সময়ের প্রতিধ্বনি-টিআইবির প্রশ্নবিদ্ধ জরিপ এবং বিরাজনৈতিকীকরণ তত্ত্ব by মোস্তফা কামাল
আগেকার দিনে সংবাদপত্রে একটা ধারণা চালু ছিল। 'নো নিউজ ইজ দ্য গুড নিউজ।' ভালো সংবাদ কোনো খবর নয়। সংগত কারণেই নেতিবাচক খবরগুলো পত্রিকার পাতায় স্থান পেত। এখন সে ধারণা কিছুটা পাল্টেছে। এখন খারাপ সংবাদের পাশাপাশি সুসংবাদও ভালো কাভারেজ পায়।
তবে তা নিশ্চয়ই নেতিবাচক খবরগুলোর মতো নয়।
আমাদের সংসদ সদস্যদের নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত রবিবার একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি জাতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশের পর সারা দেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। সেই সঙ্গে এমন প্রশ্নও তোলা হয়, তাহলে কি আবার বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে? অনেকেই বলছেন, আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে নানামুখী তৎপরতার অংশ হিসেবে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করানো হয়েছে। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলছেন, রাজনীতিকদের চরিত্র হননের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে জরিপটি করানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও টিআইবির জরিপ প্রতিবেদনের কঠোর সমালোচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, টিআইবির প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, অরাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্য টিআইবি এই প্রতিবেদন দিয়েছে।
আসলে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। বিগত ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চয়ই মানুষ ভুলে যায়নি। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে তখন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছিল। বৈদেশিক বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। অনেকেই তখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছিলেন। আবার অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময়কে অনেকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন। আবারও কি সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে? এ রকম শঙ্কা শুধু যে রাজনীতিকদের মনে তা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, আমাদেরও সে অবস্থা হয়েছে। রাজনীতিকদের অপরাধী চিহ্নিত করে বিরাজনৈতিকীকরণের অপচেষ্টা হচ্ছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। সে বিষয়টি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে।
টিআইবির রিপোর্ট প্রকাশের পর কেউ কেউ অবশ্য খুশি হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, যে সংসদ সদস্যদের বিষয়ে টুঁ শব্দটি করা যায় না, তাঁদের বিরুদ্ধে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে টিআইবি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু টিআইবিকে এত সাহস কে জুগিয়েছে? পেছনে নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য শক্তি রয়েছে। সেই শক্তিটি কি বাইরের, নাকি ভেতরের? পেছনের শক্তি ছাড়া এ ধরনের জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশের সাহস টিআইবি পেল কোথায়?
একবার সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সংসদ সদস্যের বিষয়ে মন্তব্য করে মহাবিপাকে পড়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে সংসদে এমন আলোচনা শুরু হয়েছিল যে তাঁর মান-ইজ্জত নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সংসদ সদস্যদের অসাধু কর্মকাণ্ড নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হলে মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন। অনেককে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। অবশ্য এর উল্টো চিত্রও আছে।
আবার এটাও ঠিক যে নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা একাট্টা। তাঁদের মধ্যে চরম রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তাঁরা এক সুরে কথা বলেন। শুল্কমুক্ত সুবিধায় তাঁরা কোটি টাকার গাড়ি কেনেন। সংসদ সদস্য পদের প্রভাব খাটিয়ে একাধিক প্লট বরাদ্দ নেন। সংসদে উপস্থিত না থেকেও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন। এসব তো সবার জানা। সাংবাদিকরা লিখতে গেলেই যত বিপত্তি।
আমরা নিশ্চয়ই এ কথা বলব না যে সবাই খারাপ। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ভালো কাজ করছেন। অনেকে সুনামের সঙ্গে দীর্ঘকাল রাজনীতিতে টিকে আছেন। অথচ নবম জাতীয় সংসদের ১৪৯ জন সদস্যের ওপর টিআইবির জরিপ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ৯৭ শতাংশ সদস্যই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এর মধ্যে সরাসরি অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ৫৩.৫ শতাংশ। টিআইবির জরিপ মতে, তাঁরা প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা, সরকারি কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ পাওয়া প্রভৃতি অপরাধের সঙ্গে জড়িত। জরিপে ১৩৬ জন সরকারদলীয় এবং ১৩ জন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যকে নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর মধ্যে ২৭ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।
বর্তমান সংসদের ৯৭ শতাংশ সদস্যই যদি খারাপ হন, তাহলে ভালো কাকে বলব? আমাদের বর্তমান সংসদের আসনসংখ্যা ৩০০। এর মধ্যে মাত্র ৯ জন ভালো মানুষ! বাকিরা খারাপ! এ কথা বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না। বারবারই মনে হয়, এর পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। টিআইবির উচিত ছিল, ৩০০ আসনের ওপর জরিপ করে রিপোর্ট প্রকাশ করা। আর সেই জরিপটি হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। খণ্ডিতভাবে জরিপ করার কারণে প্রতিবেদনটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এই অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিকে বিভ্রান্ত করা টিআইবির উচিত হয়নি।
টিআইবি যদি দেশের গণতন্ত্রকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখত, তাহলে বিষয়টিকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে পারত। দেশের গণতন্ত্রকে মানুষ কিভাবে দেখছে এবং গণতন্ত্র না থাকার ফলে দেশে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার একটা তুলনামূলক জরিপ করতে পারত। একই সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করতে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়েও মতামতধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারত। তাহলে নিশ্চয়ই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসত। সেদিকে না গিয়ে সংসদ সদস্যদের অপরাধী চিহ্নিত করে টিআইবি প্রতিবেদন প্রকাশ করল কেন?
