সাম্প্র্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় মিডিয়ার ভূমিকা by ড. মিল্টন বিশ্বাস
২ অক্টোবর দৈনিক কালের কণ্ঠে 'আমরা লজ্জিত, ব্যথিত : এ দায় সরকার এড়াতে পারে না' শিরোনামের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে- 'দেশ ও জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। তার আগে দুদিন কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি স্থানে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই।
সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির এ দেশের ইতিহাসে এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার উদাহরণ আর একটিও পাওয়া যাবে না। অন্য দেশের সাম্প্র্রদায়িক ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে অতীতে কুচক্রী মহল বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্র্রদায়িক সংঘাত ঘটালেও উল্লিখিত দুদিনের ঘটনা নজিরবিহীন। বৌদ্ধ সম্প্র্রদায় যে এ দেশেরই ভূমিসন্তান; অনেক আগে থেকেই বসতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে, তারও অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা উপস্থাপন করে তাদের ওপর জঘন্য হামলার নিন্দা ও বিচারের দাবি জানানো হয়েছে সম্পাদকীয়তে। আর এ ঘটনায় অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে পরের সপ্তাহব্যাপী (এমনকি ১২ অক্টোবরেও) উপসম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশ বিশিষ্টজনদের কলাম ছাপিয়ে সেই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরই উচ্চকিত করে তোলা হয়েছে। ৬ অক্টোবর শনিবার 'মতামত' পৃষ্ঠায় সাম্প্র্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পত্রিকাটির অসংখ্য পাঠকের ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। কালের কণ্ঠের বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত হওয়ার প্রত্যাশার সঙ্গে অন্যান্য জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক এবং সাপ্তাহিকসহ অনেক ইলেকট্রনিকস ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম একাত্ম হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্র্রীতি রক্ষার জন্য এ দেশের মিডিয়ার এই ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের মতো খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসীদেরও আশ্বান্বিত করে তুলেছে ও আশ্বস্ত করেছে। 'পাবনায় খ্রিস্টান পরিবারের জমি দখলের চেষ্টা' (কালের কণ্ঠ, ৩.৭.১২) এবং বরিশালের ব্যাপ্টিস্ট চার্চের ভূসম্পত্তি দখলের সংবাদ প্রকাশ করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে সংবাদপত্রই; যদিও সেই দখলপ্রচেষ্টার কোনো সুরাহা হয়নি আজও। কারণ সেসব ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দখলবাজ নেতা-কর্মীরা জড়িত। মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা অনেক সময় নেতিবাচকে পরিণত হয় ক্ষমতাসীনের দাপটে; আবার সরকার সমর্থিত মিডিয়ার ভিন্ন অর্থাৎ সংখ্যালঘুর বিপক্ষে অবস্থানের আচরণও লক্ষ করা গেছে। ২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সংখ্যালঘু সম্প্র্রদায়ের ওপর নির্যাতনের সময় তৎকালীন জোট সরকারের মদদপুষ্ট কয়েকটি পত্রিকার নেতিবাচক আচরণ এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। সেসব পত্রিকা বাদে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিডিয়ার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সে সময় দেখেছিলাম তা-ও ছিল গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষের শক্তির জাগরণের অবদান হিসেবে তাৎপর্যবহ।
বিস্ময়কর হচ্ছে, বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর তাণ্ডবের মতো সাম্প্র্রদায়িক সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। দুই মাস আগে ৪ আগস্ট দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে হিন্দু সম্প্র্রদায়ের ওপর জঘন্যতম হামলা হলো। এর আগে ফেব্রুয়ারির ৯ ও ১০ তারিখে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগ আর সাতক্ষীরার ঘটনা যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর ৩১ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল সাতক্ষীরার অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডবের ঘটনায় ছিল জামায়াতের প্রত্যক্ষ ইন্ধন। স্থানীয় একটি পত্রিকায় উসকানিমূলক খবর প্রকাশের পর কালীগঞ্জের ঘরবাড়িতে যে আগুন জ্বলেছে, তাতে একই সঙ্গে পুড়েছে হিন্দু ও মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। ধর্মীয় মৌলবাদীরা যে সুযোগের সন্ধানে রয়েছে; তারই স্পষ্ট আলামত দেখা গেছে সেখানকার ঘটনায়। স্কুলের ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত একটি নাটককে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পত্রিকার উসকানি ধর্মান্ধ রাজনীতির সংস্কৃতির পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। আবার ২২ এপ্রিলের পত্রিকায় 'নতুন ইমামকে না মানার জেরে হিজবুত তওহীদের এক সদস্য খুন' হওয়ার সংবাদটিও মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে। অর্থাৎ নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক গোপন সংগঠনের কার্যক্রম যে থেমে নেই তারও দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল বরিশালের একটি গ্রামের ঘটনা থেকে; যেখানে তারা নিজেদের মধ্যেই বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধেও সোচ্চার দেখা গেছে মিডিয়াকে।
