয়। এতেই প্রমাণিত হয়- লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে পারস্পরিক আস্থা অর্জনের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে গেলে ঐতিহাসিক শত্রুরাও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হতে পারে। যদিও এখন ইইউ ভয়াবহ আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত, সামাজিকভাবেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই; তার পরও বিগত ছয় দশকের অবদান বিবেচনা করেই নোবেল কমিটি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সম্মানিত করছে। নোবেল কমিটি বিশ্বাস করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শান্তি, ঐক্য এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউরোপকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে ইইউ।
গণতন্ত্রায়ণের পথ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই বলে আমি মনে করি না। শুরুতে মাত্র ছয়টি সদস্যরাষ্ট্র দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২৭টি। ১৯৮০-এর দিকে গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগাল যখন ইইউর সদস্য হতে চায়, তখন ইইউ শর্ত আরোপ করেছিল। স্পষ্ট জানিয়েছিল, এই জোটের সদস্য হতে হলে তাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক কাঠামো অনুসরণ করতে হবে। এতে কাজ হয়েছিল। বার্লিন প্রাচীর পতনের পরবর্তী অবস্থায় মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের পক্ষে ইউরোপীয় জোটে আসা সম্ভব হয়েছিল। এর মাধ্যমে ইউরোপে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল- পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্ব ঘোচানো সম্ভব হয়েছিল প্রভূত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে একদিকে যেমন গণতন্ত্র জোরদার হয়েছে, অন্যদিকে বহু দেশের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব্বের অবসান হয়েছে।
এসব দিক বিবেচনা করলে বলতেই হয় যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা করেছে, তা বহু রাষ্ট্রের ঐক্যের স্মারক, শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক সুবিশাল অবদান।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সীমাহীন ধংসযজ্ঞের পর থেকেই ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের চেতনা কাজ করতে থাকে মহাদেশটির ক্ষতবিক্ষত দেশে দেশে। নানা টানাপড়েনের পর ১৯৫৭ সালে রোম চুক্তির মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ঐক্যের ধারণা। বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে ২৭ দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোটে। গ্রেট ব্রিটেন অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৭টি দেশ অনেক বছর ধরে একক মুদ্রা হিসেবে 'ইউরো' ব্যবহার করছে। কার্যকরভাবে চালু করেছে ইউরোপীয় ভিসা। যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি এসেছে ইউরোপ আজ। ইইউর নোবেল জয়ের খবরে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার বলেছেন, নোবেল কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপের শান্তিকামী মানুষকে এ খবর উৎসাহ জোগাবে ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ সংস্থাটি নিজেদের পরিচয় দেয় ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি পরিবার বলে। এগুলো কেবল কাগুজে নয় বাস্তবে। ইউরোপের দেশগুলোতে একবার ভ্রমণে গেলেই এসব বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়।
২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন যে ১০টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়, এগুলোর বেশির ভাগ সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। চেক প্রজাতন্ত্র, সাইপ্রাস, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মাল্টা, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া আঞ্চলিক এ সংস্থার সদস্য হয়। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভাজন নিরসনে এটি ছিল বড় পদক্ষেপ।
যুদ্ধ মানবজাতির জন্য কখনো মঙ্গল বয়ে আনেনি। এর পরও ভয়াবহ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকে এগোতে হয়েছে। তবে বলতেই হবে, তিক্ত এ অভিজ্ঞতা ইউরোপের মতো আর কোনো অঞ্চলকে ভোগ করতে হয়নি। দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ গেছে ইউরোপে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ইউরোপকে নতুন অভিজ্ঞতা দান করেছে। এমন কোনো ধংসযজ্ঞ আর কখনোই যেন ফিরে না আসে, তা নিশ্চিত করতেই জোর দেন ইউরোপীয় নেতারা। ফরাসি রাজনীতিক জঁ্য মনে ও রবার্ট শুম্যানকে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার মূলনীতি তৈরির কারিগর বলে মনে করা হয়। এই মূল কারিগররা প্রথমত জোর দেন অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে। এ দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তি সই হয়, যার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত কমিউনিটি (ইসিএসসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে একত্র হয় ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও লুঙ্মেবার্গ। এরপর থেকে যাত্রা থেমে থাকেনি। ইউরোপ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন এক সময়ে নোবেল পেল, যখন সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এ জোটকে। এর পরও বলব, ঐতিহাসিক শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার যে অসামান্য কাজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন করে যাচ্ছে, তাকে খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আমাদের দক্ষিণ এশিয়া যদি ইউরোপের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা লাভ করে, তাহলে এ অঞ্চল উপকৃত হবে। মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, গোত্রে গোত্রে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সহনশীলতা তৈরি হবে। শান্তির ও সহযোগিতার বিকল্প নেই। ঐতিহাসিক শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার বিকল্প নেই। আমার বিশ্বাস, ইউরোপের অভিজ্ঞতা আমাদের দক্ষিণ এশিয়াকে অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক : কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail. com