আমরা স্বীকার করছি, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন কালো টাকার মালিকরা। তাঁদের প্রভাবে সৎ রাজনীতিকরা একেবারেই কোণঠাসা। তার পরও সংসদ সদস্যদের ঢালাওভাবে অপরাধী বলাটা কতটা যৌক্তিক? আর রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই তো ঠিক করতে হবে। অপরাজনীতি দিয়ে রাজনীতি কি সঠিক পথে আনা সম্ভব হবে?
আমরা দেখছি, টিআইবি ১০টি সুপারিশও দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন থেকে সংসদ সদস্যদের সরিয়ে আনতে হবে, যাতে তাঁরা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করতে হবে। বিতর্কিত সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার, সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ কমিয়ে ৩০ দিন করতে হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে ৫০ শতাংশ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যকে মনোনীত করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। বর্তমান সংসদে বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়ে যায়। যা-ই হোক, এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে। এসব বিষয়ে টিআইবি সাধারণ মানুষের ওপর জরিপকাজ পরিচালনাও করতে পারত। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত নিয়ে সুপারিশ তৈরি করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করলে টিআইবির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটত। অথচ টিআইবি নেতিবাচক একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা বাড়িয়ে দিল। এর ফলে গণতন্ত্র এবং রাজনীতিকদের ব্যাপারে টিআইবির নেতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অবৈজ্ঞানিক এবং ত্রুটিপূর্ণ এই জরিপ প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে আর কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। গণতন্ত্রে জবাবদিহিতা থাকে, যা অন্য কোনো ব্যবস্থায় থাকে না। পাঁচ বছর পরে হলেও সংসদ সদস্যদের জনগণের কাছে যেতে হয়। সংসদ সদস্যরা ভালো কাজ না করলে তার জবাব ভোটের মাধ্যমে জনগণ দিয়ে থাকেন। কাজেই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার তা-ই করা উচিত। টিআইবির যদি কোনো দুরভিসন্ধি থাকে, তাহলে তা দেশের জনগণ মেনে নেবে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
আমাদের সংসদ সদস্যদের নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত রবিবার একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি জাতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশের পর সারা দেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। সেই সঙ্গে এমন প্রশ্নও তোলা হয়, তাহলে কি আবার বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে? অনেকেই বলছেন, আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে নানামুখী তৎপরতার অংশ হিসেবে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করানো হয়েছে। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলছেন, রাজনীতিকদের চরিত্র হননের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে জরিপটি করানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও টিআইবির জরিপ প্রতিবেদনের কঠোর সমালোচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, টিআইবির প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, অরাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্য টিআইবি এই প্রতিবেদন দিয়েছে।
আসলে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তো ভালো নয়। বিগত ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চয়ই মানুষ ভুলে যায়নি। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে তখন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছিল। বৈদেশিক বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। অনেকেই তখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছিলেন। আবার অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময়কে অনেকে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন। আবারও কি সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে? এ রকম শঙ্কা শুধু যে রাজনীতিকদের মনে তা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, আমাদেরও সে অবস্থা হয়েছে। রাজনীতিকদের অপরাধী চিহ্নিত করে বিরাজনৈতিকীকরণের অপচেষ্টা হচ্ছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। সে বিষয়টি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে।
টিআইবির রিপোর্ট প্রকাশের পর কেউ কেউ অবশ্য খুশি হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, যে সংসদ সদস্যদের বিষয়ে টুঁ শব্দটি করা যায় না, তাঁদের বিরুদ্ধে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে টিআইবি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু টিআইবিকে এত সাহস কে জুগিয়েছে? পেছনে নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য শক্তি রয়েছে। সেই শক্তিটি কি বাইরের, নাকি ভেতরের? পেছনের শক্তি ছাড়া এ ধরনের জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশের সাহস টিআইবি পেল কোথায়?