এর আগে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ মুখ্য ঘটনা ছিল। কিন্তু কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দিবাগত রাতের পরিস্থিতি ও হামলার ধরন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতি ঘটেছে; সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্র্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবকেই ধ্বংস করতে চায় মৌলবাদী জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতার শত্রুরা অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। রামু উপজেলার বৌদ্ধপাড়ার উত্তম বড়ুয়া উপলক্ষ মাত্র। কারণ একই অভিযোগে আরেক দল দুষ্কৃতকারী ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের লাখেরা এলাকায় হিন্দুদের একটি মন্দির ও চারটি বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পূর্ণিমা উপলক্ষে সেখানে বৌদ্ধধর্মীয় অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি বৌদ্ধবিহারেও একই দিন সন্ধ্যায় হামলা চালানো হয়েছে। তবে রামুর বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় এ হামলা হয়েছে বেশি। বর্তমান সরকারের সময় খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটনা গত মাসে সংঘটিত হয় রাঙামাটি জেলা শহরের সরকারি কলেজে। ঘটনাটি ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে; হাঙ্গামায় দুই পক্ষের শ-খানেক আহত হয়। ২০১০ সালে রাঙামাটির ৩৬ নম্বর ইউনিয়ন সাজেকে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘাতে নিহত হয়েছিল বেশ কয়েকজন। তোলপাড় সৃষ্টি করা সেই ঘটনার পেছনেও মৌলবাদীদের ইন্ধন ছিল। ২০১১ সালে খাগড়াছড়ির বড়পিলাকে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে যে সংঘাত হয় তাতেও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ গত মাসের শেষ দুই দিনে নিশ্চিতভাবে বলা চলে পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে ইসলামবিরোধী চলচ্চিত্রের প্রতিবাদের সঙ্গে এক করে পর্যবেক্ষণ করছেন। মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি বিনষ্ট করে ফায়দা লুটচ্ছে কেউ কেউ। কোনো কোনো সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশনায় পার্বত্য এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারকে আক্রমণ করে বৌদ্ধদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের দাঙ্গা সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছে। ২৯ সেপ্টেম্বরের হামলার ঘটনায় কয়েকজন ফেসবুক ইউজার জানিয়েছে, উত্তম বড়ুয়া নামের রামুর যুবকের ফেসবুকে কোরআন অবমাননাকর ছবিটি তার পোস্ট করা নয়। এর জন্য উত্তম কোনোভাবে দায়ী নয়। 'ইনসাল্ট আল্লাহ' নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকেই ছবিটি শেয়ার ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অতএব মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রচারণায়ই ধ্বংসযজ্ঞ চলে, এটা স্পষ্ট। এ ঘটনায় ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন; তাঁদেরও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মিডিয়া।
১১ অক্টোবর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত 'ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা' শিরোনামের সংবাদটি আমাদের মতো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক ঘটনা। কারণ, চলতি মাসের ৯ তারিখে অপর একটি দৈনিকে 'আরাকানে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক মসজিদ' এবং তার আগের দিন আরেক দৈনিকে 'আকিয়াবে মসজিদ কোরআন শরিফে অগ্নিসংযোগ' শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদ দুটি মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উসকানিমূলক। মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ১০ অক্টোবর অনলাইনে প্রকাশ করেছে- 'মিয়ানমারের রাখাইন কেন্দ্রীয় মসজিদ অক্ষত আছে : বাংলাদেশ দূতাবাস' শিরোনামের সংবাদটি। এর আগের দিন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, রামুর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কোনো মসজিদে হামলা হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পররাষ্ট্র দপ্তরের এই বিবৃতি এবং বাসসের ওই সংবাদ দুয়েকটি পত্রিকা ছাড়া কোথাও গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়নি। এ ছাড়া ১১ অক্টোবর একটি পত্রিকায় ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর 'পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টীয়করণ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব' শীর্ষক প্রকাশিত কলামে খ্রিস্টান-বৌদ্ধ এবং মুসলিম-খ্রিস্টান দাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বলে অনুমিত হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিডিয়া দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে; গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংবাদপত্রের ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও উপেক্ষিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার, টেকনাফ ও চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মূল ইন্ধনদাতাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত 'বাঁকখালী' পত্রিকার বার্তা সম্পাদকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে; গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকজনকে। কারণ, সেই পত্রিকায় 'মিয়ানমারের আকিয়াবে বড় মসজিদে আগুন' শিরোনামে উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। (কালের কণ্ঠ, ১১.১০.১২)। তবে এ ধরনের কয়েকটি পত্রিকার উসকানিমূলক সংবাদ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য সংবাদপত্র ও অনলাইন এবং ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য। বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে একমাত্র মিডিয়াই জনগণের পক্ষে কথা বলছে; আর সেই কথা যদি হয় সম্প্রীতি, শান্তি ও মঙ্গলের পক্ষে তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির পরিপোষকতায় নিবেদিত থাকুক মিডিয়া- এ প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
বিস্ময়কর হচ্ছে, বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর তাণ্ডবের মতো সাম্প্র্রদায়িক সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। দুই মাস আগে ৪ আগস্ট দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে হিন্দু সম্প্র্রদায়ের ওপর জঘন্যতম হামলা হলো। এর আগে ফেব্রুয়ারির ৯ ও ১০ তারিখে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগ আর সাতক্ষীরার ঘটনা যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর ৩১ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল সাতক্ষীরার অগ্নিসংযোগ ও তাণ্ডবের ঘটনায় ছিল জামায়াতের প্রত্যক্ষ ইন্ধন। স্থানীয় একটি পত্রিকায় উসকানিমূলক খবর প্রকাশের পর কালীগঞ্জের ঘরবাড়িতে যে আগুন জ্বলেছে, তাতে একই সঙ্গে পুড়েছে হিন্দু ও মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। ধর্মীয় মৌলবাদীরা যে সুযোগের সন্ধানে রয়েছে; তারই স্পষ্ট আলামত দেখা গেছে সেখানকার ঘটনায়। স্কুলের ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত একটি নাটককে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পত্রিকার উসকানি ধর্মান্ধ রাজনীতির সংস্কৃতির পরিপূরক হয়ে উঠেছিল। আবার ২২ এপ্রিলের পত্রিকায় 'নতুন ইমামকে না মানার জেরে হিজবুত তওহীদের এক সদস্য খুন' হওয়ার সংবাদটিও মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে। অর্থাৎ নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক গোপন সংগঠনের কার্যক্রম যে থেমে নেই তারও দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল বরিশালের একটি গ্রামের ঘটনা থেকে; যেখানে তারা নিজেদের মধ্যেই বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। এসব ঘটনার বিরুদ্ধেও সোচ্চার দেখা গেছে মিডিয়াকে।
এর আগে সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গায় মানুষ হত্যা ও নারী ধর্ষণ মুখ্য ঘটনা ছিল। কিন্তু কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দিবাগত রাতের পরিস্থিতি ও হামলার ধরন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতি ঘটেছে; সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্র্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবকেই ধ্বংস করতে চায় মৌলবাদী জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতার শত্রুরা অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপচেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। রামু উপজেলার বৌদ্ধপাড়ার উত্তম বড়ুয়া উপলক্ষ মাত্র। কারণ একই অভিযোগে আরেক দল দুষ্কৃতকারী ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও ইউনিয়নের লাখেরা এলাকায় হিন্দুদের একটি মন্দির ও চারটি বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পূর্ণিমা উপলক্ষে সেখানে বৌদ্ধধর্মীয় অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি বৌদ্ধবিহারেও একই দিন সন্ধ্যায় হামলা চালানো হয়েছে। তবে রামুর বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় এ হামলা হয়েছে বেশি। বর্তমান সরকারের সময় খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটনা গত মাসে সংঘটিত হয় রাঙামাটি জেলা শহরের সরকারি কলেজে। ঘটনাটি ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে; হাঙ্গামায় দুই