ইউরোপের প্রতিটি জনপদ সব দিক থেকে সমানভাবে এগিয়েছে- এমন দাবি আমার নেই। তবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সামাজিক ও রাজনৈতিক মনমানসিকতায় ইউরোপ যতটা এগিয়েছে, যতটা সফল হয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দা বা ঋণসংকট থেকে নিজেদের উদ্ধারে ততটা সফল হতে পারেনি। তার পরও বলতে হবে, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে অন্তত শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ গেল ৬০ বছরে নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। সেদিক থেকে এই বিশ্ব-স্বীকৃতি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
বিভাজনের বিপরীতে যে ঐক্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যা সুস্থতা এবং সুবিবেচনা আনার অত্যাবশ্যক শর্ত, আমার বিশ্বাস, একই সঙ্গে তা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঐক্য শান্তি আনে এবং সমৃদ্ধিকে এগিয়ে দেয়। অনৈক্য বা বিভক্তি সমৃদ্ধিকে দূরে সরিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য, শান্তি নিশ্চিত হলে গণতন্ত্রায়ণের পথে সামনে এগোনোর পথও প্রশস্ত হয়। শাশ্বত এই সত্যগুলো পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য।
ইউরোপ মহাদেশ যুগের পর যুগ যুদ্ধ-সহিংসতায় বিদ্ধ হয়েছে। লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে পড়শি মানুষের অন্ধ আক্রমণে। ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, সম্পত্তি। বাস্তুভিটা চ্যুত হয়েছে লাখো নিরপরাধ মানুষ। অর্থাৎ এ বিশ্বাসই অনেকটা বদ্ধমূল হতে বসেছিল যে রাষ্ট্র কিংবা জাতিবিদ্বেষ এবং একই সঙ্গে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে পিষ্ট ইউরোপ হয়তো আর কখনোই পারস্পরিক সহমর্মিতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামের সংস্থাটি যুগপ্রাচীন সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। এই সংস্থাটির চলার পথ খুব মসৃণ ছিল বা আজও আছে- ভাবার কারণ নেই। তার পরও ইইউর নেতৃত্বকে অস্বীকার বা অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। নানা সীমাবদ্ধতার পরও এই সংস্থাটি কয়েক যুগ ধরে লাগাতার প্রেরণা জুগিয়েছে, মহাদেশের মানুষকে মানবিক মূল্যবোধ ও একতাবদ্ধ হওয়ার প্রেরণায় জাগিয়ে তুলেছে। তারই স্বীকৃতি দিয়েছে নোবেল কমিটি।
নোবেল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে গত ৬০ বছরের নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ পুরস্কার নোবেল কমিটির মতে শান্তি, ঐক্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে ছয় দশকের অবদানের স্বীকৃতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নোবেল কমিটির শান্তি পুরস্কার অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কের ঊধর্ে্ব উঠতে পারেনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে বিতর্ক শক্ত সমালোচনায় পরিণত হয়েছে। নারীর নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের অধিকার আদায়ে অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় ২০১১ সালে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন-সারলিফ এবং স্বদেশি লেমা বোয়িসহ ইয়েমেনের নারী অধিকার ও গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী তাওয়াকুল কারমানেকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে নোবেল কমিটি। এর আগে ১৯৯৯ সালে মেডিসিনস সানস ফ্রঁতিয়েরস একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল। সমালোচনা সত্ত্বেও এসব পুরস্কার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
নোবেল কমিটির সভাপতি থর্বজেরন জাগল্যান্ডের বিবৃতিটি প্রণিধানযোগ্য; দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের দিনগুলোতে নরওয়ের নোবেল একাডেমী বেশ কয়েক ব্যক্তিকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে, যাঁরা জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের জন্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের সেই চেষ্টা বাস্তবরূপ পেয়েছে ১৯৪৫ সালের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর দুর্দশার পর একটি নতুন ইউরোপ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ৭০ বছরে জার্মানি ও ফ্রান্স যুদ্ধে জড়িয়েছে তিনবার। আর এখন এ দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ অকল্পনীয়। এতেই প্রমাণিত হয়- লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে পারস্পরিক আস্থা অর্জনের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে গেলে ঐতিহাসিক শত্রুরাও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হতে পারে। যদিও এখন ইইউ ভয়াবহ আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত, সামাজিকভাবেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই; তার পরও বিগত ছয় দশকের অবদান বিবেচনা করেই নোবেল কমিটি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সম্মানিত করছে। নোবেল কমিটি বিশ্বাস করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শান্তি, ঐক্য এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউরোপকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে ইইউ।
