ক্রিকেটে টালমাটাল অসি সাম্রাজ্য! by শাকিল আহমেদ মিরাজ

যার উত্থান আছে তার পতনও আছে সভ্যতার বিবর্তনে চিরন্তন এ কথাটি সংস্কৃতির অন্য অঙ্গনের মতো ক্রিকেটেও চরম সত্য। যেটি উপলব্ধি করেছেন ভিভ রিচার্ডস, উপলব্ধি করেছে সত্তরের দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ; উপলব্ধি করেছেন


অর্জুনা রানাতুঙ্গা, উপলব্ধি করেছে নব্বইয়ের দশকের শ্রীলঙ্কা এবং সর্বশেষ যাদের নিয়ে এই ফিচার, উপলব্ধি করছেন সেই রিকি পন্টিং ও মাইকেল ক্লার্ক এবং উপলব্ধি করছে একবিংশ শতাব্দীর অস্ট্রেলিয়া! ক্রিকেট ভক্তদের অবগতির জন্য উল্লেখ্য- ভিভের দুর্ধর্ষ উইন্ডিজ সেবার টানা ১৭টি ওয়ানডে জয়ের পর হেরেছিল ১৮তম ম্যাচে। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জয় পরবর্তী তিন বছর ওয়ানডে জয়কে ডাল-ভাতে পরিণত করে আকাশে উড়তে থাকা শ্রীলঙ্কাও মাটিতে নেমে এসেছিল প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে। আর ১৯৯২ থেকে ২০০০ পর্যন্ত টানা ২১ জয়ের পর স্টিভের অজেয় অস্ট্রেলিয়াও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মাথা নুইয়েছিল ২২তম ম্যাচে এসে। কিন্তু তার পরও টেস্ট ক্রিকেটকে ‘কুলিন আর আভিজাত্যের মোড়কে উপস্থাপনকারী অসিরা সর্বদা ওয়ানডের ওসব জয়-পরাজয়, রেকর্ডকে পাত্তা না দেয়ার ভান করে এসেছে বার বার।
ক্রিকেটে আশি-নব্বইয়ের দশকের সেই অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা এখন বেশ সঙ্গীন। ওয়ানডে বিশ্বকাপের সর্বাধিক চারবারের চ্যাম্পিয়ন অসিরা। ২০১১ সালে উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বিশ্বকাপে টানা চতুর্থ শিরোপার লক্ষ্যে (১৯৯৯ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন) মিশন শুরু করেছিল রিকি পন্টিংয়ের দল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে যায় তাদের দৌড়। মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের কাছে হারে ৫ উইকেটের বড় ব্যবধানে। টেস্টের পতনটা আরও আগে হলেও দৃশ্যত ওয়ানডেতেও দলটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে এরপর থেকেই। তবে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হালের টি২০ ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের উত্তরসূরিদের অবস্থা বড়ই বেহাল। আয়োজিত চার আসরের একটিতেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি তারা। সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১০ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ টি২০-এর ফাইনাল খেলা। সেবার ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হেরে রানার্সআপ হয় তরুণ নেতা মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে তিন ধরনের ক্রিকেট থেকেই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন রিকি পন্টিং। পরিবর্তনের আশায় দায়িত্ব দেয়া হয় মাইকেল ক্লার্কের হাতে। তবে তার চেয়েও বড় চমক ছিল শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপের আগে আচমকাই টি২০’র জন্য আনকোড়া জর্জ বেইলিকে দায়িত্ব দেয়া। বেইলিকে অধিনায়ক করায় অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছিল। ভরসা রাখতে পারছিলেন না অস্ট্রেলিয়ান ভক্তরাও। কিন্তু শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবার আগে সেমিত উঠে যায় তারা। গ্রুপ পর্ব থেকে সুপার এইট পর্যন্ত একটি মাত্র ম্যাচে হারে অসিরা! তাতে অবশ্য অধিনায়ক বেইলির অবদান সামান্যই। ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নৈপূণ্য প্রদর্শন করে একাই দলকে সেমিতে তুলে নেন সুপার অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন। সেমিতে ক্লিক করেনি ওয়াটসন অস্ত্রÑ ওখানেই থেমে যায় অস্ট্রেলিয়া মিশন!! ওয়াটসনে ‘ওয়ানম্যান শো’ প্রদর্শিত হলেও তাই সার্বিকভাবে মোটেই আহামরি ছিল না পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার নৈপুণ্য।
