পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার বৈষম্য by শান্তা তাওহিদা

একটি দৃশ্য ভাবুন তো, গুরুত্বপূর্ণ পেশায় কর্মরত একজন মা। সারা দিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় যখন শিশুকে পড়াতে বসেন, তখন বইয়ের অধ্যায়ে পেশাজীবী বলতেই পুরুষের ছবি দেখতে পান। কোনো কোনো ছবিতে অবশ্য স্বাস্থ্যকর্মী ও সেবিকার মতো গতানুগতিক পেশায় নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে।


কিন্তু নারীরা যে এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না পাঠ্যপুস্তকে। সেই কর্মজীবী মায়ের শিশুর মনে কি এই লিঙ্গবৈষম্যের বিরূপ প্রভাব পড়ছে না? মা সারা দিন পরিশ্রম করে এসে শিশুকে যে পাঠদান করছেন, সেই পাঠে নিজের কাজের প্রতিফলন নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ২০০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত (পারিমার্জিত সংস্করণ অক্টোবর-২০১১) পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান বইয়ে মানুষ বলতে কেবল পুরুষের ছবিই দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বইগুলোর অধিকাংশ অংশে চালক অথবা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা বোঝাতে সব সময়ই ছেলেশিশু বা পুরুষের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। পুরুষকে জ্ঞানের আধেয় এবং নারীকে কন্যা-জায়া-জননী কিংবা গৃহিণী-রাঁধুনি-সেবিকার পুরোনো বৃত্তে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়লে যে কারও মনে হবে, তা যেন ছেলেশিশুর জন্য রচিত। কেবল প্রাথমিক স্তরে নয়, মাধ্যমিক স্তরেও ফুটে উঠেছে এ চিত্র।
সম্প্রতি বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ কর্তৃক প্রকাশিত ‘নির্বাচিত পাঠ্যপুস্তকের জেন্ডার সংবেদনশীলতার স্বরূপ বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় ফুটে উঠেছে এ চিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, সাংবাদিক ফিরোজ জামান চৌধুরী, গবেষক শারমিন জাহান, ফারিবা তাবাস্সুম ও আনওয়ারুল সালামের গবেষণায় উঠে এসেছে পাঠ্যপুস্তকের রচনা ও অলংকরণের দৃষ্টিভঙ্গি। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকগুলোয় আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক প্রেক্ষাপটের ছাপ স্পষ্ট। অথচ পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ও একটি শিশুর মেধা ও মননের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশু ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক, সমাজের জন্য একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে তাকে গড়ে তুলতে যে পাঠ শেখানো হবে, তাতে কোনো জেন্ডার-বৈষম্য ফুটে উঠুক, তা কারও কাম্য নয়। এমনটাই মনে করেন রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার-বৈষম্য কমেছে; তবে সেগুলো এখনো পুরোপুরি জেন্ডার সংবেদনশীল নয়। এ বিষয়গুলোই আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে গবেষণাপত্রে। গবেষণায় শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১২টি বিষয়ের ওপর মোট ১০৮টি পাঠ্যপুস্তক থেকে নমুনায়নের মাধ্যমে ২৫টি বই নির্বাচন করা হয়েছে। যেখানে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পরিবেশ পরিচিতি সমাজ, পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান, ইসলাম শিক্ষা, হিন্দুধর্ম শিক্ষা, চারুপাঠ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, সাহিত্য কণিকা, কৃষিশিক্ষা প্রভৃতি বই স্থান পেয়েছে। সে হিসেবে ২৫টি বইয়ের সর্বমোট তিন হাজার ৪৬৪টি পৃষ্ঠায় ফুটে উঠেছে মানুষ হিসেবে পুরুষের সাধারণীকরণ, মুক্তিযুদ্ধে উপেক্ষিত নারীর অবস্থান, গল্পের মূল চরিত্রে ছেলে