গণতন্ত্রায়ণের পথ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই বলে আমি মনে করি না। শুরুতে মাত্র ছয়টি সদস্যরাষ্ট্র দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২৭টি। ১৯৮০-এর দিকে গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগাল যখন ইইউর সদস্য হতে চায়, তখন ইইউ শর্ত আরোপ করেছিল। স্পষ্ট জানিয়েছিল, এই জোটের সদস্য হতে হলে তাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক কাঠামো অনুসরণ করতে হবে। এতে কাজ হয়েছিল। বার্লিন প্রাচীর পতনের পরবর্তী অবস্থায় মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের পক্ষে ইউরোপীয় জোটে আসা সম্ভব হয়েছিল। এর মাধ্যমে ইউরোপে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল- পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্ব ঘোচানো সম্ভব হয়েছিল প্রভূত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে একদিকে যেমন গণতন্ত্র জোরদার হয়েছে, অন্যদিকে বহু দেশের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব্বের অবসান হয়েছে।
এসব দিক বিবেচনা করলে বলতেই হয় যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যা করেছে, তা বহু রাষ্ট্রের ঐক্যের স্মারক, শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক সুবিশাল অবদান।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সীমাহীন ধংসযজ্ঞের পর থেকেই ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের চেতনা কাজ করতে থাকে মহাদেশটির ক্ষতবিক্ষত দেশে দেশে। নানা টানাপড়েনের পর ১৯৫৭ সালে রোম চুক্তির মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ঐক্যের ধারণা। বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে ২৭ দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোটে। গ্রেট ব্রিটেন অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৭টি দেশ অনেক বছর ধরে একক মুদ্রা হিসেবে 'ইউরো' ব্যবহার করছে। কার্যকরভাবে চালু করেছে ইউরোপীয় ভিসা। যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি এসেছে ইউরোপ আজ। ইইউর নোবেল জয়ের খবরে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার বলেছেন, নোবেল কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপের শান্তিকামী মানুষকে এ খবর উৎসাহ জোগাবে ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ সংস্থাটি নিজেদের পরিচয় দেয় ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি পরিবার বলে। এগুলো কেবল কাগুজে নয় বাস্তবে। ইউরোপের দেশগুলোতে একবার ভ্রমণে গেলেই এসব বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়।
২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন যে ১০টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়, এগুলোর বেশির ভাগ সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। চেক প্রজাতন্ত্র, সাইপ্রাস, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মাল্টা, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া আঞ্চলিক এ সংস্থার সদস্য হয়। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভাজন নিরসনে এটি ছিল বড় পদক্ষেপ।
যুদ্ধ মানবজাতির জন্য কখনো মঙ্গল বয়ে আনেনি। এর পরও ভয়াবহ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বকে এগোতে হয়েছে। তবে বলতেই হবে, তিক্ত এ অভিজ্ঞতা ইউরোপের মতো আর কোনো অঞ্চলকে ভোগ করতে হয়নি। দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ গেছে ইউরোপে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ইউরোপকে নতুন অভিজ্ঞতা দান করেছে। এমন কোনো ধংসযজ্ঞ আর কখনোই যেন ফিরে না আসে, তা নিশ্চিত করতেই জোর দেন ইউরোপীয় নেতারা। ফরাসি রাজনীতিক জঁ্য মনে ও রবার্ট শুম্যানকে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার মূলনীতি তৈরির কারিগর বলে মনে করা হয়। এই মূল কারিগররা প্রথমত জোর দেন অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে। এ দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৫১ সালে প্যারিস চুক্তি সই হয়, যার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত কমিউনিটি (ইসিএসসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে একত্র হয় ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও লুঙ্মেবার্গ। এরপর থেকে যাত্রা থেমে থাকেনি। ইউরোপ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন এক সময়ে নোবেল পেল, যখন সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এ জোটকে। এর পরও বলব, ঐতিহাসিক শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার যে অসামান্য কাজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন করে যাচ্ছে, তাকে খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আমাদের দক্ষিণ এশিয়া যদি ইউরোপের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা লাভ করে, তাহলে এ অঞ্চল উপকৃত হবে। মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, গোত্রে গোত্রে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সহনশীলতা তৈরি হবে। শান্তির ও সহযোগিতার বিকল্প নেই। ঐতিহাসিক শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার বিকল্প নেই। আমার বিশ্বাস, ইউরোপের অভিজ্ঞতা আমাদের দক্ষিণ এশিয়াকে অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক : কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail. com
No comments