পক্ষের শ-খানেক আহত হয়। ২০১০ সালে রাঙামাটির ৩৬ নম্বর ইউনিয়ন সাজেকে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘাতে নিহত হয়েছিল বেশ কয়েকজন। তোলপাড় সৃষ্টি করা সেই ঘটনার পেছনেও মৌলবাদীদের ইন্ধন ছিল। ২০১১ সালে খাগড়াছড়ির বড়পিলাকে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে যে সংঘাত হয় তাতেও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ গত মাসের শেষ দুই দিনে নিশ্চিতভাবে বলা চলে পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের টার্গেট করে হামলা চালানো হয়েছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে ইসলামবিরোধী চলচ্চিত্রের প্রতিবাদের সঙ্গে এক করে পর্যবেক্ষণ করছেন। মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দু ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি বিনষ্ট করে ফায়দা লুটচ্ছে কেউ কেউ। কোনো কোনো সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশনায় পার্বত্য এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারকে আক্রমণ করে বৌদ্ধদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের দাঙ্গা সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছে। ২৯ সেপ্টেম্বরের হামলার ঘটনায় কয়েকজন ফেসবুক ইউজার জানিয়েছে, উত্তম বড়ুয়া নামের রামুর যুবকের ফেসবুকে কোরআন অবমাননাকর ছবিটি তার পোস্ট করা নয়। এর জন্য উত্তম কোনোভাবে দায়ী নয়। 'ইনসাল্ট আল্লাহ' নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকেই ছবিটি শেয়ার ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অতএব মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রচারণায়ই ধ্বংসযজ্ঞ চলে, এটা স্পষ্ট। এ ঘটনায় ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন; তাঁদেরও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মিডিয়া।
১১ অক্টোবর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত 'ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা' শিরোনামের সংবাদটি আমাদের মতো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক ঘটনা। কারণ, চলতি মাসের ৯ তারিখে অপর একটি দৈনিকে 'আরাকানে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক মসজিদ' এবং তার আগের দিন আরেক দৈনিকে 'আকিয়াবে মসজিদ কোরআন শরিফে অগ্নিসংযোগ' শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদ দুটি মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উসকানিমূলক। মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ১০ অক্টোবর অনলাইনে প্রকাশ করেছে- 'মিয়ানমারের রাখাইন কেন্দ্রীয় মসজিদ অক্ষত আছে : বাংলাদেশ দূতাবাস' শিরোনামের সংবাদটি। এর আগের দিন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, রামুর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কোনো মসজিদে হামলা হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পররাষ্ট্র দপ্তরের এই বিবৃতি এবং বাসসের ওই সংবাদ দুয়েকটি পত্রিকা ছাড়া কোথাও গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়নি। এ ছাড়া ১১ অক্টোবর একটি পত্রিকায় ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর 'পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টীয়করণ এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব' শীর্ষক প্রকাশিত কলামে খ্রিস্টান-বৌদ্ধ এবং মুসলিম-খ্রিস্টান দাঙ্গার সম্ভাবনা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বলে অনুমিত হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মিডিয়া দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে; গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সংবাদপত্রের ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও উপেক্ষিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার, টেকনাফ ও চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মূল ইন্ধনদাতাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত 'বাঁকখালী' পত্রিকার বার্তা সম্পাদকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে; গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকজনকে। কারণ, সেই পত্রিকায় 'মিয়ানমারের আকিয়াবে বড় মসজিদে আগুন' শিরোনামে উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। (কালের কণ্ঠ, ১১.১০.১২)। তবে এ ধরনের কয়েকটি পত্রিকার উসকানিমূলক সংবাদ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য সংবাদপত্র ও অনলাইন এবং ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য। বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে একমাত্র মিডিয়াই জনগণের পক্ষে কথা বলছে; আর সেই কথা যদি হয় সম্প্রীতি, শান্তি ও মঙ্গলের পক্ষে তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির পরিপোষকতায় নিবেদিত থাকুক মিডিয়া- এ প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
No comments