কেবল সুপার এইটে টানা দ্বিতীয়ই নয়, আসরে গ্রুপ-পর্ব থেকে শুরু করে চার ম্যাচের চারটিতেই টানা জয় তুলে নিয়ে সেমিফাইনালে পা দিয়ে রাখে বিশ্বকাপের আগে ডাকসাইটে থাকা অস্ট্রেলিয়া! দুর্দান্ত ফর্ম প্রদর্শন করে জর্জ বেইলির নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া। যে কোন প্রতিপক্ষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেন অলরাউন্ডার ওয়াটসন। প্রথম পর্ব থেকে সুপার এইটের শেষ ম্যাচ পর্যন্তÑঅস্ট্রেলিয়ার পাওয়া টানা চার জয়েই ম্যাচসেরা হয়েছেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন। এক কথায় ওয়াটসনের উইলো-গোলকের ঝাঁঝেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয় প্রতিপক্ষ দলগুলো। আসলে ভিনগ্রহের বাসিন্দার মতো অসম্ভব জাদুকরী ক্রিকেট খেলে একাই অস্ট্রেলিয়াকে সেমিতে তুলেছিলেন ওয়াটশন। সেমিতে পাকিস্তানের কাছে হারের আগ পর্যন্ত শেষ চার ম্যাচে বলে-ব্যাটে আগুন ওয়াটশনের নৈপূণ্য ছিল ঠিক এমন : ৩/২৬ ও ৫১, ২/৩৯ ও ৪১*, ৩/৩৪ ও ৭২, ২/২৯ ও ৭০Ñ অবিশ্বাস্য! সে অর্থে অসি নৈপূণ্য হয়ে উঠেছিল ‘ওয়ানম্যান শো’Ñ এতেও অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের পতন ছবিটাই কি ফুটে ওঠে না? কারণ নব্বইয়ের দশকের অজেয় অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ানম্যান শো বলে কিছু ছিল না। দিন বুঝে ব্যাট হাতে যেমন স্টিভ ওয়াহ, মাইকেল বেভান, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, রিকি পন্টিংদের যে কেউ কাজটি করে দিয়েছেন; তেমননি বল হাতে ওয়ার্নের ব্যর্থতার দিনে ঠিকই দলের জয়ে দুর্দান্ত খেলেছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পি কিংবা স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলরা। সুতরাং এক ওয়াটসনের ওপর ভর করে চমক দেখালেও তা দিয়ে যে অসি সাম্রাজ্যের শেষ রক্ষা হতে পারে নাÑটি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভরাডুবি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃতপ্রায় ওয়েস্ট ইন্ডিজও যেখানে নতুন করে জেগে উঠেছে, সেখানে ওয়ানডে-টি২০ মিলিয়ে শেষ পাঁচ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার ব্যর্থতা দেশটির ক্রিকেট সাম্রাজ্যের অব্যাহত দোলাচলই প্রমাণ করে। অন্যদিকে যে টেস্টে সব সময় আভিজাত্য আভিজাত্য বলে গলা ফাটিয়ে এসেছে, সেই অভিজাত টেস্ট ক্রিকেটেও দাম্ভিক অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান এখন দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ডের পেছনে। এখন তো তবু খানিক উন্নতি হয়েছে। বছর দুয়েক আগের অবস্থান বিচারে যেটিকে একেবারে তলানিতে বললেও অত্যুক্তি হতো না। কারণ আইসিসির দশ টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে পন্টিংরা নেমে গিয়েছিল ৫ নম্বরে! ওই সময় মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১ থেকে ৫ নম্বরে নেমে আসে পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া! একেবারে সুনির্দ্দিষ্ট করে বললে, ২০০৯-এর মে-জুনেও অসিদের অবস্থান ছিল সবার উপরে; ওই বছরের আগস্ট- সেপ্টেম্বরে তারা নেমে যায় ৪-এ! এর পর ডিসেম্বর-জানু ’১০-এ এক ধাপ উঠে এসে ৩ নম্বরে কিছুদিন স্থির থাকলেও, ভারত সফরে দুই টেস্টে স্বাগতিক নম্বর ওয়ান ভারতের কাছে গোহারা হারলে ব্যর্থতার ইতিহাস গড়ে(!) অস্ট্রেলিয়া; কালিমা লাগে ব্রাডম্যানের উত্তরসূরিদের কপালে। ২০০৩ সালে আইসিসি কর্তৃক র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পর যেটি ছিল (৫ম) অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বাজে অবস্থান।
২০০৮-এর শেষভাগে এসে ওয়ার্ন-গিলক্রিস্টের মতো পরীক্ষিত সৈনিকদের অবসরে তথৈবচ অবস্থা শুরু হয় নখদন্তহীন অস্ট্রেলিয়ার। যে সূত্র ধরে টেস্টে অসিদের শীর্ষস্থান খোয়ানোর শঙ্কাটা শুরু হয়েছিল। ২০১০-এর জানুয়ারির দিকে, যখন সাউথ অফ্রিকাতে সিরিজ হেরেছিল পন্টিংরা। পরবর্তীতে নিজেদের মাঠে ফিরতি সফরে প্রোটিয়াসদের বিরুদ্ধে কষ্টে সৃষ্টে সিরিজ জিতে তখনকার মতো ১ নম্বর জায়গাটি ধরে রাখতে পারলেও জুন-জুলাইতে এ্যাসেজ হারায় আর শেষ রক্ষা হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাকে একে তুলে দিয়ে এক ধাক্কায় ৪-এ নেমে যায় অসিরা! টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সিংহাসনচ্যুত হয় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট । সেই সাথে বিশ্ব ক্রিকেটে পতন হয় অসি সাম্রাজ্যের! ২০০৯-এর ডিসেম্বরে স্বদেশে শ্রীলঙ্কাকে নাস্তানাবুদ করে ধোনি বাহিনী যখন প্রথমবারের মতো টেস্টে শীর্ষস্থান দখল করে নেয়, দুনিয়াজুড়ে তখন কেবলই ভারতবন্দনা। ক্রিকেটে ভারত যুগের সূচনালগ্নে সবাই হয়ে পড়ে মাতোয়ারা। আইসিসিতে ক্ষমতার দাপট, আইপিএলে টাকার খেলা আর মাঠে ভারতীয় ক্রিকেটারদের নৈপুণ্যের ঝলকের মোহে আচ্ছন্ন ক্রিকেটপ্রেমীদের মন থেকে অনেকটাই দূরে সারে যায় অসি সৌন্দর্য। ভাবলে কষ্ট লাগেÑবিশ্ব ক্রিকেটের জন্মের মতই দীর্ঘ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের ইতিহাস। চরম আভিজাত্যের অপর নাম ‘অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট’ আজ পায়ের তলায় মাটি খুঁজে হয়রান!

No comments

Powered by Blogger.