বা পুরুষ, সৃজনশীল প্রশ্নে পুরুষ চরিত্রের উপস্থিতি, গৃহস্থালির গৎবাঁধা কাজে নারী, বিজ্ঞানের এলাকা একান্তই পুরুষের, আর্থিক লেনদেনে পুরুষ, শারীরিক শিক্ষায় নারী-পুরুষ বৈষম্য, নানাভাবে নারীকে নেতিবাচক রূপে উপস্থাপনসহ বিভিন্ন দিক। চতুর্থ শ্রেণীর পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি’ (নবম অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৫৭) ও ‘স্বাধীনতার কয়েকজন অগ্রনায়ক’ অধ্যায়ে (একাদশ অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৭১) নারীর কোনো ভূমিকার উল্লেখ করা হয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে (পৃষ্ঠা ৪) দেখানো হয়েছে, ঘরের কাজ নারীর আর বাইরের কাজ পুরুষের। একই বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে, ছেলেশিশুর কাজ বাবাকে সাহায্য করা এবং মেয়েশিশুর কাজ মাকে ঘর গোছাতে সাহায্য করা। অষ্টম শ্রেণীর সাহিত্য কণিকা বইয়ের লেখক-কবিদের মধ্যে গদ্য লেখকের মধ্যে একজন নারীও নেই। কবিতার ক্ষেত্রে ১১ জন কবির মধ্যে মাত্র একজন নারী (জাগো তবে অরণ্য কন্যারা: সুফিয়া কামাল)। অষ্টম শ্রেণীর নিম্নমাধ্যমিক গণিত বইয়ে ক্ষমতা আর ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে পুরুষদের। আলোচ্য বিষয়গুলো একেবারেই ছোটখাটো বিষয়, তবে একটি শিশুর মনে দাগ কাটার মতো বহু জেন্ডার অসংবেদনশীল বিবরণ ও ছবি এখনো রয়েছে পাঠ্যপুস্তকগুলোয়।
এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামাল উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোয় কিছু জেন্ডার অসংবেদনশীলতা রয়েছে। এটি আসলে অসচেতনভাবেই হয়ে আসছিল এত দিন ধরে। আমরা বর্তমানে কারিকুলাম পরিবর্তন করেছি। “ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন প্রজেক্ট ও ইউনিসেফের লাইফ স্কিল বেইজ এডুকেশনের (এলএসবিই)” সুপারিশগুলোকে আমরা গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছি ২০১৩ সালের নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে। যেখানে ছাত্রছাত্রী নয়, বরং ছেলেশিশু ও মেয়েশিশু উভয়কেই শিক্ষার্থী হিসেবে উপস্থাপনসহ মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। ছবি উপস্থাপনেও ছেলে ও মেয়ের সমবণ্টন করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, ২০১৩ সালের প্রণীত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে জেন্ডার প্রশ্নে কোনো বৈষম্য থাকবে না।’
নারী প্রগতি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক আয়েশা কবীর বলেন, ‘নারী প্রগতি সংঘ অনেক বছর ধরে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, মানুষের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন করাটা জরুরি, নতুবা নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। আর এই চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা তৈরির একমাত্র শক্তিশালী মাধ্যম হল শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থাই তৈরি করে মানুষকে। তাই সমাজে, রাষ্ট্রে জেন্ডার সংবেদনশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে শিক্ষাব্যবস্থাটাকে প্রথমে জেন্ডার সংবেদনশীল করতে হবে। একদিন, দুদিন কিংবা এক মাসের প্রশিক্ষণে এটি সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় একেবারে গোড়া থেকে জেন্ডার সংবেদনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে সংবেদনশীল হওয়া তাই জরুরি বিষয়। কারণ আজকের শিশুটিই এ শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা প্রকৃত মানুষ হবে গড়ে উঠে একদিন ভূমিকা রাখবে জাতীয় নীতিতে। এসব কারণেই নারী প্রগতি সংঘ যুক্ত হয়েছে এই গবেষণাকর্মে।’

No comments

Powered by Blogger.