একবার সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সংসদ সদস্যের বিষয়ে মন্তব্য করে মহাবিপাকে পড়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে সংসদে এমন আলোচনা শুরু হয়েছিল যে তাঁর মান-ইজ্জত নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সংসদ সদস্যদের অসাধু কর্মকাণ্ড নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হলে মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন। অনেককে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। অবশ্য এর উল্টো চিত্রও আছে।
আবার এটাও ঠিক যে নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা একাট্টা। তাঁদের মধ্যে চরম রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তাঁরা এক সুরে কথা বলেন। শুল্কমুক্ত সুবিধায় তাঁরা কোটি টাকার গাড়ি কেনেন। সংসদ সদস্য পদের প্রভাব খাটিয়ে একাধিক প্লট বরাদ্দ নেন। সংসদে উপস্থিত না থেকেও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন। এসব তো সবার জানা। সাংবাদিকরা লিখতে গেলেই যত বিপত্তি।
আমরা নিশ্চয়ই এ কথা বলব না যে সবাই খারাপ। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ভালো কাজ করছেন। অনেকে সুনামের সঙ্গে দীর্ঘকাল রাজনীতিতে টিকে আছেন। অথচ নবম জাতীয় সংসদের ১৪৯ জন সদস্যের ওপর টিআইবির জরিপ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ৯৭ শতাংশ সদস্যই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এর মধ্যে সরাসরি অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ৫৩.৫ শতাংশ। টিআইবির জরিপ মতে, তাঁরা প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা, সরকারি কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ পাওয়া প্রভৃতি অপরাধের সঙ্গে জড়িত। জরিপে ১৩৬ জন সরকারদলীয় এবং ১৩ জন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যকে নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর মধ্যে ২৭ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী।
বর্তমান সংসদের ৯৭ শতাংশ সদস্যই যদি খারাপ হন, তাহলে ভালো কাকে বলব? আমাদের বর্তমান সংসদের আসনসংখ্যা ৩০০। এর মধ্যে মাত্র ৯ জন ভালো মানুষ! বাকিরা খারাপ! এ কথা বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না। বারবারই মনে হয়, এর পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। টিআইবির উচিত ছিল, ৩০০ আসনের ওপর জরিপ করে রিপোর্ট প্রকাশ করা। আর সেই জরিপটি হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। খণ্ডিতভাবে জরিপ করার কারণে প্রতিবেদনটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এই অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিকে বিভ্রান্ত করা টিআইবির উচিত হয়নি।
টিআইবি যদি দেশের গণতন্ত্রকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখত, তাহলে বিষয়টিকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে পারত। দেশের গণতন্ত্রকে মানুষ কিভাবে দেখছে এবং গণতন্ত্র না থাকার ফলে দেশে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার একটা তুলনামূলক জরিপ করতে পারত। একই সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করতে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়েও মতামতধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারত। তাহলে নিশ্চয়ই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসত। সেদিকে না গিয়ে সংসদ সদস্যদের অপরাধী চিহ্নিত করে টিআইবি প্রতিবেদন প্রকাশ করল কেন?
আমরা স্বীকার করছি, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন কালো টাকার মালিকরা। তাঁদের প্রভাবে সৎ রাজনীতিকরা একেবারেই কোণঠাসা। তার পরও সংসদ সদস্যদের ঢালাওভাবে অপরাধী বলাটা কতটা যৌক্তিক? আর রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই তো ঠিক করতে হবে। অপরাজনীতি দিয়ে রাজনীতি কি সঠিক পথে আনা সম্ভব হবে?
আমরা দেখছি, টিআইবি ১০টি সুপারিশও দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন থেকে সংসদ সদস্যদের সরিয়ে আনতে হবে, যাতে তাঁরা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করতে হবে। বিতর্কিত সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার, সংসদ অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ কমিয়ে ৩০ দিন করতে হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে ৫০ শতাংশ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যকে মনোনীত করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। বর্তমান সংসদে বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়ে যায়। যা-ই হোক, এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে। এসব বিষয়ে টিআইবি সাধারণ মানুষের ওপর জরিপকাজ পরিচালনাও করতে পারত। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামত নিয়ে সুপারিশ তৈরি করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করলে টিআইবির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটত। অথচ টিআইবি নেতিবাচক একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা বাড়িয়ে দিল। এর ফলে গণতন্ত্র এবং রাজনীতিকদের ব্যাপারে টিআইবির নেতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অবৈজ্ঞানিক এবং ত্রুটিপূর্ণ এই জরিপ প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে আর কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। গণতন্ত্রে জবাবদিহিতা থাকে, যা অন্য কোনো ব্যবস্থায় থাকে না। পাঁচ বছর পরে হলেও সংসদ সদস্যদের জনগণের কাছে যেতে হয়। সংসদ সদস্যরা ভালো কাজ না করলে তার জবাব ভোটের মাধ্যমে জনগণ দিয়ে থাকেন। কাজেই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার তা-ই করা উচিত। টিআইবির যদি কোনো দুরভিসন্ধি থাকে, তাহলে তা দেশের জনগণ মেনে নেবে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments